বিজ্ঞাপন

প্রবাসে লাশ, প্রশ্ন করলে আরও বিপদ

March 3, 2023 | 12:49 pm

মোস্তফা কামাল

লাশ কোথাও থেকে আসে না, আসতে পারে না। লাশ জড় বলে তাকে আনতে হয়। দেশে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ প্রবাসীর লাশ আনা হচ্ছেখবরটি বিশ্বাস করা কষ্টের। তথ্যটি গণমাধ্যমের নয়, আবার এর সোর্সও যেনতেন নয়। স্বয়ং মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানই সোর্স। তথ্যটি দিয়ে তিনি কয়েকটি প্রশ্নও ছুঁড়েছেন। রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় কয়েকটি প্রশ্নসহ ‘দেশে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ প্রবাসীর লাশ আনার’ পিলে চমকানো তথ্যটি দেন মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ।

বিজ্ঞাপন

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের বরাতে পাওয়া খবরটি কেবল ভুক্তভোগী নন, যে কারো জন্যই বেদনার। এর চেয়েও জঘন্য হচ্ছে, প্রবাসে এসব মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলা হচ্ছে না। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক। আলোচনায় উঠে আসে দেশে গত ৫ বছরে ৭১৪ জন বাংলাদেশি অভিবাসী নারীর লাশ এসেছে। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৮ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। তারা তো সুস্থ অবস্থায়ই বিদেশে গিয়েছিলেন। প্রবাসে পাড়ি দিতে তাদের সুস্থ, স্বাভাবিক এবং কঠিন পরিবেশেও কর্মক্ষম মর্মে সনদ নিতে হয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ এ সনদ বাধ্যতামূলক। তেমন কোনো অসুখ থাকলে স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেই বাদ পড়ে যাওয়ার কথা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তো রক্তের বিলোরুবিন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি থাকলেই নাকচ করে দেওয়া হয়। অথচ সেখানে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মরে যান! শুনতেও কেমন শোনায়? খটকায় ভরা ঘটনা। মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের প্রশ্নও এ জায়গাতেই।

প্রবাসে এসব মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ যে নেই, তা নয়। মৃত্যুর সনদে থাকা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ নিয়ে আপত্তি করতে পারেন মারা যাওয়া শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা। অভিযোগ জানানোর জায়গাটি হচ্ছে, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিতে এ সংক্রান্ত ডেস্কও আছে। কিন্তু, সেখানে প্রবাসে শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ নিয়ে পরিবারের সন্দেহ, তদন্ত দাবি বা কোনো অভিযোগ জানানোর নজির নেই। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর স্বজনরা যতো দ্রুত সম্ভব লাশ ফেরত পেলেই সন্তুষ্ট। বিদেশে মারা যাওয়া শ্রমিকের লাশ দেশে আনার কাজটিও হয় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে। লাশ দাফনের জন্য তারা বিমানবন্দরে পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা দেয়। পরে দেয় ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান।

জনশক্তি রপ্তানি আমাদের বিশাল খাত। এর সুবাদে দেশের অর্থনীতি প্রাণশক্তি পাচ্ছে। এ সেক্টরে বিশাল ব্যবসা ও কর্মসংস্থান। বনেদি ব্যবসায়ীদের ভালো রোজগারের সুযোগ এ খাতে। ফড়িয়া বা দালাল গোছের ব্যবসায়ীরাও বহু টাকা হাতান। মানুষকে ভোগান, এক সময় নিজেরাও ভুগতেভুগতে চরম পরিণতি ভোগ করেন। বেশিরভাগ উদাহরণ এমনই। সরকারের দিক থেকে প্রবাসীদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য রয়েছে প্রণোদনা, সুযোগসুবিধার কিছু প্রকল্পও। আবার প্রতারিত না হয়ে বুঝেশুনে বিদেশ যাওয়ার অবিরাম পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে এ আহ্বান ও পরামর্শ না শোনার প্রবণতা বিদ্যমান। কোনোমতে, পার করে দেওয়ার আবদার নিয়ে তারা নানান জায়গায় ধর্না দেন। এর সুযোগ নেয় আদম ব্যবসায়ী নামে পরিচিত কিছু লোক। তারা আদম পাঠান, প্রেরিতদের কিছু কিছু নানাভাবে মৃত্যুর শিকার হন। লাশ আর ক্ষতিপূরণের টাকা গোনাই হয়ে যায় তখন মুল কাজ।

বিজ্ঞাপন

কথিত এসব ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’কেও যেন ‘স্বাভাবিক’ ভাবতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারা। কোনো কোনো দেশ থেকে লাশ আনতে যে ৬৭ মাস বা বছরখানেকও লেগে যাচ্ছে, তা ভাবার ফুসরত থাকে না। তার উপর লাশ বুঝে নিতে বিমানবন্দরে কঠিন দুর্গতি তো রয়েছেই। সম্মান দেখাতে ‘রেমিটেন্স যোদ্ধা’সহ বিশেষায়িত নানা নামে সম্বোধন করা হয় প্রবাসীদের। দেশের কোথাও কোথাও সেই সামাজিক সম্মান তাদের আছে। অনেকের ধারণা, বিদেশে অবৈধভাবে গিয়েও যে অর্থ আসে তা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু আসলে তা কতোটা অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, এ নিয়ে কথা থেকে যায়। এছাড়া, মানবপাচার বিষয়ে সচেতনতা এবং পরিণতি সম্পর্কে জানার বিষয় আছে। বাংলাদেশ যে আর্থসামাজিক পর্যায়ে আছে, সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে সাগরপর্বত, মরুভূমি পেরিয়ে কোনো দেশে অভিবাসী হওয়া খুব জরুরি? মধ্যপ্রাচ্য বা কোনো দেশে সুইপার, গৃহপরিচারক ধরনের ক্রীতদাস হওয়া না সম্মানের, না ঝুঁকিহীন।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা বা আসা লাশের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে লাশের সঙ্গে মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সনদে মৃত্যুর কারণ লেখা থাকে ‘স্বাভাবিক’। গত বছর কয়েক ধরে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লেখা সনদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হওয়া এসব নারী শ্রমিকের বেশির ভাগের বয়স ৪০ বছরের কম। উড়োজাহাজে তুলে দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত তারা দেশটির কোথায় এবং কী কাজে যুক্ত হন, সে বিষয়ে বাংলাদেশের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ দূতাবাসের কাছে এলে অথবা ভুক্তভোগী নারীদের স্বজনেরা কোনো অভিযোগ করলেই শুধু সরকার এসংক্রান্ত তথ্য জানতে পারে। পরিবারের সদস্যসহ অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা এই ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ কতটা স্বাভাবিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কোথাও অভিযোগ করা বা প্রতিকার চাওয়ার ঘটনা নেই। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০২০ থেকে ২০২২ সালের তথ্য বলছে, এই তিন বছরে ৪০৪ জন নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। তাদের ২২৭ জনেরই ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লেখা ছিল। কিছু কিছু লাশে আত্মহত্যাও লেখা থাকে।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটরামরু এ নিয়ে কিছু কাজ করেছে। তাদের ‘ডেথ অব ফিমেল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শীর্ষক গবেষণার প্রতিবেদনে সনদে থাকা মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রবাসে প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের তাগিদ দিয়েছে তারা। বলেছে, দূতাবাসগুলোকে শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। বাস্তবটা সে রকম নয়। এ সামর্থ্য নেই বাংলাদেশের। লাশ আসার পর তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশকে শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে আপত্তি জানানো এতো সহজ নয়। ওই দেশে থাকা অবস্থায়ও জোর গলায় কিছু বলা বা প্রশ্ন তোলার হিম্মত যাতা বিষয় নয়। সেই চেষ্টা করলেও চ্যালেঞ্জে পড়ে যাবে শ্রমবাজার।

বিজ্ঞাপন

লেখক: সাংবাদিককলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন