বিজ্ঞাপন

বাবা নামের বন্ধুটি

April 21, 2023 | 2:09 pm

রহমান মুস্তাফিজ

আমার বন্ধু। বয়স চার কি পাঁচ বছর। উচ্চতা তিনফুটের কাছাকাছি। গায়ের রঙ প্রায় ফর্সা। গোলগাল মুখ। চোখ দু’টি বড়, টানাটানা। মায়াভরা চোখ বলতে যা বোঝায় ওর চোখ জোড়া ঠিক তা-ই। আমার সাথে তার পরিচয় একটি রেস্টুরেন্টে, হাতিরপুলে।

বিজ্ঞাপন

একদিন সন্ধ্যার পর রেস্টুরেন্টের মালিক রফিক মামার সাথে গল্প করছি আর চা-পুরি খাচ্ছি। এ সময়ই সে রেস্টুরেন্টে ঢোকে। খালি পা। হাফপ্যান্টের জিপারটা নষ্ট। বেল্টের পরিবর্তে এক টুকরো রশি দিয়ে ঢোলা প্যান্টটা আটকে রেখেছে কোমরের সাথে। শার্টের ওপরের বোতামটা নেই। দেখে মনে হচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে এই একটা শার্টই গায়ে দিচ্ছে।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে টেবিলে রাখা জগ থেকে একটা খালি গ্লাসে পানি ঢাললো। একসাথে অনেকটা পানি ঢালতে গিয়ে গ্লাস উপচে টেবিলে পড়ে পানি। পড়বেইতো, টেবিল আর তার উচ্চতা যে প্রায় সমান…! দু’হাতে গ্লাস ধরে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি পান করলো। এরপর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো।

সে রেস্টুরেন্টে ঢোকার পর থেকে তাকেই দেখছিলাম। তার এক্সপ্রেশন দেখছিলাম।

বিজ্ঞাপন

পানি পান করে তাকালো টেবিলের দিকে। মুখে সলজ্জ হাসি। হাতের ইশারায় ইউনুসকে ডাকে। তারচেয়ে বয়েসে ২/৩ বছরের বড় ইউনুস। বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসেছে। কাজ নিয়েছে রফিক মামার রেস্টুরেন্টে। তর্জনী তুলে আর ভ্রূ নাচিয়ে ইউনুসকে বোঝালো টেবিলটা মোছা দরকার। এরপর পা বাড়ায় রাস্তার দিকে। ডাকলাম তাকে। ঘুরে কাছে এসে দাঁড়ায়। চোখে মুখে প্রশ্ন। কপালপা খানিক কুচকানো। খানিকটা ভয়ও বুঝি কাজ করছে… পানি ফেলার কারণে যদি বকুনি বা মার লাগাই।

জিজ্ঞেস করলাম, সাম কি তোমার?

: বাবা…।

বিজ্ঞাপন

– বাবা কারও নাম হয়?

: হয়। মা আমারে বাবা বইলাই ডাকে। তা-ইলে ওইটাই আমার নাম।

– আর কোন নাম নাই তোমার?

: আছে না, কত্তো নাম…। কেউ পিচ্চি ডাকে, কেউ টোকাই, কেউ আবার ডাকে টেবলেট বইলা। কন, এইগুলা কোন নাম?

বিজ্ঞাপন

এক নিঃশ্বাসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায়। তারপর আবার বলে-
: ছোট মানুষতো, কিছু কইতে পারি না। একবার একজন বাজে কতা বইলা ডাকছিল, হের গায়ে থুতু মাইরা ভাগসিলাম।

পুরনো কথা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে দেয়। তারপর আবার বলে-
: কিসু মনে কইরেন না, অনেক কথা কইয়া ফালাইসি। কেউ ডাইকা সুন্দর কইরা কতা কয়-নাতো…

– তোমার আব্বু তোমাকে কি নামে ডাকেন?

: আব্বারে কোনোদিন দেখি নাই।

সুন্দর দু’চোখে নেমে আসে বিষণ্নতা। মনে হলো এ নিয়ে আর কথা বলা ঠিক হবে না। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম-
– খুব ক্ষিধে পেয়েছিল?

: হ্…। দেখলেন না, এক নিঃশ্বাসে কেমনে পানি খাইলাম?…

ইউনুসকে ডেকে বললাম, প্লেট ভর্তি করে পুরি আর মাংসের ঝোল দাও। আমার কথা শুনে বাবা নামের ছেলেটি আপত্তি জানালো। বললো-
: শুনলে মায় মারবো।

– কেন?

: ভিক্ষা কইরা খাওয়া বালা না, মায় কইসে।

– তুমিতো ভিক্ষা করছো না।

: তয় খাওয়াইবেন ক্যান?

– ধরো এই যে আমরা এতোক্ষণ কথা বললাম… এখন আমরা বন্ধু হয়েছি।বন্ধুর কাছে বন্ধু এলে তাকে যে খাওয়াতে হয় এটা তুমি জানো না?

বেশ ভারিক্কি চালে এবার সে মাথা নাড়ে- বুঝেছে। এরপর আমার পাশের চেয়ারে বসে খেতে শুরু করে। খেতে খেতেই জানায়, সে তার আব্বুকে কখনো দেখেনি। মাকে জিজ্ঞেস করেও আব্বু সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি। বরং মার খেতে হয়েছে আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করায়। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। থাকেন নীলক্ষেত বস্তিতে। মা বলেছেন আগামী বছরটা হবে বাবার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বছরে বাবা স্কুলে যাবে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হবে।

বাবাকে রেস্টুরেন্টে রেখে বাইরে আসি। খাওয়া শেষ করে বাবাও বাইরে আসে। এবার বাড়ি যাবে। হ্যান্ডশেক করে বাবাকে বিদায় জানাই। আর বলে দেই, প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে যেন নাস্তা খেয়ে যায়।

আমার ছোট্ট নতুন বন্ধু ‘বাবা’ প্রায়ই আসে রফিক মামার রেস্টুরেন্টে। তবে যেদিন আমার দেখা পায় না সেদিন না খেয়েই ফিরে যায়। প্রথম প্রথম বলেছি- এমন কোরো না, আমি না থাকলেও খেয়ে নিও।

বাবার স্পষ্ট উত্তর-
: পড়ালেখা কইরা তোমার মত বড়ো হইয়া যখন তোমারে খাওয়ামু… তখন ভাবমু, তুমি না থাকলেও খামু কিনা।

পাদটিকা:
২০০৯ সালে হাতিরপুল ছেড়ে আসি। এরপরও অনেক বছর ‘বাবা’র সাথে যোগাযোগ ছিল। বাবার সাথে যখন শেষ দেখা হয় সে তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। এরপর একদিন এক কিশোর রাস্তায় পথ আগলে দাঁড়ায়। খুব চেনা লাগছিল। পরিচয় দিল… সে আমার ছোট্ট বন্ধু বাবা। এখন কলেজে পড়ে আর একটা দোকানে পার্টটাইম কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করে। মাকে আর লোকের বাড়িতে কাজ করতে দেয় না।
সেই যোগাযোগটা ছিল আরও কিছুদিন। কোভিডকালে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। খুঁজে পাইনি। হারিয়ে গেছে বাবা নামের বন্ধুটি।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন