বিজ্ঞাপন

বনজের বিরুদ্ধে বাবুলের মামলার আবেদন খারিজ

September 25, 2022 | 12:58 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের করা মামলার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদারসহ ৬ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তিনি মামলার আবেদন করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া বাবুল আক্তারকে আদালতে হাজির করে ২০০ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ এবং কারাকক্ষে তল্লাশির অভিযোগে নিরাপত্তা চেয়ে করা পৃথক দু’টি আবেদনও একইসঙ্গে খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।

রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. জেবুন্নেছা বেগম এ আদেশ দিয়েছেন। আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা দীপেন দাশগুপ্ত সারাবাংলাকে বিষয়টি জানিয়েছেন।

মামলার আবেদনে আরও যাদের নাম ছিল- পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার মো. নাজমুল হাসান, মেট্রোর পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা, পিবিআইয়ের সাবেক দুই পরিদর্শক বর্তমানে সহকারী পুলিশ কমিশনার (পাহাড়তলী জোন) এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম ও খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা এবং পিবিআইয়ের জেলা পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবির।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি চট্টগ্রাম মহানগর পিপি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবুল আক্তার তিনটি পিটিশন দাখিল করেছিলেন। মূল পিটিশন হচ্ছে ছয় জন পিবিআই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন। আদালত সেটা খারিজ করে দিয়েছেন। বাকি দু’টি সাব-পিটিশন। একটি হচ্ছে বাবুল আক্তারকে আদালতে হাজির করে ২০০ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ, আরেকটি ফেনী কারাগারের জেল সুপারকে বন্দি বাবুল আক্তারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আদেশ। দু’টি আবেদনই আদালত নামঞ্জুর করেছেন।’

আদালত হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩ এর ১২ ধারায় বাবুল আক্তারের মামলার আবেদনটি নিষ্পত্তি করেন। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীনে করা কোনো অপরাধ, যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায় অথবা ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হইয়াছে, এরূপ অজুহাত অগ্রহণযোগ্য।’

আদালত আদেশে উল্লেখ করেছেন, সাবেক এসপি বাবুল আক্তার পরিস্কারভাবে অভিযেগ করেছেন- পিবিআইয়ের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে রিমান্ডে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। বাবুল আক্তার মাহমুদ খানম মিতু হত্যা মামলার চার্জশীটভুক্ত প্রধান আসামি। আদালতের কাছে এটি পরিস্কার হয়েছে যে, মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলা থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় তিনি কতগুলো অভিযোগ সৃজন করেছেন ঊর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

বিজ্ঞাপন

আদেশে আরও বলা হয়, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩ এর ১১ ধারা অনুযায়ী বাবুল আক্তারের মামলার আবেদন গ্রহণের বিষয়ে বিবেচ্য কিছুই পাওয়া যায়নি। ফলে এটি গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। একই আইনের ভিত্তিতে ২০০ ধারায় বাবুল আক্তারের জবানবন্দি গ্রহণেরও কোনো সুযোগ নেই।

গত ৮ সেপ্টেম্বর সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার তাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজি বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার আবেদন করেছিলেন। বাবুল আক্তার কারাবন্দি থাকায় মামলার আবেদনে স্বাক্ষর করতে পারেননি। তার পক্ষে আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ আবেদনটি আদালতে দাখিল করেন। একইসঙ্গে বাবুল আক্তারকে আদালতে হাজির করে জবানবন্দি নেওয়ারও আবেদন সংযুক্ত করেন।

এরপর ১২ সেপ্টেম্বর একই আদালতে বাবুল আক্তারের পক্ষে তার আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ আরেকটি আবেদন দাখিল করে অভিযোগ করেন, ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফেনী মডেল থানার ওসি নিজাম উদ্দিন ফেনী কারাগারে প্রবেশ করে বাবুল আক্তারের কক্ষে দীর্ঘসময় ধরে তল্লাশি চালান। হেফাজতে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে বাবুল আক্তার যে ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন, তাদের নির্দেশে ও প্ররোচনায় এ তল্লাশি চালানো হয়েছে বলে তার অভিযোগ।

আবেদনে আসামি বাবুলের দাবি ছিল, তার জীবনের ক্ষতিসাধন ও মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য ওসি কারাগারে প্রবেশ করেন। আবেদনে ওসি’র প্রবেশের তদন্ত এবং বাবুলের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ফেনীর জেলা সুপারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার বিষয় উল্লেখ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বাবুলের এই আবেদনের পরদিন অর্থাৎ ১৩ সেপ্টেম্বর মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এতে প্রধান আসামি করা হয় মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার জড়িয়ে পড়া নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তার স্ত্রীকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। তিন লাখ টাকায় ‘খুনি’ ভাড়া করে স্ত্রীকে খুন করায়। নিজেকে আড়ালে রাখতে প্রচার করেন- জঙ্গিরাই মিতুকে খুন করেছে। মিতুকে খুনের মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের ‘সোর্স’ মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। সঙ্গে ছিল আরও ছয়জন। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল মুসাকে ফোনে নির্দেশ দেন- গা ঢাকা দেওয়ার জন্য।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখনই মিতু হত্যায় বাবুল আক্তার জড়িত এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার।

২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয়- তদন্তে ঘটনার সঙ্গ বাদী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

একইদিন (১২ মে) দুপুরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে মোশাররফের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর আদালতে দেয়া গ্রেফতার ভোলাইয়া, বাবুলের ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের জবানবন্দিতে বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য আরও জোরালো হয়।

তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এসব জবানবন্দির একপর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার।

২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখান করেন। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখান করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ফলে মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলাটির পাশাপাশি করা বাবুল আক্তারের মামলাটিও সক্রিয় হয়ে যায়। দুই মামলার সমান্তরাল তদন্তভার এসে পড়ে পিবিআইয়ের ওপর।

ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারকে তার নিজের মামলায় গ্রেফতার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে বাবুলকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন।

এরপর চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের পর্যবেক্ষণ মেনে মোশাররফের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একইসঙ্গে ওই মামলার ডকেট প্রথম মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে তদন্তের জন্য আবেদন করেন। আদালত অনুমতি দিলে শুধুমাত্র বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলাটির তদন্তই চলমান থাকে এবং অভিযোগপত্র প্রদানের মধ্য দিয়ে আপাতত তদন্ত কার্যক্রমের নিষ্পত্তি হয়।

সারাবাংলা/আরডি/এমও

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন