বিজ্ঞাপন

যোগ্যতা এক হলেও পদ, বেতন, নিয়োগে পুরুষ কেন নারীর চেয়ে এগিয়ে?

April 30, 2018 | 8:40 pm

রাজনীন ফারজানা।।

বিজ্ঞাপন

নারীদের যোগ্যতা আর অবদান বোঝাতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর পঙক্তি দুটি প্রায়ই ব্যবহার করি আমরা,

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যানকর

অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’

বিজ্ঞাপন

কিন্তু দেখা যায় একই জিনিস গড়তে একজন পুরুষকে যে টাকা দেওয়া হয়, একজন নারীকে দেওয়া হয় তার চাইতে অনেক কম। নারীর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। একই যোগ্যতা থাকার পরেও প্রায়ই দেখা যায় একজন নারী তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় কম বেতন পান।

একজন নারী শ্রমিক যেখানে একই কাজের জন্য দিনপ্রতি একশ টাকা পান সেখানে একজন পুরুষ শ্রমিক পান দুইশ থেকে আড়াইশো টাকা। আয়ের এই বৈষম্য শুধুমাত্র শ্রমজীবী শ্রেণিতেই দেখা যায় তা না। ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হাউজ থেকে শুরু করে ঢালিউড, বলিউড কিংবা হলিউডের চকচকে জগতের আড়ালে ঘটে চলা লিঙ্গ বৈষম্য আর নারীর প্রতি বঞ্চনার গল্পগুলো আড়ালেই থেকে যায়।

ফোর্বস এর ২০১৭’র সবচেয়ে বেশি আয় করা অভিনেতাদের তালিকার ১৪ নম্বর পর্যন্ত কোন নারী নাই। লা লা ল্যান্ডের জন্য অস্কারজয়ী অভিনেত্রী এমা স্টোন ২৬ মিলিয়ন ডলায় আয় নিয়ে অভিনেত্রীদের মধ্যে এগিয়ে থাকলেও সবচেয়ে বেশি আয় করা অভিনেতা এমার চাইতে দ্বিগুনেরও বেশি আয় করেন। আয়ের দিক থেকে তালিকায় এক নম্বরে থাকা মার্ক ওয়েলবার্গের আয় ছিল ৬৮ মিলিয়ন ডলার। এমার চাইতে এক ধাপ এগিয়ে তালিকার চৌদ্দ নাম্বারে থাকা এমার লা লা ল্যান্ড সহকর্মী রায়ান গসলিঙের আয়ও এমার চাইতে তিন মিলিয়ন বেশি।

বিজ্ঞাপন

এমা স্টোন ও মার্ক ওয়েলবার্গ

একই চিত্র বলিউডেও দেখা যায়। যেখানে সালমান খান সিনেমা প্রতি ৬০ কোটি রুপি করে নেন সেখানে নায়িকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোন পান সিনেমা প্রতি ১০ থেকে ১২ কোটি রুপি। সাতটা একশ কোটির বেশি আয় করা সিনেমার অভনেত্রী হওয়া স্বত্বেও ২০১৭’তে দীপিকার আয় ১০ মিলিয়ন ডলার আর তালিকার উপরে থাকা শাহরুখ খানের গত বছরের মোট আয় ৩৮ মিলিয়ন ডলার। পার্থক্যটা এ রকম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতই। অর্ধেক নারী আর অর্ধেক নরের অর্জন বলে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা হলেও আয়ের দিক থেকে পিছিয়ে আছে আমাদের চোখে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করা তারকারা।

শাহরুখ খান, সালমান খান ও দীপিকা পাডুকোন

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রেও বৈষম্যের চিত্রটা একই রকম। সবচাইতে বেশি পারিশ্রমিক পান অভিনেতা শাকিব খান যিনি সিনেমা প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন। অন্যদিকে নায়িকাদের মধ্যে জয়া আহসান পান ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা যা অভিনেত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেও তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় অনেক কম।

শাকিব খান ও জয়া আহসান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা আফিয়া সুলতানার (ছদ্মনাম) ইচ্ছা ছিল সাংবাদিক হবেন। সেই ইচ্ছা থেকেই ২০০১ থেকেই টুকটাক কাজ শুরু করলেও ২০০৫ এ একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন আফিয়া। কাজের জায়গায় শতভাগ দিয়ে খুব দ্রুতই ওই প্রতিষ্ঠানের ‘এ’ লিস্টেড সাংবাদিক হিসেবে জায়গা পান তিনি। এই লিস্টে আফিয়ার পাশাপাশি ছিলেন আরও ছয়জন পুরুষ। ২০০৯ এ যখন ইনক্রিমেন্ট হয় তখন দেখা যায় আফিয়া পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার টাকা ইনক্রিমেন্ট আর তার বাকি ছয়জন পুরুষ সহকর্মী পেয়েছেন ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা ইনক্রিমেন্ট। অথচ তারা সাতজন একই মাত্রার কাজ করতেন। নারী হিসবে কখনও কোন কাজে পিছিয়ে আসেননি আফিয়া। রাতের ডিউটিও নিতেন সানন্দে। তবুও অন্যদের তুলনায় বেতন কেন কম বাড়ল জানতে চাইলে রাফিয়াকে জানানো হল যেহেতু তিনি এর মাঝে ম্যাটারনিটি লিভ কাটিয়েছেন তাই তার বেতন কম বেড়েছে। অথচ আইন অনুযায়ী এই ছুটি প্রাপ্য আফিয়ার। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রোগ্রাম হেড তাসমিয়া রহমান মনে করেন, একজন গর্ভবতী নারী মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি কাজের জায়গায় কিছুটা নমনীয়তা পাবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেটা তার অধিকার, কেউ তাকে কোন অনুগ্রহ করে সুবিধা দেয় তা নয়। আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান এ প্রসঙ্গে জানান, আইনানুযায়ী একজন কর্মজীবী মা ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন। আর একজন বাবা সন্তান জন্মদানের পর ১৫ দিন ছুটি পাবেন। অথচ অনেক বেসরকারি সংস্থায় তা মানা হয়না।

শুধুমাত্র চাকরির পরপরই গর্ভবতী হওয়ার অপরাধে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল নামকরা এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী গ্রাফিক্স ডিজাইনার সাবিহাকে (ছদ্মনাম)। চাকরির ইন্টারভিউর সময় অবিবাহিত সাবিহার যোগদানের এক সপ্তাহ আগে হুট করেই বিয়ে হয়। উনি বিয়ে করেছেন- যোগদানের দিন এটি শুনে ব্যপারটাকে স্বভাবিকভাবে নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞাপন

যদিও ব্যক্তিগত জীবনের সাথে কর্মজীবনকে কখনোই মেলাননি সাবিহা। কাজের প্রয়োজনে এমন সব জায়গায়ও গিয়েছেন যেখানে যেতে তার বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে আসা পুরুষ সহকর্মী যেতে অস্বকৃতি জানিয়েছে। এসব ঘটনায় হিতে বিপরীত হয় সাবিহার ক্ষেত্রে। কয়েকজন সহকর্মী তার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে বসের কাছে নানাভাবে তার নামে কথা লাগাতে শুরু করে।

অনেকেই ভাবেন কর্পোরেট অফিসে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে আসা লোকজনের মাঝে নারীর প্রতি বৈষম্য হয় না। কিন্তু সাবিহা গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার প্রতি বৈষম্যের মাত্রা বেড়ে যায়। উনি গর্ভবতী এ কথা শোনার পরদিন থেকে তাকে একা আনা নেওয়া করা হত যে গাড়ি দিয়ে তা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। তাকে বলা হয় এখন থেকে যে গাড়িতে সবাই যাওয়া আসা করবে তাতে আসতে। এর ফলে দেখা যেত তাকে বাসা থেকে বের হতে হত সকালে আবার আসার জন্য বসেও থাকতে হত দেড় থেকে দুই ঘন্টা। প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি কোন। বরং তাকে ঢাকার অদূরে নানা প্রজেক্টে পাঠানো শুরু করে তার বস। তাতেও না করেননি সাবিহা, কিন্তু চার পাঁচজনের গ্রুপ মিলে তাকে এমন মানসিক অত্যাচার শুরু করে যে গর্ভধারণের চারমাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন সাবিহা।

সাবিহার জীবনে বড় বৈষম্যের ঘটনা ঘটে এর আগেও। নারী হবার কারণে নিয়োগ পরীক্ষা ও ভাইভাতে ভালো করার পরেও বাংলাদেশের একটি নামকরা গ্রুপ অব কোম্পানিতে চাকরি হয়নি সাবিহার। ঢাকার বাইরে এক প্রোজেক্টে কাজ করতে কোনই আপত্তি ছিলনা সাবিহা ও তার পরিবারের। সে কথা বলার পরেও কোম্পানির মালিক পক্ষ থেকে তাকে ‘না’ করে দেওয়া হয়। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল, সাবিহাকে বলা হয় তিনি যেন একই যোগ্যতার কোন পুরুষকে পাঠান এই পোস্টের জন্য। তার একজন পুরুষ বন্ধুকে পাঠান সাবিহা যে এখনও সেই কোম্পানিতে একই পোস্টে কাজ করছে।

চাকরির বাজারে নারী হিসেবে একের পর এক বৈষম্যের স্বীকার সাবিহা এখন বাংলাদেশের চাকরির বাজার নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। বিডি জবসেও দেখেন বিভিন্ন নামকরা কোম্পানি তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লিখে দেন ‘এপ্লিকেবল ফর মেন অনলি’। সর্বশেষ চাকরিটা মানসিক পীড়নের কারণে হারালেও সাবিহা কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাননা। এত বড় কোম্পানির সাথে লড়াই করে পারবেন না ভাবেন তিনি। বরং সুযোগ পেলেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান এখন তিনি।

তবে আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ‘কেউ নারী হওয়ার কারণে চাকরি না পেলে তিনি চাইলেই আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুইস কন্টাক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর অনির্বাণ ভৌমিক বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নিয়োগের হার পঞ্চাশ-পঞ্চাশ রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তারা। তবে উচ্চপদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও উপযুক্ত কোন নারীকে অনেক সময় সেই পদে পান না বলে জানান অনির্বাণ। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যেহেতু নারীদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসা বেশিদিনের নয়, তাই প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন নারীর অভাব এখনো রয়ে গেছে। আবার নারী ড্রাইভার নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একটাও আবেদন পান নি বলে জানান অনির্বাণ ভৌমিক।

মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং গর্ভাবস্থায় ও সন্তান জন্মের পর কাজে নমনীয় পরিবেশ পাওয়া প্রসঙ্গে অনির্বাণ বলেন, এটা আসলে প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে। পরিবেশ যদি নারীবান্ধব অর্থাৎ নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয় তাহলে সহকর্মীরাও গর্ভবতী সহকর্মীর সাথে কোনরকম খারাপ আচরণ বা বৈষম্য দেখানোর সুযোগ পাবেনা। তিনি জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রসূতি মাকে সাধারণত ট্যুরে পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। যদি পাঠানোর প্রয়োজন হয়, তবে বাচ্চা এবং বাচ্চার দেখাশোনা করার লোক সাথে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অনেক সময় দেখা যায় চাকরিজীবী নারীরা এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হন যা কোন পুরুষ চাকরিজীবীকে হতে হয়না। যেমন বেসরকারী সংস্থায় উঁচু পদে চাকরি করা নাবিলা ‘স্বামী কী করে?’ ‘বাবা কী করে?’ ‘বাচ্চা আছে নাকি নাই’ ধরণের ব্যক্তিগত প্রশ্নের মুখোমুখি হন। এধরণের প্রশ্ন কোন পুরুষকে করা হয়না সাধারণত।

১৯৬০ সালের নারীবাদ আন্দোলনের পর থেকে নারীরা বড় পরিসরে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বেতন, আচরণ, চাকরি না হওয়ার মত নানারকম বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন তারা নিয়মিতই। সেই বৈষম্য মাঠ পর্যায়ের নারী শ্রমিক থেকে শুরু করে কর্পোরেট কিংবা বিনোদন জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করা নারী সবাইকেই ভোগ করতে হয়।

 

 

সারাবাংলা/আরএফ/এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন