বিজ্ঞাপন

সঞ্জীবদাকে এখনও কি চেনা যায়?

November 19, 2022 | 5:44 pm

টোকন ঠাকুর

শিল্পী ও সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী প্রয়াত হবার পর পৃথিবী আরও পনেরো বছর পার করছে এ বছর। সঞ্জীব চৌধুরী শিল্পী বা সাংবাদিক হলেও তার লেখা কবিতা ছিল, কিছু গল্প ছিল; পরে হয়তো একটি মলাটবদ্ধ গ্রন্থে সেগুলো জায়গাও পেয়েছে। ২০০৭ এ যখন তিনি মারা যান, সাংবাদিক গোলাম ফারুক আমাকে দিয়ে সঞ্জীব চৌধুরীর ওপর কিছু লেখাও লিখিয়ে নেন এবং সেগুলো দৈনিক সমকাল পত্রিকায় তখন ছাপা হয়। আজকের মতো তখন গুগল ছিল না, অনলাইন লিঙ্কও নেই সেসব লেখার।

বিজ্ঞাপন

সঞ্জীব চৌধুরীর কোনও এক জন্মদিনে এফএম ব্যান্ড রেডিও স্বাধীন-এ একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে মীর রাব্বি। সেই অনুষ্ঠানে বক্তা ছিলেন দলছুট শিল্পী বাপ্পা মজুমদার, সাংবাদিক ও আনন্দভুবন সম্পাদক গোলাম ফারুক এবং আমি। অনুষ্ঠান শুরুর আগে রাব্বীকে বলি, সঞ্জীবদার উপরে অনুষ্ঠান, শুকনো মুখে? রাব্বি ফোন করে শ্রেয়াকে। রাব্বির স্ত্রী শ্রেয়া, আলী যাকের ও সারা যাকের দম্পতির কন্যা; শ্রেয়া নিয়ে এসেছিলেন জল। সেই জল বিদেশি। সেই জলযোগেই রেডিও স্বাধীন-এর স্টুডিওতে ঢুকি আমরা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা, ফাঁকে ফাঁকে গান ছিল সঞ্জীবদার। অনুষ্ঠানের প্রায় শেষের দিকে স্টুডিওর বাইরে থেকে যুক্ত হলো সেতু, আদিত্য কবির।

সঞ্জীবদার বেঁচে থাকার বয়স আমি পার হয়ে এসেছি। তারপরও তিনি আমার কয়েক বছরের অগ্রজ। একসঙ্গে জীবনের অনেক কিছুই করেছি আমরা একত্রে। রাগ, অভিমান, ভালোবাসা ছিল আমাদের। সেটা থেকে যাবে বাকি জীবন। এরই মধ্যে গোলাম ফারুক ও আদিত্য কবির প্রয়াত। গোলাম ফারুকের অধীনে সংবাদপত্রে কাজ করেছি। আদিত্য আমার বন্ধু। হাজার স্মৃতি আছে আমাদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চারুকলা, উদ্যান, শাহবাগ, বাংলামোটর আঙিনায়।

বিজ্ঞাপন

আমাদের মারজুক রাসেলের লেখা গানে একটি অ্যালবাম বের হলো। সেসব গানের সুর করলেন সঞ্জীবদা, যন্ত্র বাজলেন বাপ্পা মজুমদার এবং গাইলেন হাসান মাসুদ। অ্যালবামের নাম আমার এই মুহূর্তে মনে পড়তেছে না। এ রকম অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছি, সম্ভবত করোনার টিকা এই বিস্মৃতির কারণ। হাসান মাসুদ, সঞ্জীবদা, বাপ্পা ও মারজুকের শ’তিনেক ছবি তুলে নিয়ে এলো আমার সহকর্মী ফটোগ্রাফার রিচার্ড রোজারিও। হাসান মাসুদ সঞ্জীবদার ক্লাসমেট ছিলেন। তো সিডি যুগ কলাপস করার কারণে প্রায় তিনশোটি ছবি বিলুপ্ত, জীবনই হয়তো কিছু বিলুপ্তির সমগ্র।

সঞ্জীবদার মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তার মৃত্যুর পরদিন আমি একটি কবিতা লিখি, যখন সঞ্জীবদার মেয়ে কিংবদন্তীর বয়স মাত্র ৪, সেই ২০০৭ সালে। কারণ, সঞ্জীবদার মরদেহটি ঢাকা মেডিকেলে দান করা হয়েছিল। বাম চেতনায় বিশ্বাসী সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন ব্যথাহত মানুষ, মেশামেশি থেকে তাই বুঝতাম। কবিতার নাম, ‘দ্য সঞ্জীব চৌধুরী আনলিমিটেড’। তৎকালীন চারুকলা-উদ্যান-ছবির হাটে সঞ্জীব চৌধুরী স্মরণসভার সন্ধ্যায় এই কবিতাটি ফটোস্ট্যাট কপি করে ১ হাজার কপি বিলিয়েছিল সঞ্জীব-প্রেমিকেরা। এই লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে, কিংবদন্তী একদিন বড় হয়ে যাবে। সত্যি, পনেরো বছর পরে কিংবদন্তী আজ একুশ বছরের তরুণী। বহুদিন কিংবদন্তী ও ওর মা শিল্পীর কোনও খবর জানি না। অথবা এক ধরনের জানি যা এখানে লেখার বিষয় নয়। আর এখানে সন্নিবেশিত দ্বিতীয় লেখাটির শিরোনাম, ‘সঞ্জীবদা যেমন করে গাইতেন’। এই লেখাটি ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করে, কারা যেন পোস্ট দেয়, ঘুরে ঘুরে তা আমার কাছেও আসে, আমি হয়তো একবার পড়ি। পড়তে পড়তে মনে পড়ে, কত কথাই তো লেখা হয়নি, কত কথাই তো লেখা হয় না। দিন চলে যায়, রাত চলে যায়, কোথায় যায় সময়?

‘যেমন করে সঞ্জীবদা গাইতেন’; লেখাটি কবে লিখেছি? ফেসবুকে যে লিঙ্কটি ঘোরে, সেখানে লেখা ২০১৬ সাল। হতে পারে। আবার আরও আগে যদি এটি লেখা হয়ে থাকে এবং সেখান থেকে এনে যদি কেউ ২০১৬ সালে পোস্ট দিয়ে থাকে, এরকম হতে পারে না? পারে। নাও পারে। সব পারে রে ভাই, সব পারে। এবার তাহলে পড়া যাক সেই দুটো লেখা। ‘দ্য সঞ্জীব চৌধুরী আনলিমিটেড’ লেখা সঞ্জীবদার মৃত্যুর পর দিনই, ২০০৭ এ। ‘সঞ্জীবদা যেভাবে গাইতেন’ ধরে নিচ্ছি ২০১৬ সালের লেখা।

বিজ্ঞাপন

দ্য সঞ্জীব চৌধুরী আনলিমিটেড
কিংবদন্তী একদিন বড় হয়ে যাবে। কিংবদন্তী একদিন বুঝতে শিখবে, কিংবদন্তী কাকে বলে? কেন মানুষ কিংবদন্তী হয়ে যায়? কেন মানুষ মুখে মুখে ফেরা জনশ্রুতির তাৎপর্য গ্রহণ করে? কফিন বাকসের দিকে তাকানো ভাবলেশহীন শিশু, শিশুটি কি জানে কফিনের মধ্যে যে ঘুমিয়ে আছে, সে কে? সে কেন বাসায় না-ফিরে ঐ বাকসের মধ্যে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে? শুয়ে থাকা মানুষটি বাবা, না সঞ্জীব চৌধুরী? সঞ্জীব চৌধুরী কে ছিলেন? কি ছিল তার অন্তরের কথা, স্বপ্নের কথা? কী ছিল তার দাহ? কেনো এতো অগ্নিময় জলের বুদবুদ হয়ে ফেটে যাওয়া? কোন ভুবনে ছিল তার স্বপ্নের পাখি?

কিংবদন্তী একদিন জানতে পারবে, এখানে অন্ধকার ছিল,পরম্পরার। তার বাবা সেই অন্ধকারে জোনাকি হয়ে গেছে। সে একদিন বুঝতে পারবে, এখানে অনেক পাথর ছিল ,তার বাবা যৌবনের সমস্ত শক্তি ঢেলে পাথর সরাতে চেয়েছে, প্রেমতীব্র পথ তৈরি করতে চেয়েছে। কিংবদন্তী একদিন শুনতে পাবে, বাতাসে রঙিন সুর ছড়িয়ে আছে, কারণ সঞ্জীব চৌধুরী গান গাইত। ভয়াল নৈঃশব্দে শব্দ ছড়িয়ে সঞ্জীব চৌধুরী চলে গেছে। শাদা শূন্যতায় মধুবনের রঙ ছড়িয়ে গেছে, আলাপের মধ্যে কবিতা পুঁতে রেখে গেছে। এখানে অনেক বিচ্ছিন্নতা ছড়ানো বলে, তার বাবা অনেক গল্প রেখে গেছে।

রাত্রি গভীর হলেও, যে রাতে কিংবদন্তীর ঘুম আসবে না, যখন সে খুলে খুলে দেখবে অ্যালবাম-ভর্তি এক মুখ, হাওড়-প্রদেশের সেই মুখই সঞ্জীব চৌধুরীর মুখ। কিংবদন্তী নিশ্চয়ই টের পাবে, বহুদিন আগে তার বাবাই কিংবদন্তী হয়ে গেছে। এমনকি তার জন্মের আগেই কিংবদন্তী হয়ে যায় মিছিলের, কবিতার, গানের দলছুট সঞ্জীব চৌধুরী। এই ঠাঠা-মরার দেশে সঞ্জীব চৌধুরী বড় বেশি অপরাধী, কারণ তার ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল। কারণ, সে ভালোবাসত। কারণ এই পোশাকি সিস্টেমের দেশে সঞ্জীব চৌধুরী আপন অস্তিত্বের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। এই ফাঁকা-ফাঁকা মন্দির-মসজিদ-গির্জার দেশে, সঞ্জীব চৌধুরী ছিন্নমুল মানুষের বাসস্থানের ভাবনা মাথায় রেখেছে। নিরন্নের, অন্ন ও পানীয়ের অধিকারের কথা বলার জন্য, সাহসে, বুক টানটান করে রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিংবদন্তী একদিন জানবে, মেডিকেল কলেজের গবেষণায় তার বাবার শরীর কাজে লেগেছিল। সেখানেই রয়ে গেছে সঞ্জীব চৌধুরীর কংকাল…। হয়তো আগন্তুকের সঙ্গে আড্ডা দিতে চায়ও, নতুন একটি কবিতা নিয়ে, গান নিয়ে মেতে উঠতে চায়। মা বকা দিলে, হয়তো একদিন খুব মন খারাপ হলে আমাদের কিংবদন্তী কাউকে না বলে একা একাই চলে যাবে মেডিকেল কলেজের দিকে। সে কি বাবার কংকালের সঙ্গে কথা বলবে- ‘বাবা আমার মন ভালো নেই, তুমি একটা গান গাও তো।’

বিজ্ঞাপন

আমরা কিংবদন্তীর পেছনে পেছনে যাব এবং লক্ষ রাখব, দেখব, বাবার কংকাল মেয়ের আবদার রাখে কিনা? কংকাল কি কথা রাখবে?

আমরা জানি সঞ্জীব চৌধুরী কিংবদন্তী ছিলেন…

যেমন করে সঞ্জীবদা গাইতেন

সঞ্জীব চৌধুরী কয়েকভাবে বেঁচে আছেন। বাংলা গানের দল ‘দলছুট’ এর প্রধান গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীর গান রেডিওতে বাজে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের রাত জাগা তরুণেরা তার গান গেয়ে হলে ফেরে, ঘরে ফেরে কিংবা তারা আর ঘরেই ফেরেই না। না ফিরে তারা কোথায় যায়? নৈশ হাওয়ায় ভেসে আসে, কতজন যে গায়, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব, কী দীর্ঘ রাত একা হেঁটেছি বিরান পথে বা কড়া নেড়েছি ভুল দরজায়…’

সঞ্জীব চৌধুরী সংবাদপত্রে তার জীবনের উজ্জ্বলতশ সময়টা ব্যয় করেছেন পেশার তাগিদে। আজকের বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের বড় বড় সাংবাদিকই সঞ্জীব চৌধুরীর হয় বন্ধু, নয় বড় ভাই, নয় অনুজ সহকর্মী। সবাই সঞ্জীব চৌধুরীকে মানে সেই দিলখোলা কিন্তু প্রতিবাদী শিল্পী মানুষটার কাছের মানুষ। আমাদের কাছে সঞ্জীব চৌধুরী হচ্ছেন সঞ্জীবদা। একটু অনুজ আমরা। সঞ্জীবদা অগ্রজ হলেও বন্ধুত্বের কাচের গ্লাসে অবারিত ছিলেন সবসময়। কারণ, সঞ্জীবদা শিল্পী। কবি। গল্পও লিখেছিলেন কিছু। তার বোহেমিয়ান জীবন বড্ড আকর্ষণীয়।

জগতে যে শ্রেণির মানুষ সিরিয়াসলি পানশালাকে ভালোবেসে বুঁদ হয়ে ভেসেছেন, বাংলাদেশের সঞ্জীব চৌধুরী সেই শ্রেণীর প্রথম বেঞ্চের ছাত্র। সেখানকার ভালো ছাত্র। বলতেন, ‘ধুর, সন্ধের পর পুরুষ মানুষ চা পান করে নাকি?’ আবার দিনেরবেলায় দেখা হলেও আড্ডা, আড্ডার শুরুতেই মহামতির আবাহন, “কথা যাই হোক, গলাটা ভিজিয়ে বসাই ভালো না? ‘শ্যালে’ তো কাছেই, কী বলেন?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি বিল্ডিংয়ের সামনের দেয়ালে বর্তমানে কিছু ম্যুরাল দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের আলোকে সেই ম্যুরালে ভাষা আন্দোলনের সৈনিক সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের প্রতিকৃতি আছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি আছে। বঙ্গবন্ধু-অরোরা-নিয়াজির প্রতিকৃতি আছে। আর দুজন গায়কের প্রতিকৃতি আঁকানো আছে দেয়ালে। একজন জন লেনন। অন্যজন, কে? বলুন তো? বলার চেয়ে আজকালের মধ্যেই টিএসসিতে গিয়ে একবার নিজের নয়নে দেখে আসুন, কার মুখ তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে?

শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী তাকিয়ে আছেন, মানুষের দিকে। এই কারণেই, মাতাল রাস্তার মতো টলোমলো মানুষটাকে সাধারণ মানুষ এত ভালোবেসেছে। আর সঞ্জীবদার গানের গলায় যে কী দরদ! প্রাণে ভরপুর ব্যথা তার কণ্ঠে। হবিগঞ্জ-সিলেটের হাওড়ের হাওয়া লেগে থাকা তার সুর, সে তো আমরা বাকিটা জীবনই মনে রাখব গানগুলো শুনতে শুনতে। সঞ্জীবদার প্রথম একক অ্যালবাম ‘স্বপ্নবাজি’তে আমাদের অনেকের লেখাকেই গান করেছিলেন। সাজ্জাদ শরিফ, আনিসুল হক, কামরুজ্জামান কামু, জাফর আহমদ রাশেদ, মারজুক রাসেল, সঞ্জীবদার সেনাপতি রাসেল ও নীল এবং আর কার কার লেখা যেন ছিল। আমার লেখাও ছিল। তবে সঞ্জীবদার গলায় ভালো ফুটেছে তার নিজের লেখা লিরিক এবং কামুর লিরিক। গানগুলো ব্যাপক শ্রোতার কাছেও পৌঁছেছে।

গায়ক বা সাংবাদিক চরিত্রের বাইরে সঞ্জীবদাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখেছি আরো এক চরিত্র। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। কিন্তু সঞ্জীবদার এক বড় গুণ ছিল- দিনে দিনে তখন কত পরিচিতি তার, কিন্তু সামাজিক ন্যায়-অন্যায় প্রশ্নে এক কঠোর সোচ্চার কণ্ঠ তিনি। যেটা সাধারণত পরিচিতি পেয়ে যাওয়া শিল্পীরা এড়িয়েই চলেন, সঞ্জীব চৌধুরী আরো যুক্ত হতেন প্রতিবাদে, তারুণ্যের পাশে। সঞ্জীব চৌধুরী তাই মানুষের কাছে বা আমাদের কাছে অ্যাক্টিভিস্ট শিল্পীও। সঞ্জীব চৌধুরী সবসময় তরুণ।

অধিকার বঞ্চিত গণমানুষকে ভালোবেসে মিটিং-মিছিল করেছেন। আশির দশকের সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যে জেনারেশন জীবন-যৌবন বিসর্জন দিয়েছে রাস্তায়, সঞ্জীবদাও তাদের মধ্যে পড়েন। এই জন্যে দেখেছিলাম, যেদিন সঞ্জীবদার লাশ আনা হয় টিএসসিতে, শোকার্ত গণমানুষের ঢল নেমেছিল। এলিট সংষ্কৃতির লোকেরা যেমন এসেছিল, নামগোত্রহীন রিকশাওয়ালা গোছের নিম্নবর্গের মানুষেও ভরে গিয়েছিল টিএসসির পরিপার্শ্ব। যারা তার গান ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/ বায়োস্কোপের নেশা আমার কাটে না…’ কিম্বা ‘গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে…’ ভালোবেসে শিল্পীর শেষযাত্রার শোকে সামিল। আমরা আমাদের এক টেবিলের, হৃদয়ের, মননের শিল্পীকে হারিয়েছিলাম।

একবার কথা হলো, আমি আর শহীদুল ইসলাম রিপন মুক্তকণ্ঠ দৈনিকের চাকরি ছেড়ে বাংলা মোটরের ভোরের কাগজ জয়েন করা নিয়ে। মুক্তকণ্ঠে তখন বেতন আটকে ছিল মাসের পর মাস। তাছাড়া তখনকার ভোরের কাগজ অফিসের পঁচিশ গজের মধ্যেই ‘শ্যালে’। বারে হেঁটে যেতেও লাগবে দেড় মিনিট। আবার বাদল-ইলোরা বিয়েতে আমার যাওয়া হলো না। মনে হয়, ওইদিন আমি নেশা করেছিলাম। বাদল হচ্ছে এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বখতিয়ার আহমদ। আমি, বাদল, মামুন, রিপন, বিপু- আমরা নেশা করতাম হয়তো তখন।

আমাদের মারজুক শাহর লেখা পুরো অ্যালবামের লিরিক দিয়ে একবার সঞ্জীবদা সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। সেখানে গায়ক হচ্ছেন পুরান ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটে সঞ্জীবদার নবম শ্রেণীতে পড়বার সময়ের স্কুল বন্ধু হাসান মাসুদ, মিউজিক করলেন তার ‘দলছুট’ এর পার্টনার শিল্পী বাপ্পা মজুমদার। অ্যালবামটির নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। লিরিক সাঁইয়ের। মারজুক শাহের।

মাঝরাতে মাঝেমধ্যে সঞ্জীবদার ফোন পেতাম। একরাতে ফোন ধরেই শুনি, ফোনের ওপারে অনেক কুকুর ডাকছে। আমি ‘হ্যালো’ বলতেই সঞ্জীবদা বললেন, ‘শুনতে পাচ্ছেন?’

বললাম,‘ হ্যা, কুকুরের ডাক। কী ব্যাপার?’

‘বাসায় ফিরছি। ওরা আমাকে চিনে ফেলেছে, তাই ডেকে ডেকে অভিবাদন জানাচ্ছে।’

আর একদিনের ছোট্ট মেমোরি নোটসেই এ লেখা শেষ করব। লেখার সময় পাচ্ছি কম। ছবি বানাচ্ছি। ছবি বানালে আর কিছু করা যায় না। যাই হোক, সঞ্জীবদার তরল সেবার কথা না লিখে লুকিয়ে যাওটাই আসলে অপরাধ, আমি মনে করি। কারণ, তিনি ভালোইবাসতেন মদিরা, তো তা লেখা উচিৎ না? মিথ্যে করে কিছু লিখব? যারা ঘুষ খায়, অন্যের সম্পদ জবরদখল করে খায়, উকিলের চরিত্রে দাঁড়িয়ে মানুষের ফ্যাঁসাদকেই পেশা করে বাঁচে, ডাক্তার হয়ে দরিদ্র রোগির শেষ সম্বল বিক্রি করিয়ে খায়, শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী তো সেসব খেতেন না। তবে অধিক তরলে মাঝেমধ্যেই তার শরীর একটু একড়ে-বেকড়ে যেত। অগত্যা ডাক্তারের শরণাপন্ন।

এরকমই এক সময়, ২০০২ এর দিকে, আমাদের প্রজন্মের দেখা উজ্জ্বল মনীষী-লেখক-চিন্তক-কবি ও অবৈবাহিক জীবনের অধিকারী আহমদ ছফা হুট করেই মারা গেলেন, মাত্র ৫৭ বছর বয়সে। খুব শোকাহত হয়েছি আমিও। ছফা ভাইকে পেয়েছিলাম বারো-তেরো বছর, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তো আমি আর সরয়ার পার্কে ছিলাম। খুব ছোটছোট নির্দোষ এক জাতীয় গাছের পাতা পুড়িয়ে সিগারেট খালি করে তামাক ভরে খেতাম আমরা। লোকে সেই পাতাকে গালিও দেয়, সিদ্ধিও বলে। সরকারিভাবে এটা খাওয়া-উৎপাদন-পরিবহন নিষিদ্ধ। আমরা তো কিছু নিষেধাজ্ঞা মানব না, ভাঙব বলেই কথা দিয়ে এসেছি। কথা কার কাছে দিছি? আমাদের যার যার অদেখা কোনো প্রেমিকার কাছে! তো সরয়ার আর আমি তামাক ভালোবাসতাম। সঞ্জীবদাকে একদিন খাওয়াতে গেলাম ঐতিহাসিক আজিজের ব্যাবিলন-উড্ডীন সিঁড়িতে বসে, সঞ্জীবদা বললেন, ‘গাঁজার টানে আমার কনফিডেন্সের টাওয়ার ভেঙে পড়ে। চলেন, পিককে যাই।’

সেদিন সরয়ার আর আমি পার্ক থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের কাছে যেতেই দেখা হয়ে গেল সঞ্জীবদা আর অঞ্জুদার সঙ্গে। কারণ, ছফার লাশ তখনই আনা হচ্ছিল মসজিদ প্রাঙ্গণে। অঞ্জুদা হচ্ছেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন। সরয়ার বলতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। আর সঞ্জীবদা সামনেই। বললেন, ‘ডাক্তারি নিষেধাঞ্জা চলছে। ১৫ দিন জল স্পর্শ করা যাবে না।’

বললাম, ‘কইরেন না।’

‘আপনারা তো ঠিকই চালাচ্ছেন’। আমাকে বা সরয়ারকে খোঁচা দিলেন সঞ্জীবদা। বললেন, ‘ছফা ভাই তো ছফা ভাই। আর কেউ না। ছফা ভাই চলে গেলেন। ছফা ভাই কি দুইবার মরবেন? তাই, যতই ডাক্তারি নিষেধাজ্ঞা থাকুক, ছফা ভাইকে চিয়ার্স করে হলেও, চলেন এক্ষুণি সাকুরায় যাই।’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা গেছি পিকক গার্ডেনে। সেদিন আমরা পিককে বসে সারা বিকাল কাটিয়ে, আমাদের চারজনের কাছের টাকা শেষ করে আরো দু’হাজার টাকার মতো বেশি জল যখন ঢেলে ফেলেছি পাকস্থলিতে, অতিরিক্ত সেই জলের দাম পরিশোধের দায় নিয়ে ভোরের কাগজ অফিস থেকে এসে নিজেও সন্ধ্যাটা গ্লাসে ঢেলে গিলে ফেললেন সাংবাদিক পুলক গুপ্ত। সাংবাদিকতা পেশা হলেও পুলকদা মিউজিক করেন। মোরশেদুল ইসলামের ‘চাকা’ ছবির মিউজিক করেছেন। এখন পুলকদা ফিরিঙ্গিদের দেশে, বিবিসিতে কাজ করেন।

সঞ্জীবদার অ্যালকোহল পার্টনার সাংবাদিক গোলাম ফারুক, ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে আমিও অনেকদিন কাজ করেছি কাগজে; সঞ্জীবদার উপরে আমাকে দিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখিয়েছিলেন ফারুক ভাই, ২০০৭-এ, সঞ্জীবদা মারা যাওয়ার পরপরই।

সিডরের সময়, যখন সঞ্জীবদা হাসপাতালে, জীবনের সঙ্গে লড়াই চলল কদিন। তিনি হারলেন, শারীরিকভাবে, মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই। একটা কথা বলতেই হবে, পৃথিবীর সকল টেবিল খালি হয়ে গেলেও সঞ্জীবদা, ফারুক ভাই আর জুয়েল ভাইয়ের (আর্টিস্ট জাফর ইকবাল জুয়েল) টেবিল প্রায় খালি হতে দেখা যেত না। তিন পাগলের হয়েছিল মেলা, বোতল নিয়ে। এরই মধ্যে ফারুক ভাই চলে গেছেন। জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে অনেকদিন পর গত সপ্তাহে দেখা হলো চারুকলার সামনে। মনে হলো, পৃথিবীর একটুখানি বয়স বেড়েছে।

‘কিংবদন্তী’ সঞ্জীব চৌধুরীর মেয়ের নাম। যদিও, সঞ্জীবদাই কিংবদন্তী। টিএসসি থেকে একটু দূরেই ঢাকা মেডিকেল, ওই মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে সঞ্জীবদার শরীরটা দান করেছে তার পরিবার। সঞ্জীবদার স্ত্রী শিল্পী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের বন্ধু। প্রায়ই ভাবি, যাই, একবার মেডিকেলের ভেতরে যাই। গিয়ে, সঞ্জীবদার কঙ্কালটা দেখে আসি।

সঞ্জীবদা আমাদের সঙ্গেই আছেন, টের পাই। আজও সন্ধ্যায় ঢাকার কোনো বারে গেলেই সঞ্জীবদাকে খুঁজি। বলা তো যায় না, আছেনই হয়তো।
যেমন থাকে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নজরুল চেয়ার’ বা সম্মানজনক কোনো স্মারক-স্মৃতি রক্ষার অংশ, সেভাবেই, একটা প্রস্তাব রাখতে ইচ্ছে করে, ঢাকার বারগুলোতে ‘সঞ্জীব চৌধুরী চেয়ার’ রাখা যায় না?

আমি যদি কোনোদিন মদিরার বার খুলি, নাম দেব, ‘বুঁদবুঁদ’। সেই ‘বুঁদবুঁদ’এর মধ্যে নিশ্চয়ই ‘সঞ্জীব চৌধুরী চেয়ার-টেবিল’ থাকবে। সেখানে বসে কোনো তরুণ শিল্পী গিটার বাজিয়ে হয়তো টান দেবে তার তার গনগনে গলায়, ‘কথা বলব না, কথা বলার কিছু নেই/ বাড়ি ফিরব না, বাড়ির ফেরার কিছু নেই…’
যে ব্যথা লুকিয়ে সঞ্জীবদা গাইতেন।

চেনা গেল সঞ্জীবদাকে? সময়ের উজ্জ্বল সন্তান শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীকে? এবার ইউটিউবে যান, শোনেন তার অন্তরের জ্বালা, গান…

 

লেখক: লেখক, নির্মাতা

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন