বিজ্ঞাপন

‘মেয়ে এক ফোঁটা পানি চেয়েছিল, কিন্তু হাসপাতাল দিতে দেয়নি’

September 28, 2022 | 10:07 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘মরিয়াম জামান আরফিয়া। আমাদের একমাত্র মেয়ে। বয়স ৮ বছর চার মাস। জ্বর আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করাই। পরামর্শে বললে ভুল হবে। কারণ, একান্ত প্রয়োজন হলে আমাদের বাসার পাশে মালিবাগের কোনো হাসপাতালেই মেয়েকে ভর্তি করাতে পারতাম। কিন্তু চিকিৎসক এক প্রকার জোর করেই তার রেফার করা হাসপাতালে যেতে বলে। পরে সেখানেই নিয়ে গেলাম মেয়েকে। কিন্তু আর বাসায় ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। জোর-জবরদস্তি করে একের পর এক ভুল চিকিৎসা করা হলো আমার মেয়ের। রোগ নির্ণয় তো করতেই পারেনি তারা। বরং ভর্তির পর থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা চিকিৎসা করেছে তার সবই আমাদের অনুমতি ছাড়া।’

বিজ্ঞাপন

‘একটা সময় শুনছিলাম, আমার মেয়ে জোরে কান্না করে বলছে, আমাকে এক ফোঁটা পানি দাও, আমার বাবা-মায়ের কাছে যেতে দাও। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার সেই আকুতি শোনেনি। তারা উল্টো আমার মেয়েকে মেরে ফেলার পরে বলছিল, এখনো বেঁচে আছে আরফিয়া। ইসিজি মেশিনে যখন সমান্তরাল দাগ দেখা যায় তখন বলে সেটা নাকি নষ্ট। পরে আমাদের জানায়, কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে আমাদের একমাত্র সন্তান।’— কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মালিবাগের বাসিন্দা জুবাইদা আলম।

রাজধানী শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি দু’জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। একমাত্র কন্যা মরিয়াম জামান আরফিয়ার ভুল চিকিৎসা করেছেন ডা. মো. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকী— এমন অভিযোগ জানিয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও শ্যামলীতে অবস্থিত স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন জুবাইদা আলম। সেইসঙ্গে রাজধানীর আদাবর থানায় একটি সাধারণ ডাইরিও করেছেন তিনি।

তবে অভিযোগ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মনিরুল ইসলাম। একইভাবে অভিযোগ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় শ্যামলীতে অবস্থিত স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, বিএমডিসি ও স্বাস্থ্য অধিদফতর।

বিজ্ঞাপন

জুবাইদা আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের একমাত্র মেয়ে আরফিয়ার জন্মের পর থেকেই আমি ওর সঙ্গেই সর্বোচ্চ সময় কাটাতাম। জন্মের পর থ্যালাসেমিয়ার একটা সমস্যা দেখা দিলে আমরা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে থাকি। ২০২১ সালের ২৯ জুন আমরা আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যাই আরফিয়াকে। সেখানে তার রক্তস্বল্পতা ধরা পড়ে। তার হিমোগ্লোবিন পাওয়া যায় ৯.২। সেই বছরের ১৭ জুলাই থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মনিরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে আমার মেয়ের চিকিৎসা চলতে থাকে। তাকে রক্তও দেওয়া হয় তখন।’

তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের ডিসেম্বরে মেয়েকে নিয়ে আমরা ভারতের ভেলরে সিএমসি হাসপাতালে যাই। কিন্তু তারা রক্ত দিতেই হবে এমন কিছু আর বলেনি। আমরা দেশে এসে সেসব বিষয় ডা. মো. মনিরুল ইসলামকে জানাই। এরপর থেকে প্রতি মাসে উনার পরামর্শ অনুযায়ীই চিকিৎসা চলছিল আমার আরফিয়ার। সর্বশেষ ৩০ আগস্ট ডা. মনিরুল বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে (২১, শ্যামলী, মিরপুর রোড ঢাকা) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান আরফিয়ার হিমোগ্লোবিন ৮.৭ ও ফেরিটিন ১৫০। এজন্য তিনি আগের ওষুধই চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আমরা সেটাই ফলো করে আসছিলাম।’

বিজ্ঞাপন

৭ সেপ্টেম্বর আরফিয়ার শরীরে জ্বর অনুভূত হয় জানিয়ে জুবাইদা আলম বলেন, ‘থার্মোমিটারে জ্বর মেপে দেখে ভয় পাই। ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর ওঠানামা করার বিষয়টি জানাই চিকিৎসককে। ডা. মনিরুল ইসলাম সঙ্গে সঙ্গেই বলেন হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য। জ্বরের জন্য হাসপাতালে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি করাবো? বাসা যেহেতু মালিবাগ তাই এদিকেই কোনো হাসপাতালে ভর্তি করানো যাবে কিনা- এমন দুই প্রশ্ন ছিল চিকিৎসকের প্রতি। তিনি এক প্রকার জোর করেই বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তির জন্য বলেন। আমরাও সেই হিসেবে নিয়ে যাই আরফিয়াকে। কিন্তু তখনও জানতাম না কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?’

তিনি বলেন, ‘৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় স্পেশালাইজড হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয় আরফিয়াকে। সেখানে তার হাতে ক্যানোলা করার জন্য তাকে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ) বিভাগে নিয়ে যেতে চায় ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও নার্সরা। এ সময় তারা ক্যানোলা করার দায়িত্ব একে অপরের দিকে দুষছিল। কিন্তু তারা পরে পিআইসিইউতেই নিয়ে যায়, যেটা ওয়ার্ড থেকে আরও অনেক দূরে। সেখান থেকে আবার আরফিয়াকে ওয়ার্ডে ফিরিয়ে আনা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওয়ার্ড থেকে নানারকমের পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো ডায়াগনসিসের জন্য পাঠানো হয়। এগুলোর কোনো ফলাফল না এলেও সেখানে আরেকজন চিকিৎসক এসে আরফিয়াকে স্যালাইনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে থাকেন। কিন্তু কিসের জন্য একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন তা আর বলেন নাই। এ সময় জানতে পারি এই চিকিৎসকের নাম ডা. ইসরাত জাহান লাকী। এদিন বিকেল ৪টায় ডা. মনিরুল এসে আমাদের জানান, আরফিয়ার টাইফয়েড হয়েছে। আর তাই অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে।’

জুবাইদা বলেন, ‘অবাক হয়ে দেখলাম ভর্তির পরামর্শ দিলেও এরপর থেকে আর বেশি কথা বলছিলেন না ডা. মনিরুল। আর অন্যদিকে, ডা. ইশরাত একের পর এক ইনজেকশন দিয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু কেন দিচ্ছিলেন তা বলছিলেন না। তবে একটা সময় এসে তারা জানায়, আরফিয়ার ম্যালেরিয়া টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। একইসঙ্গে তার হিমোগ্লোবিন ৭.১-এ নেমেছে। এরপরে আমাদের জানানো হয় আরফিয়ার শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। কারণ, তার আর জ্বর আসে নাই। এটা শুনে আমরা ডা. ইসরাত জাহান লাকীকে অনুরোধ করি মেয়েকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে। তিনি বলেন, আপনার মেয়ে ভালো আছে।’

বিজ্ঞাপন

আফরিয়ার মা বলতে থাকেন, ‘এর পর আমরা ডা. মনিরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বলেন, আফরিয়ার জ্বর আবার আসবে। আর এবার সেটা ১০৫ থেকে ১০৬ ডিগ্রি হতে পারে। কিন্তু ঠিক তার পর দিন অর্থাৎ ৯ সেপ্টেম্বর সকালে আমাদের জানান যে, আরফিয়ার বুকে ইনফেকশন হয়েছে। এ সময় আমি ওর বুক ও পিঠের এক্সরে করার জন্য বলি। অবশ্য সেটার রিপোর্ট ভালো আসে বলেই জানায় তারা। কিন্তু এদিন রাতে হঠাৎ করে এসে তারা ফের আফরিয়াকে পিআইসিইউতে নিয়ে যায়। আর এখান থেকেই আমার সব শেষ হয়ে যায়।’

দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়ে জুবাইদা বলেন, ‘তারা আমার মেয়েকে পিআইসিইউতে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো অনুমতি আমার কাছে থেকে বা আমার স্বামীর কাছ থেকে নেয়নি। আমি শুরু থেকেই জানার চেষ্টা করছিলাম যে, কেন আরফিয়াকে সেখানে নেওয়া হলো? কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। অনেক চেষ্টা করে আমি পিআইসিইউতে ঢুকে দেখি আমার মেয়ে সেখানে বেডে বসে আছে। আর সেখানে ডাক্তার ও নার্স আমার মেয়েকে ধমকাচ্ছে। তারা আমার মেয়েকে বলেছে, ওর বাবা ও মা বাসায় চলে গেছে। আমাকে দেখে মাত্র মেয়ে বলে, তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে বলে, আমাকে তারা অনেক কষ্ট দিচ্ছে। এ সময় আমি সেখানে থাকা চিকিৎসকসহ অন্যান্যদের পায়ে ধরে বলি, আপনাদের যদি টাকা লাগে নিন, কিন্তু তাও আমার কলিজাটাকে বাসায় যেতে দিন। তাদের কেউ আমার কোনো কথা শোনেননি। তারা আমাকে সেখান থেকে বের করে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পিআইসিইউ’র বাইরে আমি অপেক্ষা করতে থাকি। তখন আমার মেয়ের বার বার চিৎকার ও আকুতি শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার মেয়ে পানি খেতে চাইছিল। সে জোরে কান্না করছি এক ফোঁটা পানি হলেও যেনো ওকে দেওয়া হয়। আর আমি তখন বাইরে আকুল হয়ে ভেতরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। রাতে একটা সময় দেখলাম আমার মেয়ের পরনের পোশাক ওয়ার্ড বয়ের কাছে। সে দৌড়ে পালিয়েছে আমাদের দেখে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায় রক্ত লাগবে। আমি নিজেই ১০-১২ জন ডোনার নিয়ে এসে ক্রসম্যাচ করাই। কিন্তু তারা রক্ত নেনি।

জুবাইদা বলেন, ‘রাত ৪টার সময় মেয়ের শেষ চিৎকার শুনি আমি। ম্যানেজার এসে জানায় যে, আপনার মেয়েকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। এ সময় লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার জন্য কিছু কাগজে আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক সই নেয়। সকাল সাড় ৫ টায় মেয়ের কাছে গেলে সবাই আমাকে বলছিল, মেয়ের নাকি হার্টবিট চলছে। আমি চিকিৎসকের পায়ে ধরে বলি, সত্যি করে বলেন তো আমার মেয়ে কী বেঁচে আছে? তিনি আমার সঙ্গে রেগে বলে বেঁচে আছে। এ সময় আমাকে বলে আরফিয়াকে তিন দিন পর বেডে নিতে পারবেন। সাত দিন রাখলে ভালো হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমি পরিষ্কার দেখছিলাম আমার মেয়ের হার্টবিট কাজ করছিল না। তখন আমার মেয়ে মরে গেছে বলে চিৎকার করে উঠি আর কিছুটা উত্তেজিত হই। কারণ ওরা আমার স্বামীকেও ভেতরে আসতে দিচ্ছিল না। এ সময় সেখানে থাকা তিন জন চিকিৎসক ও নার্স পালিয়ে যায়। তখন আমার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। পরে আমার স্বামী ও আত্নীয় স্বজন চাপ দিলে তারা লাইফ সাপোর্ট খুলে দিতে বাধ্য হয়। মারা যাওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পরে তারা আমার মেয়েকে মৃত ঘোষণা করে। আর ডেথ সনদে লিখে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে নাকি মারা গেছে আমার মেয়ে। অথচ তারা এদ্দিন বলে এসেছে অন্য রোগের কথা।’

জুবাইদা বলেন, ‘ডা. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকী আমাদের বলেনি তারা আসলে কিসের চিকিৎসা দিচ্ছে। তারা কিছু না বুঝেই চিকিৎসা চালিয়ে গেছে। পরিকল্পিতভাবে আমার মেয়েকে সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে ভুল চিকিৎসায় মেরে ফেলেছে। আমি ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিএমডিসিতে অভিযোগ জানিয়েছি। থানাতেও সাধারণ ডায়েরি করেছি। স্পেশালাইজড হাসপাতালেও অভিযোগ জানিয়েছি। এরপরে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে।’ এখন আর কোনো সমাধান করে কী আমার মেয়েকে ফিরে পাবো? আর তাই আমি বিচার চাই— কান্না করতে করতেই বলতে থাকেন মরিয়াম জামান আরফিয়ার মা জুবাইদা আলম।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমোটোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মনিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত জবাব দেবো। যা সেই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে জানিয়ে দেবে।’

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও সিইও আল ইমরান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। একইভাবে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লিয়াকত হোসেনের কাছ থেকেও অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য জানতে পারেনি এই প্রতিবেদক।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন