বিজ্ঞাপন

লামাহাট্টা ও ত্রিবেণী

April 22, 2023 | 4:08 pm

উদয় হাকিম

২০১২ সালের কথা। মার্চ মাস। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লামাহাটা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। হঠাৎ থামলেন। রাস্তার পাশের কিছু ছবি নিলেন। বিশেষ করে পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা গ্রাম বা ছোট ছোট ঘর বাড়ি তাকে আকৃষ্ট করেছিল।
মমতা দেখলেন, পাহাড়ি গ্রাম। উঁচু পাহাড় থেকে ক্রমশ ঢালু হয়ে আসা সবুজে ছাওয়া মনোরম ভূমি। রাস্তার পাশে ধুপি আর পাইন বন। আশপাশে অসংখ্য পাহাড়-টিলা। চমৎকার নদী।
তার ওই দেখার পরে তিনি কিছু উদ্যোগ নিলেন। রাজ্য সরকার এবং স্থানীয়দের সহায়তায় অসাধারণ একটা ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে পরিণত করলেন লামাহাটাকে।
চায়ের বাগান, পাইন বন আর টুরিস্ট লজ দিয়ে অপরূপ সাজে সেজেছে জায়গাটি। বৌদ্ধ সন্যাসীদের থেকে লামা আর হাট থেকে হাটা বা হাট্টা মিলে এরকম নামকরণ। জায়গাটির নাম লামাহাটা বা লামাহাট্টা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যকে ঠিক রেখেই এখানে সাজানো হয়েছে সবকিছু।
সত্যি! দার্জিলিংয়ের পাশের এই জায়গাটি, লামাহাটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। শুধু মমতা কেন, ভ্রমণপিপাসু কোনও মানুষেরই ক্ষমতা নেই এমন সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার।
স্থানীয় গাইড পার্থ বাসনেত জানালেন, এটি দার্জিলিং থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। নেটে অবশ্য পাওয়া গেল ২৩ কিলো। ওই একই কথা। দার্জিলিং থেকে এটি পূবে বলা চলে। তবে উত্তর ঘেঁষা।

বিজ্ঞাপন

টাইগার হিলের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। আর তাই ঘুম রেল স্টেশন, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম মনেস্ট্রি- সবই পথে পড়লো। মনে পড়ছিল টাইগার হিলের পাশের ডাক বাংলো পয়েন্টের কথা। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পেয়ে পাহাড়ের উপরে ছবি তুলেছিলাম আমরা। যেহেতু টাইগার হিলে গিয়েছি তাই টাইগার সংশ্লিষ্ট একটা স্মৃতিচিহ্ন রাখা দরকার। সেলফি স্টিকে মোবাইল সেট করে দাঁড়ালাম। বাঘের মতো আক্রমণাত্মক পোজ নিয়ে রেডি। সবাই দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। পরে দেখলাম ছবিটা ‘অসাম হয়েছে। ‘ওয়াও’ হয়েছে।
দার্জিলিং শহর ছেড়ে যাচ্ছিলাম। শহর থেকে কিছুটা দক্ষিণে এসে পূব দিকে মোড় নিলো গাড়ি। লামাহাট্টা পৌঁছানোর আগে রাস্তার বাম পাশে দেখলাম ঝাউবন। মেঘগুলো আটকে যাচ্ছিল পাহাড়ের গায়ে। ঝাউবনের ফাঁক গলে ছবি নিচ্ছিলাম গাড়ি থেকেই। নুরুল আফসার চৌধুরী বলছিলেন, বৃষ্টি না থাকলে এখানে ‘ইয়া’ (ছবি) তোলা কেউ ঠেকাতে পারত না। সত্যিই তাই! ছেলেটি কথায় কথায় ‘ইয়া’ বলে। একারণে আমি তার নাম দিয়েছি ‘ইয়া’ চৌধুরী।
মাঝে মাঝে বৃষ্টির তোড়ে রাস্তা দেখা যাচ্ছিল না। দিনের বেলা, অথচ অন্ধকারে ছেয়ে আছে চরাচর। দু’একটা পাহাড় পেরোতেই দেখছিলাম বৃষ্টি কমছে। গাছপালা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। দুপাশে বাড়িঘর নেই। নেই কোনও ইট কাঠের স্থাপনা। কেবলই নানা গাছ-গাছালির শোভা। চা বাগান। ঘাসে ছাওয়া সবুজ চত্বর। গাছপালার জলপাইরঙা মুকুট মাথায় আকাশছোঁয়া পাহাড় চূড়া।
বৃষ্টি ছাড়ছিলই না। লামাহাট্টা এসে গেলাম। ঘন্টাখানেক লাগল। লামাহাট্টার উচ্চতা ৫ হাজার ৭০০ ফুট। প্রায় দার্জিলিংয়ের সমান উচ্চতায়। দার্জিলিং এবং কালিম্পংকে সংযুক্ত করেছে এই এলাকাটি।
জানা গেল, এখানে লোকবসিত খুব কম। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বলে কথা। স্থানীয় লোকদের সবাই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এখানে কি কৃষি হয় সেটাই বুঝলাম না। তবে হ্যাঁ, চা বাগান করাও তো কৃষিকাজের মধ্যে। পাহাড় থেকে ফলমূল সংগ্রহ কিম্বা পাহাড়ের গায়ে ক্ষুদ্র পরিসের কিছু চাষও কৃষির মধ্যেই পড়ে।
নেপালের খুব প্রভাব স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে। কথা বলেন নেপালী ভাষায়। তাদের পদবীও নেপালীদের মতো। বাস করেন শেরপা, ইয়ালমস, তামাং, ভূটিয়া ও দুপাস সম্প্রদায়ের লোক। সম্ভবত ভারতের বিখ্যাত ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া এই এলাকা থেকেই উঠে এসেছিলেন। তবে শেরপা সম্প্রদায় কেন বিখ্যাত জানেন? পর্বত আরোহনে দক্ষ এরা। যারা মাউন্ট এভারেস্ট বা উঁচু পর্বতারোহন করতে চান- তাদেরকে অবশ্যই শেরপাদের সাহায্য নিতে হয়। তারা সঙ্গে রসদ বহন করে, গাইড করে, প্রয়োজনে আরোহীকে তুলে নিতে পারে।
এখানে পাইন গাছের পাশাপাশি ধুপি দেখা যায় খুব। পাইনতো অনেকেই চেনেন। বিশাল লম্বাকৃতির বৃক্ষ। ডালপালা ছড়ায় না। শুধু উপরের দিকে উঠে। কিন্তু ধুপি গাছ কি? এটি দূর থেকে অনেকটা ঝাউ গাছের মতো মনে হয়। তবে ঝাউ নয়। দূর থেকে কাঁটাজাতীয় গাছ মনে হলেও কাঁটা নেই এর গায়ে। তবে পাতা ও বা ছোট ডাল দেখলে মনে হয় খুব ধারালো। আসলে তা-ও নয়। কাছ থেকে দেখলে মনে হতে পারে পাটের সুতোয় বোনা শতরঞ্জি। সুতোয় বোনা হাতের কাজও মনে হতে পারে। কেটে ছেঁটে রাখলে লম্বাটে হয়। আবার ঝোপের মতো হয়, হয় গোলাকারও। ধুপির ফলও হয়। দেখতে অনেকটা হরিতকির মতো। কাঁচা ফল সবুজ। পাকলে কালো।
অল্প সময়ের মধ্যে লামাহাটা বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। আগে এর নাম খুব একটু শোনা যায়নি। জায়গাটি লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখানকার ইকো ট্যুরিজম এর জন্য। পরিবেশগত ভারসাম্য ঠিক রেখে; জীব এবং জৈববৈচিত্র্য অটুট রেখে এখানে ট্যুরিজম স্পট ডেভেলপ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সব করা হচ্ছে। আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছে পরিবেশ। এখানে রাজ্য সরকার এবং গ্রামবাসীদের অংশিদারিত্বে কিছু রোড সাইড গার্ডেন এবং রিসোর্ট পরিচালিত হয়।
এখানকার একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়। রাস্তার পাশে রঙিন কাপড়ের অসংখ্য নিশান। এটা নেপালে দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখেছিলাম ভুটানে। বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এটা করেন। ভুটানে শুনেছিলাম, কেউ মারা গেলে বাঁশের আগায় (সাধারনত ১০১টি বাঁশ) রঙ্গিন কাপড় বেঁধে দেয়। বাতাসে চিকন লম্বা কাপড় উড়তে থাকে। আবার ঈশ্বরের কৃপালাভের জন্যও এটা করা হয়ে থাকে। তবে এখানে কৃপালাভই মূল উদ্দেশ্য। কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও ছিলো। বলা হয়ে থাকে- এসব রঙ্গিন কাপড়ের (স্থানীয় ভাষায় প্রার্থনা ঝালর) মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস মানুষের মনকে শুদ্ধ করে, সুন্দর এবং পবিত্রভাবের উদ্রেক করে। মন্দির, সেতু বা বিভিন্ন স্থাপনার পাশেও এ ধরনের প্রার্থনা পতাকা দেখা গেল।
আধুনিক লামাহাটাকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে আরেকটি বিষয়কে সামনে রেখে। একে বলা হচ্ছে রোমান্টিক স্থান। শান্ত পরিবেশের সঙ্গে পাহাড়-নদী দর্শনের সুখ অনাবিল। আর তাই মধুচন্দ্রিমা বা হানিমুনের জন্য এই জায়গাটি বেশ নাম কুড়িয়েছে। শৈলপাহাড়, শিলাখন্ডের ধার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী, ট্রেকিং, ধুপিবন- সবই কেড়ে নেবে মন! একটি তথ্য দিয়ে রাখি। শিলিগুড়ি থেকে লামাহাটর দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার। জিপে গেলে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টা। আর দার্জিলিং থেকে? আগেই তো বলেছি, ঘন্টাখানেক।
যা হোক, এবার বলছি আরেকটি রোমান্টিক জায়গার কথা। অন্তত আমার কাছে এটিই এ অঞ্চলের সবচেয়ে রোমান্টিক স্পট মনে হচ্ছিল। কারণ সেখানে একটি ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। যার নাম লাভারস মিট ভিউ পয়েন্ট। মূল গেইটের মধ্যে কথাটি লেখা। ধারণাটি চমৎকার! প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে নিজেরা দেখা করবেন এবং ওই ভিউ পয়েন্ট উপভোগ করবেন।
জায়গাটির নাম অবশ্যই রোমান্টিক- ত্রিবেনি। সহজ বাংলায় বলা চলে তিন বেণীর সমাহার। এখানে নদীকে বিনুনীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। লামাহাটা থেকে এটি মাত্র ৪ কিলোমিটার পূব দিকে।
ত্রিবেনী জায়গাটি পড়েছে কালিম্পং এর মধ্যে। পশ্চিম থেকে এটিকে কালিম্পং এ প্রবেশদ্বার বলা চলে। একদিকে সিকিম থেকে এসেছে তিস্তা। অন্যদিক থেকে গভীর বন পেরিয়ে স্বচ্ছ জল নিয়ে এসেছে রাঙগিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচের কাবরু পর্বতের একটি গেইসার বা উষ্ণ প্রস্রবন থেকে রাঙগিতের উৎপত্তি। এরা ত্রিবেণীতে মিলিত হয়ে ভাটিতে বয়ে গেছে তিস্তা নামে। সবুজে মোড়া রহস্যময় ঘন বন। তার ফাঁক গলে সুউচ্চ পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা যুগল স্রোতস্বিনী এখানে করেছে আলিঙ্গন। তারপর জলপরীর মতো বয়ে গেছে হাজারও মাঠ পেরিয়ে।

বিজ্ঞাপন

উপর থেকে পাখির চোখ করে দেখতে হয় ত্রিবেনির সৌন্দর্য। ভিউ পয়েন্ট পাশের একটি পাহাড়ের উপর। খাড়া ঢালুতে কংক্রিটের গাঁথুনি। রেলিং করা। কিছু অংশে ছাউনি আছে। বাকিটা উন্মুক্ত। সেখান থেকে সবচেয়ে সুন্দর দেখা যাচ্ছিল মিলনস্থলটি। সবমিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক অসামান্য জায়গা এই ত্রিবেণী। সেদিন জলটা ঘোলা ছিলো। বৃষ্টির পানি লালচে মাটি চুইয়ে পড়েছিলো নদীতে। তাই জলটা ছিলো ঘোলাটে, পিঙ্ক।
আমাদের গাড়ি যখন ত্রিবেণীতে থামে, তুমুল বৃষ্টি তখনও। বৃষ্টিতে ভিজেই একদৌড়ে চলে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। আমার আগেই মিলটন ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল। সে যখন গিয়েছিল তখন ত্রিবেণীটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল। যেই আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই চারদিক থেকে মেঘ এসে পুরো ভিউটাকে ঢেকে দিলো। কি আর করা। ওর মধ্যেই ছবি তুললাম। বৃষ্টি বাড়লে সবাই ছাউনির নিচে চলে গেল। ফিরোজ আলম তখন বললেন, দাঁড়ান আপনার প্যানোরমিক ছবি তুলে দিই।
এখানে চা-পানের জন্য সবাই বসে। কিন্তু সকাল থেকেই বিরামহীন বৃষ্টি থাকায় দোকানদারের চুলোয় আগুন জ্বলেনি। চা বসায়নি। আলো কম ছিলো। ওর মধ্যেই গ্রুপ সেলফি হলো।
ত্রিবেণী নামটা দারুন। নদীর তিনটি ধারাকে এখানে ত্রিবেণী বলা হয়েছে।

ত্রিবেণী কী?
সাধারনত মেয়েদের মাথার চুল লম্বা হয়। ওই লম্বা চুলে তারা বেণী করেন। ওরকম তিনটি বেণীর সমাহার হচ্ছে ত্রিবেণী। এটি ত্রিবেণীর একটি সাদামাটা অর্থ। আবার সাহিত্যিকরা বেণী দিয়ে বাঁধা খোঁপাকেও ত্রিবেণী বলেন। যে যাই বলুক, শব্দটা অনেক কাব্যিক। মস্তিষ্কে শব্দটি প্রবেশ করা মাত্র একটি কাব্যিক অনুভূতি নাড়া দেয়। লামাহাট্টা বা কালিম্পং এর এই ত্রিবেণীও তাই।
তিন নদীর মোহনাকেও ত্রিমোহিনী বা ত্রিমোহনা। এই ত্রিমোহনাকেও ত্রিবেণী নামে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে তিন রাস্তার মোড়কেও ত্রিবেনী বলা যায়, কিছু জায়গার এরকম নামকরণও রয়েছে বাংলাদেশসহ প্রাচীন ভারতর্ষে। কেউ কেউ এই জায়গাটিকে ত্রিবেণীসঙ্গম বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন।
হিন্দু পুরাণ মতে, ত্রিবেণী হচ্ছে পবিত্র তিন নদীর সঙ্গমস্থল বা মিলনস্থল। ওই নদীর পূণ্যধারায় তারা স্থান করে পবিত্র হন। নদী তিনটি হচ্ছে গঙ্গা (পদ্মা), যমুনা এবং স্বরস্বতী। ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে ওই তিন নদীর মিলনস্থলটি একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। হিন্দু তীর্থযাত্রীরা ওখানে গিয়ে পূণ্যস্নান করেন। তীর্থযাত্রীদের ধারণা, তিন নদীর ওই পবিত্র ধারায় স্নান করলে পাপমুক্তি ঘটে।
এলাহাবাদের ওই ত্রিবেণীতে প্রতি ১২ বছর পর একবার কুম্ভ মেলা হয়। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির দেহভস্ম ওই ত্রিবেণীর জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, মৃত ব্যক্তির পাপমুক্তির আশায়। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধির মৃত্যুর পর তার শবদেহ পোড়ানো হয়েছে এখানেই।
ফল্গুধারা নামে একটি শব্দ আছে বাংলায়। কেউ কী জানেন এর অর্থ কী? দেখেছেন কখনও সেটা কেমন? মাটির স্তরের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধারাকে বলা হয় ফল্গুধারা। এই উপমহাদেশে সেটি খুব একটা দেখা যায় না। দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডে গিয়ে সেটা দেখেছিলাম। ক্লিপস অব মহের দেখতে যাচ্ছিলাম। পথে একটা প্যালেস এর ধারে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। মাটির নিচে জলধারার শব্দ হচ্ছিল। দুই সঙ্গী প্যালেসের দিকে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বিষয়টা বোঝার জন্য। দেখলাম কোথাও কোনও জলধারা নেই। খাল বা ছড়াও নেই। নেই ড্রেন বা অন্যকিছু। পশ্চিম দিকটায় কিছুটা উঁচু ভূমি। পূবে ছিলো উপত্যকার মতো জলাভূমি। সেখানে মাটির নিচ দিয়ে জলধারা গড়িয়ে পড়ছিল। প্রকৃতির খেয়াল দেখে কিছুক্ষণ অবাক দাঁড়িয়েছিলাম।

বিজ্ঞাপন

ফল্গুধারার প্রসঙ্গে যাওয়ার কারণ আছে। কেউ কেউ বলেন, এলাহাবাদের ওই স্বরস্বতী নদী অন্তঃসলীলা। বলা হয়, যমুনা নদীর জলধারার নিচ দিয়ে বা মাটির নিচ দিয়ে ওই ধারা বহমান। অনেকটা ফল্গুধারার মতোই। হয়তো দুই ধারা ওখানে একাকার হয়ে গেছে। যদিও প্রকৃত অর্থে ফল্গুধারা হচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া নদীর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধারা।
ও হ্যাঁ, ভারতে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতেও একটি জায়গা আছে, যার নাম ত্রিবেণীনগর। ওখানেও গঙ্গা, যমুনা আর স্বরস্বতী নদী মিলিত হয়েছে। সেখানে অবশ্য তিন নদীই দৃশ্যমান। তবে গঙ্গা আর যমুনা বড় নদী। স্বরস্বতীর ধারা আগে বড় থাকলেও সরু খালের মতো বয়ে গেছে, ক্ষীণ ধারা।
মানবদেহকেও ত্রিবেণী হিসেবে দেখা হয়। শরীরের ভেতরের যে নাড়ি, শিরা, ধমনী- দেহতাত্ত্বিক ভাবার্থে এসবই ত্রিবেণী। তবে নির্দিষ্ট করে ত্রিবেণী বলা হয় স্নায়ুতন্ত্র, শিরা এবং ধমনীকে। ওই ত্রিবেণী সঙ্গমে অবগাহন করতে পারলে মনের অন্ধকার দূর হয়। আলোকিত হয় অন্তরাত্মা।
অবশ্য হিন্দু পুরাণে ত্রিবেণী তথা ওই তিন নদীকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অন্যভাবে। সেখানে ত্রিবেণীর গঙ্গাকে বলা হয়েছে ঈড়া বা ভগবতী নামে। ভগবতী হচ্ছে যে ভগ বহন করে। ভগ শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য, ঐশীগুণ বা ঈশ্বরত্ব। পিঙ্গলা হলো যমুনা নদী। আর সুষুষ্মা হলো সরস্বতী নদী। ঈড়াকে বলা হচ্ছে ধমনী, যার মধ্যে শুদ্ধ রক্ত প্রবাহিত হয়। পিঙ্গলা হলো শিরা। যার মধ্যে দিয়ে দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয় এবং পরে তা শুদ্ধিকরণ হয়। সুষুষ্মা হলো স্নায়ুতন্ত্র। যা মানুষের মস্তিষ্কে অনভূতির সৃষ্টি করে। যা জ্ঞান হিসেবে যা সঞ্চিত থাকে, প্রজ্ঞা হিসেবে প্রবাহিত হয়। যাকে তুলনা করা হয়ে থাকে সরস্বতী নদীর সঙ্গে।
ত্রিবেণী ঘাট বলতে কেউ কেউ নারীর যোনিকে বুঝিয়ে থাকেন। যেখানে অবগাহন করলে অমৃতের তৃপ্তি মেলে। যদিও এর পক্ষে জোরালো কোনও যুক্তি নেই। তবে নানা ব্যাখ্যার মধ্যে নারীর যোনি বা জরায়ুমুখের সঙ্গে ত্রিবেণীর সাদৃশ্য খোঁজা হয়। এর পেছনে যুক্তি হলো নারীর যোনি থেকে লাল (রজ), সাদা (সুধা) এবং কালো (এখানে কালোকে মধু হিসেবে মনে করা হয়েছে) এই তিনধারা প্রবাহিত হয়।
তবে ত্রিবেণীর যত অর্থই থাক, এগুলো আসলে বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে এসেছে প্রচলিত বা পৌরানিক পরিভাষা হিসেবে। নদীর ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লাল, সাদা এবং কালো এই তিনধারাকে ত্রিবেণী হিসেবে মেনে নেওয়া হয়।
ত্রিবেণীর এসব ব্যাখ্যা শুনে মাথা নষ্ট! ব্যাখ্যা যাই বলুক, আমার কাছে শব্দটা কাব্যিক, অর্থবহ। আর কালিম্পঙের এই ত্রিবেণী সত্যিই সুন্দর। বৃষ্টিনস্নাত সবুজ সতেজ বনের ভেতর থেকে লাজরাঙ্গা নববধূর মতো বেরিয়ে এসেছে তিস্তা-রাঙগিত। বেনারসীর মতো উজ্জ্বল লালসে বালু সাজানো রয়েছে মিলনস্থলে। যেন কোনও কিশোরী বধূর বাসরশয্যা। আহা ত্রিবেণী! এত সুুধা তোমার রূপে!

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন