বিজ্ঞাপন

প্রথম আলোর ছবি বিতর্ক এবং আমাদের রাজনীতি

April 2, 2023 | 4:55 pm

ওসমান এহতেসাম

গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর একটি ছবি বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই ছবিকে কেন্দ্র করে হচ্ছে বহুমুখী রাজনীতি। কেউ কেউ মনে করছেন প্রথম আলো এটি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ছাপিয়েছেন। প্রথম আলো চাল-ডালের রাজনীতি করতে চায়। প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক ফটো তুলতে ঐ শিশুকে কেন ১০ টাকা দিলেন, এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। তাদের মতে ঐ সাংবাদিক অসৎ উদ্দেশ্যে এই টাকাটা দিয়েছে। টকশোতে অনেক গুণীজনকেই দেখলাম গলা ফাটাতে। এই ১০ টাকা দেওয়াকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলতে পারে, কিন্তু আমি বলব-তা বলার পিছনে তাদের উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বহুল প্রচারিত টিভি চ্যানেল ৭১ টিভি একটি সংবাদ প্রচার করেছে। সংবাদের উপস্থাপনাও বরাবরের মতোই দারুণ। সংবাদে তারা একটি নতুন তথ্য নিয়ে আসলেন, ছেলেটির নাম জাকির হোসেন নয় সবুজ। সবুজ তার মায়ের সাথে ফুল বিক্রি করে। এ বছর সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। সবুজ চাল-ডালের রাজনীতি বোঝে না।

বিজ্ঞাপন

এখন ৭১ টিভির সূত্র ধরে আলোচনা করা যাক। প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সবুজের কি কাজ করার বয়স হয়েছে? নিশ্চয় হয়নি, তাহলে কাজ করছে কেন-এমন প্রশ্ন করলে অযৌক্তিক হবে না। আমি মনে করি, তার কাজ করার পিছনে দুইটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সংসারের অভাব অনটন, নয়তো পরিবারের অবহেলা বা অর্থ লোভ। তবে আমি অর্থ লোভকে গ্রহণ করতে পারছি না। কেননা বাংলাদের মায়েরা তার সন্তানের প্রতি খুবই যত্নবান। আর এই সবুজ যখন ফুল বিক্রি করছে তখন প্রথম আলোর ঐ ফটো সাংবাদিকও আমার মতো ভাবতেই পারে। আমার মতো তারও এই শিশুশ্রম দেখে মায়া জাগতে পারে। আমার মতো ভেবেই হয়তো তার হাতে ১০টা টাকা দিয়েছে। এতে দোষের কি হল! বরং তিনি তার উদার কাজের জন্য আমাদের করতালি পেতে পারতেন। কিন্তু আমরা তা করিনি, করেছি নোংরা রাজনীতি। স্বচ্ছ সাংবাদিকতাকে বানিয়ে দিয়েছি অপসাংবাদিতা হিসেবে। এটি লজ্জার।

টিভিতে দেখলাম, কেউ কেউ টকশো মাতিয়েছেন স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতার মর্মবাণীকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক অপচেষ্টা ছিল কিনা। এক জেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম তো বলেই ফেললেন, এটিকে সরল করে দেখার সুযোগ নেই। এটি একটি অপরাধ! তবে কোন সাংবাদিক বা পাঠক হয়তো এমন বক্তব্যে সহমত পোষণ করবেন না। আমার মনে হয়, যারাই এমন প্রশ্ন তুলছেন, তারা তো সাংবাদিক নয়-ই, ভালো পাঠকও নয়। তাই তাদের ক্যাপশন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে জানা নেই। বিশেষ করে যারা নিউজ রুমে কাজ করেন, বিষয়টি তারাই ভালো বুঝতে পারবেন।

এবার আসুন, এই বিতর্কের সৃষ্টি করল যে ক্যাপশন, এবার তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। বোঝার সুবিধার্থে নিবন্ধনে হুবুহু ক্যাপশনটি তুলে ধরতে চাই। ক্যাপশনটি ছিলো এমন- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কি করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো’ … জাকির হোসেন, দিন মজুর, সাভার

বিজ্ঞাপন

৭১ টিভি সংবাদ প্রচার করেছে ছেলেটির নাম নিয়ে প্রথম আলো নাকি মিথ্যাচার করেছে। ছেলেটির নাম জাকির হোসেন নয়, সবুজ। আমার প্রশ্ন, প্রথম আলো কোথায় বলল, ছেলেটির নাম জাকির হোসেন? অনেকের মন্তব্য স্কুল পড়ুয়া ছেলেটিকে দিন মজুর বানিয়েছে প্রথম আলো। তাও জানতে চাই, কোথায়, আর কখন বলা হলো? প্রথম আলো তাদের ক্যাপশনে উল্লেখ করেছে জাকির হোসেন, দিন মজুর। আপনারাই বলুন, এই শিশুকে কি দিন মজুর বলা যাবে? নিশ্চয়ই যাবে না। গভীর চিন্তা থেকে আসা উদ্ধৃতিটি এই শিশুর, আপনি কি তাই ভাবেন। যদি উত্তর না হয়, তাহলে এই ক্যাপশনটিও এই শিশুর নয়। ক্যাপশনটি জাকির হোসেন নামের এক দিন মজুরের। যা প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছেন। তাহলে জানার আগ্রহ বাড়বে, এই ছবির সাথে ক্যাপশনটি তো যায়না, দেওয়া হল কেন। শিশুর পরিবর্তে জাকির হোসেনের ছবি তো দেওয়া যেত। আমি বলব, আপনি সঠিক বলেছেন। তবে তা প্রকাশ করার পেছনে প্রথম আলোর দুইটি যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। এটি আমার একান্ত চিন্তা ও মতামত। যা প্রথম আলোর ভাবনার সাথে মিলতেও পারে।

২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাইরাল হওয়া খবরের ছবিটি ছিলো, ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাড়িয়ে ছিল এক শিশু। তাহলে কি বোঝা যায়? বোঝা যায়, ছেলেটির দেশ প্রেম। সে যখন দেখছে লোকজন ফুল নিয়ে স্মৃতিসৌধে যাচ্ছে, তখন তারও ইচ্ছে হতে পারে। সে ছোট বলে হয়তো যাওয়ার সাহস পায়নি। তাই জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাড়িয়ে ছিল শ্রদ্ধা জানাতে। এমনটি হতে পারে, অসম্ভব কিছু নয়। তাহলে আপনাদের আরও জানতে মন চাইবে, শ্রদ্ধার কথা লিখলে তো ভালো কথা, তাহলে চাল-ডালের স্বাধীনতা কেন চাওয়া হলো। প্রথমত, তিনি হয়তো এটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন, যে দেশের প্রতি মানুষের এত দেশ প্রেম, সে দেশে চাল-ডালের দাম সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। অর্থাৎ একদিকে মানুষের দেশ প্রেম অন্যদিকে সিন্ডিকেট। একটি সংবাদে দুইটি চিত্র তুলে ধরতেই হয়তো তিনি এমনটি করেছেন। আর নয়তো তিনি ভুল বশত এমনটি করেছেন। আর ভুল বশত যদি এমনটি করেও থাকেন, তাহলে তা ক্ষমা যোগ্য। কেননা ভুল কেবল মানুষই করে, পশু-পাখি কখনো ভুল করে না। কোনো মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে একে যদি জাল পরানো বাসন্তীর ছবির মতোই চক্রান্ত বলা হয়, তবে তা আমি ও আমরা মানতে পারি না। কেননা এ সংবাদটি রাষ্ট্রের বিপক্ষে যায়নি। সংবাদটি বার্তা দিয়েছে দেশের শক্তিশালী চলমান সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। যারা একটা চক্রান্তের মাধ্যমে দেশের দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি ঘটিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায়। দিনমজুর জাকির হোসেন প্রথম আলোকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা মিথ্যা ও বানোয়াট বলার কোন সুযোগ নেই। এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত বলারও সুযোগ নেই। জাকির হোসেন বলেছেন, সাংবাদিক লিখেছেন। এর বেশি কিছু তো নয়।

আচ্ছা যদি এই শিশুর পরিবর্তে জাকির হোসেনের ছবি বসানো হতো, তবুও কি রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র বলা হতো, নাকি বিতর্ক করা যেত। ষড়যন্ত্রের মনোভাব পোষণ করলে তিনি জাকির হোসেনের ছবি দিয়েই করতে পারতেন। তাতে কি কেউ বাঁধা দিতে পারতেন? গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা ভেবে অন্তত বাঁধা দেওয়া যেত না। এখন আপনারা বলুন, দেশ বিরোধীতার নামে আপনারা যারা প্রথম আলোর বিরোধীতা করছেন, আপনারা কেমন দেশ প্রেমিক? আপনারাই তো দেশ প্রেমের তজবি জপে দেশের ক্ষতি করছেন। লাগামহীন করেছেন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। যেখানে দেশের রাষ্ট্রপতি বলছেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরী। তাহলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে লিখলে অপরাধ হবে কেন? আমজনতার চেয়ে সিন্ডিকেটের অর্থনৈতিক শক্তি অনেক বেশি। আপনারাই একটা কাজ করুন। এমন একটা আইন পাস করুন, যেখানে উল্লেখ থাকবে- দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও দেশের অভাব-অনটনের কথা লেখা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে যেসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে নেই যৌক্তিক কোনো কারণ। কোনো কারণ ছাড়াই তরতর করে শুধুই বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। আজ এক দামে কোনো একটি পণ্য কিনে নিয়ে গেলে পরদিন দেখা যায় সেই পণ্যের দাম কেজিতে বেড়ে গেছে কয়েক টাকা। এ বিষয়ে দোকানির সহজ ও সেই কমন যুক্তি- চাহিদার চেয়ে পণ্যের জোগান কম। শুধু তাই নয়, পাইকারি বাজারের সঙ্গে নেই খুচরা মূল্যের সামঞ্জস্যও। অথচ দুঃখের বিষয় বাজার থেকে সাধারণ ক্রেতা যে দামে পণ্য কিনছেন, উৎপাদক সেই দাম কল্পনাও করতে পারেন না। এর সুফল নিচ্ছেন এক শ্রেণির প্রতারক মধ্যস্বত্বভোগীরা। যারা সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করছেন, জিম্মি করছে কৃষকদেরও। এমন অবস্থায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে দিনমজুরদের। তাই তো রাগে আর ক্ষোভে দিনমজুর জাকির হোসেন উক্তিটি করেছেন, ‘আমরা চাল-ডালের স্বাধীনতা চাই।’

সাংবাদিক যে সংবাদটি প্রকাশ করেছেন, তা তার নিজের বক্তব্য নয়। বক্তব্যটি সাধারণ মানুষের। এই সংবাদটি প্রকাশ করে তিনি সচেতন করেছেন আমজনতাকে। সচেতন করেছেন বাংলাদেশ সরকারকে। এই সংবাদটি বাংলাদেশ সরকারের বিপক্ষে নয়, বরং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে। আমি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, প্রথম আলোর এই সাভার প্রতিনিধি সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি সরকারের কাছে বিনীত প্রার্থনা করব, এই সাংবাদিক দেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাকে ফুলের মালা দিয়ে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। পরিশেষে বলব, বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব হোক উন্নয়নের নেতৃত্ব।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন