বিজ্ঞাপন

ফুটবল কূটনীতিতে সম্পর্কের নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনা

March 1, 2023 | 1:18 pm

তাপস হালদার

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হলে বাংলাদেশী সমর্থকদের উন্মাদনাকে অনেকে নিছক পাগলামি বলে মন্তব্য করেন। আবার অনেকে বাঙালিদের এই আবেগ নিয়েও কটাক্ষ করেন। অথচ বাঙালিরা এই আবেগ দিয়েই অনেক অসাধ্য কাজ সাধন করেছে। গত ফুটবল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও মেসির প্রতি বাংলাদেশের সমর্থকদের উন্মাদনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। এই ভালোবাসা ছিল সম্পূর্ণ নিখাদ। এখানে কোন দেনা পাওনার হিসেব ছিল না। কিন্তু এই ভালোবাসাই তৈরি করে আরেকটি ঐতিহাসিক ইতিহাস। বাংলাদেশি সমর্থকদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে দীর্ঘ ৪৫ বছর ঢাকায় চালু করল আর্জেন্টিনার দূতাবাস। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো ঢাকার বনানীতে নতুন দূতাবাস উদ্বোধন করেন। ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার মাত্র তিনমাসের মধ্যেই দূতাবাস চালু করল আর্জেন্টিনা। এটি শুধু একটি কূটনৈতিক মিশনই নয়, দুই দেশের ভালোবাসার মেলবন্ধন। এর ফলে তৈরি হলো সম্পর্কের নতুন দিগন্ত।

বিজ্ঞাপন

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ বরাবরই পিছনের সারির একটি দল। কিন্তু সমর্থনের দিক দিয়ে বিশ্বের একদম সামনের কাতারের দেশ। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায়ও এদেশে বিশ্বকাপ উত্তেজনা সবসময়ই বেশি থাকে। বাংলাদেশে মুলত ম্যারাডোনাকে ঘিরে আর্জেন্টিনার সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। ১৯৮৬ সালের ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার আকাশছোঁয়া সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হতে থাকে। ম্যারাডোনা যুগের পর বেশ কয়েক বছর আর্জেন্টিনার তেমন কোনো সাফল্য না থাকলেও সমর্থন একটুও ভাটা পড়েনি। তারপর মেসি যুগ শুরু হলে সমর্থন তরতর করে বাড়তে থাকে। মেসিকে ঘিরেই আর্জেন্টাইন সমর্থকরা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন বুনতে থাকে। ২০২২ সালের আগে মাত্র দুবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০১৪ সালে মেসির হাত ধরে ফাইনালে উঠলেও চ্যাম্পিয়ন ট্রফি স্পর্শ করা হয়নি। এবার সেই মেসির হাত ধরে আক্ষেপ দূর করল আর্জেন্টিনা।

ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের বাংলাদেশের মতো এত উন্মাদনা বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। বিশ্বকাপ এলেই রং-বেরঙের পতাকায় ছেয়ে যায় পুরো দেশ। নিজ দলের জার্সি ও পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে সমর্থকরা, জড়িয়ে পড়ে বাকযুদ্ধে। কোথাও কোথাও সেটা মারামারির পর্যায়েও চলে যায়। বিশ্বকাপ আসলেই বাংলা ভাগের মতো ল্যাটিন আমেরিকার দুই দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়। এমনকি একই পরিবারের মধ্যেও খেলাকে কেন্দ্র করে দুইদলের সমর্থক পাওয়া যায়। একসময় আবাহনী ও মোহামেডানের একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে ভাগ হয়ে যেত পুরো দেশ। তখনও বাড়িতে বাড়িতে দু’দলের পতাকা উড়ত। দুই দলের সমর্থকদের ঝগড়াঝাটি এমনকি মারামারির মতো ঘটনাও ঘটত। দেশের ফুটবলের সোনালী অধ্যায় আজ অতীত। ঘরোয়া লীগের ফুটবল নিয়ে সেই উন্মাদনা আর নেই। কিন্তু ফুটবল পাগল বাঙালির উন্মাদনা তো আর থেমে থাকতে পারে না। তাই বিশ্বকাপ আসলেই নিজ নিজ দলের পক্ষে উন্মাদনায় মেতে উঠে পুরো বাংলাদেশ।

২০২২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর ক্রীড়ামোদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ এবং আমার পক্ষ থেকে, আর্জেন্টিনার ফুটবলের দুর্দান্ত জয়ে আপনাকে ও আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণকে এবং ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপজয়ী দলকে আন্তরিক অভিনন্দন। এ অভিনন্দন জানাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনার জাতীয় ফুটবল দলের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রশংসা ও ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিনন্দন বার্তার জবাবে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো চিঠিতে লিখেন, ‘২০২৩ সালে ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে দু-দেশের জনগণ ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হবে। দক্ষিণ আমেরিকায় বাংলাদেশের বানিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সয়াবিন উৎপাদক দেশ আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন তেল আমদানি সহজতর হবে।’ আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট যে কথা দিয়েছিলেন তিনি মাত্র তিন মাসের মধ্যে দূতাবাস স্থাপন করে তার কথা রেখেছেন। এজন্যই দূতাবাস উদ্বোধন করে আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র ও বানিজ্যমন্ত্রী সান্তিয়াগো আন্দ্রেস ক্যাফিয়েরো অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আর্জেন্টাইনদের ভালোবাসা আছে। যে কারণে আজ এখানে দূতাবাস খোলা হল। এর ফলে খেলাধুলা, ফুটবল, সাংস্কৃতিক সবদিক থেকে উন্নতি হবে। দুই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি পাবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৭৪ সালে আর্জেন্টিনার কূটনৈতিক মিশন চালু হয়। তবে তা ১৯৭৮ সালেই বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে দেশটি দিল্লির আর্জেন্টিনা দূতাবাস থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে আসছিল। আর বাংলাদেশও ১৯৯২ সালে সরকারি ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে আর্জেন্টিনার বাংলাদেশ দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। এতদিন বাংলাদেশ তাদের ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়ায় অবস্থিত দূতাবাসের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এসব কারণে বাংলাদেশের জনগণ কিংবা ব্যবসায়ী কারোরই আর্জেন্টিনা সফর সহজসাধ্য ছিল না। কূটনৈতিক মিশন চালুর ফলে দু-দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি ছাড়াও ব্যবসা বানিজ্যের দরজা খুলে যাবে।

ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশকেও খাদ্য পন্য আমদানি ও দেশী পন্য রপ্তানির জন্য বিকল্প বাজার খুঁজতে হচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোষাক ছাড়াও জাহাজ শিল্প, ঔষধ, মেলামাইন ও সিরামিকের বেশ কদর রয়েছে আর্জেন্টিনায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা থেকে আরো বেশি সয়াবিন, ভুট্টা, গম আমদানির সুযোগ রয়েছে। ২০২১ সালে আর্জেন্টিনা থেকে বাংলাদেশ ৮৭ কোটি ৬০ কোটি ডলারের পন্য আমদানি করেছে, পক্ষান্তরে রপ্তানি করেছে মাত্র ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পন্য। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এই বিপুল বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হবে।

ল্যাটিন আমেরিকার দুইটি দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের বিপুলসংখ্যক সমর্থক বাংলাদেশে রয়েছে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিলের সরকার এ দেশে তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে বিপুল সমর্থনের কথা প্রথম জানতে পারে। পরে ব্রাজিলের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক এ দেশে এসে ফুটবল সমর্থকদের উন্মাদনা নিয়ে বেশ কিছু সংবাদ প্রচার করে। এরপর ব্রাজিলের সাধারণ জনগণও বাংলাদেশের সমর্থকদের কথা জানতে পারে। আর এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জনগণ তাদের সমর্থকদের কথা জানতে পেরেছে। এই দুইটি দলের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসা অতি প্রবল। আর্জেন্টিনার সাধারণ জনগণও বাংলাদেশের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিদান দিতে উদগ্রীব হয়ে আছে। আর্জেন্টিনার জনগণ ক্রিকেট সচেতন না হলেও ওয়ানডে সিরিজে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে, বুয়েন্স আয়ার্সে উড়েছে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সমর্থন দিতে তৈরি হয়েছে সমর্থক গোষ্ঠী।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে দুরত্ব ১৭ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু ফুটবলের কল্যাণে এই দুরত্ব কখনোই এতটা মনে হয়নি। সমর্থকদের কাছে মনে হয়েছে যেন নিজেরই দেশ। দু-দেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক গভীর বন্ধুত্ব। এটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ চালু করতে পারে ফুটবল কূটনীতি। বাংলাদেশী পন্যে আর্জেন্টিনার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে দেশটি হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন