বিজ্ঞাপন

‘মনোবল’ ভাঙতে পুলিশবক্সে হামলা, চার্জশিটে আসামি ১৬

October 26, 2022 | 10:13 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থার সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। অভিযোগপত্রে ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। যারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘নব্য জেএমবির’ সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দেশে শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠায় ‘মূল বাধা’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে নব্য জেএমবির সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে পুলিশ সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে ট্রাফিক বক্সে হামলা করা হয়েছিল বলে অভিযোগপত্রে ‍উঠে এসেছে। তবে এই হামলার মূল নির্দেশদাতা কে, সেটি তদন্তে উঠে আসেনি।

বুধবার (২৬ অক্টোবর) মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় গুহ আদালতে ১০ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি নগর পুলিশের প্রসিকিউশন শাখায় জমা দেন।

জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলার ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার মামলার একটি অভিযোগপত্র পেয়েছি। এতে ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৪৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। আমরা অভিযোগপত্র সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিয়েছি। আদালত এখনও কোনো আদেশ দেননি।’

বিজ্ঞাপন

আসামিরা হলেন- নব্য জেএমবির স্থানীয় গ্রুপের আমির মো. নোমান খান, স্থানীয় গ্রুপের সামরিক কমান্ডার এবং পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ মো. সেলিম, দাওয়াতি শাখার প্রধান জহির উদ্দিন এবং সদস্য মহিদুল আলম, মঈনউদ্দিন, আবু সাদেক, রহমতউল্লাহ আকিব, মো. আলাউদ্দিন, মো. সাইফুল্লাহ, মো. এমরান, মো. শাহেদ, মো. কাইয়ূম, মুহাম্মদ কায়ছার, মোরশেদুল আলম, মুহাম্মদ শাহজাহান এবং ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর।

এদের মধ্যে কায়ছার, মোরশেদ আলম ও শাহজাহান পলাতক আছেন। বাকি ১৩ জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। ১৭ বছর বয়সী কিশোরের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে শিশু আইনে দোষীপত্র দাখিল করা হয়েছে।

সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ৬ (২), ৮, ৯, ১০ ও ১২ ধারায় দাখিল করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, নব্য জেএমবি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পুলিশ বক্সে হামলার সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেয়। আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে দেশ ও জনসাধারণের নিরাপত্তা বিপন্ন করার উদ্দেশে সরকারি স্থাপনায় হামলা ও সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার উদ্দেশে বোমা হামলা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির মতাদর্শী নব্য জেএমবি সংগঠনের সদস্যভুক্ত হয়ে সংগঠনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র, সহায়তা ও প্রচেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার অপরাধ করেছে বলে তদন্তে সত্য প্রতীয়মান হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে নব্য জেএমবির সদস্যরা সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যেই পুলিশ বক্সে প্রথম হামলা চালায়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার কয়েকজন জঙ্গি বলেছে- স্বপ্রণোদিতভাবে সংগঠনের আদর্শ বাস্তবায়ন এবং শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য। দেশের প্রচলিত আইনকে তাগুতের আইন এবং বাংলাদেশ পুলিশকে তাগুত বলে তারা মনে করে। এজন্য পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে বোমা হামলার মাধ্যমে তাদের হত্যার পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির।’

২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে দুই পুলিশ সদস্যসহ অন্তত পাঁচজন আহত হন। এই ঘটনার পর তদন্তকারী সংস্থা নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ১৩ জনকে গ্রেফতার করে।

বোমা হামলার তিনমাস পরেই ২০২০ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র এমরান, পলিটেকনিকের ছাত্র আবু ছালেহ এবং দোকানকর্মী সাইফুল্লাহ- এ তিনজনকে গ্রেফতারের পরই কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট হামলার সঙ্গে নব্য জেএমবির সম্পৃক্ততার তথ্য পায়। এরপর ওই বছরের অক্টোবরে নব্য জেএমবির ওই গ্রুপের দাওয়াতী শাখার প্রধান জহিরসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ গ্রুপের সামরিক কমান্ডার সেলিমকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বক্সে বোমার হামলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের পুরো ছক উদঘাটন করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

বিজ্ঞাপন

অভিযোগপত্রে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গ্রেফতার ১৩ জনের মধ্যে নয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৬ জন আসামিসহ মোট ২০ জনের একটি গ্রুপ চট্টগ্রাম নব্য জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে। সামরিক কমান্ডার সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপসে ‘বড় ভাইদের’ সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। দাওয়াতি শাখার প্রধান জহির চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া বাজারের হকার্স মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারি ছিলেন। সেলিমের মাধ্যমে নোমান ও জহির এই সংগঠনের যুক্ত হয়। ২০১৭ সালে ইউটিউবে লাদেন, মোল্লা ওমর, তামিম আল আদনানি, আব্দুর রহমান, কাজী ইব্রাহিম ও জসিম উদ্দিন রাহমানির ওয়াজ শুনে তারা জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়। সেলিম হোয়াটস অ্যাপে জিহাদি ভিডিও পাঠিয়ে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করত।

২০১৮ সালে জহির তার বন্ধু শাহজাহান, নোমান, মোরশেদুল ও সেলিমকে নিয়ে পদুয়া বাজারের পূর্বদিকে ফরিয়াদিরকূলে বেড়াতে যায়। সেখানে সেলিম প্রস্তাব দেয়, প্রতি সপ্তাহে কোরআন হাদিসের আলোকে গ্রুপ মিটিংয়ের। এরপর থেকে তারা সবাই একসঙ্গে ফজরের নামাজে পড়তে শুরু করে। নামাজ পড়তে গিয়ে আলাউদ্দিন, আকিব ও হাবিবকে নিজেদের গ্রুপে টেনে নেয়। কিছুদিন পর শাহজাহান দুবাই চলে যায়।

২০১৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে একদিন জহির ফরিয়াদির কূলে গিয়ে দেখতে পায়- নোমান, আলাউদ্দিন, হাবিব, শহিদ, সাহেদ, কাইছার, সাদেক ও কামাল পাহাড়ের মধ্যে গাছে আরবি লেখা কালো পতাকা বেঁধে সেলিম তাদের বায়াত (শপথ) করাচ্ছে। জহির বায়াতে ছিল না। তবে সবাই মিলে একসঙ্গে ছবি তোলে। জহিরের মোবাইল থেকে সব ছবি সেলিম নিয়ে নেয়।

উল্লেখ্য, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে জঙ্গলঘেরা একটি এলাকায় বায়াত নেওয়ার সময় মুখে ও মাথায় কাপড়বাঁধা নয় যুবকের একটি ছবি প্রকাশ করে।

অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে জহির দাওয়াত দিয়ে মহিদুল আলম ও মঈনউদ্দিনকে গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে। সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে ‘বড় ভাইদের’ সঙ্গে যোগাযোগের পর নোমান খানকে আমির, নিজেকে সামরিক শাখার প্রধান এবং জহিরকে দাওয়াতি শাখার প্রধান ঘোষণা করে। টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে ‘বড় ভাইদের’ সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি মূলত সেলিম একাই করত। তাদের নির্দেশের কথা জানিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জহির, নোমান ও মোর্শেদকে ডেকে সেলিম নির্দেশ দেয়- পুলিশ বক্সে হামলা করতে হবে। এরপর সেলিম নিজেই হাবিব, শাহেদ, কাইছার, আবু সাদেক, সাইফুল ও এমরানকে নিয়ে দল তৈরি করে।

সেলিম আইইডি (বোমা) তৈরির পিডিএফ ফাইল মোবাইল ফোনের সাহায্যে সদস্যদের সরবরাহ করে। মঈনউদ্দিন, রহমত ও আইয়ূব জিআই পাইপ দিয়ে আইইডি বানিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায় পরীক্ষামূলকভাবে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সেলিম পুলিশ বক্সে হামলার জন্য জহির, নোমান ও মোরশেদুলকে নির্দেশ দেয়। ফেব্রুয়ারি মাসে সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে ‘সরকারি বাহিনীকে মারতে হবে’ মর্মে নির্দেশ পাবার কথা আলাউদ্দিনকে জানায়।

ঘটনার দিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে একটি আইইডি (বোমা) নিয়ে সেলিম, সাদেক, কাইছার, হাবিব ও শাহেদ লোহাগাড়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসে। নগরীর ষোলশহর ‍দুই নম্বর গেট এলাকায় সাইফুল্লাহর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সাইফুল্লাহ সেলিমকে নাসিরাবাদের আপন নিবাসের গিরি ভবনে এমরানের বাসায় নিয়ে যায়। চবি ছাত্র এমরান সেখানে ব্যাচেলর বাসায় ভাড়া থাকত। সেলিম কীভাবে আইইডি’র বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে সেটি শিখিয়ে দেয় এমরানকে। সেলিম সেখানে আইইডি রেখে সাইফুল্লাহকে নিয়ে বের হয়। জুমার নামাজের পর সেলিম ও সাইফুল্লাহ মিলে নগরীর বিভিন্ন এলাকা রেকি করে দুই নম্বর গেইটে ট্রাফিক বক্স হামলার জন্য নির্ধারণ করে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সময় আবু সাদেক ট্রাফিক বক্সের ভেতরে টেবিলের নিচে আইইডি রেখে আসে। সেলিমের নির্দেশ অনুযায়ী- এমরান ও সাইফুল্লাহ বিস্ফোরণ ঘটানোর দায়িত্বে ছিল। এমরানের হাতে ছিল রিমোট কন্ট্রোলার। কিন্তু সাইফুল্লাহ ট্রাফিক বক্সের দক্ষিণে যাত্রী ছাউনির পাশে দাঁড়িয়ে রিমোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর সেলিমকে ফোন করে সাইফুল্লাহ বলে- আমরা সফলভাবে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি। এরপর শুধুমাত্র এমরানকে শহরে রেখে বাকি সবাই লোহাগাড়ার পদুয়ায় চলে যায়।

সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপে কার কাছ থেকে পুলিশ বক্সে বোমা হামলার নির্দেশ পেয়েছেন- সেটা অভিযোগপত্রে উল্লেখ নেই। এছাড়া বিভিন্ন আসামির জবানবন্দিতে হাবিব, মাইনুল, কামাল ও শহীদের- এ চারজন ঘটনায় জড়িত বলে তথ্য এলেও তাদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়নি। ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্রের মাধ্যমে তাদের আসামি করা হবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

কয়েকদফা চেষ্টার পরও কল রিসিভ না করায় এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় গুহ’র বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন