বিজ্ঞাপন

সাংবিধানিক চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা সমার্থক

November 4, 2022 | 11:40 am

আবুল খায়ের

সুদীর্ঘ দুই যুগের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিসমূহ উৎসারিত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনা-কাঠামোও গড়ে উঠেছে মুক্তিসংগ্রামের পরম্পরায়। ১৯৫৫’র ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর ৩ দিন ব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের বার্ষিক রিপোর্ট পেশকালে দলকে অসাম্প্রদায়িককরণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বন্ধুগণ! একথা অনস্বীকার্য যে, যে সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় তখনকার বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী আমাদের সংগঠনকে একটি ‘সাম্প্রদায়িক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছিল। মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের ধর্মানুরাগের সুযোগে ইসলামকে হাতিয়ার করেই তার শাসন অব্যাহত রেখেছিল। জনগণও তখন লীগ সরকারের বিভ্রান্তি হতে নিজদেরকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। এ অবস্থায় আমাদের সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক করা সম্ভব হলেও মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবের মোকাবিলা করার কাজে তা ব্যর্থ হতো। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। …আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে এ কথা ঘোষণা করতে পারি যে, দেশের সকল ধর্মের সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষী মানুষকে একটি গণপ্রতিষ্ঠানে সমবেত করার প্রয়োজন। বস্তুত আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবো।”

বিজ্ঞাপন

১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ মুসলিম লীগ ও সাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করেছিল। ফলত, ’৫৫ সনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটির বর্জন হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। এর ফলে অসাম্প্রদায়িক তথা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা তখন থেকেই হয়ে ওঠে বাঙালী জাতীয়তাবাদের তথা বঙ্গবন্ধুর চেতনার আবশ্যকীয় অঙ্গস্বরূপ।

একই অধিবেশনে গণমানুষের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যে ক্ষমতার লোভে লোভী নন সে প্রসঙ্গে শেরে-বাংলা একে ফজলুল হকের কঠোর সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘…বড়ই পরিতাপের বিষয়, …মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক ক্ষমতা লোভের বশবর্তী হয়ে একথাই চিন্তা করতে লাগলো যে, যদি জনাব হকের দ্বারা একটি নূতন প্রতিষ্ঠান গঠন করানো যায় এবং জনাব হকের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে তার প্রিয়ভাজন হওয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তারা ভেবেছিল হক সাহের যদি নূতন পার্টি গঠন করেন তাহলে আওয়ামী লীগ ও হক সাহেবের পার্টি মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হবে, কারণ জনগণ হক-ভাসানীর মিলন চায়। অতএব, নির্বাচনে যদি এই যুক্তফ্রন্ট দলের বিজয় হয় তাহলে হক সাহেবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খুবই সম্ভাবনা থাকবে, কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মন্ত্রীত্ব লোভী নন।’

ইতিহাসের বাস্তবতা বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গণমানুষের অধিকার ও স্বার্থ সমুন্নত রাখতে আদতেই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কখনোই ক্ষমতার লোভে নীতি বিসর্জন দেয়নি। মন্ত্রীত্ব, প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাবও পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে গণদাবীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে শির উঁচু করে যে স্থির-প্রতীজ্ঞ মনোভাব প্রদর্শিত হয়েছে তার নমুনা মেলে ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের পর আইয়ুব খান আহুত গোল টেবিল বৈঠকের প্রাক্কালে। তখন সামরিক শাসক গোষ্ঠী প্রদত্ত লোভনীয় বহু প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু পায়ে ঠেলেছেন। আর ’৭১-এর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই।’ গণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় আপোষহীন মনোভাবই শত নির্যাতন-নিপীড়নের সামনেও তাকে টলাতে পারেনি। হিমালয় সমান অটল সাহস আর ধৈর্য নিয়ে তিনি সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রমের যে অমিততেজ বিক্রম তার চারিত্র বৈশিষ্ট্যে প্রদর্শন এবং প্রতিফলিত করেছেন তা সকল বৈষম্যের অবসান সূচিত করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রবর্তনের আদর্শিক ও নৈতিক ভিত্তি যুগিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গণমানুষের কথা বলার অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন সমুন্নত রাখা আর সাংবিধানিক চর্চায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাকে বঙ্গবন্ধু ধ্যান-জ্ঞান করতেন। এর প্রমাণ মেলে রাষ্ট্র পরিচালনার্থে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রদানে সম্মত ছিল না। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর বাঙালী জাতির জনপ্রতিনিধিদের হাতে সংবিধান প্রণীত হবে এটি তারা যেকোন মূল্যে ঠেকাতে চেয়েছিল। এবং এজন্যই জেনারেল ইয়াহিয়া মার্চের ৩ তারিখে আহুত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালে জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। অথচ, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের প্রতারণাপূর্ণ ছলনার পরও সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বলেছিলেন, ‘…যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার সে ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো…।’

গণতন্ত্রের ইতিহাসে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি প্রদানে এ-কথার গভীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। বক্তব্যটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুযায়ীই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্যে পরিষ্কার বলা হয়েছে ‘আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয়’ অর্থাৎ ‘সংখ্যা’ গুরুত্বপূর্ণ নয় তার চেয়েও অধিক গুরুত্ববহ হচ্ছে ‘ন্যায্যতা।’ ন্যায্যতা প্রতিপন্ন হলে গরিষ্ঠ অবস্থানে থেকেও তা মেনে নেওয়ার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে বক্তব্যটি একটি নৈতিক-আদর্শিক সোপানে উন্নীত এবং গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার পুণ্যবচন হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আসীন হয়।

বঙ্গবন্ধুর চেতনাই হচ্ছে বাঙালী জাতীয়তাবাদের, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের, বাংলাদেশ গণপরিষদের এবং সর্বোপরি সংবিধানের আদর্শিক-নৈতিক ভিত্তি। যে চেতনা গড়ে উঠেছিল দীর্ঘ দুই যুগের নব্য ঔপনিবেশিক ধাঁচের নিকৃষ্ট ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে মোকাবেলা করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আর এ সংগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শামিল হয়েছিল বাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-বুর্জোয়াসহ বাঙালী জাতির দেশপ্রেমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি। বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র এই স্তরের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছিল মহান সব সংগ্রামের সাধন-সাফল্য। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল মূলত উদার গণতান্ত্রিক। সমাজের অনগ্রসর মেহনতি অংশের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের কর্মসূচীর সাথে উদার কৃষক-গণতান্ত্রিক চেতনার পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বিপ্লবী কৃষক-গণতন্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

’৭০-এর দশকে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা এবং দেশে দেশে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কর্তৃক নিরঙ্কুশ সমর্থন প্রদান এদেশের জনসাধারণের এক সুবিপুল অংশকে সমাজতান্ত্রিক চেতনা বিপুলভাবে প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়। এরই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয় বঙ্গবন্ধুর চেতনায় এবং সংবিধানে যেখানে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সন্নিবেশিত হয় সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সমাজতন্ত্রের নবতর ব্যাখ্যা ছিল তা হচ্ছে গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ এবং তিনি নিজেই সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার ধারণাকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন

বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠন ও সংবিধান প্রণয়নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনেতিক দর্শনের শতভাগ প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষক-গণতন্ত্রী; ইংরেজীতে রাজনৈতিক বর্গটিকে বলা হয় peasant-democrat। কৃষক-গণতান্ত্রিক সংগ্রামের দু’টি দিক রয়েছে-সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা। বঙ্গবন্ধু মুজিব সূচিত বাঙালীর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের দু’টি দিক-মর্মবস্তুগভাবে এটি সাবেকী সামন্ততন্ত্রের হালনাগাদ রূপ সামরিক-স্বৈরাচার বিরোধী ও সাবেক পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি শাসনের প্রত্যক্ষ রূপটি ঔপনিবেশিক বিধায় তা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের শুরু হতে অর্থাৎ ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত পুরো কালপর্ব জুড়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবের রাজনৈতিক কর্মসূচী কৃষক-গণতন্ত্রের দুটো শর্তই পরিপূর্ণভাবে পূরণ করে বিকশিত হয়ে সর্বোচ্চ রূপ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছে।

নভেম্বর ৪ ১৯৭২, বাংলাদেশ গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে বক্তৃতারত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

নভেম্বর ৪ ১৯৭২, বাংলাদেশ গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে বক্তৃতারত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত কালপর্বে কৃষক-গণতন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মুজিবের রাজনৈতিক বিবর্তন মুসলিম জাতীয়তাবাদী থেকে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদীতে রূপান্তরের ইতিহাস। এই পরিবর্তন কেবল ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু মুজিবের চৈতন্যিক পরিবর্তন নয়; জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠাংশের রাজনৈতিক রূপান্তরও বটে। প্র্যাগম্যাটিক রাজনীতিক হিসেবে এখানেই গণনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সার্থকতা। জনসাধারণের সাথে তার সম্পর্কের বন্ধন এতই নিবিড় ও অচ্ছেদ্য যে, নিছক স্বীয় রাজনৈতিক চেতনার পরিবর্তন নয়, বরং সমগ্র জনগোষ্ঠীকে তিনি বিপুল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে পৌঁছে দিয়েছেন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সর্বোচ্চ ধাপে। যার আরম্ভটা হয়েছিল প্রথমে ’৪৮-এর ১১ মার্চ মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবীতে এবং পরে ’৬৬তে প্রণীত ৬ দফা দাবীনামায় অন্তর্ভূক্ত ‘এক মাথা এক ভোট’-এর ভিত্তিতে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার তথা স্বাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে। এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রাপ্তবয়ষ্কদের ভোটাধিকারের দাবী আদায় করে ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে স্বাধিকারের সনদ ৬ দফার প্রতি গণরায় অর্জন করে বঙ্গবন্ধু মুজিব বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে রাজনৈতিক বৈধতা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যখন পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করে, তখন এই গণরায়ের বৈধতার বলেই বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রায় সকল দেশের সহানুভূতি অর্জনে সমর্থ হয়। নিয়মতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক পন্থায় কী করে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণ সম্ভব তা বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের মাধ্যমে স্ফটিকস্বচ্ছতায় প্রমাণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব তিনি সর্বব্যাপী এক গণযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে অভিষিক্ত করেছেন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে-প্রতিষ্ঠা করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

বিজ্ঞাপন

জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট থাকা সত্ত্বেও কোনদিন ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। ’৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুখের কথাই ছিল আইন। বাংলার জনসাধারণ সে সময় বঙ্গবন্ধু মুজিবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির পর ’৭২-এ যখন আওয়ামী লীগ দলীয় বেশ ক’জন গণপরিষদ সদস্যকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করলো চরমপন্থীরা, তখনো বঙ্গবন্ধু মুজিব গণপরিষদ অধিবেশন চালু রেখে ৯ মাস সময় নিয়ে জাতিকে উপহার দিয়েছেন তৎকালীন সময়ের সেরা সংবিধান-ইতিহাসে যা খ্যাত হয়ে আছে ’৭২-এর সংবিধান নামে। এসব না করে তিনি প্রয়োজন মতো ফরমান জারী করে আইন করতে পারতেন এবং সেই ফরমানগুলোই হতো সংবিধান। কিন্তু তা তিনি করেননি। গণপরিষদে জনপ্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে বলবৎ করলেন সংবিধান। তার এই আচরণটি বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক এবং উত্তরসূরীদের জন্য গৌরবের।

সংবিধানের চার মূলনীতি- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও  সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু অন্তর্ভূক্ত করলেন সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু মুজিব তো সমাজতন্ত্রী নন। তবে কেন সংবিধানে সন্নিবেশিত করলেন ‘সমাজতন্ত্র’? এ প্রশ্নের উত্তরটি নিহিত আছে বঙ্গবন্ধু মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন ‘কৃষক-গণতান্ত্রিক’ মতাদর্শে। কৃষক-গণতান্ত্রিক দর্শন সংগ্রামী বস্তুবাদের স্বতঃস্ফূর্ততা থেকে উৎসারিত। প্রবল গণভিত্তিই এর মূল শক্তি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীতে নবীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শক্তি-সাম্যের যে অবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতির সেই বাস্তবতার অমোঘ নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধু মুজিব পরিচালিত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষ, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপস্থিতি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদানে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিল বিধায় এবং দেশের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রের দাবীতে দেশের যুবসমাজসহ সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবী বঙ্গবন্ধু মুজিবকে সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণে মূলত উৎসাহিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাকশাল কর্মসূচী ছিল প্রকৃতই গণমুখী। লক্ষণীয় যে, তিনি ’৭২ বা ’৭৩-এ বাকশাল করেননি, করেছেন ’৭৫-এ। বাকশাল বিষয়ে তার অবস্থান ছিল পরিষ্কার। অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে বেগবান বিকাশ ত্বরান্বিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বাকশাল ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি। কিন্তু আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও দলীয় এই ত্রিমুখী ষড়যন্ত্রের নিকট আপাত পরাস্ত হয়েছেন তিনি। চোখের সামনে চিলির নির্বাচিত গণনায়ক সালভাদর আলেন্দের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও কৃষক-গণতন্ত্রের প্রবল স্বতঃস্ফূর্ততায় আপ্লুত বঙ্গবন্ধু নিজকে ঠেলে দিয়েছেন সর্বনাশা পরিস্থিতির দিকে। শত্রুর প্রতি অতিউদারতা ও দেশের মানুষের প্রতি অতিভালোবাসায় তার জীবনমন্ত্র ছিল, ‘করি শত্রুর সাথে কোলাকুলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।’

’৭৩ ও ’৭৪ জুড়ে আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ভয়াবহ রূপ লাভ করে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রীদের নাটের গুরু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নীলনকশা বাস্তবায়নে তথা স্বাধীন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানপন্থী ধর্মান্ধ দলগুলো, রাতারাতি গজিয়ে ওঠা বৈজ্ঞানিক বিপ্লববাদ ও চরমপন্থী নকশালদের কিছু কুকর্ম বাস্তবায়নে পরাজিত শত্রু দেশ পাকিস্তান সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। এছাড়া সদ্য স্বাধীন নবীন রাষ্ট্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে সাবেকী পাকিস্তানি মতাদর্শের লোকজন বহাল থাকায়, নির্বিঘ্নে ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়। ফলত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে বছর জুড়ে থানা লুট, ফাঁড়ি লুট, পাটের গুদামে আগুন, খুন, রাহাজানি, ব্যাংক লুট ইত্যাকার ধ্বংসাত্মক কুকর্ম চলতেই থাকে। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নেমে আসে ’৭৪-এর বন্যা। দেখা দেয় প্রবল খাদ্য সংকট। সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা খাদ্য সংকটের পুরো সুযোগটি কাজে লাগায় বিশ্বাসঘাতকতা করে। এমতাবস্থায় আলজেরিয়ার রাজধানী আলেজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ফিদেল ক্যস্ট্রো তো বঙ্গবন্ধুকে স্পষ্ট বলেই দিয়েছিলেন, ‘এক্সিলেন্সি মুজিব, তোমাকে আমরা খরচের খাতায় রেখেছি। তোমাকে আলেন্দের পরিণতিই বরণ করতে হবে। তুমি ভুল করছো। কেবল তোমার সন্তানতুল্য মুক্তিযোদ্ধারাই তোমাকে রক্ষা করতে পারে। তুমি ওদের দিয়ে সেনাবাহিনী গঠন করো, প্রশাসনের দায়িত্ব ওদের হস্তে অর্পণ করো।’

পরবর্তীতে পরিস্থিতির বাস্তবতা উপলব্ধি করে এসব বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু মুজিব ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়নে ‘বাকশাল’ গঠন করেন। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার বয়স বৃদ্ধি পেয়েছে। দূষিত জলভার ধারণ ও বহনের ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে ফেলেছে। বাকশালের মতো একটি গণমুখি কর্মসূচী সফলতার সাথে বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে তার সক্ষমতা হারিয়েছে। আর ধূর্ত হায়নার দল তীর্থের কাকের মতো ওৎ পেতে ছিল কবে বঙ্গবন্ধু মুজিব রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার ঘোষণা প্রদান করেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির দিকে। যাতে এক ব্যক্তির হস্তে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সাথে সাথে সহজেই ব্যক্তিটিকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা যায়। বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নির্বিঘ্নে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি ও সীমাহীন অপপ্রচার করতে খুনিচক্র প্রচুর সময় পেয়েছে এবং হত্যাকাণ্ডের দিনক্ষণ নির্ধারণেও তারা শতভাগ সফল হতে পেরেছে।

সমাজতন্ত্রী না হয়েও সমগ্র বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে স্যালুট করে স্বাগত জানিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ আর বাকশাল কর্মসূচির মূল দর্শন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বাকশাল হচ্ছে শোষিতের গণতন্ত্র।’ বঙ্গবন্ধু মুজিব ট্রু ন্যাশনালিস্ট, খাঁটি জাতীয়তাবাদী! যেমনটা গণচীনের জাতির জনক সান-ইয়াৎ সেন; আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক; ভারতের জাতির জনক মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী; ঘানার নেতা কাওমি নক্রুমা; চিলির অবিসংবাদিত নেতা সালভাদর আলেন্দে; কঙ্গোর স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক প্যাট্রিস লুমুম্বা, আধুনিক কিউবার প্রতিষ্ঠাতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো, দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা…। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি অতুলনীয়। তিনি কখনোই একনায়ক ছিলেন না; ছিলেন আপাদমস্তক গণতন্ত্রী; গণমানুষের একান্ত আপনজন। ফলত, দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘকালের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তার চেতনাকে সূত্রায়িত করা হয় ‘মুজিববাদ’ বলে।

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ঘোর অন্ধকার যুগের ইতিহাসকে যিনি বদলে দিয়েছিলেন ২৪ বছরের সংগ্রামী জীবনের কঠোর তপস্যা দিয়ে; যিনি বাঙালীর পাঁচ হাজার বছরের মহত্তর জীবনাদর্শ নিজ জীবনে প্রস্ফুটিত করেছিলেন বিনয়ভূষণ তপোবীরের মতই; স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের বারোটি বছর কারান্তরালের নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন অসীম ধৈর্য আর অপরিসীম সহিষ্ণুতা নিয়ে; ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে দুর্জয়-সঙ্কল্প বোধ দ্বারা চালিত হয়ে জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্যে পরিণত করেছেন; কোনরূপ অন্যায়ের কাছে যিনি নতি স্বীকার করেননি-বাঙালীর ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাবী বংশধরদের উদ্দেশে কর্তব্য-করণীয় যেভাবে নির্দেশ করেছেন, সেটি প্রতিপালনে সচেষ্ট হলে বাঙালীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পুণ্যার্জনে ভবিষ্যৎ পুণ্যময় হয়ে আগামী জীবন শোভিত হবে সুনিশ্চিত। কেননা ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় তিনিই একমাত্র যোগসূত্র। আর সকল কিছুই আমাদের জাতীয় জীবন থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে প্রায় নিঃশেষিত। ফলে, তার পরমারাধ্য নির্দেশকে ধ্যান-জ্ঞান করেই পথ তৈরী করে এগিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে অন্ধ হয়ে থাকলে চলবে না মোটেই। কেননা, অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?

সংবিধান, ৫ম সংশোধনী ও হাইকোর্টের রায়

বাংলাদেশ গণপরিষদে ৪ নভেম্বর, ১৯৭২-এ গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে এদেশের মানুষের শত বছরের সংগ্রামের স্বপ্ন, আকাঙ্খা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রূপায়ন ঘটেছিল। গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকার শতভাগ প্রতিফলিত করতে গণপরিষদ সদস্যবৃন্দ ছিলেন বদ্ধপরিকর। ‘স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার রঙ্গীন আশায় বুক বেঁধে জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল গণপরিষদের প্রতিনিধিদের।’ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তারা সংবিধান-প্রণয়ন করবে এমনটাই ছিল আশা। কিন্তু পাকিন্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিণামে ত্রিশ লক্ষ সোনার সন্তানের আত্মদানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জনগণের অভিরুচি অনুযায়ী দেশ শাসিত হোক এমন অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ গণমানুষের চেতনার প্রতিফলন হিসেবে প্রণীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। প্রণীত সংবিধান হয়ে ওঠে জাতির আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত রূপ।

কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাসের বর্বরতম ও নৃশংসতম অধ্যায় সংঘটিত করে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে সংবিধান ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যাবতীয় অর্জনসমূহকে ভুলুণ্ঠিত করে। সংবিধান স্থগিত করে। দেশে সাংবিধানিক চর্চা, নিয়মতান্ত্রিকতা, গণতান্ত্রিক আবহে রাজনীতি চর্চার সকল পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সামরিক স্বৈরশাসকগণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিক্ষেপ করে, রাজনীতিকে বেচাকেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাষ্ট্র ও সমাজে সর্বব্যাপী অনিয়মের রাজত্ব গড়ে তোলে। একের পর এক সামরিক ফরমান জারি করে সংবিধান বহির্ভূত তথাকথিত ‘হাঁ’, ‘না’-ভোট; রাষ্ট্রীয় তহবিলের টাকায় দল গঠন; দেশের সকল এলাকায় মাস্তান, খুনি, সমাজ বিরোধীদের রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে-অর্থায়নে রাজনৈতিক মঞ্চে টেনে আনা; রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী ও পতিতজনদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে দুর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতি চালু করে রাজনীতিকে কলুষিত করার যে মহাযজ্ঞ শুরু করে তা অচিরেই সমগ্র বাংলাদেশকে গ্রাস করে। নিয়মতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ভূমিষ্ঠ গণপ্রজাতন্ত্র অচিরেই অনিয়ম আর স্বেচ্ছাতন্ত্রের করালগ্রাসে নিপতিত হয়।

’৭৫ উত্তরকাল থেকে ’৯৬ পর্যন্ত অর্থাৎ জিয়া-এরশাদ-খালেদার আমল পর্যন্ত একটানা সীমাহীন দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন-অনিয়ম-স্বেচ্ছাচার হয়ে ওঠে সমাজে ও রাষ্ট্রের নিয়ামক ব্যাপার। সমাজ ও রাজনীতি এতোটাই কলুষিত হয়ে পড়ে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমূহ তথা ত্যাগ-তিতিক্ষা, আদর্শ-মতাদর্শ, ভোটাধিকার, মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীগত অধিকার ইত্যাদি সব জাদুঘরের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। তদস্থলে প্রতিস্থাপিত হয় খুন, দখল, ভোট-ডাকাতি ও ভোট-ক্রয়, মত প্রকাশে বাধা, সভা-সমাবেশ দমন, সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ-বিত্তে সমৃদ্ধ কতিপয়ের হস্তে কুক্ষিগত হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা। জনগণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচারপতিগণও সেনাপতিদের, কায়েমী স্বার্থবাদীদের তল্পিবাহক হয়ে ওঠে। ফলে ’৭২-এ প্রণীত সংবিধান ও এর ভিত্তিতে গড়ে উঠবে যে স্বপ্নের বাংলাদেশ তা অধরাই থেকে যায়। পরিস্থিতি এতোটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, একটানা চলতে থাকা এরকম ইতর ও নিকৃষ্ট শাসনে অনিবার্য হয় সাময়িক বিরতির। ’৯৬তে দীর্ঘ ২১ বছর পর মার্জিনাল গরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসীন হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বপ্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদকালে অর্জিত হয় বেশকিছু সাফল্য। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় সাংবিধানিক অর্জন, সংবিধান থেকে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ অপসারণ করে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম করা। কুখ্যাত অধ্যাদেশটি ছিল সংবিধানের উপর চেপে বসে থাকা এক জগদ্দল পাথর।

কিন্তু ২০০১-এর বিতর্কিত নির্বাচনের পর পুনরায় দেশের ভাগ্যাকাশে নেমে আসে বিপর্যয়ের ঘোর অমানিশা। এর মধ্যেই আশাজাগানিয়া সূর্যকিরণ দেখা দেয় ২০০৫-এর ২৯ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে। পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী বলে হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায় প্রদান করে। রায়ে খুনি মোশতাক, শপথ ভঙ্গকারী বিচারপতি সায়েম ও জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন অবৈধ হয়ে যায়। পরে হাইকোর্টের এই রায় চ্যালেঞ্জ করে আপীল বিভাগে রিট আবেদন পেশ করে বিএনপি ও এর সমমনা আইনজীবীগণ। এর পরপরই ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গণরায়ে ৯০ শতাংশ আসনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বপ্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। দীর্ঘকাল পর দেশ সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে আগুয়ান হয়। ২৮ জুলাই ২০১০ তারিখে হাইকোর্টের রায়ের কিছু অংশ সংশোধন করে সুপ্রীম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় দেন। এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান পুনরায় ’৭২-এ প্রণীত মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করে। কিছুদিন পর ২৬ আগস্ট, ২০১০ তারিখে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষণা করে সপ্তম সংশোধনীও সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ বলে রায় দেয় হাইকোর্ট। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধান সংশোধনে গঠন করেন বিশেষ সংসদীয় কমিটি। কমিটি এবিষয়ে কয়েকটি বৈঠক করে এবং রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পুনসংস্থাপন করে সংবিধানের মূল চেতনা ফিরিয়ে আনতে সংবিধান সংশোধনে জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পেশ করে যা জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদিত হয়।

এর আগে সুপ্রীম কোর্টের এ রায়ের আলোকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা জনাব কামাল হোসেন বলেন, “আপীল বিভাগ মূলত দু’টি বিষয় ছাড়া হাইকোর্টের রায় প্রায় হুবহু বহাল রেখেছেন। ওই দু’টি বিষয়ের একটি হচ্ছে নাগরিকত্ব-সংক্রান্ত সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদ; যেখানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হবেন।’ আর অন্যটি হচ্ছে, বিচারপতি নিয়োগ-সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ। এতে বলা হয়েছে বিষয়টি সম্পর্কে আদালতের যে রায় আছে তা অনুসরণ করতে হবে। তাই এ অনুচ্ছেদের কোন পরিবর্তন করতে হবে না। তিনি রায়কে স্বাগত জানিয়ে আরও বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানের সংশ্লিষ্ট সংশোধন হয়ে গেছে। এখন সরকার এ ব্যাপারে একটি গেজেট প্রকাশ করতে পারে। …এজন্য জাতীয় সংসদে কোন বিল উত্থাপনের দরকার নেই। সরকার যে বিশেষ কমিটি গঠন করেছে, তার সঙ্গে আদালতের রায় বাস্তবায়নের কোন সম্পর্ক নেই।”

এতদ্বিষয়ে জনাব কামাল হোসেনের মন্তব্যের অনুরূপ মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক। প্রধান বিচারপতি পদে শপথ গ্রহণের পর সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে। এটা আর নূতনভাবে কার্যকর করার কিছু নেই। আমরা আইন মন্ত্রণালয়কে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধান পুনঃমুদ্রণের আহ্বান জানাই।’ কিন্তু সরকার সে পথে না এগিয়ে সংবিধানবিষয়ক সংসদীয় কমিটি গঠন করে, সমাজের সর্বস্তরের পেশাজীবী প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে জাতীয় সংসদে যে প্রতিবেদন দাখিল করে, তার ভিত্তিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ২০১১ গৃহীত ও কার্যকর এবং সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃসংস্থাপিত হয়।

সাংবিধানিক চর্চার সালতামামি

গৌরবময় অতীতের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও বলবৎকৃত সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধানের পবিত্র দায়িত্ব পালনে আমাদের সাফল্য বা ব্যর্থতার সালতামামি আবশ্যক। কেননা উত্তরকালে ’৭২-এ প্রণীত সংবিধানটির উপর যে পরিমাণে যথেচ্ছাচার চালানো হয়েছে এবং যে কায়দায় চালানো হয়েছে তার তুলনাও ইতিহাসে বিরল। সেজন্য এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, তুলনামূলক বিচারে প্রণীত সংবিধানটি মর্মবস্তুগত দিক থেকে এতোই আধুনিক, উদার চেতনা সম্বলিত ছিল যে, জাতি হিসেবে আমরা বাঙালীরা কী আদৌ এর সমতুল্য বা যোগ্য?

আজ যতভাবে যতদিক থেকে প্রজাতন্ত্রের অঙ্গসমূহ যতই পাপস্খলনের চেষ্টা করুক না কেন, এই পাপাচারের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে যে তামসশক্তি সমাজে ও রাষ্ট্রে দম্ভভরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে তাতে কোন একদল ‘রাইচরণের’ বিজ্ঞজনোচিত বিচক্ষণ রায়ে ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর মতো ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন হয়তো সম্ভব! কিন্তু হামাগুড়ি দিয়ে যে খোকাবাবু স্বাভাবিকভাবে চৌকাঠ পার হয়ে ভুবন দেখায় সমর্থ হতো তাকে শৈশবেই বিকলাঙ্গ, বিকৃত ও সমাধিস্থ করে দেওয়ার হীন প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যারা মার্শাল ডেমোক্রেসির উদ্ভব ঘটিয়েছিল এবং সেই যজ্ঞে যারা সারথী হয়েছিল তাদের কোথায় প্রত্যাবর্তন ঘটবে ইতিহাস সে প্রশ্নের সমাধান না জেনে পাপস্খলনের সুযোগ দেবে না আদৌ!

সাংবিধানিক চর্চা ও স্বপ্নের বাংলাদেশ

’৭২-এর মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে নিরন্তর সাংবিধানিক চর্চা অব্যাহত রাখার মাধ্যমেই কেবলমাত্র স্বপ্নের আরাধ্য বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে বঙ্গবন্ধুর চেতনা সম্পর্কে নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন জরুরী। যে চেতনাধারিত আছে তার কর্মময় জীবনে, আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থাদি (অসমাপ্ত আত্মজীবনী; কারাগারের রোজনামচা; আমার দেখা নয়াচীন) ও অসংখ্য বক্তৃতা-বিবৃতিতে। দূরদর্শী ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর নির্বাচনী ভাষণে বলেছিলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের গুরুভার বহন করতে দেওয়া কোনোপ্রকারেই উচিত নয়। রাজনীতিতেও সশস্ত্র বাহিনীর জড়িয়ে পড়া একেবারেই অনুচিত। উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্ত পেশাদার সৈনিকদের জাতীয় সীমানা রক্ষার গুরুদায়িত্ব এককভাবে পালন করা বাঞ্ছনীয়।’ এই রাষ্ট্রনায়কোচিত অমূল্য ও প্রজ্ঞাচক্ষু কথাগুলো জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যথাযথভাবে অনুসৃত হয়নি বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে বারংবার দেখা দিয়েছে দুর্যোগের ঘনঘটা। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংবিধানকে সমুন্নত রাখা, সাংবিধানিক অধিকারসমূহ সম্পর্কে সদা-জাগ্রত মনোভাব নিরন্তর জারি রাখার মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র জনজীবনে সংবিধানের নীতিসমূহ অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।

’৭২-এর নভেম্বরের ৪ তারিখ, যেদিন গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হয়, সেদিনের বক্তৃতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ বংশধর, ভবিষ্যৎ জনসাধারণ কিভাবে শাসনতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে তারই উপর নির্ভর করে শাসনতন্ত্রের সাফল্য, তার কার্যকারিতা। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক।’

সংবিধান বলবৎ হওয়ার চার যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রজাতন্ত্রের স্থপতি ও সংবিধান প্রণেতা মহান নেতৃবৃন্দ কথিত ভবিষ্যৎ বংশধরেরা সাবালক হয়েছেন। অনেকেই আইন-সভার সদস্য হয়েছেন। কিন্তু সংবিধানে লিপিবদ্ধ অপরূপ সুন্দর স্বপ্নটি অধরাই থেকে গেছে। সমগ্র জাতিকে একসূত্রে সূত্রায়িত করার তাবৎ অর্জনগুলো অদৃশ্য হয়েছে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সুমহান চেতনা ও আদর্শের বন্ধনে সমগ্র জাতিকে একত্রিত করার মতো পবিত্রতম ও সুন্দরতম আশাবৃক্ষটি নিষ্ঠুর আর চরম পৈশাচিকতার শিকার হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান আদর্শ ও চেতনা সমেত সমূলে সমাধিস্থ হয়েছেন টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে।

হারিয়ে যাওয়া অর্জনসমূহ পুনরুদ্ধারে দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলনে জনসাধারণ পরিশ্রান্ত এবং ক্লান্ত। সংবিধান অনুসারে যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য-পীড়িত আর বিপুল জনভারে ভারাক্রান্ত প্রিয় মাতৃভূমির দৈন্যদশা ঘুচিয়ে আমাদের হারানোর পরিমাণটার বিশালত্ব ও গভীরতা পরিমাপ করবার মতো বোধটুকু অর্জনের সহায়ক পরিবেশ যতদিন আমরা গড়ে তুলতে না পারবো, ততদিন স্বপ্নের বাংলাদেশ অধরাই থেকে যাবে আর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রগতিপন্থীরা হয়ে থাকবেন বেদনার সন্তান!

লেখক: গবেষক ও প্রকাশক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন