বিজ্ঞাপন

মিলটন রহমানের অণুগল্প ‘মাটি’

April 20, 2023 | 9:00 am

মিলটন রহমান

প্রায়ই এমন হয়। মধ্যরাতে পুরো ঘর আলো-অন্ধকারে বারোয়ারী তানের মতো বাজে। অনেকগুলো মুখ, অনেকগুলো কন্ঠ মৃদু থেকে মৃদুতর হতে হতে মিলিয়ে যায়। কেবল একটি কন্ঠ কানে প্রবেশ করে মগজে থির বসে থাকে। বহুদিনের পরিচিত সেই কন্ঠ। মাটি ছেড়ে আসার সময় এই কন্ঠইতো, হ্যাঁ এ কন্ঠইতো হাতে এক পুটলি মাটি হাতে দিয়ে বলেছিলেন, যত্নে রাখিস। এ তোর জন্মভিটের মাটি। বড় পবিত্র। বাবা, সেই মাটি হাতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, আমার সাথে তোর আর দেখা না হলেও, এ মাটির দিকে তাকাবি। দেখবি তোর আর মন খারাপ হবে না। পৃথিবীর কোনও মাটি এর চেয়ে মনোহর নয়। যখনই তাকাবি দেখবি কতকিছু ঘিরে আছে তোকে!

বিজ্ঞাপন

সত্যিইতো এই মুহুর্তে পুরো ঘরে নড়েচড়ে বসার ঠাঁই নেই। ভাসা এক ধ্যানে বাজাচ্ছে মুরালীতে। নাচছে মন্দোদরী। বাড়ির পুকুর ঘাট ঘেষা বড় আম গাছের গুঁড়িতে সহস্র বছর মন্দোদরীর বাস। রামলাল হাজারীর বউ লক্ষীদেবি মাটি ছেড়ে যাওয়ার সময় আমার দাদি তমিজা বেগমের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মন্দোদরীকে। দাদি তাকে রেখে গেছেন আমার মা-বাবার হাতে। আমার হাতে বাবার তুলে দেওয়া সেই মাটির সাথে মন্দোদরী এখন বিলেতের বাসিন্দা। আমি কি কখনও দেখেছি তাকে? দেখেছি তো। এই যে দেখছি এখন।

এই মুহুর্তে আমি কোথায় আছি তা বলা মুস্কিল। নিজের ঘরেই তো ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তা কোনও ঘর নয়। গভীর বনের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছি। চতুর্দিকে তীরের ফলার মতো ছুটছে আলোর বাজি। একটা বিশাল ডানা সদৃশ পাখি ঘূর্ণির মতো বন কাঁপিয়ে নেমে এল। আমাকে ও মন্দোদরীকে ডানায় তুলে এক টানে উঠে গেল মধ্য আকাশে। মধ্যরাতে পুরো আকাশ জুড়ে আছে বিভিন্ন রঙ ও আকৃতির তারা। কোথাও কোথাও একটি আলোর রেখা নেমে গেছে মাটির দিকে। নেমে যেতে যেতে আলোর রেখা কথা বলে! কেউ কোথাও যেতে পারে না। যাওয়ার ভান করে। দেহটা যায়। আর কিছু যায় না। মানুষ নিজের সাথে নিজে সারাক্ষণ প্রতারনায় লিপ্ত থাকে। মানুষ বড় মিথ্যুক! মন্দোদরী খিল খিল করে হাসে। তার হাসিতে আবার বেজে ওঠে ভাসানীর বাঁশি। সেই বাঁশির সুরে গড়িয়ে পড়ে হাসি নয়, কান্নার মতো রোনাজারি। কতগুলো নিকষ কালো পাখি গোত্তা মেরে সেই করুণ বাঁশির সুরে পুড়ে যাচ্ছে। তাদের পালক পোড়া গন্ধে পুরো আকাশ ভারি হয়ে ওঠে। একদিন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পাখি শিকার করে ফেরার সময় এমন কতগুলো পাখি দেখেছিলাম। মানুষের মতো কথা বলে। পাখি শিকারের প্রতিবাদে তারা আত্মহত্যা করে। সেই আত্মহননের স্থান হিশেবে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের একটি উঁচু টিলার নাম পাখিবলি। আমরা এখন সেই টিলার উপর উড়ে এসেছি। বিশাল দেহী পাখিটি তার দুটো ডানায় ঢেকে দিয়েছে পাখিবলির স্থান। মন্দোদরী আর আমি শক্ত হাতে ধরে আছি পাখির পালক। কত পাখির প্রতিবাদ দেখলাম এই পাহাড়ে। আমাদের বয়ে আনা পাখিটি এখানে কেনো এল? সে কী আত্মহত্যা করতে চায়? নাকি পাখিবলিতে আমাদের রেখে যেতে চায়। আমরা উড়োজাহাজের মতো পাখিবলিতে অবতরণ করতেই, তীব্র ঝড়ের মতো উড়ে গেল সহস্র পাখি। আমার পা মাটি ছুঁয়েছে। মন্দোদরী ঠিক মাটিতে দাঁড়িয়েছে নাকি শূন্যে ভেসে আছে তা বোঝা যায় না। তবে তার রূপ নিরব এবং শোকের পাহাড়ে আলোর মচ্ছব বইয়ে দিচ্ছে। মন্দোদরীর বয়স হাজারের বেশি! এতো বয়সে এমন মনোহর কোনও নারী কি থাকে! এখানে তোমাকে নিয়ে এসেছি, দেখার জন্য, মানুষগুলো কিভাবে পাখি হয়ে বেঁচে আছে তা দেখাবার জন্য বলেই মন্দোদরী নূপুরের মতো ঝনঝন করে বেজে উঠল। আমি তার কথা বুঝে ওঠার আগেই সম্মুখে এসে দাঁড়ায় রামলাল হাজারী। যে কিনা এক সময় এই তল্লাটের জমিদার ছিলেন। সাতচল্লিশে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাগ হয়ে যাওয়া দেশ, আর পঞ্চাশে জমিদার প্রথা বাতিলের পর এই হাজারী তালুক ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এতোদিন পর কোথা থেকে এলেন তিনি! আমি তাকে এর আগে কখনও দেখিনি। তাহলে এখন দেখামাত্র চিনলাম কি করে! তার দৈহিক আকৃতি কি আমার পরিচিত ছিল? না ছিল না। তার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে শোনা আছে। তাতেই কি আমি চিনে নিলাম? মন্দোদরী আমার ঘোর চিরে অট্টহাসিতে ভাসিয়ে দিলো অন্ধকার। চেনা মানুষকে চিনতে পূর্ব পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না। তুমি এবং তোমরা তাকে চেনো। এই মানুষটি এক সময় বিপুল বিক্রমে এই তল্লাট শাসন করেছিল। মন্দোদরী আমার সূত্রধর। তাকে ছাড়া আমি কখনও আর কোনও নারীর কথা ভাবিনি। আমি বহুবার পালিয়েছি, এই ভেবে, যাকে একেবারে নিজের করে পাওয়া যায় না, তার জন্য অপেক্ষায় থেকে কি লাভ! মন্দোদরী কখনও আমাকে বলেনি অপেক্ষায় থাকতে। এমন একটি নারীর সঙ্গলাভ এক মানব জনমে কি সম্ভব নয়?

বিশালদেহী সেই পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দে আমি যেনো বহুদূর কোনও পথ থেকে এক টানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছি পাখিবলিতে। সবে অন্ধকারের ঘোমটা টেনে আলো মাথা তুলতে শুরু করেছে। নির্ঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি অজস্র পাখির নিথর দেহ পড়ে আছে এখানে সেখানে। কোথাও কোথাও মাটি ফুঁড়ে ধোঁয়া উড়ছে। মনে হচ্ছে কোনও এক পোড়ো জমিতে দাঁড়িয়ে আছি। এটাই কি তোমার জন্মভিটে? এটাই কি তোমার দেশ? এই বিরান ভূমি ছেড়ে পালিয়েছো তুমি! আমি সহস্র বছর তোমাদের বাড়ি ছেড়ে যাইনি। তুমি কিভাবে চলে গেলে! দেখছো তোমার দেশ আজ কিভাবে পাখিবলিতে রূপ নিয়েছে! তুমি কিছুই করলে না। তুমিও খুনের দায় এড়াতে পার না। তুমি প্রচন্ড সুবিধাবাদি প্রতারক।

বিজ্ঞাপন

মন্দোদরী, মন্দোদরী বিশ্বাস করো আমি এসবের কিছুই জানি না। তুমি যেয়ো না মন্দোদরী। আমাকে এই বিষন্ন মাটিতে ফেলে যেয়ো না। ম..ন..দো..দ..রী এ…ই ম..ন..দো..দ..রী, যে..ও না, না.. না..

গলা শুকিয়ে কাঠ। আর ডাকতে পারছিলাম না। ঘুমে ভেঙে কাঠের ওপর হুড়মুড় করে উঠে বসে দেখি, মাটি ছেড়ে আসার সময় বাবার দেওয়া মাটির পুটলি আমার হাতের মুঠোয় লাফাচ্ছে!

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন