বিজ্ঞাপন

৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে উধাও বিএনপি নেতা!

November 20, 2022 | 8:30 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এসএসসি ব্যাচভিত্তিক একটি গ্রুপের নাম ‘এসএসসি ০২-এইচএসসি ০৪’। ২০০২ সালের এসএসসি ও ২০০৪ সালের এইচএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা মূলত এই গ্রুপের সদস্য। ওই গ্রুপে সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপি নেতা ইসমাইল হোসেন ওরফে রিগ্যান। গ্রুপে বন্ধুদের কাছে নিজেকে একজন বড় ঠিকাদার হিসেবে পরিচয় দিয়ে দ্রুতই সবার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। সেলিব্রেটি, বড় আমলা, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ছবি দিয়ে খুব দ্রুতই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন সবার কাছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের দিকে গ্রুপের অ্যাডমিন বনে যান ইসমাইল।

বিজ্ঞাপন

শুরু হয় তার মানুষ ঠকানোর ব্যবসা। বন্ধুদের সাহায্য করার নামে অর্থ বিনিয়োগ করিয়ে লাভের লোভ দেখাতে থাকেন তিনি। অনেকেই সেই ফাঁদে পা দেন দ্রুতই। কেউ কেউ বিনিয়োগ শুরু করেন ইসমাল হোসেনের ঠিকাদারি কাজে। একটা সময় জানা যায়, ফেসবুক বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন রিগ্যান।

শুধু তাই নয়, বন্ধুবান্ধব ছাড়াও নানাভাবে প্রতারণা আশ্রয় নেন তিনি বিভিন্ন সময়ে। চট্টগ্রামের নানা প্রকল্প, অফিসে ভাড়ায় চালানোর গাড়ি সরবরাহ করার নামে মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করেন ইসমাল হোসেন। লাভের আশায় মানুষও গাড়ির কাগজপত্রসহ চাবি বুঝিয়ে দিতেন তাকে। আর ভাড়ায় চালানোর নাম করে সেই গাড়িগুলোই একাধিকবারের বেশি সময় বিক্রি করতেন বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে। শুধু তাই নয়, দেশে ছেড়ে পালানোর আগে চট্টগ্রামের খুলশীর অভিজাত ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দার মার্সিডিজ গাড়ি অন্যের কাছে বিক্রি করে দেন নাম মাত্র মূল্যে।

খুলশীর সেই অভিজাত ফ্ল্যাটে বসবাসের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা সময়ে দিতেন নিজের আলিশান অফিস গ্লোবাল করপোরেশনের ছবিও। আর তাই দেখে মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জনের পরে প্রতারণা করেন ইসমাইল হোসেন। বর্তমানে ভুক্তভোগীরা ইসমাইল হোসেনের খুলশীর বাসায় ভিড় করেন টাকা পাওয়ার আশায়।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু খুলশী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সন্তোষ কুমার বলেন, ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ জমা হয়েছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইসমাইল হোসেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে পলাতক আছেন। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, ইসমাইল হোসেন দুবাই চলে গেছেন। এখন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। প্রয়োজন হলে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টাও করে যাচ্ছি।

খুলশী থানা সূত্রে জানা গেছে, ইসমাইল হোসেন রিগ্যান চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ অলিপুর পাটোয়ারি বাড়ির মফিজুল ইসলাম পাটোয়ারীর ছেলে। তিনি হাজীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। তার পড়ালেখা স্নাতক পর্যন্ত। ইসমাইলের বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গত মাসে ৯টি মামলা হয়। আরও অনেকে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মামলা হলেও তদন্তে নেমে পুলিশ ইসমাইলের কোনো টাকা ও সম্পদের হদিস পাচ্ছে না।

২০০২ এসএসসি ব্যাচের একাধিক অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত সদস্য হিসেবে জয়েন করলেও ধীরে ধীরে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠে সবার মাঝে। ব্যাচের যেকোনো অনুষ্ঠানে বেশ ভালো অংকের আর্থিক সাহায্য দিতেন রিগ্যান। নিজেকে পরিচিত করাতেন একজন ঠিকাদার হিসেবে, যিনি বাংলাদেশের বর্তমানে নানা রকমের উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

২০০২ এসএসসি ব্যাচের আতিকুজ্জামান সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমদিকে তেমনটা চেনা জানা কারও সঙ্গেই ছিল না। কিন্তু ব্যাচের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে ভালো অংকের সাহায্যই করত টাকা দিয়ে। খুলশীর বড় বাড়ি আর অফিস থেকে অনেকে সেটা স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। দেখা গেল কেউ এক লাখ টাকা ইনভেস্ট করার পরে পাঁচ হাজার টাকা লাভ পেয়েছেন। এভাবে এক লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেন ইসমাইল হোসেন।’

তিনি বলেন, ‘সে কিন্তু সব লেনদেন এক এলাকা থেকে করেনি। প্রথমে যদি চট্টগ্রাম করে থাকে, তবে এরপরে সেটা করেছে রাজশাহীতে। এরপরে ধীরে ধীরে আবার ফেনী, চাঁদপুর, ঢাকা বিভিন্ন এলাকার বন্ধুদের কনভিন্স করে সেটা করেছে। সবাই তাকে বিশ্বাস করেছে, কারণ অনেকেই তো লাভ পেয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ সে সবাইকে বলে একটা বিশাল কাজ পাওয়ার কথা যেটার জন্য তার কাছে ফান্ড নেই। সেখানে সে পার্টনারশিপের মাধ্যমে সাহায্য করার জন্য বলে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন পেশাজীবী যারা আছে আমাদের ব্যাচের, তাদের অনেকেই লাভের আশায় সাহায্য করে গেছে। ঢাকার এক বন্ধু প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকা দেয় তাকে। প্রথম দিকে প্রতি লাখে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা করে লাভ দিতো। কিন্তু পরে দেখা গেল গত মাস খানেক আগ থেকে সে হাওয়া। তার সব টাকাই এখন আর পাবে কি না সেটা সে বলতে পারে না। এমন আরও অনেকে আছে, যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যক্তিগতভাবে তাকে পাঁচ লাখ থেকে শুরু করে ১০ লাখ বা ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকাও দিয়ে গেছে। কিন্তু এখন সবাই টাকার আশায় ছুটছে খুলশীর দিকে, আর সেখান থেকে থানায় গিয়ে ধরনা দিচ্ছে। কিন্তু টাকা পাওয়ার কোনো আশা এখনো পাচ্ছে না।’

শুধুমাত্র টাকা নয়, বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অফিসে মোটা অংকের টাকায় ভাড়া নিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে গাড়িও নিয়েছেন ইসমাইল। কিন্তু আত্মগোপনের আগে সে গাড়িগুলোও বিক্রি করেছে দিয়েছে জাল কাগজপত্র বানিয়ে।

বিজ্ঞাপন

ইসমাইল হোসেন রিগ্যানের প্রতারণার শিকার হয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন নাজিম উদ্দিন নামে তার এক বন্ধু। প্রয়াত নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী ইসমত আরা বলেন, ‘রিগ্যানকে বিশ্বাস করেছিলাম। তাকে বিশ্বাস করে ১টি কার ও ১টি মাইক্রো, ১টি জেনারেটর ও ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। রিগ্যান পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনে স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান। এমনকি তাকে এতোই বিশ্বাস করতাম যে, তার গাড়ির ডকুমেন্টসগুলো পর্যন্ত তাকে দিয়েছি। আমি আজ সর্বস্বান্ত হয়ে প্রশাসনের দরজায় এসেছি, প্রশাসন যেন আমার পাশে থাকেন।’

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে অনেক তথ্য জানা গেছে ইসমাইল হোসেনের বিষয়ে। তিনি বছর খানেক আগে চট্টগ্রাম আসেন। রেন্ট-এ-কারের সাইনবোর্ডের নাম করে দেশি ও বিদেশি নানা কোম্পানিতে গাড়ি ভাড়া দেওয়ার কাজ শুরু করেন তিনি। অন্যদের তুলনায় বেশি ভাড়া যোগাড় করে দেওয়ার কারণে তার জনপ্রিয়তা দ্রুতই বাড়তে থাকে। একইসঙ্গে বিশ্বস্ততাও বাড়ায় সবার সঙ্গে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল এবং মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ চট্টগ্রামে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিগ্যানের ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ইপিজেডের বিদেশি কোম্পানিগুলোতেও গাড়ি সাপ্লাই দিতে থাকে রিগ্যান।

জানা গেছে, বড় বড় ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, প্রবাসী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ রিগ্যানের প্রতারণা থেকে রক্ষা পায়নি। অভিনব কায়দায় কয়েকশ’ মানুষের তিনশ’ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছেন তিনি।

খুলশী থানায় অভিযোগ জানাতে আসা এসএসসি ২০০২ ব্যাচের একই গ্রুপে থাকা রিগ্যানের বন্ধু বলেন, ‘আমরা তার বাডিতে গিয়েছিলাম। সেখানে জানতে পারি সে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ছাত্রদলের আহ্বায়ক এবং উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে পরিচিতি পায়। তার চাচা হাজীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও হাজীগঞ্জ সদর পশ্চিম ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আনিসুর রহমান কানু পাটওয়ারীর হাত ধরে রাজনীতিতে অংশ নিয়ে ভংয়কর প্রতারক বনে যায় সে।’

তিনি জানান, স্থানীয়রা বলেছেন— রিগ্যান তার চাচা উপজেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আনিছুর রহমান কানু পাটওয়ারীর সহায়তায় চাঁদপুর এবং হাজীগঞ্জে যেসব ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যবসায়িক পার্টনার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। বিএনপির কমিটিতে চাচার সাথে ভাতিজা প্রতারক রিগ্যানও মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে স্থান করে দেওয়া হয়।

প্রতারণার শিকার সাদাফ চৌধুরী নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি ইসমাঈল হোসেন রিগ্যানের গ্রামের বাড়ি হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের পাটওয়ারী বাড়ি গেছিলাম। সেখানে দেখি তার দোতলা সম্পন্ন তিনতলা বিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত একটি আলিশান বাড়ি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এ সময় কথা হয়, তার বাড়ি ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে। তারা জানান, রিগ্যান, তার বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান, দুই ভাই ও ভাইদের স্ত্রী, সন্তান এবং এক বোনসহ দুবাই গেছেন।’

বাড়ির সর্ম্পকীয় চাচা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছর যাবৎ রিগ্যান সপরিবারে চট্টগ্রামে স্যাটেল। তবে নিয়মিত বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো। ১০/১৫ দিন আগেও বাড়িতে এসেছিল রিগ্যান। এসময় তার বাবা-মা, ভাই, ভাইদের স্ত্রী, বোন ও সন্তানসহ তার নিকট আত্মীয়-স্বজনেরা এসেছিল।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমরা কিছু জানিনা। তবে টিভির খবরে দেখেছি এবং কিছু লোক বাড়িতেও এসেছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার অপর এক চাচা জানান, তার নিকট আত্মীয়-স্বজনেরও প্রায় আড়াই কোটি টাকা রয়েছে রিগ্যানের প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও ব্যবসার কথা বলে বলাখালের এক ব্যক্তির ৪ কোটি টাকা, সাতবাড়িয়ার এক ব্যক্তির ৪৭ লাখ টাকা, মুন্সীর হাটের এক ব্যক্তির ৪২ লাখ টাকাসহ বেশ কিছু মানুষের কয়েক কোটি টাকা নিয়েছে বলে স্থানীয় লোকমুখে জানা গেছে। তবে কেউ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।

ইসমাঈল হোসেন রিগ্যানের বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম.এ রহিম পাটওয়ারীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের বিষয়টি জানতে পেরেছি। তবে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ আসেনি।

স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ঠিকাদারি এবং গাড়ির শো-রুমের ব্যবসা দেখিয়ে ব্যবসায়ী মনির হোসেনের ৪ কোটি টাকা, হায়দার আলী স্বাধীনের ২০ লাখ টাকা, হাজীগঞ্জ উপজেলার ১১ নম্বর হাটিলা পশ্চিম ইউনিয়নের ধড্ডা গ্রামের ফারুকের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, হাজীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবায়েদুর রহমান খোকন বলির ১৯ লাখ টাকা, একই উপজেলার ৫ নম্বর হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের কৈয়ারপুর এলাকার রোকন তালুকদারের ৪৬ লাখ টাকা, হাজীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী শরীফের ৭ লাখ টাকা, চাঁদপুরের জামাল সুমনের ৮৫ লাখ টাকা, হোসাইন সবুজের ৩৩ লাখ টাকা, সালাউদ্দিনের ৩৩ লাখ টাকা।

এছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়ী, প্রবাসী এবং রাজনৈতিক নেতাসহ প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী প্রায় ৪৪ জনের কাছ থেকে ব্যবসায়ীক পার্টনার করার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ এলাকার স্থানীয়রা জানায়, রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা বদলায় ইসমাইল হোসেনের। আর তখন সে চট্টগ্রামের দক্ষিণ খুলশীর তিন নম্বর সড়কে সানম্যার রয়েল রিজ নামের অভিজাত এ্যাপার্টমেন্টে ২২৮৯ বর্গফুটের ডি-৪ ফ্ল্যাট কিনে তাতে বসবাস করতে থাকেন। দুই কোটি টাকারও বেশি দামের ফ্ল্যাটটি সাজাতে বেশ বড় অংকের টাকা ব্যয়ও করেন। পাশের ৪ নম্বর সড়কে ৫৭০ নম্বর বাড়িতে অফিস স্থাপন করেন। গ্লোবাল করপোরেশন নামের কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন।

স্থানীয়রা আরও জানায়, গত বছরখানেক ধরে রিগ্যানের চলন-বলন এবং কাজ-কর্মে বেশ পরিবর্তন আসে। যে গাড়ির জন্য মাসিক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ভাড়া পাওয়া যায়, সেই গাড়ি রিগ্যান ৭০/৭৫ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে নিচ্ছিলেন। বেশি ভাড়া দিয়ে কৌশলে বাজারে নিজের ব্যবসার সুনাম কুড়িয়ে নেয় রিগ্যান। তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ডাক্তার, পুলিশ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষ তাকে মাসিকভিত্তিতে ভাড়ায় গাড়ি দিতে থাকে। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে ভাড়ার টাকা ব্যাংকে বা নগদে পেয়ে যাওয়ায় বহু গাড়ি মালিক এক বছরেও তার গাড়ির চেহারা দেখেননি।

পুলিশের কাছে আসা সর্বশেষ অভিযোগ অনুযায়ী, মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন রিগ্যান চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ১৪২টি কার ও জিপ গাড়ি নিয়ে ভাড়ায় পরিচালনা করছিলেন। ধীরে ধীরে সেগুলো বিক্রি করেন নানা ভাবে। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন স্লিপ বা ব্লু বুকে থাকা মালিকের নাম এবং ছবি ব্যবহার করে নকল জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরি করে ইসমাইল হোসেন। সেগুলোর সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পানির দামে গাড়ি বিক্রি করতে শুরু করে। তিনি ৫০ থেকে ৬০টিরও বেশি গাড়ি বিক্রি করে তুলনামূলক সস্তা মূল্যে। প্রাইভেট কার, মাইক্রো কিংবা জিপ যাই হোক না কেন, ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকার মাঝে গাড়ি বিক্রি করে তিনশত টাকার স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রয় রিসিট বানিয়ে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, একই গাড়ি পরে ডেলিভারি দেওয়ার নাম করে পাঁচ থেকে ছয় জন ব্যক্তির কাছেও বিক্রি করা হয়েছে। বাজার মূল্যের চাইতে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা কম মূল্যে পাওয়ার আশায় কেউ এতে জোরাজুরি করেননি। নিজের বাসার পাশের ফ্ল্যাটের মালিকের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িও এভাবে ৬৭ লাখ টাকা মূল্যে বিক্রি করে ইসমাইল হোসেন। সেই ক্রেতা গাড়ি বুঝে নিতে গেলেই শুনেন আসলে সেটা বিক্রি হয়নি। আর তখন তিনি প্রতারিত হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান।

শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরেই নয় বরং চন্দনাইশ, আনোয়ারা, মিরেরশরাইসহ নানা এলাকায় এমন প্রতারণার ঘটনায় যুক্ত ইসমাইল হোসেন।

পুলিশ জানায়, ইসমাইল হোসেন মূলত তার ফ্ল্যাটটিও বিক্রি করে আরও কয়েক মাস আগে। কিন্তু সেটাই আবার ভাড়া নিয়ে থাকেন। ফলে কেউ তার এমন উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি। সেই বিল্ডিংয়ের কারও কাছ থেকে লোন নিয়ে সেটা ফেরত না দেওয়া, ব্যবসার কথা বলে টাকা নিয়ে পালিয়েছে ইসমাইল হোসেন।

খুলশী থানার ওসি সন্তোষ চাকমা বলেন, ইসমাইল হোসেন মূলত একজন প্রতারক। নানাভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত খুলশী থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা এবং তিনটি সাধারণ ডাইরি (জিডি) রেকর্ড হয়েছে। এমনকি তিনি যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন, সেখানের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও বহু টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তারা মামলা করতে আসবেন বলে জানিয়েছেন।

ওসি সন্তোষ চাকমা বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে প্রায় পৌনে দুইশ কোটি টাকা প্রতারণার তথ্য পেয়েছি। প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। সবশেষ অভিযোগ যেদিন আসবে সেদিন হয়তো বুঝবো আরও কত জায়গায় সে প্রতারণা করেছে মানুষের সঙ্গে।

রিগ্যানের এসএসসি ব্যাচ ২০০২ গ্রুপের একাধিক সদস্য জানান, তিনি পালিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। টাকা পাচার করে দিয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে। শুধু তিনি না বরং তার পুরো পরিবারই পালিয়ে গেছে একসঙ্গে।

খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সন্তোষ চাকমা প্রতারিতদের সকলকেই পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে প্রকৃত তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের অনুরোধ জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, পুরো বিষয়টিই তদন্ত করা হচ্ছে। রিগ্যানকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সারাবাংলা/এসবি/এনএস

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন