বিজ্ঞাপন

রফিক আজাদ, শব্দের সরস্বতী তীরে

April 23, 2023 | 4:25 pm

দিলারা হাফিজ

রূপসী শব্দের যাদুকর, কবি রফিক আজাদের (১৯৪৩–১৯১৬) জীবনেও প্রেম এসেছে বারে বার, বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন পথপরিক্রমায়, ব্যাকরণের নানা সূত্রে, কখন সূত্রহীন ব্যতিক্রমী নিপাতনে সিদ্ধ উপাচারে। প্রেমের কবিতা রচনায় যেমন তিনি সিদ্ধহস্ত, তেমনি ব্যক্তিগত প্রেম পারাবার পারি দিতে গিয়ে অমৃতের চেয়ে গরলই পান করেছেন বেশি। সামাজিক গোত্র প্রধানদের বেত্রাঘাতে জর্জরিত হয়ে বিষে নীলকণ্ঠ কবি রফিক আজাদের প্রেমের কবিতা অধিক তেজোদীপ্ত হয়েছে প্রণয়ের শক্তিতে, সাহসী উচ্চারণে, অমৃতের আহবানে; সাড়া ফেলেছে হৃদয় থেকে হৃদয়ে—
‘যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেবো
জীবনের ভুলগুলো;
যদি ভালবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘ পথে
তুলে নেবো ঝোলাঝুলি।
যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষ
মখমল দিন পাবো;
যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙাবো আর
সমুদ্র সাঁতরাবো।’
(যদি ভালবাসা পাই/ ক. স পৃ.১২৫)

বিজ্ঞাপন

সত্যিকার অর্থে প্রকৃত ভালবাসার জন্য তিনি আক্ষরিক অর্থেই পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়েছেন, কত যে কষ্টের নুনসমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন— কত হাজার বার, তা বলে শেষ করা যাবে না। আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলি না কেন, কাছে থেকে তার আনন্দ, দুঃখ-বেদনাভার সবই দেখবার সুযোগ হয়েছে। তার সঙ্গে আমি জীবন জড়িয়েছিলাম জীবনেরই অমোঘ এক নিয়মে। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশটি বছর কাটিয়েছি তার আনন্দ-বেদনা, দুঃখ- কষ্টের সহযাত্রী, সহমর্মি হিসেবে। একজন কবি হিসেবে জীবনসঙ্গি কবির বেদনাভার বুঝতে চেষ্টা করেছি তার মর্মের গহীন তলদেশে প্রেমের আলো জ্বালিয়ে।

কতটুকু পেরেছিলাম জানিনে, তবে এই প্রচেষ্টায় ত্রুটি রাখিনি। আমি একজন ক্ষুদ্র কবি হিসেবে তার পর্বত প্রমান প্রতিভার মূল্যায়ণ করতে পারব না, তবে ভালবাসায়, অনুপ্রেরণায় তাকে সৃষ্টিশীলভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছি আপ্রাণ। বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রয়োজনের বোধ থেকে তা করেছিলাম। নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করেছি, তার ভালবাসার বেদীতলে নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে ধন্য মেনেছি এই জীবনকে।

ইদানীং কবির লেখা ডায়েরিগুলো খুঁজে দেখছি। তিনি যদিও নিয়মতান্ত্রিক ডায়েরি লেখক ছিলেন না। তবে কারও ব্যবহারে কষ্ট পেলে বা কোনও আনন্দের ঘটনা মনে রাখবার মতো হলে তা লিখে রাখতেন। সে রকম একটি ডায়েরীর পাতা থেকে উল্লেখ করছি তার প্রেমাস্পদকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখা—

বিজ্ঞাপন

‘২৪/১০/৮৩
৩৩, পার্টি হাউজ, আজিমপুর, ঢাকা
আজ অফিসে যাইনি। প্রত্যেকদিন ভোরেই অফিসে না যাওয়ার ইচ্ছে আমায় পেয়ে বসে। গোলামী ভাল্লাগেনা।
শুধু কবিতা লিখে যদি চলত তবে আর কোখনোই চাকরিবাকরি করতাম না। কিছু করতে আমার একদম ইচ্ছে হয় না। বহুদিনপর মনের মধ্যে প্রচুর ভাবনার মেঘ জমেছে, অঝোর বর্ষণ হতে পারে— কিন্তু সেই পরিবেশ কই! আমি গুছিয়ে বসে একাগ্র হয়ে বসতে চাই। কিন্তু চাকরি, টাকার চিন্তা, দারিদ্র্য, অসচ্ছলতা আমার ভেতরের creative urg-কে খেয়ে ফেলছে। প্রচুর কবিতা লেখার আছে। লিখতে ইচ্ছেও আছে। এতটুকুন ছোট একটা কামরা। আমরা দুজনই তো নই। তাছাড়া অসচ্ছলতা প্রধান অন্তরায়। সাজানো সংসার তো ছিল, ছিল লেখার জন্যে আলাদা ঘর— কিন্তু ছিল না মানসিক স্থিরতা, শান্তি। জীবনে কল্যাণময়ী যত্নশীল একজন নারীর কি দরকার তা আমার চেয়ে কে আর বেশি জানে।
যাক সে জীবন ফেলে এসেছি পেছনে। আমার প্রেম, আমার জীবন তৃষ্ণাকে ধারণ করে আছে বর্তমানে যে নারী, সে জানে প্রতিভার কদর, নিজে কবি সে— কাজেই তাকে আর বিশেষ করে কিছু বোঝানোর প্রয়োজন হয়নি, হচ্ছে না। ও তো ভালবেসেছে আমার কবিতা ও সমগ্র আমাকে, দোষত্রুটিসহ এই সম্পূর্ণ আমাকে। এই শান্তিটুকু আছে বলে আবার শিল্পেসাহিত্যে মন ফিরিয়েছি। যদি বড় কিছু হই তো তাতে ওরই অবদান বেশি থাকবে। ওর ভালবাসা আমার বাকি জীবনের পাথেয়। আমি ওকে চাই বাংলাভাষার প্রতিভাবান (মহিলা) কবি হিসেবে দেখতে। আমরা দুজনেই দাঁড়াবো সবার মাথার উপরে উঁচু হয়ে, এই আকাঙ্খা আমার। ও একটু কবিতায় মনোযোগী হলে আমার আর কিছু চাই না।’
এ রকম খণ্ড খণ্ড ডায়েরির পাতায় আমার প্রতি তার আবিষ্টতা, আস্থা, প্রণয়-নিগূঢ় নানা অনুভূতিকে প্রকাশ করে প্রচুর চিঠি যেমন লিখেছিলেন তেমনি তার কিছুটা লিপিবদ্ধ আছে ডায়েরির পাতায়। এই ডায়েরির লেখাগুলোর সন্ধান তার জীবদ্দশায় আমি পাইনি। এজন্যে পাইনি যে, আমরা পরস্পর দুজন মানুষ প্রেমেজাড়িত মানব-মানবী হলেও অনেকক্ষেত্রেই কিছু আদর্শ মেনে চলতাম। এর মধ্যে একটি ছিল আমরা কেউ কারও ডায়েরি পড়তাম না। ডায়েরি পড়াটা অসাদাচরণ, এজন্যে কেউ কারও ডায়েরী ছুঁয়েও দেখেনি বলে এতোকাল পরে এসব লেখা উদ্ধার হলো— যখন তিনি আর এ জগতের বাসিন্দা নন।

সর্গ—২

আমাদের দু’জনার মধ্যে একটি বোঝাপড়া ছিল এরকম, দুজনের কর্মজীবনের, কর্মস্থলের কোনও বিষয়েই পরস্পর হস্তক্ষেপ করব না। আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে ইডেন কলেজে প্রায় পঁচিশ বছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছি। এই সময় পরিসরে কবি হিসেবে, কিংবা সাহিত্যের বিচারক হিসেবে অনেকে কবি-সাহিত্যিক আমার নিমন্ত্রেণ এসেছেন কিন্তু রফিক আজাদ আসেননি। অনুরূপভাবে কবি যখন সাপ্তাহিক ‘রোববার’ অথবা ‘ঘরে-বাইরে’ এমন কি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন, তখনও গ্রন্থকেন্দ্রের সে পত্রিকায় আমি কবিতা ছাপতে দিইনি। এই পারস্পরিক আদর্শ আমরা ধরে রেখেছি আজীবন।

বিজ্ঞাপন

জানি, শিল্পীর ক্ষেত্রে ছাড় দিলে পিছিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু তা জেনেও আদর্শচ্যুত হইনি। সময়কে রফিক দেখেছেন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে, জীবন নদীর হন্তারকরূপে। সারাজীবন রফিক আজাদ হাতে ঘড়ি পরেননি। সময় পরিমাপক যতো ঘড়ি তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছেন তার ভক্ত, বন্ধু এবং স্বজনদের কাছ থেকে, দুই একদিনের বেশি কোনওটাই পরেননি। এখনও ঘরে জমা হয়ে আছে ৮/৯ টি ঘড়ি। তার নামে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিযাদু ঘরে জমা থাকবে কবির ব্যবহৃত অন্যান্য তৈজসপত্রের সঙ্গে এই ঘড়িগুলোও।

এই সময় নিয়েই চমৎকার একটি কবিতা আছে কবির ‘সশস্ত্র সুন্দর’ কাব্যগ্রন্থে। যার উল্লেখ না করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ মনে হবে।
‘সময়, তোমার সময় আছে নাকি?
দাঁড়াও একটু আমার করিডোরে,
ঘরের ভেতর বন্দী আছি— থাকি,
তোমার মুখটি দেখব প্রাণভরে।
সময়, তোমার বন্ধ করো ঘড়ি
বন্দী-জীবন ধন্য করে মরি।’
(প্রতিদ্বন্দ্বী, সশস্ত্র সুন্দর)

সময়ের বন্ধন থেকে মুক্তি কে না চায়? এই মুক্তি কেবলমাত্র মৃত্যুর ভেতর দিয়েই সম্ভব হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের জীবনে। কিন্তু কবি ও শিল্পীরা তাদের শিল্পসৃষ্টির মধ্যে দিয়েও এই মুক্তির রসাস্বাদন লাভ করে থাকেন। একইভাবে প্রণয়ের মধ্যে দিয়ে জীবনকে আস্বাদন করেন নিত্যনতুন করিডোরে। নারী পুরুষের ভালবাসা চিরকালের অমরকাব্যের বিষয়। প্রাচ্য সাহিত্যের মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারতে, মধ্যযুগের গীতিকবিতায়, কাব্যে-গানে, উপন্যাসে, নাটকে সর্বত্র বিয়য়বস্তু হিসেবে এসেছে নারী-পুরুষের প্রণয় বা প্রেম। রবীন্দ্রনাথ তার গানে বলেছেন,
‘প্রেমকে আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাবো
রূপে তোমায় ভোলাবো না ভালবাসায় ভোলাবো।’

বিজ্ঞাপন

রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক ভালবাসা, প্রেমের উপলব্ধিজাত অনুভূতির কথা এভাবেই উঠে এসেছে তার গানে, কবিতায়, কাহিনীকাব্যে, নাটকে, কাব্যনাটকে। রফিক আজাদও তার প্রেমাস্পদের জন্যে যুগ-যুগান্তর প্রতীক্ষার কথা বলেছেন তার কবিতায়, একটু ভিন্নভাবে—
‘আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বথের মতো
প্রতীক্ষা করব,
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধরে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমাণ—
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অমল বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পায়ে
শিকড় গজাবে
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না।’
(কাব্যসমগ্র পৃ. ১৬১)

এই কবিতাটি রচনাকাল ১৯৮১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে। তখন আমাদের ভাললাগা, ভালবাসায় পরিণত হয়েছে। পরস্পরকেকাছে পাবার দুরন্ত এক বাসনা বিপরীত স্রোতে বার বার যখন ধাক্কা খেয়ে টাইটানিকের মতো ডুবে যাবার উপক্রম, সে রকম একটাসময়ে তিনি লিখলেন এই কবিতাটি।

সর্গ—৩

কেন আমি আমি এক পা এগোই তো দুই পা পিছিয়ে আসি, তা তিনিও জানেন ভাল। নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করি, অনেকদিন দেখা করি না, ভুলে যাবার ধ্যান রপ্ত করি। তবু কী ভুলতে পারি, পারি না। পারি না বলেই দুজন দুজনার জন্যে ‘প্রতীক্ষায়’ অঙ্গিকারাবদ্ধ থেকেছি সমস্ত জীবন।

আমাদের বিয়ে হয় ১৯৮৩ সালের মে মাসের ১২ তারিখে। ৮১, ৮২, ৮৩ সাল পর্যন্ত অসংখ্য চিঠি কবি আমাকে যেমন লিখেছেন, তেমনি বেশ কিছু কবিতাও আছে আমাকে নিয়ে। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে চিঠিতে লিখলেন কবি—

৩/১/৮২
রাত ৩.১৫

দিলা, আমার দিলা,

তোমার মুখোমুখি, পাশাপাশি অনেকদিনই তো বসেছি, অনেক প্রয়োজনের, অপ্রয়োজনের কথা হয়েছে, হয়েছে আধুনিক কবিতা নিয়ে দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন আলোচনা। মাঝে মধ্যে তোমার দু/একটি কথায় কষ্ট পেয়েছি; হয়তো আমার অগোচরে আমিও তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু পরস্পরকে আমরা কতোটা চিনতে পেরেছি বা প্রকাশ করতে পেরেছি? আমি কিন্তু সত্যি বাকপটু নই একটুও। নীরব ভাষায় নিজেকে যতোটা প্রকাশ করতে পারি, তারও চেয়ে অনেক কম পারি ভাষা ব্যবহারে। গভীর গোপন কোনও কথা কি ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব? আমার ধারনায় নেই, তোমার আছে?
তোমাকে আমার খুব ভয় হয়। ভয় এই কারণে যে, পাছে তুমি আমায় ভুল বুঝে না বসো; তা-হলে আমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ভয় এই কারণে যে, আমার কোনও কথায়, কোনও ব্যবহারে তুমি আঘাত পাও, তা আমি চাই না। তোমাকে ভয় এ কারণেও যে, তোমাকে আজও আমি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারলাম না— অথচ তুমি মোটেই রহস্যময় নও, নও মোটেও অস্পষ্ট চরিত্রের মানুষ— তুমি মোটামুটি খোলামেলা এবং দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তবুও ভয়…।
তোমার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলই আমার কাম্য, আমি চাই কবি হিসেবে শক্তভূমিতে দৃঢ় পায়ে অন্য সবার মাথার উপর, অনেক উপর উঁচু হয়ে দাঁড়াও এবং সর্বোপরি ভাল থাকো। তোমাকে আমি সুখী দেখতে চাই, দেহ-মনে সুস্থ্, প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি।
তুমি কতো সহজে সামান্য ব্যাপার নিয়ে কবিতা লিখতে পার, আমি পারি না। তাৎক্ষণিক ব্যাপার আমার পক্ষে লিখে-ওঠা খুব কষ্টকর। তুমি নিজেই তো দেখেছো, তোমার খাতায় লেখা কবিতাটি। তুমিই তো মন্তব্য করেছিলে, উপদেশ। কিন্তু আমি মোটেই ওই অর্থে লিখিনি ওটা সেদিন। জেগে-ওঠা বলতে আমি অন্যকিছু বোঝাতে চেয়েছিলাম, বোঝাতে পারিনি, আমারই ব্যর্থতা সেটা। ওটা তো কবিতা ছিল না, ঐ লেখাকে চিঠিই বলতে পার। কিন্তু ঐ যে আমি বলেছি, ভাষা-ব্যবহারে কোথায় যেন একটা গ্যাপ রয়ে যায়। আমি কথা কম বলতে চাই ঐজন্যেই, চোখের ভাষায় বলতে চাই মনের কথা। একটি/দুটি ক্ষেত্র ছাড়া আমি প্রধানতই রূঢ়— আমাকে অন্য অনেকে নিষ্ঠুর গুণ্ডা প্রকৃতির লোক বলেই জানে, বুঝলে কোমল পাথর!
তোমার সঙ্গ আমাকে শান্তি দেয়। গ্রীষ্মকালে, দুপুরে শীতল পানীয়ের চেয়েও শান্তি প্রদায়িনী তোমারসঙ্গ। বলতে দ্বিধা নেই তোমাকে খুব করে কাছে পেতে চাই, আরও দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ; অথচ তোমাকে আঘাত করে নয়, তোমার দিক থেকে কোনও দ্বিধা বা অসম্মতি বা বিন্দুমাত্র তোমার মর্যাদা ও অভিমানকে আহত করে নয়। আমি জানি, এ আমার অসঙ্গত, অসমীচীন চাওয়া। তুমি কি আহত হলে?
যাক গে। তুমি কবিতা লেখার জন্যে চাপ দিচ্ছিলে। কবিতা এবং জীবনে আমি কোনও পার্থক্য করি না। আমি যা ফিল করি জীবন দিয়ে তাই লিখি, এজন্যেই না-পাওয়ার, বিষাদের, বেদনার কবিতায় আমার বই ভরপুর। ব্যর্থতা ছাড়া আমার কোনও মৌলিক আন্তরিক অভিজ্ঞতা নেই যে দিলা! ব্যর্থতার কথা লিখতে বড় কষ্ট হয়, হৃদয়তন্ত্রীতে ক্যানেস্তারার মতো ঝনঝন শব্দ ওঠে— ও আমি আর লিখতে চাই না; না-পাওয়ার কথায় আমার কবিতা বড় বেশি ভারি হয়ে আছে, আহত হয়েছি বারবার। ঐ ধরণের কবিতার সংখ্যা আর বাড়াতে চাই না। তার বিদ্রোহ বিপ্লবের কবিতা বরং লিখবো। সেক্ষেত্রেও কোনও নারীর আন্তরিক প্রেরণা আমার প্রয়োজন, কোনও বিপ্লবী পার্টির নয়।
তোমাকে আমি বিপদে ফেলতে চাই না, তোমার সম্মুখের সুন্দর জীবনকে আমি নষ্ট করতে চাই না। আমি চাই তুমি আরও সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠো, আমি প্রাণভরে দেখি। তোমাকে খুব বড় প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। তোমার মধ্যে যে বিপুল বিশাল সম্ভাবনা আছে, তাকে সম্ভব করে তোলো। উপদেশ নয়, আন্তরিক আকাঙ্খার কথাই বললাম।
আমার কিছু ভাল লাগে না। সারাজীবন এলমেলো চললাম। ভেবেছিলাম সংসারে আবদ্ধ থেকে, বন্ধু সঙ্গ পেয়ে মোটামুটি কাটিয়ে দেবো কায়ক্লেশে জীবনটা। কিন্তু হলো কৈ! পরিবর্তে দিন-দিন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছি। বাধ্য হয়েই আমি পানীয়ের শরণাপন্ন হয়েছি, বিলাস বা ফ্যাশানের কবলে পড়ে নয়। পানীয় আমাকে ভুলে থাকতে সাহায্য করে, অনেক অপমান, দুঃসহ যন্ত্রণা, কষ্টকর জীবন যাপনের গ্লানির হাত থেকে রক্ষা করে। আমাকে উদ্ধার করার জন্যে পানীয় ছাড়া অন্যকোনও সমুজ্জ্বল হাত এগিয়ে আসেনি তো।
আমার কিছু ভাল্লাগে না। অনেক আবোলতাবোল লিখলাম। নিজ গুণে ক্ষমা করে দিও। তোমার একটা স্পষ্ট, অদ্ব্যর্থক দীর্ঘ চিঠির প্রত্যাশায়।

তোমার
-জীবন
(ওটাই আমার ডাক নাম)

সর্গ—৪

এই সময় পরিসরে আমারও দ্বিধা- দ্বন্দ্ব শিমুল তুলোর মতো খুব উড়তে শুরু করে দিলো। টাঙ্গাইল সরকারি কুমুদিনী কলেজ থেকে বদলী হয়ে ঐতিহ্যবাহী ইডেন মহিলা কলেজে যোগদান করেছি সবে। বিশাল ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস সংলগ্ন দুটি ছাত্রী হোস্টেল। তার একটিতে সহকারী হল সুপারের দায়িত্ব পেয়েছি আবাসন সুবিধাসহ। দুই কক্ষ বিশিষ্ট আমার আবাসনটি ছিল নতুন হোস্টেলের ছাত্রীকক্ষের গা-ঘেঁষে। কান পাতলে ছাত্র-শিক্ষক যে কারো কথাই পরস্পর শুনতে পারা যেত। প্রথম মাসখানেক একা, এরপরেই মফস্বল শহর মানিকগন্জ থেকে দুই ভাই-বোনকে এনে, ঢাকার আজিমপুর গালর্স হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে শেলিকে, ইউনিভারসিটি ল্যাবরেটোরি স্কুলে ভাই শীতলকে ভর্তি করে দিলাম নবম শ্রেণীতে।।

প্রথমদিন থেকেই তৃতীয় বর্ষ অনার্স এবং এম এ ক্লাসের ছাত্রীরা আমার ক্লাস লেকচারে বিমুগ্ধ, অভিভূত। মাইকেল মধুসূদনদত্তের মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ অতি সহজ ও তরল করে পড়াতে পেরেছি —এটাই আমার প্রাথমিক যোগ্যতা বিচারক ছাত্রীদের কাছে। অতপর সাহিত্যতত্ত্ব ও ছন্দ পড়িয়ে আরও জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছিলাম অল্পদিনেই। বিভিন্ন বিভাগের সিনিয়র সহকর্মীরা আমার জন্যে পাত্র খোঁজেন ভালবেসে, তারা আড়েঠাড়ে কথা বলেন— বুঝতে পারি সব। কিন্তু শৈলচূড়ায় নীড়বাঁধার মতো আমার মনের মধ্যে যে বাসা বেঁধেছে শতবর্ষ-সাধনার ধন ‘প্রেমরোগ’। এই রোগে আক্রান্ত আমি, সে কথা কাউকেই জানাতে পারি না আর।

কী করব আমি? কি করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না যেন কিছুতেই। কবির প্রতি দুর্বার টান অধিকন্তু তার অসহায়, পর্যুদস্তঅবস্থা বিবেচনায় এনে একজন নবীন কবি হিসেবে প্রতিভাধর বিখ্যাত একজন কবিকে অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। বারবার শক্তি হারিয়ে ফেলি, নিজের কাছে নিজেকেই খুব অচেনা মনে হয়। বাইরের কঠিন খোলস ভেদ করে ফুলের রেণুর মতো কোমল ও সোনালি হৃদয় নিয়ে বসে আছেন যে কবি, কী করে ফেরাই তাকে।

সারাক্ষণ মাথার মধ্যে একই চিন্তা, কী করে ফেরাই তাকে?

সংসার-জঞ্জালে বাঁধা যে জীবন তাকে নিয়ে আর যাই হোক সময়ক্ষেপণও সঙ্গত নয়। এ রকম শতমুখ কণ্টকে ছিন্নভিন্ন সময়ের প্রহরী দুজনেই আমরা। কোথাও নিরিবিলি বসবার মতো জায়গা নেই। প্রথম থেকেই একটি ‘রেঁস্তোরা এ্যাণ্ড বার সাকুরা’ই ছিল আমাদের আলাপনের নিভৃতিস্থল। সেটি ছিল কবির উপার্জনের তুলনায় ব্যয়বহুলই বটে। তবু এছাড়া আর কোন উপায়ও আমাদের ছিল না। এ যুগের মতো এতো সাহসী ছিল না সে যুগের সেই প্রেম। লুকিয়ে-চুরিয়েই নিজের পথ করে নিতে হতো তাকে। মধ্যযুগের ‘কাম’ সবে আধুনিক যুগে এসে তবে না ‘প্রেম’ নাম ধারণ করেছে। কাজেই দিন-ক্ষণ-সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হতো আমাদের। ধরা পড়লে প্রাচীন যুগের মতো মৃত্যুদণ্ড হয়তো হতো না, কিন্তু সমাজের দণ্ডমুণ্ডদের সঙ্গে জীবনপণ লড়াইটিও কিছু কম নয়— যা জীবনরস শুষে নেয় অনেকটাই।

‘সাকুরা’র বাইরে প্রথম সকাল দশটা থেকে ২টা অবধি ৪ ঘণ্টা আমরা সময় কাটিয়েছিলাম একসঙ্গে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে। প্রস্তাবটি ছিল কবির দিক থেকে। না করতে পারিনি। এতো ভালবাসা তো পাইনি জীবনে, এমন কী দেখিওনি অন্যের জীবনে। কাজেই না করব কোন দুঃসাহসে।

ওর হাত ধরে সেই আমার প্রথম ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখা। নানারঙ বাহারি ফুলের সমাবেশ ছাড়িয়ে খুঁজে পেতে ঘনবাঁশঝাড়ের ছায়াচ্ছন্ন তলায় বসে, ঝড়াপাতার কার্পেটের মর্মর ধ্বণি শুনে কাটিয়েছিলাম সময়টুকু। কথক আমি, ফুলঝুড়ির মতো কথা ছোটে আমার, কবি কেবলি নির্বাক শ্রোতা। সবিস্ময়ে কেবলি শুনলেন। বললেন খুব কম। এর পরদিন তিনি দুটি কবিতা লেখেন ‘তোমাকে কাছে পেয়ে’ এবং ‘একটি দুপুর’। কবিতা দুটোই কবির ‘একজীবনে’ কাব্য গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে। শুরুটা করেছিলেন এইভাবে—

সমস্ত শরীরময় বেজে ওঠে সুখের সঙ্গীত,
ধমনীতে উদ্দাম নৃত্যের শব্দ শুনি,
শিরায়-শিরায় দ্রুত শিহরণ জাগে:
চতুর্দিকব্যাপী আনন্দ, আনন্দ শুধু—
হৃদয়তন্ত্রীতে ওঠে গুঞ্জরিত সুরের লহরী;
সারা জীবনের সকল বিষাদ খেদ
মুহূর্তেই ঝরে যায়, পাপ-তাপ, ব্যর্থতার গ্লানি
ধুয়ে মুছে যায়;
বেঁচে থাকা খুব অর্থময় হয়ে ওঠে—
প্রকৃতিও অপূর্ব সৌন্দর্য তার মেলে ধরে আজ
এই হতদরিদ্রের চোখের সম্মুখে;
অকৃপণ উদারতা জেগে ওঠে হৃদয়ে আমার:
ধুলোকাদা থেকে আমি ভালবেসে কোলে তুলে নিই
শত্রুর সন্তান;
অপরাহ্ণে পেয়ে যাই ভোরের আস্বাদ,
………. ……….. …………

তোমার কথার পাখি
খুশিতে বিহ্বল হয়ে ডানা ঝাপ্টে চলে আসে দ্রুত
আমার আকাশে
দিনমান ব্যেপে শুধু পাখি-ডাকা ভোর
জেগে রয় আমাদের ঘিরে;
আন্দোলিত হতে থাকে
বাতাসে উড্ডীন ভালবাসার পতাকা;
মেদে-মাংসে স্থূলকায় এই দেহ ফিরে পায় দ্রুত
ব্যালে-শিল্পীর শরীর,
আনন্দে-আবেগে-প্রেমে জেগে উঠি সুখের সঙ্গীতে।।

(তোমাকে কাছে পেয়ে/ ক. স. পৃ১৯৫)

বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেই দুপুরকে নিয়েই রচনা করেন কবি ‘একটি দুপুর’ নামক অপর কবিতাটিও। সেখানেও দিনমাসবর্ষব্যাপী প্রতীক্ষার পর কবির ব্যক্তি জীবনেই পেয়ে যান মানবেতিহাসের অনন্য একটি দুপুর। কবির ভাষায়:
কতো যে দুপুর গেছে আমার জীবন থেকে খসে
নিষ্পত্র বৃক্ষের মতো নিঃস্ব, রিক্ত, নিঃসঙ্গ, একাকী;
দিনমাসবর্ষব্যাপী প্রতীক্ষার পর উপহার পেয়ে যাই
তোমার কল্যাণে এই সবুজ দুপুর।

সাঁইত্রিশটি বসন্তের সবুজ ফুলেল দুপুর কাটিয়েছি আমরা বোটানিক্যাল উদ্যানের সেই বাঁশবনের তলায়। মধ্য এক দুপুরে খররৌদ্র তাপে আমাকে বসিয়ে রেখে কবি চলে গেলেন অনন্তের ছায়াচ্ছন্ন বাঁশঝাড়ের অনন্তের ছায়াতলে, চিরনির্বাসনে। আমি আজ সেইসব দিন-রাত্রির এক বিরহী ছায়ালিপি।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন