বিজ্ঞাপন

নেতা ও ছায়ামানব

April 23, 2023 | 1:19 pm

শামস সাইদ

সল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাটিক এক জীবন নেতার। যার পুরোটাই গল্পে ঠাসা। সে গল্প রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম ও কারাগারের। শুরুটা ছিল সাদামাটা। পরিকল্পনাহীন। তবে বড় এক স্বপ্ন ছিল। ছুুটছিলেন সেই স্বপ্নের পেছনে। স্বপ্ন ধরার পথে তার সম্বল ছিল একটি কণ্ঠ। তাতে ছিল উত্তপ্ত স্বর। গমগমে আওয়াজ। সে স্বরে মোহ ছিল। মুগ্ধ হতো মানুষ। জড়িয়ে যেত মায়ার জালে। জাদুর ঘোর নেশায় ফেলে দিত তার কথা। ছিল অসংখ্য মানুষের সমর্থন, ভালোবাসা। সেই মানুষদের অধিকাংশই প্রান্তিক। যারা ছিলেন চাষাভূষা, খেটে খাওয়া শ্রমিক, কুলি-কামার ও মজুর। তারা ছিলেন নিপীড়িত। নিষ্পেষিত। অধিকারহারা। দেশ আছে, অধিকার নেই। পরবাসীর মতো। মুক্ত হলেও বন্দি। হাত পা না বাঁধা থাকলেও মুখ তাদের তালা লাগানো। বোবা মানুষ? না, কথা বলতে পারেন। কিন্তু বলেন না। সাহস পান না। কথা বলা অপরাধ। না হয় তাদের কথা কেউ শোনে না। গুরুত্বহীন। শাসকগোষ্ঠীর কান পর্যন্ত পৌঁছে না তাদের চিৎকার। হাহাকার। না হয় শাসকগোষ্ঠী এড়িয়ে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত এই জনপদের মানুষকে। সে এক অবজ্ঞাই বলা যায়।
অধিকারহারা প্রান্তিক এই মানুষরা খুঁজছিলেন একজন নেতা। শাসকগোষ্ঠীর কান পর্যন্ত যিনি পৌঁছে দিবেন তাদের কথা। আন্দোলন সংগ্রাম করে আদায় করবেন অধিকার। পাশে দাঁড়িয়ে বলবেন, তোমরা আমার ভাই। চিন্তা করো না। কেউ পারবে না তোমাদের অধিকার কেড়ে নিতে। তাহলেই শাসকগোষ্ঠীর ঘুম ভাঙবে। তাদের কথায় কান দেবেন। আর দূর হবে তাদের দুঃখ-কষ্ট হাহাকার।
সেই মানুষকে একদিন খুঁজে পেল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। একটি কণ্ঠ নিয়ে হাজির হলেন তিনি। বললেন তাদের অধিকারের কথা। দুঃখকষ্ট দূর করার কথা। মানুষের ভেতর উৎসব বয়ে গেল। মরা মুখে হাসি ফুটল। মনে হলো ত্রাতা এসেছেন। এমন একজন মানুষের জন্যই তো তারা অপেক্ষা করেছেন শত শত বছর। এবার মুক্তি মিলবে। জনগণ ছুটছে তার পেছনে। তিনি ছুটছেন স্বপ্নের পথ ধরে। ঘুরছেন গ্রামের পর গ্রাম। এক জনপদ রেখে যাচ্ছেন অন্য জনপদে। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো তার কাছে সুর আছে। মুক্তির বার্তা আছে। আছে বেঁচে থাকার গান। পেট ভরে খাওয়ার মন্ত্র। মাথা উঁচু করে বাঁচার সূত্র। মানুষ ছুটছে হন্য হয়ে। কাজ ফেলে চলে আসে রাস্তায় কিংবা বিকেলের ময়দানে। তার কাছে জমা রাখতে চায় বিশ্বাস। কারণ, তাদের বিশ্বাস নিয়ে তিনি পালিয়ে যাবেন না। করবেন না বিশ্বাসঘাতকতা। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় আচরণের জবাব দেবেন। দূর করবেন খাদ্যের অভাব। থাকবে না দুঃখকষ্ট।
কেন তারা অচেনা অজানা নেহায়েত কম বয়সের একজন মানুষের ওপর এই বিশ্বাস রাখতে চাইলেন? বা রাখলেন? কেন মনে হলো তাদের মুক্তি নিয়ে এসেছেন? কেন মনে হলো তাদের বিশ্বাস নিয়ে পালিয়ে যাবেন না? কারণ, তাদেরই মতো তিনি। একটুও আলাদা নয়। পাশে বসেন। তাদের মতো কথা বলেন, খাবার খান, কাপড় পরেন। কাঁধে হাত রেখে ভাই বলে জড়িয়ে ধরেন। সে ডাক কত আদর স্নেহ, মায়া-মমতায় জড়ানো। তাদের কষ্ট বোঝেন। দুঃখ পান। নিজের জন্য কিছু করেন না। সে কৌশলও নেই। সারাদিন ছুটে বেড়ান তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায়।
অবেহেলিত সেই প্রান্তিক মানুষের বিশ্বাসই একদিন তাকে নেতা বানিয়ে দিল। দরাজকণ্ঠে তাদের কথা বললেন তিনি। তুলে ধরলেন খাদ্যের অভাব। দুঃখ-কষ্ট লাঘবের কথা বললেন। শাসকগোষ্ঠীর কানে পৌঁছে গেল এই খবর। তারা অবাক। এ আবার কে? চাষাভূষা, শ্রমিক, কুলি-কামারদের নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। কী চায় সে! শাসক গোষ্ঠীর চক্ষুশূল হয়ে পড়লেন তখন।
প্রান্তিক মানুষরা এখন আর তাকে নেতা ভাবে না। নেতা তারা আগেও দেখেছে। পেয়েছে। কিন্তু সেই নেতাদের মতো না তিনি। সম্পূর্ণ আলাদা। তারা ভাবতে শুরু করল এবার বন্ধু। ভাই। আপনজন। তার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত তারা। পিছপা হবে না। দিচ্ছেও। পথে নামছে, আন্দোলন সংগ্রাম করছে। কণ্ঠে তাদের মুক্তির স্লোগান। জোর পাচ্ছে শরীরে। সাহস জড়ো হয়েছে বুকে। পিছিয়ে যায় না। অচল করে দিচ্ছে রাজপথ। কাঁপিয়ে দিচ্ছে শাসকদের মসনদ।
প্রান্তিক মানুষেরা আরও একধাপ উচ্চাসনে বসিয়ে দিল নেতাকে। না নেতা, না বন্ধু, এবার বসাল পিতার আসনে। কারণ, পিতার মতো এই জনগোষ্ঠীর ভাগ্য গড়ার চেষ্টায় নিজের সবটুকু বিসর্জন দিলেন তিনি। সেটা খুব সহজ ছিল না। তা জানতেন নেতা। জেল-জুলুম অত্যাচার নেমে এলো তার ওপর। মাঠ ছেড়ে যেন পালিয়ে যান। না হয় ভিড়ে যান তাদের দলে। মাঠ ছাড়লেন না তিনি। তাদের দলেও গেলেন না। আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। এবার অধিকার না, স্বাধীন দেশ গড়ার চেষ্টায় মনোনিবেশ করলেন। কারণ, পরগাছা শক্তিশালী হতে পারে না। হতে পারে না মহিরূহ। গাছের থেকে বড়ো হলেও পরগাছাই থেকে যায় নাম। আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না। তাই সমস্ত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি দেশ নির্মানের পরিকল্পনা করলেন। একদিন সবাইকে ডেকে জড়ো করলেন মাঠে। উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে বজ্র কণ্ঠে বললেন, তোমরা প্রস্তুত হও। যার যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। পরাধীনতার শিকল ভাঙব আমরা। সংগ্রাম করব। স্বাধীনতা আনব। রক্ত দেব। জীবন দেব। তবু এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চাই। মুক্ত হবেই ইনশাহআল্লাহ। কেউ আটকাতে পারবে না।
সমস্ত মানুষ বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ল। তারা স্বাধীনতা চায়। মুক্তি চায়। চায় অধিকার। এই কথায়ই শুনতেই জড়ো হয়েছিল তারা।
বুদ্ধিমান লোকেরা এই বক্তব্য শুনে হেসে উঠলেন। কারণ, এসব তাদের কাছে হাস্যকর ও বোকামী ছাড়া কিছু মনে হয়নি। তারা ভাবছিলেন এ স্বপ্ন অলিক। কোনোদিন সম্ভব নাকি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করা! কী এমন শক্তি আছে তার? ওই চাষাভূসা মানুষ আর একটি কণ্ঠ। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি দেবতা। তারা জানে নেতা পারবেন। হারবেন না। ঠিক তিনি পেরেছেন। শাসকগোষ্ঠীকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বাধীন দেশ। তখন বুদ্ধিমান লোকেরা সুর পাল্টালেন। আমরাও ভেবেছিলাম আপনাকে দিয়েই সম্ভব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এসব বলে তারা ঘিরে ফেললেন নেতার জীবন। যারা ছিলেন নেতার শক্তি, সেই প্রান্তিক মানুষদের দূরে সরানোর চেষ্টা এবার।
নেতা বসলেন শাসকের আসনে। অন্য এক জীবন তার। সারাদিন কাটে রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যস্ততায়। এখন আর ছুটে যেতে পারেন না সেই মানুষদের কাছে। তবে খুলে রেখেছেন বাড়ির দরজা। সকাল-সন্ধ্যা নেই, মানুষ আসে, খায়। নেতার সাথে কথা বলে। কত দাবি তাদের। কত চাওয়াপাওয়া। এসবে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন নেতা।

বিজ্ঞাপন

২.
এক সন্ধ্যায় একা হয়ে গেলেন নেতা। নেতাকর্মী কিংবা পরিবারের সদস্যরা নেই কাছে। একান্তে বসলেন বাড়ির তিন তলার ছাদের দক্ষিণ পাশে চেয়ার পেতে। হাতে পাইপ। চশমাটা খুলে রাখলেন। কিছুটা সময় একা থাকার চেষ্টা। চোখ বন্ধ করলেন। সবকিছু এলেমেলো লাগছে। পাইপে টান দিলেন। মনে পড়ল সেই বালক বয়সের কথা। দেখেছেন বাংলার মানুষের দুঃখ। কীভাবে কেড়ে নিয়েছে তাদের অধিকার। আন্দোলনটা ছিল সেখানে। সেই আন্দোলনের ফসল মায়ের ভাষা রক্ষা। স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা। সফলই হয়েছেন বলা যায়। তবে ঝড় বয়ে গেছে জীবনের আঙিনা থেকে। বিধ্বস্ত করতে না পারলেও কম এলোমেলো করেনি। টোপ ফেলেছিল লোভের, ক্ষমতার। বন্দি হননি লোভের কারাগারে। বন্দি হয়েছিলেন শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার অন্ধদেওয়ালে। ওটা ভেঙে ফেলেছিলেন লাথি দিয়ে। বাইরে বের হলেই মনে পড়ত সেই প্রান্তিক মানুষের কথা। যারা তার কাছে জমা রেখেছিল বিশ্বাস। ভালোবাসা। স্বপ্ন। সব ছেড়েছুড়ে আবার নেমে পড়তেন রাজপথে। ছুটতেন তাদের কাছে। চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষে গড়ে তুললেন আন্দোলন। ফাঁসির রশি প্রস্তুত হলো তার জন্য। কত আয়োজন তাকে সরিয়ে দেওয়ার। সে হত্যা বৈধ করার জন্য দরবারও বসল। কোনো কিছু টিকল না প্রান্তিক মানুষের গর্জনের সামনে। তারা হুংকার দিয়ে রাজপথই শুধু দখল করল না, জীবন দিতে শুরু করল। নেতার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত মরবে। তবু ঘরে ফিরে যাবে না। নেতাকে আটকে রাখতে পারল না, মুক্তি দিতে বাধ্য হলো সরকার।
নিজের মুক্তি চাননি নেতা। চেয়েছিলেন এই জাতির মুক্তি। সে মুক্তি হয়নি। তাই খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হতে পারলেন না। আবার শুরু হলো সেই সংগ্রাম। অতপর মুক্তি এলো আরও অগণতি মানুষের জীবন আর রক্তের বিনিময়ে। পূরণ হলো তার স্বপ্ন। প্রতিষ্ঠা পেল স্বাধীন দেশ। সেই দেশের আজ শাসক তিনি। এখানে এসে থামলেন। অনেকগুলো প্রশ্ন থামিয়ে দিল তাকে।
প্রথম প্রশ্ন, শাসক জীবনে তিনি সফল, না সংগ্রামী জীবনে? এক জীবনের দুই অধ্যায়। তুলনা করে দেখতে চাইলেন। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ পরে পাইপে টান দিয়ে মুখ ভরে ধোঁয়া ছেড়ে তাকালেন আকাশের দিকে। মাথায় চেপে বসল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইল ভূমি। সাড়ে সাতকোটি মানুষ। তাদের স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া। এসব এলোমেলো করে সরিয়ে রেখে উত্তরটা খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। কে এসে আবার ভাগ বসাবে তার একান্ত এই সময়টুকুর ওপর। সংগ্রামের কোথাও হেরে যাননি তিনি। সে বালক বয়স থেকেই। আটকে দিয়েছিলেন মন্ত্রীর পথ। আদায় করে নিয়েছিলেন স্কুল ঘরের চালের টিন। তারপর অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামে জয়ী হয়ে আজ এখানে।
শাসক জীবনের চিত্র দেখলেন উল্টো। চিন্তার ভাঁজ তখন কপালে। খাদ্যের অভাবে না খেয়ে আছে মানুষ। অথচ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খাদ্যের অভাব দূর করতে আন্দোলন করেছিলেন তিনি রাজপথে। কেন খাদ্যের অভাব? কেন না খেয়ে আছে মানুষ? জবাব দিতে হবে। দাবি করেছিলেন মন্ত্রীর পদত্যাগ। সেই তিনি আজ চুপ কেন? তার দেশের মানুষ না খেয়ে থাকবে কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর হারিয়ে গেল সন্ধ্যার নবীন অন্ধকারে। সামনে এসে দাঁড়াল দুর্নীতি। তার গ্রাস ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। সে গিলছে, গিলছে। সমস্ত দেশটাকে অজগরের মতো গিলে নিশ্বাস নিতে চায়। অথচ তার সংগ্রাম ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছেন। বক্তব্য দিয়েছেন দরজা কণ্ঠে। শপথ পড়িয়েছেন অসংখ্য মানুষকে। তারাও অঙ্গীকার করেছিল দুর্নীতি করবে না। আজ কেন তিনি চুপ? নেই তার সেই কণ্ঠ? গালায় হাত বুলালেন। কণ্ঠ আছে। কিন্তু স্বর নেই। কার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিবেন? শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে? তিনিই তো শাসক। তার এই জীবন পথের দুটি অস্ত্রের একটি আজ অচল। কণ্ঠ তার রুদ্ধ হয়ে গেছে। সেই তেজ নেই। কথা বলতে পারছেন না। আর একটা শক্তি চাষাভূষা, কৃষক, শ্রমিক মজুর কুলি কামার খেটে খাওয়া সেই প্রান্তিক মানুষ। তাদের থেকেও দূরে সরে যাচ্ছেন। তারা যে স্বপ্ন দেখেছিল সে স্বপ্ন খুঁজে পেয়েছে? তিনি পেরেছেন তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে? এখানে এসে থামলেন নেতা। মনে হচ্ছে পারেননি। কেঁপে উঠল তার শরীর। পাল্টে গেল ভাবনা। কই, কেউ তো আসে না এই অভিযোগ নিয়ে। কেউ তো বলে না আপনি পারেননি। কেন পারলেন না? কেন মনে হলো সংগ্রামী জীবনের সফলতা ব্যর্থ হয়ে গেছে শাসক জীবনে। তখন মনে হলো হারিয়ে গেছে তার সেই শক্তি। কণ্ঠ আছে, স্বর নেই। তার পাশে অনেক মানুষ। কিন্তু সেই প্রান্তিক মানুষ নেই। ওই দুটি শক্তি ছিল তার সফলতার হাতিয়ার। সেই শক্তি কেন হারিয়ে ফেললেন? কেন ব্যবহার করছেন না? প্রথমটার উত্তর সহজ। কার বিরুদ্ধে কথা বলবেন? দ্বিতীয়টার উত্তরও পেয়ে গেলেন। সংগ্রাম সাধারণ মানুষ নিয়ে করা যায়। ওখানে সংখ্যা হয় শক্তি। শক্তির প্রবাহ দরকার। কিন্তু দেশ তাদের নিয়ে পরিচালনা করা যায় না। অন্য একটা প্রশ্ন হানা দিল তখন মাথায়। যাদের নিয়ে দেশ চালাচ্ছেন তারা বিশ্বাস রাখেনি তার ওপর? ভালোবাসে না তাকে? কিংবা দেশকে? কেন তারা শক্তি হয়ে উঠছেন না ওই প্রান্তিক মানুষদের মতো?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার পরে ক্লান্ত মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল নেতার। পাইপে আগুন দিলেন। টান দিয়ে তাকালেন রাস্তার দিকে। একটা কথা দুই ঠোঁট ফাঁক করে বেরিয়ে গেল। আহ! নতুন প্রশ্ন দখল করল তখন মাথা। ভুল মানুষ তার চারপাশে? স্বার্থ খুঁজছে তারা? তাই তো মনে হচ্ছে। সবাই তো চাইতে আসে। ছেলের চাকরি। জামাইর পদোন্নতি। ব্যাবসার লাইসেন্স। জমির প্লট। কোথায় সুবিধা আছে তা খুঁজে বেড়ায়। না দিতে পারলে আক্ষেপের কণ্ঠে শোনা যায়, এ জন্য যুদ্ধ করেছিলাম! কিছুই তো পেলাম না। এরা যুদ্ধ শেষে দেশটাকে গণিমতের মাল মনে করছে। ভাগভাটোয়ারা করে খাবে। নিজের করে নেবে। বড্ড বেশি আত্মকেন্দ্রিক তার পাশের মানুষেরা। নিজের বাইরে ভাবতে চায় না। চায় না দেশ গড়ার অংশিদার হতে।
প্রান্তিক মানুষেরা আসে তাকে দেখতে। কতকিছু নিয়ে আসে। কারও গাছের ডাব, পুকুরের মাছ, গাছের লাউ, খেজুরের রস। দিলেও কিছু নিতে চায় না। একবেলা ভাতও খেতে চায় না। বলে আপনাকে দেখতে এসেছি নেতা। দেখেই তারা খুশি। হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। মনে পড়ল সেই ভিখারির কথা। যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে দাঁড়িয়ে ছিল কয়টা পয়সা দেওয়ার জন্য। কই তারপর তো কিছু চাইতে এলো না। কিছু চাইতে আসেনি তার জন্য জীবন দেওয়া অসংখ্য মানুষের পরিবার। আসেনি আসাদের মা, মতিউরের বাবা, মনুর ভাই। তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই? একটা প্রশ্ন নেতার মনকে আবার বিদ্ধ করল। সেই মানুষেরা পেয়েছে তাদের অধিকার? তিনি পেরেছেন?
কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর আর একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন। এই দেশ প্রতিষ্ঠায় লাভবান হয়েছে কারা? যারা তার সংগ্রামকে হাস্যকর ভাবত তাদেরই দেখছেন। যারা ছিল তার শক্তি, কোনোদিন প্রশ্ন তোলেনি চাওয়া-পাওয়ার, হিসাবের খাতা খোলেনি, তারা আজও বঞ্চিত। না, এভাবে চলতে পারে না। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন। আবার কথা বলবেন। স্বর ফিরিয়ে আনবেন কণ্ঠে। কৃষক, শ্রমিক, মজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। সহ্য করবেন না অন্যায়। সেই স্বপ্নের দেশ গড়ে তুলবেন। ফিরিয়ে আনবেন হারানো শক্তি। যে শক্তি তাকে কখনো হারতে দেয়নি। এসব ভেবে পাইপে টান দিলেন নেতা।

৩.
ভাবনা শেষ হলেও উঠতে পারলেন না নেতা। ছায়ামানব এসে দাঁড়ালেন পেছনে। কিছুটা অবাক হলেন নেতা। এতক্ষণ কেউ আসেনি। ভাবনাটা শেষ হতেই…।
ছায়ামানব মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হলেও ছায়ার মতোই অদৃশ্য থাকেন। নেতার খুব কাছের তিনি। যখন তখন চলে আসেন। বেডরুম, খবার ঘর, অফিস, বাধা নেই কোথাও। কারণ, নেতা তাকে পছন্দ করেন। নেতার সাথে ছাত্রজীবনে পরিচয়। নেতারও তখন বয়সটা নেহায়েত বেশি না। নেতা হয়ে ওঠার পথে। তারপর লেগে আছেন। পাইপে টান দিয়ে মুখ ঘুরালেন নেতা। তুই এসেছিস। বস।
ছায়ামানব স্থির। তার মুখে কথা নেই। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। নেতার মুখ তখনও বিধ্বস্ত। কিছুটা ক্লান্তও। লুকাতে পারেননি সেই ভাবনা। মুছে ফেলতে পারেননি কপাল থেকে চিন্তা রেখা। নেতা আবারও বললেন, কী দেখছিস? বস।
ঘুরে এসে ছায়ামানব বসলেন নেতার সামনের চেয়ারে। কিছুটা অবাক হলাম আপনাকে দেখে।
কেন?
একা বসে আছেন! তাহলে মানুষের থেকে আলাদা হতে পেরেছেন! না দেখলে কষ্টই হতো বিশ্বাস করতে।
গম্ভীর মুখে ঠোঁট কামড়ালেন নেতা। মানুষের থেকে আলাদা হতে পারলেও নিজের থেকে আলাদা হতে পারিনি। চেয়েছিলাম নিজের থেকে আলাদা হয়ে কিছুটা হিসেব বুঝে নিতে। সে চেষ্টা থামিয়ে দিয়েছে অনেকগুলো প্রশ্ন। এই সন্ধ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে আমার ভাবনা। বসেছিলাম দুই জীবনের হিসেব নিয়ে।
পারলেন মিলাতে?
জানি না। তবে জীবনের দুইটা পার্ট খুঁজে পেলাম। কিছুটা তুলনা করে দেখলাম।
ছায়ামানব উঠে এসে হাত রাখলেন নেতার পায়ে। চশমাটা চোখে দিয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালেন নেতা। এ কী করছিস!
আপনার চরণধূলি স্পর্শ করছি।
কী এমন করলাম যে চরণধূলি স্পর্শ করলি?
যেদিন প্রথম আপনাকে দেখি সেদিন স্থির করেছিলাম আপনি আমার নেতা। তখন খুব বেশি বয়স না আমার। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভাবার মতো বড় হইনি। তবে মুগ্ধ হয়েছিলাম আপনার কথা শুনে। ব্যক্তিত্ব দেখে। আজ মনে হলো ভুল করিনি। ভুল মানুষকে নেতা মানিনি।
ভুল মানুষ! ধাক্কা লাগল নেতার বুকে। কিছুক্ষণ পরে বললেন, তুই ভুল মানুষকে নেতা মানিসনি ঠিক আছে। কিন্তু অসংখ্য ভুল মানুষের দেওয়ালে আমি আটকে পড়েছি। সেই মানুষের হিসেব নিয়ে বসেছিলাম। তা তোর কেন মনে হলো ভুল মানুষকে নেতা মানিসনি?
জাহাজে ভাসমান নাবিক সমুদ্রের গভীরতা জানে না। খুঁজেও পায় না তল। তার জন্য ডুব দিতে হয়। জীবনও তেমন। জীবনের গভীরতা খুঁজে পেতে সব ছেড়ে জীবন সমুদ্রে ডুবে যেতে হয়। নাবিক সমুদ্রে ডুব দিতে যায় না। গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। ক্ষমতার জাহাজের নাবিক আপনি। জীবনের এত গভীরে নেমে পড়েছেন ভাবতেই পরিনি। আপনার তো এসব ভাবার কথা নয়।
পাইপে টান দিয়ে নেতা বললেন, শোন, এখন মনে হচ্ছে ক্ষমতার জাহাজের নাবিকের থেকে জীবনের গভীরে ডুবে হিসেব মিলানোটা গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজটা আরও আগে করা উচিত ছিল।
নেতা ও ছায়ামানবের জন্য চা এলো। দুজনেই হাতে নিলেন কাপ। চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ রাখলেন নেতা। কথাটা কাউকে বলতে চাইনি। তোকে বলব। কারণ, তুই আমাকে বুঝিস।
ছায়ামানব কিছুটা অপ্রস্তুত। নেতা কী বলবেন তাকে, যা কাউকে বলেননি। বলতে চাননি। আচ্ছা তুই বলতো, শাসক হিসেবে কতটা সফল আমি? সত্যটা বলবি। গম্ভীর মুখে জানতে চাইলেন নেতা।
বেশ কঠিন পশ্ন। কখনো ভাবিনি। মেপেও দেখিনি আপনার সফলতা। শুধু আপনাকে দেখেছি। তবে ব্যর্থ শব্দটা আপনার সাথে বড়ই বেমানান, ওটা যায় না লিডার।
নেতা হাসলেন। শব্দ না করে। তুই মাপছিস। জানিসও। কিন্তু বলবি না। ভাবছিস আমি কষ্ট পাব। মেনে নিতে পারব না। হ্যাঁ, মেনে নিতে পারছি না। তবে রাতারাতি তো পাল্টেও ফেলতে পারছি না পরিস্থিতি। এটাই তো ব্যর্থতা। তুই তো জানিস, আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম, খাদ্য সংকটা দূর করতে পারেননি তিনি। পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেদিন আমার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এসেছিল আগুনের বুলেট। আজ আবু হোসেন সরকারের জায়গায় আমি। তার থেকেও বড় পদে। পুরো দেশের দায়িত্বে। সেই দেশ চরম খাদ্যসংকটে। খাবারের অভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ। হয়তো কেউ আমার বিরুদ্ধে মিছিল নিয়ে নামেনি। পদত্যাগ দাবি করেনি। এরপরও বলবি সফল?
ছায়ামানব স্থির হয়ে গেলেন। নেতা তাহলে এসব ভাবছেন! আপনার পদত্যাগ চায়নি কে বলল? কিছুক্ষণ চুপ থেকে এই প্রশ্ন নেতার সামনে রাখলেন তিনি।
চমকে উঠলেন নেতা। তাহলে পদত্যাগ চাইছে মানুষ!
আন্দোলন দুই ধরনের হয় লিডার। আপনি যেটা করেছিলেন ওটা ছিল অধিকার আদায়ের আন্দোলন। তাই নেমেছিলেন রাজপথে। আপনার বিরুদ্ধেও আন্দোলন হচ্ছে। সে আন্দোলন অধিকারের না। অপসারণের। তাই অদৃশ্য। শব্দহীন। সেখানে স্লোগান নেই। নেই উত্তেজনা। এর নাম ষড়যন্ত্র। এই যন্ত্র আপনি দেখতে পাবেন না। কিন্তু আপনার চারপাশ ঘিরে আছে।
খটখট করে হাসলেন নেতা। তোর মুখে একটাই কথা শুনি। বল, কে করবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র? কেনই বা তোর মনে হচ্ছে বারবার ষড়যন্ত্র চলছে?
আমেরিকা খাদ্য পাঠানোর কথা বলেও পাঠাল না। এই সংকট তো তাই তৈরি হয়েছে। সে কথা অস্বীকার করতে পারবেন? এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই?
কী আর উদ্দেশ্য থাকবে। কিউবার সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। তাই সাহায্যের হাত পিছিয়ে নিয়েছে। হয়তো তাদের ভালো লাগেনি। আমরা স্বাধীন হয়েছি কারও মন জয় করে চলার জন্য নয়। তাহলে এ লড়াই, জীবনদান বৃথা যাবে। পাইপে টান দিয়ে নেতা বললেন, এখানেও একটা শিক্ষা আছে। পরের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। সয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। নির্ভরশীল হও নিজের ওপর। গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে। বল বল নিজের বল, জল জল নদীর জল। ওটাই আসল কথা।
তা ঠিক আছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে না পারলে কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। আপনি চাইবেন এগিয়ে যেতে। তারা চেষ্টা করবে পেছন থেকে টেনে ধরতে। যাদের মুখ দেখবেন না আপনি। তারা মেনে নিতে পারবে না আপনার সফলতা। অদৃশ্য শত্রু মোকাবিলা করা কঠিন। সে দুর্বল হলেও।
ঘুরে বসলেন নেতা। কথাগুলো ধরতে শুরু করেছে তার মন। ছায়ামানব বললেন, আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন আপনি। এখন আপনাকে সেখানে দাঁড়াতে হয়েছে। তা দেখে আনন্দ পাচ্ছে কিছু মানুষ। সেটা বুঝতে পারছেন?
সেটা আমিও ভাবছি। কী করব বল। রাষ্ট্র চালাতে দরকার সৎ মানুষ। যাদের লোভ নেই। চাওয়া পাওয়ার হিসেব নেই। আমি যাদের নিয়ে চালাচ্ছি, অধিকাংশই নিজের নিজের করে। হাঁপিয়ে উঠেছি এসব দেখতে দেখতে। সারা জীবন আমার লড়াই ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সেই আমার দেশে দুর্নীতি হচ্ছে। লুটতরাজ চলছে। আমি সব জানি, বুঝি। তবু কিছু করতে পারছি না। দেশ চালাতে তো লোক লাগবে। কাকে নিয়ে চালাব? লোম বাছতে কম্বল উজাড়। একটা কথা আছে না। বাদ দিতে গেল কেউ থাকে না। একা হয়ে যেতে হবে।
আপনি তো একাই। চারপাশে যারা আছে তারা আপনার না।
তা আমিও জানি। সংগ্রাম জীবনে আমার দুটি শক্তি ছিল। যার কারণে কখনো ব্যর্থ হইনি। একটা ছিল আমার দরাজ কণ্ঠ। তা আজ স্তম্ভিত। অন্যটা ছিল প্রান্তিক মানুষ। তাদের কাছ থেকে বলতে গেলে আজ আমি বিচ্ছিন্ন। শক্তিহারা শাসকে পরিণত হয়েছি। তবে এসব মেনে নেব না। আমাকে ব্যর্থ করার চেষ্টায় যারা লিপ্ত হয়েছে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ফিরিয়ে আনব সেই পুরোনো শক্তি।
তাই করুন নেতা। আজ আমি ওঠব। কেন এসেছিলাম তা ভুলে গেছি। তবে একটা কথা বলার ছিল। মনে পড়লে আবার আসব।
ছায়ামানব উঠে গেলেন। নেতা বসে রইলেন। উঠতে পারছেন না। ক্রমশ জমে যাচ্ছেন। একাকিত্ব হারালেন কিছুক্ষণ পরেই। আবার মানুষেরা ঘিরে ফেলল তাকে।

৪.
ছায়ামানব চলে গেলেও সেই ভাবনায় ডুবে আছেন নেতা। ষড়যন্ত্র! কে করবে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র? হ্যাঁ, দুর্নীতি করছে। স্বজনপ্রীতি আছে। নিজের করে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতায় বসতে চায়। হতে চায় মন্ত্রী, এমপি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এমন কাউকে দেখছেন না। এ কথার গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বাস হারাতে চাইছেন না। তবে ওই কথাটা দূরও করতে পারছেন না। আরও একজন লোক বলেছে এ কথা। তিনি নেতার স্ত্রী। তার সংগ্রামী জীবনের লড়াকু সাথী। সবাইকে বিশ্বাস কইরো না। তোমার কিন্তু শত্রু আছে। তখনও হেসে উঠেছিলেন নেতা। যখন পাইপে টান দিয়ে গভীরে ডুব দিলেন, তখন এই ভাবনা তার মাথায় চেপে বসল। শত্রু আছে। ষড়যন্ত্র চলছে।
সপ্তাহখানেক পরে আবারও ছায়ামানব এলেন নেতার সামনে। আজ বাড়িতে না, অফিসে। নেতার সামনে অনেক লোক। তবু নেতা চোখ রাখলেন ছায়ামানবের মুখে। দেখলেন কিছুটা চিন্তিত। জানতে চাইলেন, কিছু বলবি?
মাথা নাড়লেন ছায়ামানব। হ্যাঁ, বলার আছে। নেতা সময় দিলেন। বল।
একান্তে বলতে চাইলেন ছায়ামানব। কারণ, নেতার সামনে যারা বসে আছেন তারা মুখোশধারী। তার চোখে কালো চশমা। এটা দিলেই মানুষ আর মুখোশ আলাদা করতে পারেন। দেখছেন সব মুখোশ। যারা নেতাকে ব্যর্থ করতে চায়। তার থেকেও বড় প্লান করছে, নেতাকে সরিয়ে দেবে। না হয় মেরে ফেলবে। যখন চশমা খুললেন, দেখলেন নেতার সহকর্মীরা। কেউ এমপি, মন্ত্রী, কেউ দলের নেতা।
নেতা বললেন, তাহলে বসতে হবে।
ছায়ামানব বসলেন। সে অনেকক্ষণ। একা হতে পারছেন না নেতা। দুপুর পেড়িয়ে যাচ্ছে যাচ্ছে। নেতা উঠলেন, খেতে যাবেন। ডাকলেন ছায়ামানবকে আয়, আমার লগে খা। তোর ভাবি খাবার পাঠাইছে। কী পাঠাইছে কইতে পারি না।
খাস কামরায় ঢুকলেন নেতা। তার পেছনে ছায়ামানব। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলেন তারা। শিং মাছের ঝোল আর কবুতরের মাংস। ভাত মুখে দিয়ে মৃদু হাসি মুখে নেতা বললেন, আজ কোনো যন্ত্রের খবর নিয়া আসছিস নাকি?
ছায়ামানব মাথা তুললেন। খেতে পারছেন না। শক্ত হয়ে গেছে তার চোয়াল। অনেকক্ষণ পরে বললেন, আজ যন্ত্র নিয়ে আসিনি। সতর্ক করতে এসেছি।
ভ্রু কুচকালেন নেতা। তা আবার কী?
সাবধানে থাকবেন। আপনার নিরাপত্তা বাড়ান। ওই বাড়িতে না থেকে এখানে চলে আসেন।
নেতা এবারও হাসলেন। তুই সারাদিন এসব নিয়েই থাকিস। কে আমাকে মারবে বল? কে আছে এই দেশে আমার শত্রু? মানুষ ভালোবেসে আমাকে নেতা বানিয়েছে। আমার জীবনের গল্পটা বলছি না তোকে। কোথা থেকে আমি এখানে এসেছি। কারা এনেছে। পেছনে যে যাই বলুক আমার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কথা বলে না। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে কাজ কর। দেশটাকে গড়তে হবে। আমি হেরে যেতে পারি না। মানুষের মুখের হাসি আমার আনন্দ। সেই আমি আজ মানুষের মুখে চোখ রাখতে পারছি না।
কিছুক্ষণ ভেবে আবার মুখ খুললেন নেতা। বল, কে আমার শত্রু? এই জাতি আমার শত্রু হতে পারে না। শত্রুর হাত থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। আমাদের দেশ হয়েছে। এখনও ওসব নিয়ে কেন ভাবিস? তাছাড়া ওই বাড়িটা তোর ভাবি ছাড়তে চায় না। ওটা তার নিজের বাড়ি। এটা সরকারের বাড়ি। খুব কষ্ট করে তিলে তিলে গড়েছে। তাই আমিও জোর করি না। ওখানেই কাটাতে চাই জীবনের বাকি সময়। সাধারণ মানুষ যখন তখন ওখানে ঢুকে পড়তে পারে। এখানে তা পারবে না।
ছায়ামানব চুপ। কিছুক্ষণ পরে বললেন, শত্রুর কথা বলছেন। জমিতে ফসল ফলালেও আগাছা জন্মায় লিডার। পতিত থাকলেও জন্মাবে। ফসলের মধ্যে যে আগাছা জন্মায় তা সহজেই দেখা যায় না। দেখলেও উপরে ফেলা কঠিন। ফসল নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। শত্রু বিষয়টা প্রাকৃতিক। শত্রুর হাত থেকে মুক্ত হয়েছেন তাই বলে শত্রু নাই তেমন না। শত্রু তৈরি হয়ে যায়। কেউ না থাকলে ভাইয়ের শত্রু হয়ে যায় ভাই।
তোর কথা ঠিক আছে। তবে একটা কথা বলি, আমাকে কেউ মারবে না। ভয় পাইস না। তাছাড়া জীবনের কথা ভাবিও না আমি। আজও ভাবছি না। এই ছোট্ট জীবনে বহুবার মৃত্যু দেখেছি, তা খুব কাছ থেকে। কবরও দেখেছি। নিজের কবর কেউ দেখতে পায়? আমি দেখেছি। পরোয়া করিনি। মৃত্যু অবধারিত। এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। পারবে না। আসবেই। রিজিক নির্ধারিত। বেশি খেতে পারবে না। যতই জমা করো।
ছায়ামানব অবাক হচ্ছেন। কার সামনে বসে আছেন। কী বলতে এসেছেন। কী শুনছেন। তবু বললেন, সাবধানে থাকবেন লিডার। খারাপ কিছুর গন্ধ পাচ্ছি।
তোর তো ভয় হচ্ছে আমাকে মেরে ফেলবে। এটা মনে রাখিস, যদি আমাকে মেরে ফেলে, হয়তো এই দেহ বিলিন হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাসে থেকে যাবে আমার নাম। মুছে ফেলতে পারবে না। ষড়যন্ত্র করে ইতিহাস হওয়া যায় না। দেখিস না নবাব সিরাজ আজও ইতিহাসে অমলিন। দুর্মোচ্য। কোথায় সেই লোভীরা? বিদেশিদের সাথে হাত মিলিয়ে যারা নষ্ট করেছিল নিজ দেশের স্বাধীনতা। তাদের ঘৃণা করে মানুষ। বুঝতে পেরেছিস।
কথা নেই ছায়ামানবের মুখে। খাওয়া শেষে বেরিয়ে এলেন তিনি। নেতা পাইপ টানলেন। কিছুকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বসলেন তার আসনে। মন দিলেন কাজে। কাউকে শত্রু ভাবতে চাচ্ছেন না। তাতে মনের অশান্তি বাড়বে। এমনিই হাজারটা সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাছাড়া এই জাতি তার শত্রু হতে পারে না, সে বিশ্বাস এখনও অক্ষত আছে তার হৃদয়ে। মৃত্যুদূতের ভূমিকায় দাঁড়াবে তার সামনে এমন সাহস কার আছে? হাত না কাঁপলেও হৃদয় কাঁপবে। হৃদয় কাঁপলে গুলি করা যায় না। করতে পারবে না।
নেতা এসব পাত্তা না দিলেও সতর্ক হলেন ছায়ামানব। অদৃশ্য চোখে আলো ফেলে চলছেন নেতার পথ অনুসরণ করে। ক্রমশ বাড়ছে তার ভয়। ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হতে চলছে। নেতাকে সরিয়ে দেবে তা প্রায় নিশ্চিত।
নেতার মনও স্থির হচ্ছে না। সেই সন্ধ্যার পরে বাড়ছে তার অস্থিরতা। বারবার মনে হচ্ছে তিনি পারেননি সেই প্রান্তিক মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে। এসব ভেবে চিন্তায় ডুবে থাকেন প্রায়ই। একরাতে বেরিয়ে পড়লেন কাউকে কিছু না বলে। তখন বেশ গভীরই হয়েছে বলা যায় রাত। ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি বের কর। শহরের বাইরে কোথাও যাব।
গাড়িতে বসলেন নেতা। হাতে পাইপ। যাচ্ছেন রাজধানী ছেড়ে। তার গুরুর আস্তানায়। এক সময় দলের সভাপতি ছিলেন। আলাদা হয়ে গেছে দল। পার্থক্য বেড়েছে মত ও পথের। কিন্তু কমেনি শ্রদ্ধা। সংকটে এখনও তার কাছে যান। কিছুক্ষণ বসে থাকেন। গল্প করেন। ভালো লাগে। গুরুও সাহস জোগান। হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তোমার ওপর নির্ভর করছে এই জাতির ভাগ্য।
নেতা কোথায় যাচ্ছেন প্রটোকল ছাড়া? রাত গভীরে এই দৃশ্য দেখে ছায়ামানব অস্থির। তিনিও বেরিয়ে পড়লেন। নেতাকে বহনকরা গাড়ি শহরের সীমানা পেরিয়ে ছুটে চলছে নিঃসঙ্গ পথের বুক পেরিয়ে। নেতাও নিঃসঙ্গ। সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়ার কথা তার পথে। প্রশাসন ছুটে বেড়াত পেছনে। সেসব থেকে আজ তিনি নিজেকে মুক্ত করলেন। ফিরে গেলেন সংগ্রামী জীবনে।
ভাবুক মনে পাইপ টানছেন নেতা। তবে একথা ভাবছেন না যে এভাবে বেরিয়ে পড়া ঠিক হয়নি। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান। প্রটোকল মানা উচিত। মাথায় তার অন্য চিন্তা। পিষ্ঠ হচ্ছেন রাষ্ট্রের যাঁতাকলে। এসব নিয়ে আলোচনা করবেন রাজনৈতিক পুরনো গুরুর সঙ্গে। সমাধান নেই তার কাছেও। থাকে না মুক্তির পরামর্শ। তবু ছুটে যান। কিছুটা প্রশান্তি স্পর্শ করে মন। এই যা।
এসব জানেন না ছায়ামানব। নেতা যে আজকাল চিন্তিত সেটা বুঝতে পারেন। রাষ্ট্রে সংকট আছে। খুঁজছেন সমাধানের পথ। সারাজীবন লড়াই করেছেন মানুষের মুক্তির। সেই তার দেশে ক্ষুধার কারাগারে আটকে পড়েছে মানুষ। এসব নিয়ে নেতা ভাবলেও ছায়ামানব ভাবছেন নেতার জীবন নিয়ে। নেতার গাড়ি দেখতে পাচ্ছেন এতটা দূরত্ব রেখে চলছেন। যেন দেখতে না পান নেতা। বুঝতেও না পারেন। তার এই গোপন পরিচয়টা নেতার সামনে উম্মোচন না হোক। এ তার অনন্য ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। জীবনের বিনিময় হলেও নেতার সুরক্ষার চেষ্টা করবেন।
নেতা দেখছেন রাতের গ্রাম। জোছনায় ডুবে আছে চরাচর। বইছে শীতল বাতাস। মনে পড়ছে পুরনো কথা। এই জনপদে ছুটে বেড়াতেন। ভুলে যেতেন রাত-দিনের হিসেব। ছিল না ক্ষুধা আর ক্লান্তি। যেখানে যা পেতেন খেয়ে নিতেন। অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে যেত পথে। লুঙ্গি পরা, গামছা গায়ে, হাতে কাস্তে। কলকারখানা থেকে ছুটে আসা ঘামে ভেজা মানুষের মুখ তার সামনে।
কিছুক্ষণ পরে নেতার গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে নেমে তিনি ঢুকে পড়লেন গুরুর আস্তানায়। বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইলেন গুরু। তুমি!
এসেছি আপনাকে দেখতে।
তা এত রাতে! জানো তুমি এখন রাষ্ট্রপতি। এভাবে বেরিয়ে পড়তে পারো না। মোটেই ঠিক হয়নি কাজটা। কতরকম শত্রু থাকতে পারে।
হাস্যজ্জ্বল মুখে নেতা বললেন, আপনার কথা মনে পড়ল। এতসব ভাবলে আসতে পারতাম না। আপনার শরীর নাকি খারাপ? শিক্ষকদের বেতন দিতে পারেননি।
পান চিবাচ্ছেন গুরু। কথা নেই তার মুখে। নেতাকে দেখে অবাক হচ্ছেন তিনি। আজও তার কথা মনে করে। রাত গভীরে ছুটে আসে। একটা প্যাকেট গুরুর হাতে দিয়ে বললেন, এটা রাখেন। অল্প কিছু টাকা আছে। শিক্ষকদের বেতন দিয়েন।
গুরু হাসলেন। আমারে যে সম্মানটা তুমি করো, কেউ তা করে না। খুলে বসলেন রাজনীতির সেই পুরনো খাতা। কত কত গল্প। কত পথে ছুটেছেন তারা একই স্বপ্ন নিয়ে। সে আলাপে আলাপে বুড়া হয়ে গেল রাত। সব ভুলে গেছেন নেতা। মনে হচ্ছে এই জীবনটা তার। কোনো চিন্তা নেই মাথায়। হালকা লাগছে।
ছায়ামানব অস্থির। অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে সিগেরেট টানছেন। চোখ বিছিয়ে রাখছেন পথে। কখন বের হবেন নেতা। কিন্তু বের হচ্ছেন না। ছায়ার মতো অনুসরণ করে আবার ছুটবেন তার পেছনে।
নেতা বের হলেন আরও অনেকক্ষণ পরে। ছায়ামানবও পেছন ধরলেন। নেতা পাইপ টানছেন। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে নিভে গেল পাইপের আগুন। তন্দ্রা নামল তার চোখে।
ছায়ামানবের চোখে ঘুম নেই। গ্রামের পথ পেরিয়ে নেতা ঢুকে পড়লেন শহরের সীমানায়। তখনও ছায়ামানব সরে গেলেন না। নেতার গাড়ি যখন বাড়ির আঙিনায় থামল, পথ পাল্টালেন তখন। কিন্তু ভাবনা তার রয়ে গেছে। নিরাপদে ফিরেছেন নেতা। তবু এভাবে বের হওয়া ঠিক হয়নি। পথের হিসেব রেখে বসলেন নেতার বাড়ির হিসেব নিয়ে। ওটাও তো নিরাপদ না। এ শঙ্কা বহুবার নাড়িয়ে গেছে তার মন। সতর্ক করেছেন। পাত্তা দেননি তার কথা। হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। রাখ তোর ভয়। কে মারবে আমাকে? সবই তো আমার লোক।
জীবন নিয়ে ভাবনা নেই নেতার। নিরাপত্তার কথাও ভাবেন না। ভাবছেন জনগণের কথা। সুখি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার চেষ্টা। সেই প্রান্তিক মানুষেরা যেন খুঁজে পায় তাদের স্বপ্ন। ফিরে পায় অধিকার। খেতে পারে পেট ভরে।
এই অদৃশ্য অনুসরণ বেশি দিন গোপন রাখতে পারলেন না ছায়ামানব। নেতা ধরতে পারেননি। নিজেই ধরা দিলেন। অনেকটা ক্ষোভেই সেই ছায়া থেকে নিজেকে বের করে আনলেন। একটা গোপন খবর এতটা শঙ্কিত করল যে রাত দুপুরে ছুটে এলেন। সন্ধ্যায়ও এসেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ করেছেন নেতার সঙ্গে। তখন এসব জানতেন না। মধ্যরাতে ছায়ামানবকে দেখে অবাক নেতা। আবার তুই!
একটা কথা বলতে এসেছি লিডার।
তা সন্ধ্যা রাতে বললি না কেন? কাল বলতি। জরুরি হলে ফোন করতি। এই রাতে আসতে হলো। ফোনে বলতে পারলি না, কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা।
কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন ছায়ামানব। কথাটা বলতে গিয়েও আটকে যাচ্ছেন বারবার। বললেও গুরুত্ব দেবেন না নেতা। উল্টো ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতে পারেন। কিসব চিন্তা করছিস। কাজ নাই তোর? কে আসবে আমাকে মারতে? কে মারতে আসবে তা বলতে পারবেন না তিনি। কিন্তু শত্রুর পায়ের আওয়াজ খুব কাছে। কান পাতলে শুনতে পান। এই ভয় ছায়ামানবেকে অস্থির করে তুলেছে।
নেতার ক্ষিপ্ত কণ্ঠ। কী হলো। তুই যে কিছু বলছিস না। ঘুমাতে যাব আমি।
বিপন্ন কণ্ঠ ছায়ামানবের। আজ রাতে এখানে থাকবেন না লিডার। অন্য কোথাও চলে যান। বঙ্গভবনে যান।
ঠিক ধমক দিলেন নেতা। তোর মাথা খারাপ হয়েছে। মধ্যরাতে কোথায় যাব আমি? প্রটোকলের একটা ব্যাপার আছে। তা জানিস তো। যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে পারি না আমি।
হঠাৎ ছায়ামানবের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, কোথায় ছিল সে রাতে আপনার প্রটোকল?
কোনো রাতের কথা বলছিস তুই?
যে রাতে মওলানার কাছে গিয়েছিলেন।
অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন নেতা। যে খবর গোয়েন্দারাও জানে সে খবর ওর কাছে। কিছুক্ষণ পরে বললেন, তুই কেমনে জানলি?
আপনার গাড়ির পেছনে একটা গাড়ি ছিল। তা জানেন আপনি?
কৌতূহলো বাড়ছে নেতার। কী বলছে এসব। না তো। কোনো গাড়ি ছিল না।
ছিল। সেই গাড়িতে ছিলাম আমি। প্রকাশ্যে এলেন ছায়ামানব। তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন নেতা। আচ্ছা তুই এখন যা। আমি ঘুমাব। কাল ইউনিভার্সিটিতে যাব। সকালে আসিস।
ছায়ামানব নড়ছেন না। তার একই কথা, লিডার আপনি এখানে থাকবেন না।
গুরুত্ব দিলেন না নেতা। ব্যর্থ হলেন ছায়ামানব। কিছুক্ষণ পরে হতাশ হয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তার ভয়টা দূর করতে পারলেন না।
ঘুমাতে গেলেন না নেতা। পাইপ জ্বালিয়ে বসলেন বারান্দায়। কেন এত করে বলছে সরে যেতে? কেন ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করছে? হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো মধ্যরাতে। তবু নেতা ভাবতে পারলেন না তার শত্রু আছে। কেউ আসবে তাকে মারতে। তার মাথায় কোনো জটিল সমীকরণ নেই। নেই অতীত। নেই ভবিষ্যতের কল্পনা। বর্তমানের হিসেব। হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল মাথা।
বারান্দা ছেড়ে বিছানায় এলেন নেতা। কিছুক্ষণ লাগল চোখ বন্ধ হতে। নেতা ঘুমালেন। জেগে উঠল শত্রুরা। ছায়ামানব বসে আছেন। তার চোখে আজ ঘুম নেই। খুব অস্থির।
খুব সকালে বেজে উঠল ছায়ামানবের ফোন। ভেবেছিলেন নেতার ফোন। তবে এত সকালে কেন! হয়তো বলবেন তুই আমাকে নিয়ে এত ভাবিস। এসব মিছে ভাবনা। কিন্তু ফোন তুলে শুনলেন অন্য কথা। সে কথা নেতার নয়। তবে খবরটা নেতার। এই খবর শুনে বরফের জমতে শুরু করলেন ছায়ামানব। তার অস্তিত্ব যখন শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে তখন চিৎকার করে উঠলেন। আমি পারলাম না লিডার। পারলাম না আপনাকে রক্ষা করতে। এই ব্যর্থতা আমার জীবনে অভিশাপ হয়ে থাকবে। আর্তনাদের কণ্ঠে বললেন, ভুল মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখলেন আপনি। ওরা বিশ্বাসঘাতক ছিল। এ কথা আর আপনাকে বলতে পারব না আমি। বলতে পারব না লিডার।
৫.
সে রাতে নিহত হলেন নেতা। পরের সকালে পাল্টে গেল সব। কারফিউর কবলে পড়ল দেশ। শোকে পাথর হয়ে গেল মানুষ। আওয়াজ নেই তাদের মুখে। নতুন শাসকদের ভয়ে লুকিয়ে পড়ল অনেকে। এই খবর শুনেও ছায়ামানব ছুটতে পারলেন না নেতার বাড়িতে। দেখতে পারলেন না প্রিয় মানুষের নিথর মুখ। আত্মগোপনে চলে গেলেন। যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন অনেকের সঙ্গে। এই হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলবেন। কিন্তু সাড়া পেলেন না। সবাই আতঙ্কগ্রস্থ। নেতাকে হারিয়ে তারা দিশেহারা। ছায়ামানব কী করবেন। এই শহর ছেড়ে পালাতে হবে। না হয় তাকে খুঁজে বের করবে ওরা। হত্যা না করলেও জেলে বন্দি করবে। তার বুকে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন। সে আগুন লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। বেরিয়ে আসতে চায়। ধ্বংস করে ফেলবেন সব।
মৃত্যুপুরী শহরে আট দিন গোপন আস্তানায় লুকিয়ে রইলেন ছায়ামানব। নিরুদ্দেশের পথে যাওয়ার আগে দেখতে চাইলেন মায়ের মুখ। এক সন্ধ্যা মা এলেন। জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। মা দেখলেন ছেলের থমথমে মুখ। যাতে জমে আছে কষ্টের মেঘ। বললেন, তুই ঘরে থাকিস না। তোকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেললে বুক ভরে কাঁদতে পারব না আমি। মা হিসেবে তুই আমার কাঁদার অধিকার কেড়ে নিস না।
মায়ের ভাষা বুঝতে পারলেন না ছায়ামানব। তাকিয়ে আছেন মায়ের মুখে দৃষ্টির নোঙর ফেলে। আর বসে থাকিস না বাবা। বেরিয়ে পড়। আন্দোলন কর। তুই মরে গেলেও আমি বলতে পারব, নেতা হত্যার প্রতিবাদে জীবন দিয়েছে আমার সন্তান। মনে রাখিস, খোদার বিচারে সময় লাগতে পারে। দেরি হতে পারে কিন্তু অবিচার অন্ধকারের কোনো জায়গা নেই সেখানে। এই হত্যার বিচার হবেই একদিন।
প্রতিজ্ঞা করলেন তখন ছায়ামানব, যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, যুদ্ধ হবে বাংলায়। নেতা হত্যার বদলা নেবেন। সেই রাতে ঢাকা ছাড়লেন। নিজ এলাকায় গিয়ে গড়ে তুললেন সেই পুরনো বাহিনী, যারা লড়াই করেছিল দেশের জন্য। সারা দেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টু শব্দ করার উপায় নেই, তখন এক দল যোদ্ধা অস্ত্র হাতে গর্জে উঠল। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে স্লোগানে কাঁপিয়ে তুলল সীমান্তের জনপদ। এই আন্দোলন কাঁপিয়ে দিল শাসক শ্রেণির মনোবল। তারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন ছায়ামানবকে। দেশান্তরি হতে বাধ্য হলেন তিনি। না হয় শাসকশ্রেণি হত্যা করবে তাকে। আশ্রয় নিলেন পাশের দেশে। কিন্তু মন থেকে সরাতে পারছেন না নেতার মুখ। হাজারো স্মৃতি যন্ত্রণা দিচ্ছে। কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তার হৃদয়।
দেশে ফিরলেন ছায়মানব। ততদিনে পেরিয়ে গেছে নয় বছর। সেই দেশ নেই। নেই সেই মানুষ। সব পাল্টে গেছে। তবু নেতা রয়ে গেছেন মানুষের মনে। পথে-ঘাটে। অলিতে-গলিতে। তার সেই প্রান্তিক মানুষেরা ভুলে যায়নি তার কথা। ছায়ামানব এসে দাঁড়ালেন নেতার বাড়ির সামনে। বাড়িটা আজ শূন্য। দরজা জানালা বন্ধ। কোথাও নেই কোলাহল। রাস্তায় মানুষ নেই। পাখির ডাক নেই। চোখ রাখলেন বারান্দায়। ওখানে বসতেন নেতা। পাইপ টানতেন। আকাশ দেখতেন। পাখিদের খাবার দিতেন। বক্তৃতা করতেন। নেতাকে খুঁজছেন তিনি। দেখছেন না। কানে বাজছে তার সেই কণ্ঠ। কষ্টে ভিজে উঠছে চোখ। দাঁড়াতে পারলেন না ওখানে। পালিয়ে এলেন। এরপর হাঁটতে শুরু করলেন। যাবেন নেতার কাছে। তিনি শুয়ে আছেন গ্রামে। যেখানে জন্মেছিলেন। পরদিন সন্ধ্যায় পৌছলেন সেখানে। দাঁড়ালেন নেতার কবর সামনে নিয়ে। কাঁদলেন অঝোরে। চোখ বন্ধ করে পাঠ করলেন ফাতেহা। বললেন, লিডার, কী অবস্থায় আছেন জানি না। আপনার শরীরে হাড়ের অস্তিত্ব আছে না বিলীন হয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি না। তবে আপনার নাম রয়েছে এ জাতির হৃদয়ে। পারেনি কেউ মুছে ফেলতে। পারবে না কোনোদিন। পারবে না।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন