বিজ্ঞাপন

ডিসি’র সঙ্গে দ্বন্দ্ব: আইনজীবী নেতাদের ‘ভূমিদস্যু’ বলায় মামলা

September 29, 2022 | 6:50 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো : ‘ঢাকাপ্রেসডটকম’ নামে একটি ফেসবুক পেইজে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে ‘ভূমিদস্যু’ উল্লেখ করে মানহানিকর তথ্য প্রচার করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের হয়েছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে মিথ্যা ও মানহানিকর বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে বলে মামলার আরজিতে অভিযোগ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ জহিরুল কবিরের আদালতে মামলাটি দায়ের করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন দোয়েল।

মামলার আরজিতে ফেসবুক পেইজের লিংক উল্লেখ করে ‘ঢাকাপ্রেসডটকম’কে মূলত অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেসবুকের লিংক উল্লেখ করে কাজী কমলা তানিয়া ও ওবায়দুর রব কয়েস নামীয় আরও দু’জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

বাদী মেজবাহ উদ্দিন দোয়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আদালত মামলা গ্রহণ করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অথবা এর চেয়ে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।’

বিজ্ঞাপন

মামলার আরজিতে ফেসবুক পেইজটির বিষয়ে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ‘ফলো বাংলাদেশ’ নামে অনলাইন পেইজটি চালু করা হয়। ৪ মার্চ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘হেড লাইন’। ১২ মার্চ পেইজটি আবারও আগের নামে ফিরে আসে। ২৪ আগস্ট পেইজটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ঢাকাপ্রেসডটকম’।

অভিযোগ করা হয়েছে, সেই পেইজে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ২১ মিনিটে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন এবং ২১ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টা ২৭ মিনিটে সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ হাশেমের নাম ও ছবি উল্লেখ করে মানহানিকর বক্তব্য প্রচার করা হয়। সাধারণ সম্পাদককে ভূমিদস্যু চক্রের হোতা-১ উল্লেখ করে বলা হয়, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে ভূমিদস্যু ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন প্রভাবশালী চক্র। তাদেরই একজন অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম মো.জিয়াউদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক।

বিজ্ঞাপন

সভাপতিকে ভূমিদস্যু চক্রের হোতা-২ উল্লেখ করে বলা হয়, জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরে সরকারি খাসজমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে চলছে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান। প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা দেখে ভূমিদস্যুদের নির্দেশে ছিন্নমূল মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সব অপরাধীদের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এদের মধ্যে অন্যতম আবু মোহাম্মদ হাশেম। তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি।

মামলার আরজিতে আরও অভিযোগ করা হয়, ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা ১০ মিনিটে সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ও ছবি যুক্ত করে একই অনলাইন পেইজ থেকে মানহানিকর আরও বিভিন্ন বক্তব্য প্রচার করা হয়।

মামলার বাদী মেজবাহ উদ্দিন দোয়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনলাইন পেইজে গিয়ে সাধারণ আইনজীবীরা আমাদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নামে মানহানিকর এ সব বক্তব্যের প্রতিবাদ করলে ঢাকাপ্রেসডটকম, কাজী কমলা তানিয়া এবং ওবায়দুর রব কয়েসনামীয় ফেসবুক লিংক থেকে কুরুচিপূর্ণ বিভিন্ন জবাব দেওয়া হয়। আইনজীবীদের সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও ভূমিদস্যু চক্রের দালাল বলে উল্লেখ করা হয়। সমিতির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে আমি থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম্। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ আদালতে যাবার পরামর্শ দিলে আমি আজ (বৃহস্পতিবার) মামলা করি।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৫, ২৯ (২) এবং ৩১ (২) ও ৩৫ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে বলে বাদী জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

মামলার আরজির একাংশে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্তদের সঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির পূর্ব কোনো বিরোধ ছিল না, বর্তমানেও নেই। মূলত চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সমিতির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক কিছু অবৈধ কর্মকাণ্ডে জেলা আইনজীবী সমিতি কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলে। এতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সমিতির দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত অনলাইন পেইজের মাধ্যমে সমিতির ১২৫ বছরের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে ‘ভূমিদস্যু, জবরদখলকারী ও প্রতারক’ উল্লেখ করে মানহানিকর প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

উল্লেখ্য, নগরীর কেন্দ্রে লালদিঘীর পাড়ের দক্ষিণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পাহাড়, যেখানে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ও আছে, সেই পাহাড় নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আইনজীবী সমিতির গত একবছরেরও বেশিসময় ধরে পাল্টাপাল্টি চলে আসছে। সেই পাহাড়ে আদালত সংলগ্ন এলাকায় জেলা আইনজীবী সমিতি আইনজীবীদের চেম্বারের জন্য নতুন দু’টি ভবন নির্মাণেরর উদ্যোগ নিলে আপত্তি তোলে জেলা প্রশাসন। সমিতির ওই দুই নতুন স্থাপনা নির্মাণকে জেলা প্রশাসন বলছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। আর সমিতির দাবি, নিয়ম মেনে ‘অনুমোদন’ নিয়েই তারা ভবন করছেন। ওই পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করতে এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তাতে সায় দেন প্রধানমন্ত্রী। জেলা প্রশাসন ও আইনজীবী সমিতি নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকায় বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।

এরপর গত জুলাইয়ে সীতাকুণ্ডের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়ে ৫টি মৌজায় প্রায় ৩১০০ একর সরকারি খাসজমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ শুরু করে জেলা প্রশাসন। উচ্ছেদ করতে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসকের কয়েক দফা সংঘাত হয়েছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান সলিমপুর থেকে অবৈধ বসতি ও স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে সরকারি খাসজমিগুলো উদ্ধার করে সেখানে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন। এই মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১২ সেপ্টেম্বর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আইনজীবীদের সঙ্গে বিরোধ হলেও আদালতের পাহাড়কে ‘জঞ্জালমুক্ত’ করার উদ্যোগে বিভিন্ন মহলের প্রশংসা কুড়ান জেলা প্রশাসক। সলিমপুর নিয়ে জেলা প্রশাসকের অবস্থানকেও ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল।

কিন্তু এর মধ্যে গত ১৫ সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে জেলা প্রশাসক মোহাম্ম মমিনুর রহমানের একটি কর্মকাণ্ডে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ওইদিন জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম রিটার্নিং অফিসার অর্থাৎ জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে যান। মনোনয়ন পত্র জমাদান শেষে নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য শফর আলী প্রার্থীর বিজয় কামনা করে মোনাজাত ধরেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে রিটার্নিং অফিসারকেও হাত তুলে অংশ নিতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে।

মোনাজাতের পর আওয়ামী লীগ প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামকে বাম পাশে এবং সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে ডান পাশে বসিয়ে উপস্থিত দলটির নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। বক্তব্যে তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার যেন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়, সেজন্য বিএনপি-জামায়াতের দোয়া কামনা করেন। জেলা প্রশাসকের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদ।

মোনাজাত এবং জেলা প্রশাসকের বক্তব্যের ভিডিও এবং ছবির ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশিত হয় সারাবাংলায় এবং পরবর্তীতে আরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করে নিতে আইনি নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান খান। ১৮ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানকে সেই স্থলে বসিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।

কিন্তু এরপর থেকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে— জঙ্গল সলিমপুরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করায় ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকদের ইন্ধনে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তাকে বদলির চক্রান্ত করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের পক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা, এনজিও, উপজেলা চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ কয়েকজন রাজনীতিক, ক্রীড়া সংগঠক, সাংবাদিক নেতাদের একাংশ মাঠে নামেন। তাদেরও একই মত, জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে।

এরপর ‘ঢাকাপ্রেসডটকম’ নামে অনলাইন পেইজ থেকে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও একজন জনপ্রতিনিধির নাম-ছবি ব্যবহার করে একই ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন