বিজ্ঞাপন

ভূয়া খবরের বাস্তুতন্ত্র : ১৯৭৪ থেকে ২০২৩

April 6, 2023 | 3:55 pm

অরুণ কুমার গোস্বামী

‘ফেক নিউজ ইকোসিস্টেম’ বা ‘ভূয়া খবরের বাস্তুতন্ত্র’ ২০২৩-এ আবার তাৎপর্যপূর্ণভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অভিজ্ঞ মহলের অভিমত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে, ঠিক তখনই ভূয়া খবরের এই ইকোসিস্টেম রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে মানুষের চেতনাকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই ‘ভূয়া খবর’ এর সংক্রমণ দেখা যায়। এটি এমন একটি সংক্রমণ যে এর কারণে ‘ভুয়া খবরের ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র’ সম্পর্কিত ন্যারেটিভের উদ্ভব ঘটেছে। বাংলাদেশে ভূয়া খবরের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম অব ফেক নিউজ এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে দেশের একটি বাংলা সংবাদপত্রে পরিবেশিত একটি ‘ভূয়া খবর’।

বিজ্ঞাপন

ভূয়া খবর নিজগুণেই বিভ্রান্তিকর! বাংলাদেশে ‘ভূয়া খবরের এই ইকোসিস্টেমের’ যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সাল থেকেই। রক্তের সাগর পেরিয়ে সদ্য স্বাধীন এই দেশটি যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সফলতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল ঠিক তখনই কুড়িগ্রামের বধির-নিঃশব্দ বাসন্তী বালাকে মাছের জাল পরিয়ে সংবাদপত্রে ছবি ছাপানো হয়েছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির অপতৎপরতায় অস্থির, অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে জর্জরিত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল। বাসন্তী বালার ছবি যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল তারাও এটিই চেয়েছিল!

১৯৭৪ সালের পর ৪৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে। নদীর অনেক জল সাগরে প্রবহিত হয়েছে। কিন্তু ভূয়া খবরের ইকোসিস্টেম অটুটই রয়ে গেছে। বাংলাদেশে ভূয়া খবরের ইকোসিস্টেমের বিভিন্ন গোষ্ঠীর পক্ষে আছে প্রচুর ব্যাখ্যা ও যুক্তি। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের মূহুর্তে জন্মদিন পালন সংক্রান্ত ভূয়া ও ক্ষতিকর চেতনা লালনের পক্ষে যুক্তি; দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের পক্ষে বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করার নিষ্ঠুর যুক্তি; ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ভিক্টিমরা নিজেরাই ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে যাওয়ার ভূয়া খবর প্রচারের পক্ষে যুক্তি; বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি আইন পাস করার পক্ষে যুক্তি; এই খুনীদের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টি গঠনের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ যুক্তি; বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে খুনীদের চাকুরী দেওয়ার পক্ষে রাষ্ট্রবিরোধী যুক্তি এবং এমন আরও অনেক বাংলাদেশবিরোধী কর্মকান্ডের পক্ষে বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপনের যুক্তি ও ব্যাখ্যা বাংলাদেশে ভূয়া খবরের ইকোসিস্টেমের কর্তাব্যক্তিরা করে থাকেন।

২০২৩ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছিল। গৌরবের বর্তমানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ স্মরণ করছে আজ থেকে ৫৩ বছর আগের পরিস্থিতির কথা। ৫৩ বছর আগে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং তারপর থেকে, এটি যে উন্নয়নমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, এটি যে জিডিপি স্তরে পৌঁছেছে, এটি যে অর্থনৈতিক সূচকগুলি উন্নত করেছে, এটি যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি করেছে, এটি যে দারিদ্র্য বিমোচন করেছে এবং এর যে প্রগতিশীল রূপান্তর ঘটেছে, সবই প্রশংসনীয়। প্রকৃতপক্ষে, খুব কম মানুষই ৫৩ বছর আগে কল্পনা করতে পেরেছিল যে, মাত্র ৫৩ বছরের অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই পর্যায়ে পৌঁছাবে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অত্যন্ত ঘন জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি, শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব, চরম দারিদ্র্য এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার মতো সব বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ক্রমাগত যুদ্ধ করেছে এবং বিজয়ী হয়েছে যা অন্য কোনো জাতিকে স্থায়ীভাবে বা অন্ততপক্ষে কিছু সময়ের জন্য পঙ্গু করে দিতে পারে। বাংলাদেশ শুধু সব বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি বরং এখন বৈশ্বিক পরিমন্ডলে এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে এটি অন্যান্য অনেক অনুরূপ বা তুলনাযোগ্য দেশগুলির জন্য একটি ইতিবাচক উদাহরণ হয়ে উঠেছে যারা বাংলাদেশের সাফল্যকে অনুকরণ করার আশা করছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেলকে এমনকি পাকিস্তানও অনুকরণ করতে আগ্রহী।

বিজ্ঞাপন

সর্বোপরি লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও পরিচর্যা করতে থাকা বাংলাদেশ একটি সদয় জাতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে। এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ এবং এর প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া চরম সংকটে পড়তে পারত। বাংলাদেশের এই মর্যাদাকর অবস্থাকে কলঙ্কিত করার জন্যই প্রথম আলো এই সংবাদটি প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর উর্ধ্বগতির ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের ভিত্তি হচ্ছে প্রায়ই এ ধরনের ভূয়া সংবাদ পরিবেশন করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসন্তুষ্ট একটি পক্ষ যে প্রতিপক্ষের উপর ক্ষিপ্ত তাদের সম্পর্কে উত্তেজনাকর অথচ ‘ভূয়া খবর’ পরিবেশন করা। এভাবে পত্রিকাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে থাকে। অপর একপক্ষকে সন্তুষ্ট করে মিথ্যা তথ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অনেক মুনাফাও আছে। যারা মিথ্যা তথ্য তৈরি করে এবং যে প্ল্যাটফর্ম সমর্থনে জড়িত তাদের সুবিধাগুলি অনেক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নির ক্ষেত্রী এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেফ্রি ভোয়াস (২০১৭) যৌথভাবে লিখেছেন ‘দ্যা ইকোনোমিক্স অব ফেক নিউজ’ শীর্ষক একটি গবেষণা নিবন্ধ। ইংরেজি এই শিরোনামটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ভূয়া সংবাদের অর্থনীতি’। এই গবেষণা নিবন্ধে লেখকদ্বয় বলছেন, ‘বিভ্রান্তিকর সংবাদের স্রষ্টা, ভোক্তা এবং মধ্যস্থতাকারীরা একে অপরের উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আর এর দ্বারা ভূয়া খবরের ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র সৃষ্টি হয়।’

একটি শিশুকে ১০ টাকা ঘুষ দিয়ে স্বাধীনতা দিবসে একটি মিথ্যা খবর তৈরি করে তা পরিবেশন করা নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু বুদ্ধির পরিচয় বহন করে না। প্রশ্ন হচ্ছে প্রথম শ্রেণিতে পড়া একটা শিশুকে এভাবে ব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চাওয়া অনৈতিক ও গর্হিত হিসাবে আখ্যায়িত করা সমীচিন নয় কি? জঘন্য এই অপরাধ যারা করেছে তাদেরকে গ্রেফতার করলে কিছু কিছু বিদেশি ঝাঁপ দিয়ে পড়ে কেন? যেসব দেশ বিবৃতি দিয়েছে সেসব দেশে কোন একটা শিশুকে যদি এভাবে এক্সপ্লয়েট করা হতো তাহলে তারা কি করত? আর বাংলাদেশে কি ব্যবস্থা নেওয়া সমীচিন?

বিজ্ঞাপন

সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর মিডিয়িা, ডাটা এন্ড সোসাইটির ফেলো আন্ড্রেই রেক্টর(২০১৯) ‘ফেক নিউজ এন্ড ফ্রিডম অব দ্যা মিডিয়া’ শীর্ষক এক গবেষণা নিবন্ধে ‘ফেক নিউজ’ বা ‘ভুয়া খবর’ রোধ করার লক্ষ্যে যে সিদ্ধান্তগুলি রয়েছে তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মিডিয়ার স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করেছেন।

সাম্প্রতিককালে ‘ভূয়া খবর’ ধারণাটি আন্তঃসরকারি নীতি এবং প্রবিধানে দুর্দান্ত গতি অর্জন করেছে। একই সাথে ভূয়া খবরের পিছনের ঘটনাগুলিকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সে সম্পর্কে কোনও সাধারণ পদ্ধতি এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে ‘ভূয়া সংবাদ’ হল ‘মিথ্যা তথ্য’ প্রচার করার পুরানো মিডিয়া অনুশীলন যা ১৯৩০ এর দশকে লীগ অফ নেশনস দ্বারা কিছুটা মোকাবিলা করা হয়েছিল।

ভুয়া খবর অনাবৃত করার লক্ষ্যে ইউক্রেনের একদল তরুণ ‘স্টপফেক নিউজ’ নামে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করা শুরু করেছেন। কিয়েভ মহিলা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং শিক্ষার্থীরা মিলে ‘স্টপফেক নিউজ’ গড়ে তুলেছেন। ‘স্টপফেক নিউজ’ নিজেকে জনসেবামূলক সাংবাদিকতা প্রদানের জন্য একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করছে। ২২ জুলাই ২০১৭ থেকে, ‘স্টপফেক নিউজ’ এর কর্মীরা রাশিয়া থেকে ইউক্রেন সম্পর্কে বিভ্রান্তি এবং ভুল তথ্যের একটি সাপ্তাহিক ওভারভিউ তৈরি কওে প্রকাশ করে। এবং তা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয় এবং কিয়েভ পোস্ট অনুষ্ঠানটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে।

জাতিসংঘ ১৯৫০ সালে ফ্রিডম অব ইনফরমেশন শীর্ষক সংকলিত গ্রন্থে ‘মের্জাস টু কাউন্টারঅ্যাক্ট ফলস ইনফরমেশন’ প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টারি রিসার্চ সার্ভিসেস কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে নাজা বেন্টজেনের ‘ফেক নিউজ এন্ড দ্যা ইইউ’স রেসপন্স’ এমন আরও অনেক গবেষণাকর্ম ইতোমধ্যেই ‘ভূয়া খবর’ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে করা হয়েছে। তবে, ভূয়া খবরের প্রতিরোধে করণীয় বিষয়টি এখনও গবেষণা পর্যায়েই আছে, চূড়ান্ত হয়নি। ভূয়া খবরের প্রতিরোধে সর্বজনগ্রাহ্য করণীয় নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত এর যারা ভিক্টিম তারা স্ব স্ব দেশের প্রচলিত আইন, রীতি-নীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটিই স্বাভাবিক। তবে, খবর ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ভূয়া খবরের ইকোসিস্টেমের ক্ষতিকর তৎপরতা থেকে রক্ষা পাওয়া এখন জনপ্রিয় চাহিদায় পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা। ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থের লেখক, সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন