বিজ্ঞাপন

পিতৃপরিচয়হীন সন্তান; হাইকোর্টের রায় ও করণীয়

January 25, 2023 | 6:36 pm

অর্পিতা চৌধুরী

সব তথ্যের উৎস ফেসবুকে পাশাপাশি দুটি খবর পড়ছিলাম। প্রথমটি হলো- ঢাকা সিলেট মহাসড়কে মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণীর (২৫) জন্ম দেওয়া নবজাতকের ঠাঁই হলো সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছোটমণি নিবাসে। দ্বিতীয়টি- শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে ব্যবহৃত সব ফর্মে অভিভাবকের ঘরে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক শব্দ বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করতে হাইকোর্টের নির্দেশ।

বিজ্ঞাপন

এই যে মহাসড়কে এক শিশুর জন্ম হলো, তার মা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং পিতা অজ্ঞাত। এ শিশু যখন স্কুলে ভর্তি হতে যাবে তখন স্কুলের শিক্ষার্থীর তথ্য ফরমে আগে যেখানে পিতার নাম লেখা বাধ্যতামূলক ছিল সেখানে সে পিতা-মাতা কারো নাম না লিখেই তার আইনানুগ অভিভাবকের নাম দিয়ে সে স্কুলে ভর্তি হতে পারবে। হাইকোর্টের রায় সংক্ষেপে এ কথাই বলে। যেহেতু আমাদের হাতে এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় আসেনি তাই বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ কম।

অনেকেই ভাবছেন এ আইনের ফলে ‘অভিভাবকত্ব’ আইন বুঝি পালটে যাচ্ছে। সমাজে বুঝি ‘পিতার পরিচয়ের’ দিন শেষ হতে যাচ্ছে। লিভ টুগেদার করা জুটির সন্তান, ডিভোর্সড নারীর সন্তানকে বুঝি এখন আর ‘বাধ্যতামূলক’ বাবার নাম বহন করতে হবে না। আদতে কিন্তু তা না। অনেকক্ষেত্রেই পিতার নাম উল্লেখ করা যায় না- যুদ্ধ শিশু, গণধর্ষণের কারণে জন্ম নেওয়া শিশু ইত্যাদি অনেক কারণ থাকে। এ ধরনের ঘটনায় এ আইন একটি সুবিধা দেবে। কারণ শিক্ষা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, বাংলাদেশে শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব ‘মুসলিম শরীয়া আইন’, ‘পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ; ১৯৮৫’ এবং ‘অভিভাবক ও প্রতিপালন আইন; ১৮৯০’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, পিতা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক আর মা হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক। এক্ষেত্রে সন্তানকে মায়ের কাছে দিলেও আইনানুযায়ী ভরণপোষণ পিতাকেই বহন করতে হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে সন্তানের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বের আইনগত অধিকার নিয়ে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘২০০৮ সাল থেকে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে দায়ের হওয়া মামলাগুলো ঝুলে আছে এবং আদালত ছয় মাসের মধ্যে এসব পারিবারিক আদালতে নিস্পত্তির আদেশ দিয়েছিলেন’। আইনে যা-ই থাকুক আদালতের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, নাবালক বা শিশুর স্বার্থ ও কল্যাণ। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৮ সলের এপ্রিলে আদালতের রায়ে একমাত্র মেয়ের অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন।

বিজ্ঞাপন

অভিভাবকত্ব আইন অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদে থাকা নারী যদি তার সন্তানের হেফাজতকারীও হন তাহলেও একটি পাসপোর্ট করতে গেলেও পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় পিতাকে লাগবে। কারণ আইন অনুযায়ী পিতা হচ্ছেন সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক। তাই এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভরণপোষণের মামলার সাথে যুক্ত হয় কাস্টডি মামলা।

পিতৃপরিচয়, অভিভাবকত্ব, হেফাজতকারী, কাস্টডি, উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ এসব নিয়ে যে বিভাজন এর মূলে রয়েছে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ না থাকা। আমাদের দেশে পারিবারিক আইন আছে ‘পার্সোনাল ল’ অর্থাৎ ধর্ম অনুসারে। এখানেই সংকটের উদ্ভব। উদাহরণস্বরূপ আমরা যদি বিবাহ ঘটনাটি নেই তাহলে আমাদের কাছে উন্মোচিত হবে বঞ্চনা কত ধরনের হতে পারে! ধর্মে উল্লেখ না থাকলেও মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রি হয়। অন্য দিকে হিন্দু ধর্মানুসারীদের জন্য বিয়ে রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক নয়। বৌদ্ধরা যেহেতু ‘হিন্দু ল’ অনুযায়ী চলে তাদের ক্ষেত্রেও ঐচ্ছিক রেজিস্ট্রেশন প্রযোজ্য। খ্রিশ্চান ধর্ম অনুযায়ী আবার বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। বিয়েই যেখানে আইন দ্বারা সুরক্ষিত না সেখানে বাকী আইনি সুবিধা আপনি কিভাবে পাবেন? কাজেই হিন্দু ও বৌদ্ধ নারী বঞ্চিত হচ্ছে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে, হোঁচট খাচ্ছে প্রয়োজনের সময় বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে।

সন্তানের অভিভাবকত্ব আইন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ যে কোনো বিষয়ে সংবিধান অনুযায়ী নারী পুরুষের যে সমতা তা পেতে হলে আমাদের যা করতে হবে- ১. সিডও অনুষদের ধারা ২ অনুযায়ী নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং আইনে সংস্কার করা ধারা ১৬.১ (গ) অনুযায়ী বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্ব বন্টন; এ দুই ধারায় বাংলাদেশকে অনুমোদন দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

২. উত্তরাধিকার আইন সবার জন্য এক হতে হবে অর্থাৎ পিতামাতার সম্পদে ছেলে ও মেয়ে সন্তানের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৩. ‘পার্সোনাল ল’ নয় সব ধর্ম-বর্ণ জাতি লিঙ্গ সবার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন পাশ করতে হবে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় ‘পার্সোনাল ল’ মানতে চায় সেটা হবে তার ঐচ্ছিক ব্যাপার।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীর তথ্য ফরমে যে নতুন সংযোজনের কথা হাইকোর্ট তার রায়ে বলেছে তা ক্ষুদ্র হলেও একটা পদক্ষেপ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বহুদিন যাবত উত্তরাধিকার আইন সমান করার ব্যাপারে বলে যাচ্ছেন। কিন্তু সব ধর্মের পুরোহিত, যাজক, মোল্লা সর্বোপরি পুরুষেরা এর পরিবর্তনে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার চাইলে যে কোনো জনবান্ধব ও যুগোপযোগী আইন আনতে পারে, সরকারের সে সক্ষমতা আছে। অভিভাবকত্ব আইনসহ সব ধরনের পারিবারিক আইনের সংস্কার করার সদিচ্ছা সরকারকে দেখাতে হবে। কোনোকালেই কোন পরিবর্তনে সমাজের সবাইকে খুশি করা যায়নি। তাই মোল্লা, পুরোহিত, যাজক এদের স্বার্থ রক্ষা না করে সরকার দেশের আঠারো কোটি মানুষের জন্য যা কর্তব্য, যা মঙ্গল সে পথে হাঁটবে- নাগরিক হিসেবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এজেডএস/এসবিডিই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন