বিজ্ঞাপন

বইয়ের দামে পাঠক হতাশ, নিরুপায় প্রকাশকরা

February 5, 2023 | 10:48 pm

আসাদ জামান

প্রথমা প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ বইটি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করছিলেন জনৈক তরুণ লেখক (নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ আছে)। মীনহাজ-ই-সিরাজ জুজ্জানীর লেখা ফারসি ভাষায় ইসলামী বিশ্বের বিস্তৃত ইতিহাস সমৃদ্ধ এ বইটি বহুকাল আগে বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বাংলাদেশে কিংবদন্তিতুল্য প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ, অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।

বিজ্ঞাপন

এবারের বইমেলা বইটি পুনর্মুদ্রণ করেছে প্রথমা প্রকাশনী। ক্ল্যাসিক এ বইটি যে সব শ্রেণির পাঠকের জন্য, তা নয়। বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়, বোদ্ধা শ্রেণির পাঠক অথবা লেখালেখি করেন— এমন ব্যক্তিরাই মীনহাজ-ই-সিরাজ জুজ্জানীর লেখা ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ বইটি খোঁজ করবেন।

তো যা বলছিলাম, জনৈক তরুণ লেখক অনেকক্ষণ ধরে বইটি নাড়াচাড়া করছিলেন এবং বার বার মূল্য সংযোজন অংশে চোখ বুলাচ্ছিলেন। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার, বইটি কিনছেন? ‍কিনুন, আপনার জন্য এটা চমৎকার বই।’

বেশিরভাগ লেখকই রসবোধে পারদর্শী হন। সুতরাং তিনিও কৌতূক করে বলে ফেললেন, ‘প্রথমার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হলেন কবে?’ আমি বললাম, বিষয়টা সেরকম না। প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ ‘আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া’র মৃত্যুর আগে সমরিতা হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় তাকে নিয়ে লেখার দায়িত্ব পড়েছিল। সেই সুবাদে তার কিছু বই পড়েছিলাম। একবার সশরীরে তার সঙ্গে দেখাও করেছিলাম। সেই থেকে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া এবং তার লেখালেখির প্রতি একটা ফ্যাসিনেশন তৈরি হয়েছে আরকি।

বিজ্ঞাপন

আমাদের কথপোকথন মনোযোগের সঙ্গে শুনছিলেন প্রথমা’র বিক্রয় প্রতিনিধি মো. বখতিয়ার মাহমুদ শুভ। কথাপর্ব এবার শুরু হলো তার সঙ্গে। শুভ’র উদ্দেশে তরুণ লেখকটি বললেন, ‘৪৫১ পৃষ্ঠা অর্থাৎ ২২৬ পাতার একটা বইয়ের মূল্য ১২০০ টাকা হয় কী করে? পাশে থাকা নারী বিক্রয় কর্মীটি তাত্ত্বিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘বইয়ের মূল্য কি পৃষ্ঠা গুনে হয়? যারা বই কেনে, তারা টাকার দিকে তাকায় না।’

অপেক্ষাকৃত বিনয়ী মো. বখতিয়ার মাহমুদ শুভ বললেন, ‘হ্যাঁ, এবার বইয়ের মূল্য একটু বেশিই— সবাই এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। বইয়ের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে নিশ্চয়ই যৌক্তিক কোনো কারণ আছে।’

বিজ্ঞাপন

অতঃপর প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ বইটা না কিনেই ফিরে গেলেন তরুণ ওই লেখকটি। প্রথমা থেকে প্রকাশিত প্রায় একই কলেবরে মুদ্রিত ১৫০০ টাকা মূল্যের একটি সিরাত গ্রন্থ নেড়েচেড়ে দেখে খালি হাতেই ফিরে গেলেন আরেকজন ভদ্রমহিলা।

এবারের অমর একুশে বইমেলার খণ্ড খণ্ড এসব দৃশ্য যেন বইয়ের ঊর্ধ্বমূল্যের প্রতীকী চিহ্ন। পরম আগ্রহ নিয়ে মেলায় এসেও ঊর্ধমূল্যের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বই কিনতে পারছেন না অনেকেই। যিনি পাঁচটি বই কেনার নিয়তে মেলায় এসেছেন, তিনি দুইটা বই কিনে বাসায় ফিরছেন।

কথা হয় শ্যামপুর থেকে মায়ের সঙ্গে মেলায় আসা মো. আল আমিন খানের সঙ্গে। ‘সহজে শিখি সি প্রোগ্রামিং’ এবং ‘ম্যাটাল্যাব পরিচিতি’ নামক দু’টি বই কিনে বাসায় ফিরছেন তিনি। এ প্রতিবেদককে আল আমিন খান বলেন, ‘বইয়ের অনেক দাম। সে কারণে আম্মু বেশি বই কিনতে দেয়নি।’

আল আমিন খানে মা মিসেস ঝুমি বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিন ছেলের লেখা-পড়া, সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খাইতে হয়। তার ওপর আবার এবার বইয়ের দাম অত্যধিক বেশি। সে কারণে ওরা অনেক করে বই কিনতে চাইলেও কিনে দিতে পারিনি।’

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদ মাহফুজ ‘ইহয়াউ উলুমিদ্দিীন’ বইটি কিনে হলে ফিরছিলেন। ইমাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-গাজ্জালি (র.)-এর লেখা বিখ্যাত এই বইটির বাংলা অনুবাদ কেনার কারণ সম্পর্কে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “সাধুসংঘ’ বইটি কিনে নিয়ে গেছি। আজ এটা কিনলাম। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে সুফিজমের ওপর আগ্রহ আছে। কিন্তু অত্যধিক দামের কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট্ট কলেবরে মুদ্রিত বইগুলো কিনছি।”

রিয়াদের সঙ্গে থাকা তার বন্ধু সাবরিনা ইসলাম শেফা বলেন, ‘ও তো তাও একটা কিনেছে। টাকার জন্য তো আমি বই কিনেত পারলাম না। বইয়ের দাম এবার আকাশ ছোঁয়া।’

মেলার ‘হাতে খড়ি’ উন্মুক্ত মঞ্চের পশ্চিম-উত্তর কোণে একটি ডিসপ্লে বোর্ডের নিচে বসে ‘DINOSAUR WORLD’ পড়ছিল পাঁচ বছর বয়সী ইনায়া ইমতিয়াজ জারা। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ‘এক ডজন ছোট গল্প’, ‘বুনো বিড়াল’ এবং ‘গোয়েন্দা আঙ্কেল’।

অদূরেই বসে ছিলেন ইনায়া ইমতিয়াজ জারার মা প্যান্ডোরা গ্লোরী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বইয়ের মূল্য অকল্পনীয়। ইচ্ছা থাকলেও খুব বেশি বই কিনতে পারবে না কেউ।’

বইয়ের এই অতি মূল্য’র বিষয়টি অস্বীকার করছেন না প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, কম দামে বই দিতে পারলে বিক্রি বাড়ত। বিক্রি বাড়লে প্রফিট বাড়ত। বাজারে কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বইয়ের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে ঐতিহ্য প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী আরিফুর রহমান নাঈম সারাবাংলাকে বলেন, ‘জানুয়ারির ৩১ তারিখ পর্যন্ত আমরা কাগজ কিনেছি ৬০ শতাংশ হারে বর্ধিত মূল্যে। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে কাগজ কিনতে হচ্ছে ১০০ শতাংশ হারে বর্ধিত মূল্য দিয়ে। অর্থাৎ গত বছর বইমেলার সময় আমরা যে কাগজ ১০০ টাকায় কিনতে পেরেছি, সে কাগজ এবার ২০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা বইয়ের মূল্য বাড়িয়েছি মাত্র ২৫ শতাংশ। এতে করে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করে কম লাভ হবে, কিন্ত লস হবে না। লস হবে পাঠকের। তারা ১০০০ টাকার বই এবার ১২৫০ টাকায় কিনবে। এন্ড অব ডে, ক্ষতিটা আমাদেরও হবে। কারণ, আমরা পাঠক হারাব।’

ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটিডের (ইউপিএল) প্রধান বিক্রয় কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বইয়ের দাম কিছুটা বাড়াতে হয়েছে কাগজের মূল্য বাড়ার কারণে। তবে কত শতাংশ বাড়িয়েছে, সেটা প্রোডাকশনের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা বলতে পারবে।’

কাগজের দাম বাড়ার কারণে এবার নতুন বই প্রকাশের অনুপাতটাও আপাতত কম মনে হচ্ছে। মেলার পঞ্চম দিন রোববার নতুন বই এসেছে মাত্র ৭৩টি।

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সমরজিৎ রায় চৌধুরী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহিদ মুস্তাফা। আলোচনায় অংশ নেন মইনুদ্দীন খালেদ ও মুস্তাফা জামান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিল্পী হাশেম খান।

প্রাবন্ধিক বলেন, ‘বরেণ্য শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী হাতে লেখা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম নকশাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান লোগোসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের লোগোর প্রণেতা। তিনি ছবি আঁকতেন দেশের রূপবৈচিত্র্যকে বিষয় করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও ছবি এঁকেছেন তিনি। এছাড়া নিসর্গ ও মানুষ ছিল তার প্রিয় বিষয়। গ্রামীণ দৃশ্যাবলি, সেইসঙ্গে তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত দৃশ্যাবলি তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। শিল্পী সমরজিৎ জীবনব্যাপী প্রগতিশীল আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ করেছেন। শান্তির অন্বেষায় তার চিত্রপটে রং, রেখা, রূপ একাকার হয়ে আছে।’

সভাপতির বক্তব্যে শিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী ছিলেন নিষ্ঠাবান একজন শিক্ষক। দৃঢ় মনোবলের অধিকারী এই শিল্পী চাটুকারিতাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি, বরং ভালোবাসা দিয়েই সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের মন জয় করেছিলেন। তিনি তার নিজের চিত্রভাষা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।’

আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কুদরত-ই-হুদা, বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, আবু সাঈদ তুলু, ফরিদুর রহমান।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি আলতাফ হোসেন, আসলাম সানী এবং মারুফ রায়হান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মীর বরকত, ইকবাল খোরশেদ এবং কাজী বুশরা আহমেদ তিথি। এছাড়া ছিল ফয়জুল আলম পাপ্পুর পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘প্রকাশ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াকুব আলী খান, সালাউদ্দিন আহমদ, সুজিত মোস্তফা, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী এবং প্রিয়াংকা গোপ।

যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন সুবীর চন্দ্র ঘোষ (তবলা), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড), ফিরোজ খান (সেতার) এবং মো. হাসান আলী (বাঁশি)।

আগামীকাল সোমবার (৬ ফ্রেব্রুয়ারি) অমর একুশে বইমেলার ষষ্ঠ দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কাজী রোজী’ এবং ‘দিলারা হাশেম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন নাসির আহমেদ ও তপন রায়। আলোচনায় অংশ নেবেন আসলাম সানী, শাহেদ কায়েস, আনিসুর রহমান এবং শাহনাজ মুন্নী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অসীম সাহা।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন