বিজ্ঞাপন

সম্মেলন ছাড়াই ‘নাজিল হওয়া’ কমিটিতে ৩৮ বছর পার!

December 19, 2022 | 11:34 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ধরতে গেলে চার দশক। আর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবে ৩৮ বছর। এই সময়ে হয়নি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সম্মেলন। অথচ সংগঠনটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এক বছর পর পর সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ৩৮ বছর সম্মেলন ছাড়াই চলছে মহানগর কমিটি। কেন্দ্র থেকে মহানগরে এ পর্যন্ত চারটি কমিটি দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান যে এক বছর মেয়াদী নগর ছাত্রলীগের কমিটি, সেটিও পার করছে নয় বছর। তবুও নেই সম্মেলনের কোনো উদ্যোগ।

বিজ্ঞাপন

পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বৈরি পরিস্থিতিতেও চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছিল। এরশাদের সামরিক শাসনামলের শুরুর দিকে একবার সম্মেলনের পর সেই যে বন্ধ হয়েছে, কঠিন পরিস্থিতি পার করেও আর সম্মেলনমুখী হয়নি সংগঠনটি। কেন্দ্র থেকে লিখিত ‘ফরমান’ জারি করে একের পর এক কমিটি দেওয়া হয়েছে, যাকে ওপর থেকে ‘নাজিল হওয়া কমিটি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা।

গঠনতন্ত্রে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ সাংগঠনিক জেলা শাখার মর্যাদাপ্রাপ্ত। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১০ ধারার খ-উপধারায় বলা হয়েছে, ‘জেলা শাখার কার্যকাল এক বছর। জেলা শাখাকে এ সময়ের মধ্যে নির্বাচিত কর্মকর্তাদের হাতে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের অনুমোদনক্রমে ৯০ দিন সময় বাড়ানো যাবে। এ সময়ের মধ্যে সম্মেলন না হলে জেলা কমিটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ আহ্বায়ক বা এডহক কমিটি গঠন করে ৯০ দিনের মধ্যে সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে আহ্বায়ক বা এডহক কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং কেন্দ্রীয় সংসদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’

নগর ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সাত বছর পর ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। এতে আলতাফ হোসেন চৌধুরী সভাপতি এবং আ জ ম নাছির উদ্দীন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর ১৯৮৪ সালের ২৩ মে সর্বশেষ সম্মেলনের মাধ্যেমে কমিটি হয়। এতে রফিক হোসেন বাচ্চুকে সভাপতি ও গোলাম মোস্তফা বাচ্চুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

বিজ্ঞাপন

এরপর গত ৩৮ বছরে সম্মেলন ছাড়াই কেন্দ্র থেকে দেওয়া হয়েছে নগর ছাত্রলীগের চারটি কমিটি। ১৯৮৮ সালে জাফর আহমেদ সভাপতি ও জিএম সাহাবুদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক, ৮৯ সালে মফিজুর রহমান সভাপতি ও রহিম উদ্দিন সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি পাঠায় কেন্দ্র। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর সভাপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে যান মফিজুর রহমান। বিলুপ্ত হয়ে যায় মফিজুর-রহিমের নেতৃত্বাধীন কমিটি।

আশির দশকে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিক কলিম সরওয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘রফিক হোসেন বাচ্চু ও গোলাম মোস্তফা বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন কমিটির পর এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের আর কোনো কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে হয়নি। সেসময় একদিকে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব, সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামসহ নানা কারণে সম্মেলন করার মতো পরিস্থিতি ছিল না।’

এদিকে, মফিজুর-রহিম কমিটি বিলুপ্তির পর প্রায় চার বছর কাণ্ডারিবিহীন ছিল নগর ছাত্রলীগ। ২০০০ সালে নগরীর বহদ্দারহাটে ছাত্রলীগের আট নেতাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে শিবিরের সন্ত্রাসীরা। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে ২০০০ সালে ১২ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি ঘোষণা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

২০০৩ সালে স্টিয়ারিং কমিটি বিলুপ্ত করে এম আর আজিমকে সভাপতি ও মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই কমিটি ১০ বছর দায়িত্ব পালন করে।

এরপর ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ২৪ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। এক বছর মেয়াদের ওই কমিটি ইতোমধ্যে নয় বছর পার করেছে। এর মধ্যে ঘটে গেছে নানা নাটকীয়তাও। বিভিন্ন ঘটনায় আলোচিত-সমালোচিত হওয়ার পর ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন নুরুল আজিম রনি। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে। পরে তাকে ভারমুক্তও করা হয়।

গঠনতন্ত্র না মেনে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে ছাত্রলীগকে গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। সারাবাংলাকে বলেন তিনি, ‘সম্মেলনের মাধ্যমে তৈরি হয় নতুন নেতৃত্ব। সংগঠনকে গঠনতন্ত্রের ধারাবাহিকতা মেনে পরিচালনা করলে কোনো সংকট থাকে না। আমরা মাঝে মাঝে ছাত্রলীগে যেসব সংকট দেখি সেগুলো গঠনতন্ত্রের ব্যত্যয়ের কারণেই মূলত সৃষ্টি।’

জানতে চাইলে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি কমিটি বেশিদিন রানিং করা নেতৃত্ব বিকাশের অন্তরায়। অনেক সময় দেখা যায়, গঠনতন্ত্র মেনে ধারাবাহিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের অভাবে অনেক যোগ্য নেতৃত্ব হারিয়ে যায়। সাংগঠনিক নেতৃত্বগুণ থাকার পর ও নেতৃত্বে আসতে না পেরে তারা হতাশ হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। এভাবে সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি বাধাগ্রস্ত হয়।’

বিজ্ঞাপন

সম্মেলন কবে, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তিন/চার বছর ধরেই চেষ্টা করছি নগর সম্মেলন করতে। কিছু সমস্যা থাকার কারণে করা যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা পেলে এক সপ্তাহের মধ্যেই সম্মেলন করতে আমরা প্রস্তুত আছি। যেহেতু সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি এখনও ঘোষণা করা হয়নি, তাই নগরের সম্মেলন কবে নাগাদ হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছি না।’

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন