বিজ্ঞাপন

খুলনা-মোংলা রেল সংযোগ: ৪ বছরের প্রকল্প যাচ্ছে ১১ বছর

February 1, 2023 | 10:57 am

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫০ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণে যাচ্ছে ১১ বছর। অথচ মাত্র তিন বছরে এটি নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি এবং সংশোধনের মুখে পড়ে ‘খুলনা-মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি। এবার দ্বিতীয়বার সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।

বিজ্ঞাপন

খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের মাধ্যমে মংলা পোর্টের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে, সুন্দরবনে অধিক পর্যটক আসার সুযোগ পাবে‌।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এই রেলপথ নির্মাণে প্রথম ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৭২১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সেখান থেকে প্রথম সংশোধনীতে বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮০ কোটি ২২ লাখ টাকা। এখন আবার দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে মোট ধরা হচ্ছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি ৯২ লাখ  টাকা। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৮৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। এ সময় ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৬  শতাংশ। তবে যেসব কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে সেগুলোর মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। খবর পরিকল্পনা কশিন সূত্রের।

প্রকল্পের মেয়াদ পঞ্চমবারে আরও এক বছর ৭ মাস বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রকল্প এলাকার মাটির গুণাগুণ নিম্নমানের হওয়ার কারণে নতুনভাবে ডিজাইন রিভিউ করে বিশেজ্ঞ মতামত নিয়ে প্রকল্পের কাজ নির্বাহ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই কাজের কাঙ্খিত অগ্রগতি সাধন সম্ভব হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া অনুমোদিত ডিজাইন সেটেলমেন্টের চেয়ে বাস্তবে অধিক সেটেলমেন্ট হওয়ায় পরামর্শক, ঠিকাদার এবং প্রকল্প প্রতিনিধি নিয়মিত ক্লোজ মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে। ফলে বেশি সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে।

আরও বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর ও ২০১৭ সালের ১ লা জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক দফতর থেকে প্রকল্পের জন্য কিছু পরিমাণ অধিগ্রহণ করা ভূমি হস্তান্তর পাওয়া গেছে। ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে। দ্বিগরাজ স্টেশন এপ্রোচ রোডের ভুমি এখনো অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি।

বিজ্ঞাপন

ভূমি অধিগ্রহণ দেরি হওয়ায় কাজ শুরু করতে যেমন বিলম্ব হয়েছে তেমনি অধিগ্রহণ সমাপ্ত না হওয়ায় নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতেও বর্তমানে সমস্যা হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় যৌক্তিক কারণে চুক্তিপত্রের অবশিষ্ট ১৩ শতাংশ এবং সম্ভাব্য রিমেডিয়াল কাজ সমাপ্তির জন্য চুক্তিপত্রের অনুমোদিত মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বরের স্থলে চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে করা ভাল হবে।

এছাড়া চুক্তিপত্র মোতাবেক কাজ শেষে আরো ১২ মাস ডিফেক্ট লায়াবিটি পিরিয়ড প্রয়োজন হবে। যা আরডিপিপির মেয়াদের সঙ্গে অর্ন্তভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত করা হয়।

এতেও কাজ শেষ হয়নি। দ্বিতীয়বার ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ সাড়ে ৩ বছর বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় না বাড়ালেও তৃতীয়বার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ ২ বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এবারও শেষ হয়নি কাজ।

পরবর্তীতে চতুর্থবার ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এখন দ্বিতীয় সংশোধনীতে এতে পঞ্চমবারের মতো ১ বছর ৭ মাস বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংস্থান এবং অত্যাবশ্যকীয় নতুন আইটেম অন্তর্ভুক্তিসহ ঠিকাদারের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় ভেরিয়েশন চূড়ান্ত করা এবং অনুমোদন এখনও সম্ভব না হওয়ায় ঠিকাদার চুক্তিপত্রের অতিরিক্ত কাজের ভিত্তিতে প্রাপ্য বিল দাবি পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। তাই ঠিকাদারের ক্যাশ-ফ্লো ব্যহত হচ্ছে।

এ জন্য কাজের অগ্রগতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া  প্রকল্পের সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুপারিশ করে পিএ খাতের পরিবর্তে সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য আহবান করা দরপত্র গত বছরের ৭ আগস্ট অনুমোদিত হয়েছে।

গত বছরের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড ইস্যু করা হয়। কাজটি চলতি বছরের মার্চে শেষ হবে আশা করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করা, পিসিআর প্রণয়ন, প্রকল্পটি হস্তান্তরসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বর্ধিত করা প্রয়োজন।

তবে গত বছরের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত পিআইসি এবং গত ২৮ জুনে অনুষ্ঠিত পিএসসি সভার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্মাণ সময় কমে ভিইউপির উভয় প্রান্তের এপ্রোচ ফিলিং স্টেজ কন্সট্রাকশন যতদুর সম্ভব পরিহার করে দ্রুততার সঙ্গে নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরামর্শকের কাছ থেকে বিকল্প এবং গ্রহণযোগ্য কারিগরি প্রস্তাব পাওয়া যাবে। তাই ১২ মাস ডিএলপি ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন এবং ১২ মাস ডিএলপি, বিজি ফেরত দেওয়া সহ চূড়ান্তভাবে প্রকল্প হস্তান্তরের জন্য ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই সময় পর্যন্ত অনুমোদনের প্রস্তাব করা হয়।

প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে আইএমইডির মতামতঃ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত এক বছর ৭ মাস বৃদ্ধির বিষয়ে আইএমইডি মতামত দিয়েছে।

এক্ষেত্রে আইএমইডি কলেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। গত বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত বাস্তব অগ্রগতি ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। প্রকল্প অফিস ও দাখিল করা কর্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।

এছাড়া অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত ও প্রক্রিয়াধীন অবশিষ্ট জমি অধিগ্রহণের কাজ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত সম্পন্ন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জমি সংক্রান্ত ক্রস-কাটিং ইস্যুগুলো আলোচনা করে দ্রুত নিস্পত্তির পরামর্শ দেওয়া হয়।

এছাড়া ২৫ মিটার দীর্ঘ ১০ নং ব্রিজ পরিদর্শনে সেতুর উভয় পাশের এমব্যাংকমেন্টের মাটি এখনও সেটেল না হওয়ার কারনে নির্মিত সেতুটির মারাত্বক কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য কারিগরি সমাধানের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কুয়েটে পাঠানো হয়।

সরেজমিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাটির বোরিংয়ের কাজ দেখা যায় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে কারিগরি মতামত নিয়ে উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নির্মিত রেললাইন খুলনা-বাগেরহাট জেলার অনেকটা জলাভুমি বরাবর নির্মাণ করা হয়েছে, ফলে এমব্যাংকমেন্টের মাটির সেটেলমেন্টে অনেক বেশি সময় লাগছে।

এছাড়াও কোথাও কোথাও অনাকাঙ্খিত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বার বার ডিজাইন সংশোধনের প্রয়োজন হচ্ছে। এতে এ প্রকল্পের দূর্বল সম্ভাব্যতা যাচাই প্রমানিত হয়। ভবিষ্যতে এরকম প্রকল্প তৈরিতে অধিকতর যাচাই বাছাই যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়েকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন: আইএমইডি নির্মিত রেল স্টেশন ও সার্ভিস এরিয়ার ভবনগুলোর পরিদর্শনে এই ভবনগুলো ফিট করা বা ব্যবহৃত কাঠ, দরজার, হ্যাজবোল্ড, লক, জানালার গ্রিল ইত্যাদি অত্যন্ত নিম্নমানের হয়েছে দেখতে পায়। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এখনও কক্ষগুলোর ফিটিংস সংযুক্ত করা হয়নি। এত নিম্নমানের উপাদান কিভাবে ফিট ব্যবহার করা হলো বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মনিটরিংয়ে গাফিলতি রয়েছে। দ্রুত ব্যবহৃত কাঠসহ অন্যান্য নিম্নমানের আইটেমগুলো পরিবর্তন করে আইএমইডিকে জানার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।

প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সারাবাংলাকে বলেন, প্রকল্পটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫০ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে মোংলা সমুদ্র বন্দরকে বিদ্যমান রেলওয়ে নেটওয়ার্কেও সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে রেলযোগে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।

সারাবাংলা/জেজে/এনইউ

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন