বিজ্ঞাপন

২৫ বছরেও শান্তি ফেরেনি, পাহাড়ে এবার ‘নতুন’ চুক্তির প্রস্তাব!

December 2, 2022 | 10:00 am

প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাঙ্গামাটি: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সইয়ের পর কেটে গেছে আরও ২৫টি বছর। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের দীর্ঘ আড়াই দশকে সবুজ পাহাড়ের রাজনীতিতে হয়েছে নানা মেরুকরণ। পাহাড়িদের পক্ষে চুক্তি সম্পাদনকারী সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে হয়েছে আরও তিনটি আঞ্চলিক দল।

বিজ্ঞাপন

জেএসএস বলছে, চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছার অভাবে অগ্রগতি হচ্ছে না। তারা অবিলম্বে ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করে চুক্তি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতাকারী সংগঠন প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) বলছে, চুক্তির নামে দীর্ঘ ২৫ বছর পাহাড়িদের সঙ্গে শুধুই প্রতারণা করেছে সরকার ও জনসংহতি সমিতি। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে সরকারকে এবার নতুন করে ভাবতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) হিসাবে, চুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হলেও অবশিষ্ট ২৯টি ধারা সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে, চুক্তির বেশকিছু ধারাকে ‘বিতর্কিত’ দাবি করে সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে বাঙালিভিত্তিক সংগঠনসমূহ।

পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাহাড়ে যে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফেরানোর আশা নিয়েই চুক্তির সই হয়েছিল। দীর্ঘ ২৫ বছরেও পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেই আশা ভেস্তে যাচ্ছে। চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে মাঝে মেরুকরণে বাঁক পাল্টাচ্ছে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক। ঐক্যের আশা ভেঙে আরও নতুন নতুন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটছে। থেমে থাকেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। সবশেষ গত বুধবার রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নে গুলিতে খুন হয়েছেন এক মোটরসাইকেল আরোহী।

বিজ্ঞাপন

নতুন ‘চুক্তির’ প্রস্তাব ইউপিডিএফের
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধীতা করে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। চুক্তি সইয়ের দুই যুগ পরে এবার পাহাড়ে হানাহানি বন্ধে সরকারের কাছে নতুন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে ইউপিডিএফ। গত ৯ জুন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ২ নম্বর চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়কলক এলাকায় এক অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. এমদাদুল ইসলামের কাছে দাবিনামা হস্তান্তর করা হয়।

চুক্তির আকারে পেশ করা ইউপিডিএফের ৬৬ পৃষ্ঠার দাবিনামার আটটি ভাগে ৮৭টি দাবি উল্লেখ রয়েছে। দাবিনামার আটটি ভাগে উল্লেখ আছে; সাংবিধানিক অবস্থা, সাংবিধানিক আইন ব্যতিত অন্যান্য কতিপয় আইনের রহিতকরণ ও সংশোধন, সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৮৮ এর সংস্কার, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সমূহের সংস্কার, পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন, পুনর্বাসন মামলা প্রত্যাহারসহ অন্যান্য বিষয় এবং চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি ও চুক্তি বলবৎকরণের প্রস্তাব।

দাবিনামা পেশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ইউপিডিএফ মুখপাত্র অংগ্য মারমা সারাবাংলা ডটনেটকে বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তিকে নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী উভয়পক্ষ সরকার ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যে চুক্তি ২৫ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি নিয়ে আসতে পারেনি, সেই চুক্তির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান পালনের নামে আনন্দ উল্লাস পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে তামাশার সামিল। সরকার ও জনসংহতি সমিতির পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিশেষত চুক্তির ধারাকে নিয়ে। এর মাধ্যমে সবার কাছে পরিষ্কার যে পাহাড়ে এই চুক্তির মাধ্যমে শান্তি ফিরে আসবে না, হারানো জমি ফিরে পাব না। নতুন ক্যাম্প সম্প্রসারণই অদ্বিতীয় প্রমাণ চুক্তির ধার লঙ্ঘন। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির বিষয়ে সরকার ও দেশের মানুষকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। আমরা চাই পাহাড়িদের নায্য দাবি মেনে নিয়ে সরকার পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করুক।’

বিজ্ঞাপন

নতুন আতঙ্ক ‘কেএনএফ’
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) নামে সশস্ত্র সংগঠনের পর এবার কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে আরেকটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করেছে। গত ২১ জুন রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজমপাড়ায় তিনজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় ওঠে আসে কেএনএফ।

পাহাড়ের ‘কুকি-চিন’দের নিয়ে বিশেষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি করা কেএনএফের বেশকিছু সদস্যকে সম্প্রতি বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। সংগঠনটির বিরুদ্ধে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে চাকমা সার্কেল চিফের দেওয়া আভাসের সত্যতা মিলেছে জঙ্গিসহ কেএনএফ সদস্যদের গ্রেফতারের ঘটনায়। পাহাড়ে এখন মগ বাহিনীর পর নতুন আতঙ্ক কেএনএফ।

এর আগে গত আগস্ট মাসে সারাবাংলা ডটনেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আসল দল ও আঞ্চলিক দল মিলে আটটি দলের কার্যকলাপ রয়েছে। কম হলেও একটি ইসলামি দলের উপস্থিতি রয়েছে; যাদের সঙ্গে কেএনএফ নামের দলটির সম্পর্ক রয়েছে। গত দুয়েক বছর ধরে জেএসএস (সন্তু লারমা) ও ইউপিডিএফের (প্রসিত খীসা) মধ্যে তেমন বিবাদ ঘটেনি। তবে ইদানিংকালে ইউপিডিএফ একজন মধ্যস্থতাকারীর ব্যক্তির মাধ্যমে কিছু দাবিনামা পেশ করেছে। তবে এখানে এতগুলো দল হয়েছে; আঞ্চলিক দল ও তথাকথিত আঞ্চলিক দলের এমন কিছু কার্যকলাপ হয়, মানুষের মনেই তখন প্রশ্ন জাগে এসব সরকারের মধ্য থেকে হতে দিচ্ছে কিনা? কারণ সমানভাবে সব দল ও তথাকথিত দলের লোকজনকে গ্রেফতার করা কিংবা কার্যক্রম সীমিত করা দেখছিনা। এই আটটি দলের প্রতি সরকারের যে সংস্থাগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে এবং সহিংস কার্যকলাপ বন্ধে নিয়োজিত তারা বৈষম্যহীন, যথাযথ এবং দক্ষভাবে যদি তাদের ওপর আইন দ্বারা ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এতগুলো দল-তথাকথিত দল অস্ত্র-চাঁদাবাজি করতে পারতো না।’

পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে দোষারোপের বৃত্তে
চুক্তির বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার জানান, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির রজতজয়ন্তী উপলক্ষে উৎসবমুখর পরিবেশে চুক্তির বর্ষপূরতি পালিত হবে এই আশা-ভরসা ছিল। কিন্তু দেখা গেল রক্ত পিচ্ছিল সংগ্রামের মাধ্যম অর্জিত চুক্তি আসলে তেমন আশাপ্রদ কিছু বয়ে আনতে পারেনি। ২৫ বছর পরে আমরা যদি দেখি এই অঞ্চলের মানুষ চুক্তির মধ্য দিয়ে কী পেল? দেখা গেল যে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনের প্রতিষ্ঠা ছাড়া তো আর কিছুই হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো বিশেষায়িত অঞ্চল, জেলাপ্রশাসক ও এসপি সাহেব সমতলের মতোই প্রশাসন চালাচ্ছেন; তাহলে এখানে বিশেষ শাসন আসলো কিভাবে? সেখানেই বোঝা যায় চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি। সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের যথাযথ পুনর্বাসন করা হয়নি। তাহলে আমরা এর থেকেই বুঝতে পারি আমরা কী পেলাম। আজকে ২৫ বছরে আমরা দেখি যে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছার অভাব ও সরকারের একটা অংশ চুক্তি বিরোধিতা করার কারণে চুক্তি ব্যাহত হচ্ছে, বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যে সরকারের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে; সেই চুক্তির সরকার এখনও চুক্তিকে ফেলে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী চাইলেও চুক্তি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে নানা বাধা-বিপত্তি এসে যাচ্ছে বলে আমরা অনুমান করেছি। যেহেতু আমাদের চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না; সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা সরকারকে তাগাদা দেব। তার মানে এই নয় আমরা দেশদ্রোহী হয়ে যাচ্ছি।’

বিজ্ঞাপন

চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পূর্ণ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসেনি। পাহাড়ে এখনও বিপুল সংখ্যক সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি, প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল, গত ২৫ বছরে পাহাড়িদের ওপর কমপক্ষে ১৯টি বড় ধরণের সাম্প্রদায়িক হামলা। সব সময় ভীতিকর পরিবেশে জীবনযাপন করতে বাধ্য হওয়া শান্তি ফিরে না আসার বড় প্রমাণ। সরকার গত আগস্ট মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি, এখানে শান্তি থাকলে, সবকিছু ঠিক মত চললে অনুমতি না দেয়ার তো কোন মানে হয় না। চুক্তি ২৫ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি আসেনি; এই সত্য সরকার বাইরের দুনিযার কাছে লুকাতে চাইছে।’

রাঙামাটির সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘২৫ বছর আগে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। ২৫ বছরে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। মোদ্দাকথা ২৫ বছরেও বাস্তবায়ন না হওয়াটা আমরা যারা চুক্তির পক্ষে ছিলাম তাদের জন্য কষ্টকর। চুক্তি বাস্তবায়ন আমরাও (আওয়ামী লীগ) চাই, তারাও (জেএসএস) চায়; প্রধানমন্ত্রী অনেক আন্তরিক। এখন তাদের গুলিতে যদি দুই-চারজন মারা যান, আহত হয় তাহলে কি শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবেশ থাকে? শান্তি চুক্তির একটা পক্ষ আওয়ামী লীগ। কিন্তু ওরা (জেএসএস) বলছে এদেরকে রিজাইন করাও, আওয়ামী লীগ থাকতে পারবে না। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে নেতিবাচক মনোভাব ভুলে উভয়পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।’

সারাবাংলা/এমও

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন