বিজ্ঞাপন

এবারও আন্তর্জাতিক সংযোগহীন, বিদেশি অতিথিবিহীন মেলা

January 26, 2023 | 7:39 pm

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বাংলার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্বের নানা ভাষার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংযোগ স্থাপনে বাংলা একাডেমি একযুগ আগে যে উদ্যোগ নিয়েছিল, কোভিডের কারণে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে এসে তা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বিদেশি ভাষার কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের সরব উপস্থিতি ছাড়াই দেশি ভাষার কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের নিয়ে গত তিনটি মেলার ‘মহাকর্মযজ্ঞ’ উদ্বোধন ও ‘সফল’ পরিসমাপ্তি টানে বাংলা একাডেমি।

বিজ্ঞাপন

তবে কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি এবং এক দেশ থেকে আরেক দেশ ভ্রমণে বিশ্ব নাগরিকদের কোনো বাধা না থাকলেও এবারও আন্তর্জাতিক সংযোগহীন, বিদেশি অতিথিবিহীন ‘অমর একুশে বইমেলা’ আয়োজন করছে কর্তৃপক্ষ।

মেলা পরিচালনা কমিটি এবং বাংলা একাডেমির বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে, এবার বইমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কোনো বিদেশি অতিথি থাকছেন না, থাকছে না কোনো আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন বা আন্তর্জাতিক সেমিনারপর্ব।

অথচ কোভিডের আগে টানা ১১ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিদেশি ভাষার কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। উদ্বোধন অনুষ্ঠানসহ মেলা চলাকালে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন ও সেমিনারে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, ভাষাবিদদের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে মেলা। ওই বছরগুলোতে বেশ কয়েকজন নোবেল লরিয়েটের পদধূলিতে ধন্য হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আর এ যাত্রার সূচনাটা হয়েছিল ২০০৯ সালে।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১ ফ্রেব্রুয়ারি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ উদ্বোধন করতে বাংলা একাডেমিতে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সচিব, বাংলা একাডেমির সভাপতি, মহাপরিচালক, সচিব এবং মেলার সদস্য সচিবকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন মঞ্চে ওঠেন, তখন দেখতে পান দর্শক সারিতে বসে আছেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক কলকাতার মহাশ্বেতা দেবী।

এরপর স্বভাসূলভ ভঙ্গিতে বিশিষ্ট এই লেখককে মঞ্চে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খুব সম্ভবত অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাসে সেবারই প্রথম বিদেশি কোনো অতিথি উদ্বোধন মঞ্চে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন। মহাশ্বেতা দেবী বাংলা একাডেমি বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন, নাকি অন্য কোনো কাজে ঢাকায় এসে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন, সেটি নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, এর এক বছর পর থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিদেশি ভাষার কবি, সাহিত্যিক, লেখক, নোবেল লরিয়েট, ভাষাবিদ, পণ্ডিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

বিজ্ঞাপন

২০১১ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভারত, চীন ও স্পেনের লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা অংশ নেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাসে সেবারই প্রথম কোনো নোবেল লরিয়েট লেখক অংশগ্রহণ করেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্ততৃা দেন নোবেল বিজয়ী বাঙালি লেখক অমর্ত্য সেন।

২০১২ সালটা ছিল ভাষা আন্দোলনের হীরকজয়ন্তীর বছর। ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি অর্থাৎ হীরকজয়ন্ত্রী উদযাপনে বিশেষভাবে বইমেলা আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। হীরকজয়ন্তী উদযাপনে বিশেষ আলোচনা ও সেমিনার আয়োজন করা হয়। মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্য রাখেন ব্রিটিশ নাগরিক ও বাংলা ভাষার পণ্ডিত উইলিয়াম রাদিচে।

২০১৫ সালের ১ ফ্রেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবং চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১২টি দেশের ৪৮ জন সাহিত্যিক অংশগ্রহণ করেন। এ বছর জার্মানির প্রখ্যাত সাহিত্যিক হান্স হার্ডার, ফরাসি লেখক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, বেলজিয়ামের সাহিত্যিক ফাদার দ্যতিয়েন এবং ভারতের বিশিষ্ট ভাষাবিদ পবিত্র সরকার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। মেলার চতুর্থ দিনে আলোচনায় অংশ নেন মারিয়া বারেরা হেলেনা, তবিয়াস বিয়ানওনে, দাতু ড. আহমেদ কামাল আব্দুল্লাহ, জার্মেইন ডুবেনব্রুট, সিন্ডিলি ব্রাউন, পিটার নাইবাস, জামি ঝু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, উদয় নারায়ণ সিংহ, কবি সুবোধ সরকার প্রমুখ।

বিজ্ঞাপন

সে বছর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখককেদর পাশাপাশি ত্রিপুরা, আসাম, বিহারের মৈথিলি ও ভোজপুরি ভাষার বেশ কয়েকজন কবি, সাহিত্যিক ও লেখক বাংলা একাডেমির আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তীতে আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বছর ১ ফেব্রুয়ারি মেলা উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মঞ্চে দেখা যায় আন্তর্জাতিক প্রকাশক সংস্থার সভাপতি রিচার্ড চারকিনকে। সেবার দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবে শ্লোভাকিয়া, মরোক্ক, সুইডেন, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের কবিরা অংশ গ্রহণ করেন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়াত বার্নিকাট মেলায় এসে নিজের মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেন।

২০১৭ সালে গ্রন্থমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনেরও আয়োজন করে। এবারও ১ ফেব্রুয়ারি মেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে চীন, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ভারতের কবি-সাহিত্যকরা বক্তব্য রাখেন। চার দিনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে দেশি-বিদেশি অতিথি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে ১৬টি পর্বে বক্তব্য/প্রবন্ধ উপস্থাপনা/আলোচনা/স্বরচিত কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সাতটি দেশের ২৭ জন লেখক-সাহিত্যিক অংশ নেন।

২০১৮ সালের বইমেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন বেশ কয়েকজন বিদেশি অতিথি। তারা বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এগনিস মিডোস, ক্যামেরুনের ড. জয়েস এসউনটেনটেঙ, মিশরের ইব্রাহিম এলমাসরি এবং সুইডেনের অরনে জনসন।

২০১৯ সালের অমর একুশে বইমেলায় বিদেশি অতিথির মধ্যে ভারতের বিখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ ও মিশরের লেখক মোহসেন আল-আরিশি উপস্থিত ছিলেন। মেলায় মোহসেন আল আরশির লেখা ‘শেখ হাসিনা: যে রূপকথা রূপ কথা নয়’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিদেশি অতিথিদের এই আনা-গোনায় ছেদ পড়ে ২০২০ সালে কোভিড পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি বদলালেও বিদেশি অতিথিদের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি বিগত বছরগুলোর অবস্থানেই আছে। এবারের বইমেলা বিদেশি ভাষার কোনো কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের দেখা যাবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা একাডেমির একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার বিদেশি কোনো অতিথি থাকছে না। থাকলে এ কয়দিনে আমাদের কাছে নিশ্চয় তালিকা চলে আসত।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে. এম. মুজাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখে। বিদেশি মেহমান থাকবে কিনা, সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।’

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বইমেলা উপলক্ষে আমরা কাউকে আমন্ত্রণ জানাই না, এটি আমাদের কাজ নয়। আমন্ত্রণের বিষয়টি বাংলা একাডেমি করে থাকে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনি এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।’

সারাবাংলা/এজেড/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন