বিজ্ঞাপন

শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন কারিক্যুলাম বাস্তবায়নে লাগবে ৩ বছর

November 27, 2022 | 8:44 am

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেট

ঢাকা: মাধ্যমিক পর্যায়ে আলাদাভাবে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ আর থাকছে না। দশ বিষয়ের সবগুলোর বই সবার জন্য একই। আসছে বছরে নতুন কারিক্যুলামে প্রাথমিকভাবে প্রথম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণি দিয়ে শুরু হবে এই কার্যক্রম। নতুন কারিক্যুলামে পাঠদান শুরু করতে দেশের সরকারি-বেসরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত বিদ্যালয়গুলোর চার লাখেরও বেশি শিক্ষককে প্রস্তুত করা হচ্ছে। অবশ্য সব শ্রেণিকে নতুন কারিক্যুলামে যুক্ত করতে সময় লাগবে তিন বছর।

বিজ্ঞাপন

নতুন কারিক্যুলাম অনুযায়ী সবাইকে পড়তে হবে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, শিল্প ও সংস্কৃতি এবং ধর্ম। তবে ধর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে যে যার ধর্ম বিষয়ে পাঠ নিবে। এছাড়াও প্রতিটি বিষয়ই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি নিয়মে থাকবে।

নতুন কারিক্যুলামের জন্য সংশ্লিষ্ট শ্রেণির পাঠ্যসূচীতে যেমন পরিবর্তন আসবে, তেমনি পরিবর্তন থাকবে পাঠ্যবই ও পরীক্ষা পদ্ধতিতেও। শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির হবেন শিক্ষকেরা। ফলে এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও যেমন একটা সংশয় কাজ করছে, তেমনি শিক্ষকদের মধ্যেও রয়েছে নতুন কারিক্যুলামে নিজেকে মানিয়ে পাঠদানের চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন কারিক্যুলামে শিক্ষার্থীদের ওপর মুখস্ত বিদ্যার চাপ কমবে, চাপ থাকবেনা পরীক্ষার। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পাঠের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। ফলে শিক্ষকদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা চ্যালেঞ্জ থাকলেও ভয়ের কারণ নেই।

যা থাকছে নতুন কারিক্যুলামে:
রূপরেখা অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেনিতে প্রয়োগ করা হবে শিক্ষার নতুন কারিক্যুলাম। সেখানে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে এই পরীক্ষার পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে। অন্যদিকে, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে যে সমাপণী পরীক্ষা নেওয়া হতো নতুন কারিক্যুলামে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ সাল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষায় আলাদা কোনো বিভাগ থাকছে না। বর্তমানে নবম শ্রেণিতে যেভাবে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বেছে নিতে হয়, সেরকম কোনো ভাগ থাকবে না। দশম শ্রেনি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীদের ১০টি বিষয় পড়তে হবে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়াের বিধান রাখা হয়েছে। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ভিন্ন দুই পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষে মূল্যায়ন, শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে করণীয়, সাপ্তাহিক ছুটির বিষয়ও কারিক্যুলামে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।

কারিক্যুলাম সংশোধনের কাজ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবি। সেখানকার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের পাঠদান আনন্দময় করার মূল উদ্দেশ্য নতুন কারিক্যুলামে। একই সঙ্গে সবার ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করাও কারিক্যুলামের অন্যতম লক্ষ্য। নতুন শিক্ষাক্রমের বৈশিষ্ট তুলে ধরে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, নতুন কারিক্যুলামে পড়াশোনা হবে আনন্দময়। বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তরের বোঝা ও চাপ থাকবে না। মুখস্তনির্ভরতা বাদ দিয়ে এর পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। জ্ঞান, দক্ষতা মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ রাখা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে।

শুরুর প্রস্তুতি কতটুকু:
নতুন বছর শুরু হতে বাকি মাত্র এক মাস। এনসিটিবি সূত্র বলছে, নতুন বছরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদানের মধ্য দিয়ে শুরু করা হবে নতুন কারিক্যুলাম। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে প্রথম শ্রেনির সকল বই লেখা শেষ করে এখন মুদ্রণের প্রস্তুতি চলছে। অন্যদিকে কাজ চলছে মাধ্যমিকেরও।

বিজ্ঞাপন

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মশিউজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, আমরা গত ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন কারিক্যুলামের পাইলটিং শুরু করি। এছাড়া ধাপে ধাপে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রথমে শুধু সরকারি, আধা সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কথা বলা হলেও পরে আমরা বলেছি নন এমপিও, ব্যক্তি মালিকানাধীন থেকে শুরু করে সব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন কারিক্যুলামের আওতায় আসবে এবং পাঠদানের জন্য তারা প্রশিক্ষণ পাবেন। সে হিসেবে আমরা মোট চার লাখেরও বেশি শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে পেরেছি। তিনি বলেন, আগামী ডিসেম্বরে শিক্ষকদের আরেকটি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে আমরা জেলা লেভেলে প্রত্যেক বিষয়ে তিনজনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তারা হবে মাস্টার ট্রেইনার। তারা ৫২০টি উপজেলার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।

অধ্যাপক মশিউজ্জামান আরও জানান, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, কনটেন্ট তৈরি ও নতুন পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে।

প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়:
শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন কারিক্যুলাম শুরু করতে এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়… স্বীকার খোদ এনসিটিবি’র। এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, দুই বা তিন জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে গোটা বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রস্তুত করা সম্ভব না। আবার সকলকে প্রশিক্ষিত করে চেয়ার টেবিল, বই, পোশাক প্রস্তুত করে পড়তে বসাও সম্ভব না। পৃথিবীর কোনো দেশ এটা পারেনি। সকলেই এক্সিস্টিং দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে লক্ষ্যে পৌঁছে।

বিজ্ঞাপন

এই কারিক্যুলাম আবার সংশোধন হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, অবশ্যই কারিক্যূলাম চেঞ্জ হবে। পৃথিবীর কোনো কারিক্যূলামই একবারে করা হয় না। সংশোধন হবে। ২০১২ সালের কারিক্যুলার ২০১৭ সালে রিভাইস করার কথা। কাজও করে ফেলছিলাম, কিন্তু কোভিডের কারণে তা পিছিয়ে গেছে। টেকনোলজি পাল্টায় বলে কোনো দেশেই আট বছরের বেশি কোনো কারিক্যুলাম এক্সিস্ট করে না। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসার, প্রযুক্তি অনেক কিছু নতুন নিয়ে আসছে। এখন যদি কারিক্যুলাম রিভাইস না করি তাহলে আধুনিক কোনো কিছু শিক্ষার্থীরা শিখবে না। সেজন্য প্রযুক্তি, সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাও পরিবর্তন আনতে হবে। এটাই প্রক্রিয়া। আমাদের অনেক শিক্ষাবিদ এই কারিক্যুলাম নিয়ে নানান কথা বলে থাকেন। ষাটের দশকের কারিক্যুলাম নব্বই বছর পর্যন্ত চলতে পারে কিন্তু এরপর সম্ভব না। এখন প্রযুক্তি বিজ্ঞান অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সকল অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে এই কারিক্যুলাম তৈরি করেছি। আমরা জানি নানান ক্ষেত্র থেকে প্রশ্ন উঠবে এটাই সত্যি। এসব মাথায় নিয়েই আমরা বিষয়টা শুরু করতে চাই। বলেন, নতুন কারিক্যুলামে যাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত, প্রস্তুতির কমতি নেই।

রূপরেখা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান হবে নতুন কারিক্যুলামে। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও অষ্টম শ্রেনি এবং ২০২৫ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সকল শ্রেনিতে নতুন কারিক্যুলাম শুরু করার কথা বলা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৬ সালে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেনিতে নতুন কারিক্যুলামে পাঠদান শুরু হবে।

সারাবাংলা/জেআর/রমু

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন