বিজ্ঞাপন

ফেনী মুক্ত দিবস

December 6, 2022 | 9:27 am

মোহাম্মদ নাদের হোসেন ভূঁইয়া

৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তন এবং ১৫৬,৯৭১ জনসংখ্যা ফেনী শহর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে পুরো দেশকে সংযুক্ত করেছে। ফেনীর উত্তরে কুমিল্লা জেলা ও ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রাম জেলা, পূর্বে ভরতের ত্রিপুরা প্রদেশ, পশ্চিমে নোয়াখালী জেলা অবস্থিত। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা সকল ক্ষেত্রে ফেনীর মানুষের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। ১৯৭১ সাথে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি এক্ষেত্রে ফেনীর সূর্য সন্তানদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।

বিজ্ঞাপন

ফেনী জেলার উৎপত্তি নিয়ে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। আমাদের ফেনীর হয়েও অনেকে হয়তো বিস্তারিত এই ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। আসুন আগে বিষয়টি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক। বর্তমান ফেনী জেলা এক সময় মহকুমা ছিল। ফেনী নদীর নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ফেনী। মধ্যযুগে কবি ও সাহিত্যিকদের কবিতা ও সাহিত্যে একটা বিশেষ নদীর স্রোতধারা ও ফেরি পারাপারের ঘাট হিসেবে আমরা ‘ফনী’ শব্দ পাই।

ষোড়শ শতাব্দীতে কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলপুর তার বর্ণনায় লিখছেন- ‘ফনী নদীতে বেষ্টিত চারিধার, পূর্বে মহাগিরি পার নাই তার।’ সতেরো শতকে মির্জা নাথানের ফারসি ভাষায় রচিত ‘বাহরিস্তান-ই-গায়েবীতে’ ফনী শব্দ ফেনীতে পরিণত হয়। আঠারো শতকের শেষভাগে কবি আলী রেজা প্রকাশ কানু ফকির তার পীরের বসতি হাজীগাওর অবস্থান সম্পর্কে লিখছেন- ‘ফেনীর দক্ষিণে এক ষর উপাম, হাজীগাও করিছিল সেই দেশের নাম।’ কবি মোহাম্মদ মুকিম তার পৈতৃক বসতির বর্ণনাকালে বলেছেন- ‘ফেনীর পশ্চিমভাগেজুগিদিয়া দেশে………।’ বলাবাহুল্য, তারাও নদী অর্থে ফেনী ব্যবহার করেছেন। আদি শব্দ ‘ফনী’ মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় ফেনীতে পরিণত হয়েছে।

১৮৭২-৭৪ সালের মধ্যে মোগল আমলের আমীরগাও থানা নদী ভাঙ্গনের মুখোমুখি হলে তা ফেনী নদীর ঘাটের অদূরে খাইয়অ্যারাতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ঐ থানাটি কোম্পানির কাগজ পত্রে ‘ফেনী’ থানা (ফেনী নদীর অদূরে বলে) নামে পরিচিত হয়। অতঃপর ১৮৭৬ সালে নতুন মহকুমার পত্তন হলে খাইয়অ্যারা থেকে থানা দফতরটি মহকুমা সদরে স্থানান্তরিত হয় এবং নতুন মহকুমাটি ফেনী নামে পরিচিত হয়।

বিজ্ঞাপন

১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে যে সকল মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয়েছিল ফেনী জেলা তার মধ্যে একটি। জেলাটির আয়তন ৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৮৪ সালের পূর্বে এটি নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা ছিল। এ মহকুমার গোড়াপত্তন হয় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মিরসরাই, ছাগলনাইয়া ও আমীরগাঁও-এর সমন্বয়ে। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কবি নবীন চন্দ্র সেন। ১৭৭৬ সালে মিরসরাইকে কর্তন করে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভক্ত করা হয়। প্রথম মহকুমা সদর দফতর ছিল আমীরগাঁওয়ে। ১৮৮১ সালে তা ফেনী শহরে স্থানান্তরিত হয়। ফেনী জেলা বাংলাদেশের ছোট জেলা গুলোর মধ্যে একটি। তবে ফেনী জেলা একটি বর্তমানে আধুনিক ও সুন্দর জেলা বলা যায়। আধুনিকতা ও উন্নয়েনের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে ফেনী অনেকটাই এগিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে প্রকাশিত আর্থিক অন্তর্ভূক্ত সূচীতে ফেনী ২য় অবস্থানে রয়েছে।

ফেনীর উৎপত্তির ইতিহাসের মতই মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অবদান চমকপ্রদ। ১৬ ডিসেম্বর সমগ্র বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ফেনী স্বাধীনতা লাভ করে ৬ ডিসেম্বর। এই দিন প্রথম জেলা হিসেবে যশোর, নীলফামারীর সাথে সাথে ফেনীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনী ছিল দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে তিন দিক থেকে ফেনীর রয়েছে সীমান্ত। ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ফেনীতে ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন চালায়। ফেনী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এরমধ্যে শুভপুর ও বিলোনিয়া যুদ্ধ অন্যতম। তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা ফেনী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম আব্দুল মালেক (যুদ্ধকালীন সময়ে বি এল এফ এর প্রেসিডেন্ট) ও মরহুম খাজা আহমদের নেতৃত্বে ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা দেরাদুন ও চোত্তাখোলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। বিএলএফের ফেনী মহুকুমা কমান্ডার হিসাবে ভিপি জয়নাল ফেনীর পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ফেনী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম ভারতের বিলোনিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে অভিযান চালান। মুক্তিবাহিনী বিলোনিয়া, পরশুরাম, মুন্সিরহাট, ফুলগাজী হয়ে যুদ্ধ করে এগোতে থাকলে পর্যুদস্ত হয়ে পাক হানাদার বাহিনীর একটি অংশ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের রাস্তায় এবং অপর অংশ শুভপুর ব্রিজের ওপর দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। জাফর ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত এই বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি অনন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। পাক হানাদাররা ৫ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে গেলে ৬ ডিসেম্বর ফেনী হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এতে জেলাবাসী লাল সবুজের বিজয় নিশানা উঠিয়ে ফেনী শহর ও গ্রামগঞ্জে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর দিনটিকে ফেনী জেলাবাসী ফেনী মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪ জন বীর উত্তম, ৭ জন বীর বিক্রম এবং ২০ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন ।

বিজ্ঞাপন

যুগে যুগে ফেনীর মাটিকে আলোকিত করেছেন অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি ও মনীষীরা। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামে ফেনী জেলায় উলেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহনকারী ফেনী জেলার বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বাংলা সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি ও ফেনীর প্রথম মহকুমা প্রশাসক কবি নবীন চন্দ্র সেন, ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক বঙ্গবীর শমসের গাজী, ৫২’র ভাষা শহীদ আবদুস সালাম, শহীদ বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, তার ভাই শহীদ বুদ্বিজীবি ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার, ভাষা সৈনিক এবং প্রাক্তন বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সাব-সেক্টর কমান্ডার ও এবং সাবেক মন্ত্রী জাফর ইমাম, শহীদ বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, বীর বিক্রম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, সাহিত্যিক গীতিকার এবং ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, শহীদ বুদ্ধিজীবী ফয়জুল মহিউদ্দিন, বীরবিক্রম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হক শিক্ষাবিদ এবং ভাষা সৈনিক শরিফা খাতুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুল হক খান, বীরউত্তম খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাহমুদ।

মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর সূর্যসেনাদের অবদান সরূপ অমর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ফেনী সরকারি কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ ও জেল রোডের পাশে বীর শহীদদের নামের তালিকাসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ এবং বিলোনিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। যা তরুণ প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয় ফেনীর গর্বিত সন্তানের সাথে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় অর্ধশতাব্দি পরে এখনো গণমাধ্যমে দেখা যায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অনেক জায়গায় সঠিক মূল্যায়িত হচ্ছে না! বিভিন্ন স্তরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে প্রকৃত বীরেরা অবহেলিত। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা সরকার প্রদত্ত ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেয়, আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা থাকে বঞ্চিত।

দেখা যায়- দেশ স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বর্ষে পা রাখলেও এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা সরকারি তালিকায় আসেনি কিংবা মূল্যায়িত হয়নি। এমন ঘটনা সারা দেশেই ঘটছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে গুলোতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গর্বিত অধিকারটি লাভ করে।

বিজ্ঞাপন

তাছাড়া সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরে এসে আজও দেখা যায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের খেলার মাঝে বাংলাদেশের মানুষ হয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন দিতে। পাকিস্তানের জার্সি গায়ে এবং তাদের দেশের পতাকা হাতে হাঁশি মুখে তাদের বরণ করতে নিতে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি দৃশ্য। কতটা অমানবিক হলে এমন কাজটি করা সম্ভব। হয়তো তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানে না, জানে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে। জানলে তারা এমন কাজটি কখনো করতে পারে না। তাই আমাদের পাঠ্যপুস্তক গুলাতে মুক্তিযুদ্ধের সকল ইতিহাসকে আরো অধিক পরিমাণ এবং নান্দনিকতার সাথে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। যাতে করে আগামী প্রজন্ম দেশের জন্য লজ্জার কারন না হয়ে বরং হয়ে উঠে গর্বের প্রতীক।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন