বিজ্ঞাপন

মায়া কিংবা মায়াবড়ি

April 23, 2023 | 7:37 pm

শফিক হাসান

আড়াইটার দিকে গনগনে সূর্য মাথা বরাবর থাকে নাকি কাত হয়ে পড়তে শুরু করে কোনও একদিকে ইদ্রিসপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এটা কখনও খেয়াল করেনি। তবে এ গ্রামের তেত্রিশ বছরের পুরোনো বাসিন্দা খায়রুননেসার চলন্ত একটা শব্দঘড়ি আছে, যথাসময়ে শুনেই বুঝতে পারেন, এখন আড়াইটা বাজে! সময়ের হেরফের হয় না বললেই চলে। জব্বার মুন্সী যখন তার প্যাডেলচালিত ভ্যানে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে নিজ বাড়ির দিকে যায় এই সরু রাস্তা ধরে, তাল কদম কড়ই গাছের না-পড়া ছায়া মাড়িয়ে কোনও জবারের প্রত্যাশা না করেই প্রতিদিন বলে যায়, কী গো খালা, আরামের ঘুম ঘুমাইছ নি?
গেরস্তবাড়ির খুব কম বউ-ঝিই দুপুরে ঘুমানোর সুযোগ পায়, খায়রুননেসার তো ঘুমানোর প্রশ্নই ওঠে না; তবুও জব্বার মুন্সী বলার জন্যই কথাটা বলে যায়। আর দীর্ঘদিন যাবত কথাটা শুনতে ভালই লাগে খায়রুননেসার। কী একটা মায়া জড়ানো আছে অপ্রয়োজনীয় বাক্যটাতে। জব্বার মুন্সী দুপুরে বাড়িতে এসে প্রথমে গোসল করবে, তারপর ভাত খাবে, এই দুটি নিয়মিত কাজের সঙ্গে খায়রুননেসাকে ডাক দেওয়াও তৃতীয় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেজাজ-মর্জি ভাল থাকলে কখনও খায়রুননেসা জবাব দেন, অ্যা রে গোলামের হুত, আঁই ঘুম যাইয়ের! আঁর কাম-কাজ তোর মা আই করি দেয়।
সকাল থেকে খদ্দেরদের ইট টেনে, কাঁচা মাটির জোগান দিয়ে, মালিকের ফাই-ফরমাশ খেটে যথারীতি আজও জব্বার মুন্সী ব্রিকফিল্ড থেকে ফেরার পথে ভ্যানের বেলে ছন্দময় শব্দ তুলেছে, প্রতিদিনকার সংলাপও দিয়েছে কিন্তু দুটো কাজের একটিও যায়নি খায়রুননেসার কানে। ওই সময়ে তার চড়া মেজাজের ততোধিক চড়া কণ্ঠে ধমক বেরিয়েছে ওই বান্দি, কারে তুই আম্মা কছ? তোর মা মরি গেছে নি?
অথচ দুই সপ্তাহ আগেও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে স্বামীর কল এলে মোবাইল ফোনের উপর হামলে পড়তেন তিনি। কখনওবা কাঠনির্মিত খাটের ফুলতোলা বেডশিটের উপর আয়েশ করে বসতেনও। কথা শুরু হতো খাওয়া-পর্ব দিয়ে বেয়ানবেলায় কী খাইছেন! এখন আর কল ধরেন না খায়রুননেসা, বিরক্তি বোধ করেন নির্দিষ্ট সময়ে মোবাইল ফোন বেজে উঠলে। এ ঘরের একমাত্র বউ তহুরা কিংবা তার ছেলে আবদুল হাকিম কথা বলুক এটাও চান না তিনি। তহুরা আজ শ্বশুরের সঙ্গে কুশলাদি সেরে যখন আরেকটা প্রশ্ন করে আব্বা, আফ্রিকান আম্মা কেইক্যান আছে খায়রুননেসার মেজাজ না চড়ে আর যায় কই!
শাশুড়ির রাগ ও গালির তোয়াক্কা না করে তহুরা কথা চালিয়ে যায়। কয়েকদিন আগে আফ্রিকান কালো আম্মার ছবি মোবাইল ফোনের ইমোতে সে দেখেছে আর মনে মনে বলেছে আব্বা এই হাঙ্গা কিল্লাই কইল্ল! ঘরের আগুন বাইরের আগুন দুটোতে তহুরাও পোড়ে। শাশুড়ির শাপশাপান্ত আরও বাড়তে থাকলে ওপাশ থেকে তবারক উল্লাহ বলে ওঠেন ভাবছিলাম আইজ তোঁর এই দেশি আম্মার লগে কতা কওয়াই দিমু। অন দেই তোঁর হড়ির মাতা গরম!
যুগপৎ শ্বশুরের প্রতি রাগ ও শাশুড়ির প্রতি বিরক্তি গোপন করে তহুরা আহ্লাদি কণ্ঠে বলে, হেতেনে রে কি বাংলা শিখাইছেন নি, আব্বা?
আরে কী ক, আঁই শিখমু হেতিগো ভাষা। আঁর তো চারিবারি করি খাইতে অইব।
আম্মারে বাংলা না শিকাইলে যেই সময় দেশে আইব কতা কইব কেমনে? মাইনষে কি নতুন বউ চাইত বুলি আইত ন?
তবারক উল্লাহ বলেন, তোঁর হড়ি হেতি রে ঘরে উইঠতে দিব নি? কী মনে অয়!
তহুরার অনেক কিছুই মনে হয়, সেসব মুখ ফুটে বললে নিজেরই বিপদ। আবদুল হাকিম যদি মাটি কামড়ে বিদেশে পড়ে থাকত, শ্বশুরকে সংসারের হাল ধরার জন্য বিদেশে যেতে হতো না। বিদেশে না গেলে আফ্রিকার ওই পেঁচামুখী ডাইনির সঙ্গেও কখনও দেখা হতো না। ঘরেও জ্বলত না অশান্তির আগুন।
শাশুড়ির গালিগালাজের মাত্রা অন্য বাড়ির পড়শির কান পর্যন্ত পৌঁছাতে থাকলে বাধ্য হয়ে তহুরা কথা সংক্ষেপ করে। আফ্রিকান মারে সালাম দিয়েন বলে তড়িঘড়ি করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বাইরে এসে রোদে শুকাতে দেওয়া সিদ্ধ ধানে পা চালায়। লম্বা সারিতে ধানগুলো সমান রোদ পাবে; তষ ঝরে গিয়ে শুকাবে দ্রুত। মাটিতে রোদ লাগলে দ্রুত ধানের ওশ টানতে পারে।
যে বয়সে মানুষ ছেলের ঘরের, মেয়ের সংসারের নাতি-নাতনি নিয়ে হাসি-তামাশায় মাতে, খুঁজে পায় জীবনের নতুন অর্থ সে সময়েই বিদেশমুখী হলেন তবারক উল্লাহ। সংসারের চাকা সচল রাখতে এছাড়া উপায়ও ছিল না। আবদুল হাকিমকে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে বাহরাইন পাঠিয়েছেন, সে ফেরত এল সাত মাসের মাথায়। লাট সাহেবের মতো ভাব নিয়ে, বেশরম গলায় ফেরার কারণ ব্যাখ্যা করল বেড়াইতাম গেছিলাম, বেড়ানি শেষ। দেশ-দুইন্যাই ঘুরি চান ফরজ কাম।
ময়মুরব্বিরাও এমন না-হক কাজে ক্ষুব্ধ। তারা যখন ধমক দিয়ে বলেন, এতগিন টেঁয়া খরচ করে কেউ মরার দেশে বেড়াইত যায় নি আবদুল হাকিম অন্য সুরে কথা বলে দেশের লাই হরান হড়ে, দাদা/ নানা/ জেডা!
অল্পদিন পরে ভেতরের খবর ঠিকই ফাঁস হয়ে যায় আদতে ওর প্রাণ কাঁদত বউয়ের জন্য! তহুরাকে ছাড়া আবদুল হাকিম থাকতে পারবে না। এমন বিলাসী বিদেশ ভ্রমণে সবাই নাখোশ হলেও একমাত্র তহুরার মধ্যে চিন্তার লেশমাত্রও দেখা গেল না। উল্টো যুক্তি হিসেবে বলা শুরু করল আল্লার দিন, আল্লায় একভাবে না একভাবে লই যাইবই। কুত্তা-বিলাইও কি না-খাই থায় নি?
তবারক উল্লাহ ভেবেছিলেন ছেলে অনেক টাকা নষ্ট করেছে যখন, এবার ঘর-সংসার খেত-খামার দেখবে। ঠিকমতো তদারকি করতে পারলে তারা হয়ে উঠবে সচ্ছল কৃষক। বছরব্যাপী খোরাকির চাহিদা মিটবে। মৌসুমে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, গোল আলু, মিষ্টি আলু, শিম, আলু, মুলা-ডুল্লা-মাইরার শাক এসবের আবাদ করতে পারলে চিন্তা কী। ঘরে পালা হাঁস-মোরগ আছে, বাজার থেকে তেল-নুন, রুই-বোয়াল মাছের মতো বড় মাছ কিনলে দিব্যি দিন চলে যাবে। কিন্তু তাও হলো না; খেতের কাজ নাকি আবদুল হাকিমের ভাল লাগে না। তার দাদা ছিলেন এ গ্রামের চেয়ারম্যান, সেই তাকদ ও জমিদারি ভাবটা রয়ে গেছে আবদুল হাকিমের রক্তকণিকায়। তাই রঙিন ছাপার লুঙ্গি পরে সে সারাদিন এই তল্লাটে ওই তল্লাটে ঘুরে বেড়ায়। সরকারি দলের নেতা-কর্মীর খাতায় নাম লেখানোর জন্য পার্টি অফিসেও গিয়েছিল কয়েকবার। সেটাও হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। সুযোগটা কাজে লাগালে তাকে আর দশজন বোকা কামলার মতো ঘামে ভিজতে হবে না, বৃষ্টির পানি লাগাতে হবে না গায়ে।
পাড়া বেড়িয়ে, উপজেলার জায়গা বেজায়গায় ঘুরে-ফিরে যেখান থেকেই সে ফিরুক, খাবার সময়ে বাড়িতে এসে হাঁক দেয় কই গো মা, ভাত দ। ভোক লাগছে।
বউয়ের কাছে না চেয়ে আবদুল হাকিম কেন বরাবর মায়ের কাছে ভাত চায়, এটা নিয়ে তহুরার একধরনের চাপা মনোকষ্ট আছে। কিন্তু সংসারে অশান্তির ভয়ে কখনও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। একটু উনিশ-বিশ হলে আবদুল হাকিম এখনও জালি বেত দিয়ে পেটাতে আসে। বাবা-মায়ের অসম্মান পছন্দ করে না একদমই। যদিও এমন মান্যি-গন্যি করা ছেলে সত্যিকারের কাজের বেলায় ঠনঠন! এখনও পায়ের উপর পা তুলে খায়। বেখেয়ালি ছেলের অসহযোগিতায় অনেকটা বাধ্য হয়ে তবারক উল্লাহ বিদেশের পথ ধরলেন। ছেলের মতো তিনিও অনেকটা সৌখিন মানুষ। খেত-খামারে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারেন না। গ্রামের বিচার-সালিশ, কজ্জিয়া-ফ্যাসাদে বেশি সময় ব্যয় করেন। এসবেই তার সুখ ও আনন্দ। শেষকালে তবারক উল্লাহর বিদেশযাত্রায় আত্মীয়-এগানের অনেক রকম কথা কানে তুললেন না। লাভ কী তাতে, ভুল যা করার আগেই করেছেন। একমাত্র সন্তান হিসেবে লাই দিয়ে মাথায় তোলা হয়েছে আবদুল হাকিমকে, এখন চাইলেও নামানো যাবে না।
দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ে করে ফেললেন তবারক উল্লাহ। এটা নাকি তার চাকরির জন্য ভাল কাজে দেবে। জোহানেসবার্গের কোথাও দোকান দিতে পারলে আরও ভাল হবে। কিন্তু খবর গোপন রাখতে চাইলেও পারলেন না। তারই এক দেশি ভাই মোবাইল ফোনে ঠিকই কথাটা লাগিয়ে দিয়েছে! এখন পুরো গ্রাম জানে খবরটা। বয়স্ক মহিলাদের যাদের অফুরন্ত সময়, তারা পানে চুন লাগাতে লাগাতে হাপিত্যেস করে আহা রে, কী হোলা কী অইল!
দুই নৌকায় গতর ভাসিয়ে তবারক উল্লাহ ভালই বিপদে পড়েছেন। জোয়ান বউ রাগ করলে সেটা ভাঙানো তুলনামূলক সহজ; বয়সী বউয়ের রাগ চ্যালা কাঠের মতোই শক্ত আর বিপজ্জনক!
বিকাল চারটার পরে যখন ঘরকন্নার কাজ কমে আসে, গোসল-খাওয়া সেরে বাড়ির অধিকাংশ বউ-ঝি একটু বিশ্রামে যায় তখন খায়রুননেসা মোড়া পেতে বসেন তাদের ঘর লাগোয়া বাঁশঝাড়ে। বাঁশঝাড়ের পাশে পুকুরে টেংরা-পুঁটি তখনও নিয়ম করে ঘাই দিয়ে যায়, হেলেদুলে আদার খায়। গভীর পানি থেকে শোল মাছ দোল খেলে সেটাও ধরা পড়ে উপরি স্তরের বুদবুদে। পাখপাখালির ডাক ধীরে ধীরে সরু হয়ে আসতে শুরু করে। সূর্য তখন হেলতে শুরু করে পশ্চিমাকাশে। বাঁশঝাড়ের চিরল পাতা ভেদ করে নারকেল-সুপারি গাছের পাতা মৃদুমন্দ বাতাসে নড়ে, ছায়া ছায়া জায়গাটায় একটুখানি বাতাস যেন জুড়িয়ে দেয় শরীর-মন এ অনুভূতি ও সৌন্দর্যের কোনও তুলনা হয় না। কিন্তু খায়রুননেসা এসবের কিছুই দেখেন বা অনুধাবন করেন বলে মনে হয় না। কী ভাবেন তিনি, পোড়াকপাল নিয়ে আল্লাহর কাছে বিচার দেন নাকি ফেলে আসা দিনের সুখস্মৃতির জাবর কাটেন; কেউ জানে না, বোধকরি তিনি নিজেও না!
খায়রুননেসার বেহাল দশা থেকেই হোক কিংবা বাজারে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে লোকজন ইদানীং বহুচর্চিত প্রবাদটি ঘনঘন উচ্চারণ শুরু করেছে, যায় দিন ভালা, আইয়ে দিন খারাপ।

বিজ্ঞাপন

দুই.
তবারক উল্লাহর অপরাধকে একটুখানি লঘু করতেই বোধহয় ইদ্রিসপুর গ্রামে সূচিত হয় নতুন অধ্যায়। এই মাথা থেকে ওই মাথায় লহমায় ছড়িয়ে পড়ে মুখরোচক বাক্যটি নিজামের বউ হলাই গেছে। আজই নিজামের সৌদি আরব থেকে ফেরার কথা, ঢাকার বিমানবন্দরে নামবে দুপুর দুইটা নাগাদ, আর দুইটার আগেই কিনা রিজিয়া উধাও! রিজিয়ার পলায়নের পক্ষেও লোকজন সমর্থন দিতে পিছিয়ে থাকে না। কে কবে নিজামকে ত্রিপুরা হারবালের দোকান থেকে বেরোতে দেখেছে, গঞ্জ থেকে কিনেছে শক্তিবর্ধক টনিক, বিমল ডাক্তারের কেবিনে বসে থাকত প্রায়ই এসব অজানা তথ্যও নতুন রূপ পায়। আবার রিজিয়া কার লগে লাইন মারে, বাপের বাড়ি যাওয়ার নাম করে লাং নিয়ে সিনেমা দেখে রূপসা হল থেকে বেরিয়েছে, সলিমের কাকা দেখেছে রূপভারতী হলের সামনে বোরকাপরা অবস্থায় এমন সাক্ষী-সাবুদেরও অভাব হয় না। জামাই-বউ উভয় পক্ষই মোটামুটি একই মাত্রায় অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পরও গ্রামের চা দোকানে, হাটে-বাজারে গুঞ্জনের ডালপালা মাথা নোয়ায় না। বিচারকরা যার যার অবস্থান থেকে উভয়ের মুখে ঝামা ইট ঘষে দিতে থাকে। কেউ কেউ বলে শ্বশুর-শাশুড়ির হশকুনির কারণেই রিজিয়া এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, আবার কারও ভাষ্য নতুন বউ ঘরে রেখে যে পুরুষ পাঁচ বছর বিদ্যাশ করতে পারে হেতে ব্যাডা নাকি খাসি! আক্কল-ক্যাশ নাই, হড়া নাই লেয়া নাই এমন মাইনষের বউ তো দড়িছেঁড়া গাই অইবই।
নিজামের বউ পলায়নে মুখরোচক কোনও গল্পে তাল মেলাতে পারে না শুধু আজগর আলী। তার বুক কাঁপে, দীর্ঘশ্বাস পড়ে অজানা আশঙ্কায়। নিজামের কথা মনে করে, নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে খেই হারায় বারবার। ঈমান-আমান নিয়ে আল্লাহ তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সুযোগ দেবে কিনা এমন দুশ্চিন্তায়ও কাতর হয়। শুধু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। নিজাম হয়তো পাপের শাস্তিই পেয়েছে, অভিন্ন পাপের শাস্তি আজগরের কপালেও ধার্য হয়ে আছে কিনা এসব ভেবে বুক ধড়ফড়ায়। মনে মনে ক্ষমা চায় মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে। আর সদ্য প্রয়াত মায়ের উপরও তার রাগ জাগে। হারামজাদী আরও কিছুদিন পরে মরতে পারত না!
সাধের আকিজ বিড়িও আজ বিস্বাদ লাগে। ঠোঁটে আগুনের ছ্যাঁকা লাগতেই বিড়িটা ছেড়ে দেয় খালের দিকে। বাঁশের সাঁকো পার হতে গিয়ে যেন আজগর পুলসিরাত পার হওয়ার পরীক্ষা দেয়। মনে বেশি দুশ্চিন্তা নিয়ে সাঁকোতে ওঠা হয়তো ঠিক নয়। এমন তত্ত্বকথা অবচেতন মনে এলেও মস্তিষ্কজুড়ে দাপাদাপি করে অন্য স্মৃতি। নিজেদের যৌথ পাপাচার।
গ্রামের মানুষের দিনযাপনের স্বাধীনতা অবাধ। তাই রাত সাড়ে বারোটার দিকে একদিন আজগরের যখন ঘুম ভেঙে যায়, তার মনে হলো খালপাড়ে বসে একটু বিড়ি টেনে এলে মন্দ হয় না। ম্যাচ ও বিড়ির প্যাকেটটা কোঁচড়ে গুঁজে দুলকি চালে হেঁটে এসে আয়েশ করে বসে খালপাড়ে। আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো অল্প অল্প আলো দিচ্ছে। বাতাসও বইছে মৃদুমন্দ। আজগরের ভাল লাগতে শুরু করে। বিড়িটা ধরিয়ে পরপর তিনটা টান মারার পর তার চোখ দুটি চঞ্চল হয়ে ওঠে। একটা ছায়াকে হেঁটে আসতে দেখে সে। প্রথমে ভূত-প্রেত ভেবে ভয় পেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়। জ্বলন্ত আগুন যখন হাতে আছে ভূত-প্রেত আসবে না, এটা হয়তো কোনও মানুষই হবে। কিন্তু ভূঁইয়াবাড়ি থেকে কে কোথায় যায় এত রাতে, কেন যায়! সচকিত চোখে আজগর উঠে দাঁড়ায়। ছায়ামূর্তি তখন আরও কাছে চলে আসে। গলাখাঁকারি দিয়ে আজগর বলে ওঠে, কে রে? কোনাই যান!
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অনিচ্ছুক-জবাব আসে আঁই য়্যা-না।
বিড়ির ক্ষয়াটে আলো আর তারার আবছায়া ঝিকিমিকিতে সে চিনতে পারে অন্ধকার পথিককে। এ যে তাদেরই বাড়ির নিজাম! কিন্তু এত রাতে নিজাম ভূঁইয়াবাড়িতে কী করে। এ বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তাহে। সেই সন্দেহ মাথায় নিয়েই আজগর দূরসম্পর্কের জেঠাতো ভাইকে প্রশ্ন করে, এত রাইতে তুই ইয়ানে কিয়া করছ?
আবারও কাঁপা জবাব আসে এমনে আইছি।
এমনে আইছছ নাকি ভূঁইয়াবাড়িত চুরির সুযোগ খোঁজছ?
নিকটজনকে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে সে বলে, তুই কিয়া কস ইগিন? আঁই চোর নাকি চোরের হোলা?
আজগর বুঝতে পারে, কিছু একটা লুকানার চেষ্টা করছে নিজাম। এত সহজে সে ছেড়ে দেবে কেন? তাই এবার শক্ত গলায় বলে, কিল্লাই আইছছ সইত্য করি ক, নইলে আঁই অন চিল্লাই কমু, তুই চোর। গত হাপ্তার চুরিও কইচ্ছছ তুই নিজে!
নিজাম এবার ধরা পড়ার ভঙ্গিতে বলে, না রে, আঁই জোছনা ভাবির কাছে গেছিলাম।
কিল্লাই গেছস এই মাইজ রাইতে?
দরকার আছিল।
হেতির জামাই তো বিদ্যাশ থায়। জামাইর কাম করি দিতি নি গেছস?
এবার ওর হাত চেপে ধরে নিজাম। বলে, ওই কামই কইচ্ছি। আল্লার দোয়াই, তুই কারওগোরে কিছু কইছ না!
কইতাম ন। কিন্তুক আঁরে ভাগ দিতে অইব!
গোপন সম্পর্কের কথা ফাঁস করলে জোছনা ভাবি রাগ করবে, নিজের গোপন ভাণ্ডারটাও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে; নানা দোনামোনার মধ্যে নিজাম আজগর আলীকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বোঝাতে সমর্থ হয় না। শেষমেশ নিমরাজি হয়ে নিজাম জোছনা ভাবির ঢুলির বেড়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকে ভাবি, ও ভাবি; দুয়ার খোলেন।
নিঃশব্দে দরজা খুলে গেলে দুজনেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকে। নিজাম ধরা পড়ে যাওয়ার বয়ান দিয়ে বলে, ইগারে খুশি করি দেন। নইলে হেতে গেরাম করি দিব।
জোছনা একটুও ভয় পেল না, বোধকরি ধরা পড়ার ভয়ে শঙ্কিতও নয়। নিজামকে চলে যেতে বলে দরজা বন্ধ করে দেয়। আজগরকে নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে জোছনা বলে, হিলাইয়া, তুই আর কাম হাছ ন, ক্যান্? রাইত-বিরাইতে ইঁডা মাইরতে আইছছ আঁর ঘরের চালে!
আজগর খুশি চাপা রাখে না। ফিসফিসিয়ে বলে, ভাবি, মনে করেন আইজগার তুন ইয়ানই আঁর পারমেট কাম। আঁই কিন্তুক পত্যেক দিন নদীত ডুব মারিউম।
আইচ্ছা, হইরে ডুব দিস। অন কাম শুরু কর। নিজাম হিলাইয়া তো দুই মিনিটও টিকে না, তুই কতক্ষণ থাকতি হারছ, ছাই! আইজ তোর হরীক্ষা নিমু। নদীত ডুব মারইন্যা মানুষগা হাঁচুইর জানে নি!
আজগরের সারা অঙ্গে রোমান্স জাগে, তৎপর হয় দ্রুত। ঘামে-জলে-শীৎকারে জোছনা ভাবি যখন বারবার বেষ্টন করল দক্ষ সাঁতারু আজগরকে, সে বুঝল পরীক্ষায় পাস করেছে।

তিন.
কেমন যেন একটা নেশা ধরে যায়। নিষিদ্ধ গোপন নেশায় তলিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ আজগর আলী। জোছনা ভাবি বরাবরই দিলদরিয়া। পালাক্রমে নিজাম ও আজগর সুযোগ নিয়েছে কিংবা দিয়েছে। উপোসী মানুষ আলুভর্তা থেকে বিরানি যা পায় তাই খেয়ে সন্তুষ্ট থাকে। কয়েক মাস পরে নিজাম বিয়ের পিঁড়িতে বসে। পুলিশ কনস্টেবল শ্বশুরের বদান্যতায় বিদেশে যাওয়ার সুযোগও মেলে তার। দুই বছরের মাথায় তাদের শনের ঘর ভেঙে পাকা দালান দাঁড়িয়ে যায়। এই দালানে রিজিয়া সুখেই ছিল। তার হড়ি-আম্মা অন্য কূটনিদের মতো বেহুদা জ্বালা-যন্ত্রণা দেয় না। নেপথ্যে ক্ষমতাবান পুলিশ বাবার প্রভাব কিংবা উপকারও থাকতে পারে। এরপর আজগর আলীই জোছনা ভাবির সা¤্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠে। কিন্তু রাতের একক সম্পর্ক এক বছর না গড়াতেই কুদ্দুস মাঝি দেশে ফেরে। কেন সে আর বিদেশ করবে না, পরিষ্কার করে বলে না কিছু। বউয়ের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক। কোথাও কোনও অবনতি ঘটেনি। জোছনা ভাবিও বেমালুম ভুলে গেছে আজগরকে! অথচ কোনও কারণে একদিনও যদি আজগরের সঙ্গে রঙ্গরস করতে না পারত, তার সুন্দর চেহারায় ছায়া পড়তে সময় লাগত না। শালার মানুষ এত তাড়াতাড়ি কীভাবে পিটিও হয়ে যেতে পারে! পরীক্ষার খাতার পাতা উল্টানোর সময় স্কুলের মেয়েরাও তো একটু সময় নেয়! অবশ্য পল্টি দেবেইবা না কেন, ঘরে স্বামী থাকলে জোছনা ভাবির পরপুরুষের সাহায্য কেন লাগবে! এসব বলে নিজেকে বুঝ দেয় আজগর আলী। চিকন চেষ্টা চালিয়েও অন্য কোনও প্রবাসীর বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি সে।
অধিকাংশ বউই সময়মতো নামাজ-কালাম পড়ে, আল্লাহ-বিল্লাহ করে। মাগরিবের নামাজ পড়ে পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী নুনভাত শাকভাত জাউভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেরোসিনের চেরাগ বেশিক্ষণ জ্বালিয়ে রাখার সক্ষমতা যাদের আছে, তারাও অপচয় করে না। ফজরের নামাজের সময় মোরগ ডাকে, তখন আবার উঠে পড়ে প্রায় সবাই। চেরাগ জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ে না। সুবেহ সাদেক পেরিয়ে ধীরে ধীরে দ্বীনের আলো ও দিনের আলো দুটোই একত্রে ফোটে।
একাকিত্বের জ্বালা সইতে না পেরে আজগর আলী একপর্যায়ে কৃষক বাবার শরণাপন্ন হয়। লজ্জা-শরম ভেঙে বলে, আব্বা, আঁরে বিয়া করাই দেন।
বিস্মিত হওয়া ভাব গোপন রেখে রুস্তম আলী ছেলেকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোর বউরে ভাত-কাড় দিব কে?
আঁই দিমু, আব্বা। আমনের ছিন্তা নাই।
তাইলে ঢাকা-চিটাং চলি যা। কাম-কাজ করি টেঁয়া রুজি কর।
আগে বিয়া, আব্বা। কাম হরে।
মাঙ্গার বাজারে তেল-মরিচ টানাটানির সংসার। গৃহকর্তা সহজে বশ মানবেন কেন। কিছুদিন আগে সংসারের চাহিদা মেটাতে নতুন করে দুইটা হালের গরু বর্গা নিয়েছেন। ছেলের কী গতি করা যায়, সেই চিন্তাও করেন। মেট্রিক পাস করা থাকলে আজগরের জন্য তিনি পোর্টে চাকরি করা অফিসার খালাতো ভাইকে সুপারিশ করে দেখতে পারতেন, একটা পিয়নের চাকরি জোগাড় করে দিতে পারবে কিনা। এখন তো সেটাও সম্ভব না। মনে মনে বলেন হড়ালেয়া ন থাইলে গরিবের হোলাহাইন বদিল্লা ন দি আর কী কইরব! কিন্তু ছেলে কামলা খাটবে, দিনমজুরি করবে, কাবিখার মাটি কাটবে এটাও মন থেকে মেনে নিতে পারেন না। ছেলেটা তো মাশাল্লাহ, দেখতে-শুনতে খারাপ না। ভাল জামা-কাপড় পরলে সাহেবদের ছেলের মতোই লাগে।
ক্ষুধার্ত বাঘের তেজ টগবগ করে আজগর আলীর শরীরে। বাবার কাছে সুবিধা করতে না পেরে একদিন মাকেই শুনিয়ে দেয় ধমকের বাণী এক হাপ্তার মইধ্যে আঁর বিয়া দিবি! না দিলে তোরা দোনোজন বাড়ি ছাড়ি চলি যাবি। তন এতিম হোলা পরিচয় দিই আঁই বিয়া কইরতে হারিউম।
ক্ষ্যাপা ছেলের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় বিয়ের আয়োজনে নামতেই হলো। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বুদ্ধি দিয়ে বললেন, কলিকালের ছেলেপেলে এমনই! বিয়ে তো আগে-পরে দিতেই হবে। তারচেয়ে বরং ফরজ কাজটা একটু আগেই হয়ে যাক। ছেলেও বউ পেয়ে নিশ্চয়ই কামাই-রুজিতে মন দেবে। ঘরে হাতি থাকলে কলা গাছ জোগাড়ের চিন্তা বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ কেউ এটাও বলল, ইদ্রিসপুর গ্রামের মানসম্মান সবই গেল। আজগরের দেখাদেখি আরও ছেলেপেলে নষ্ট হবে, বেয়াদবি করবে বাবা-মায়ের সঙ্গে। সমাজটা আর বসবাসের উপযোগী রইল না।
বিয়ের দিন আজগরের খুশি আর ধরে না। বাবা-মাকে পরপর তিনবার পা ছুঁয়ে সালাম করেছে। পরে বাবাকে দেওয়া কথা রেখেছিল সে। নতুন বউকে ঘরে রেখে পাশের গ্রামের একজনকে ধরে সে নারায়ণগঞ্জে আসে। টেম্পুর হেল্পারির চাকরি নেয়। অবসর সময়ে চিটাগাং রোডের ফুটপাতে জুতা বিক্রি করে। উপার্জন খুব একটা খারাপ না। দুই সপ্তাহ পরপরই বাড়িতে যায়। বউ তার জন্য অপেক্ষা করে, বালিশের ওয়াড়ে লেখে ভুলো না আমায়, পতি পরম ধন। একটা বালিশের প্রচ্ছদে লাল সুতায় বুনন করেছে আজগর + পুষ্প। কিন্তু দিন সবার সমান যায় না। সুখ-দুঃখ আপন মায়ের পেটের ভাই। আজগর আলীর মা মারা যান হঠাৎ করেই। মায়ের শোক না ফুরাতেই আসে বউকে আগলে রাখার দুশ্চিন্তা। মা নেই, ঘরে নতুন বউ রেখে শহরে কাজে মন বসাতে পারে না সে। ভাড়া কাটতে উল্টাপাল্টা করে প্রায়ই, যাত্রীদের বকা খায়, ওস্তাদের গালি শোনে। মা যে মারা গেল, বাবার মধ্যে তেমন শোকের চিহ্নও দেখতে পায় না আজগর। বাবা এখন চুলে-গোঁফে নিয়ম করে কলপ লাগান। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ান। কে বলবে তার স্ত্রী মারা যাওয়ার একমাসও পার হয়নি! এই গ্রামেই প্রবাসী ছেলের বউয়ের সঙ্গে শ্বশুরের কুকর্ম ধরা পড়েছে, মাস তিনেক আগে।
নানাবিধ দুশ্চিন্তা ও অঘটন আশঙ্কায় মাথা ঘোরে আজগর আলীর। নিজের সম্মান ও বউয়ের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য চাকরি ছেড়ে তাই বাড়িতে ওঠে। জুতার ব্যবসাটা লাভজনক হয়ে উঠছিল, সেটা ছেড়ে আসতে কম কষ্ট হয়নি।
বর্ষাদিনে হাতর থেকে মাছ ধরে, খালে জাল মেরে, বিভিন্ন জায়গা ও অজায়গায় গজিয়ে ওঠা কচুশাক ও লতি, আইলের শাক টুকিয়ে দিনগুলো খারাপ যাচ্ছিল না। বউও খুশি তাকে কাছে পেয়ে। অন্য বউয়েরা যেমন সারাদিন এটা নাই ওটা চাই বলে ঘ্যানঘ্যান করে পুষ্প কখনই মুখ ফুটে কোনও চাহিদার কথা প্রকাশ করেনি। ছেঁড়া শাড়িতে অন্তত তিনটা তালি দিয়েছে পরপর, তবুও কখনও মুখ ফুটে জানায়নি চাহিদার কথা। বরং ঈদে-চাঁদে পুষ্প বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরের জন্য, স্বামীর জন্য লুঙ্গি-শার্ট এসব চেয়ে-চিন্তে আনে। তার বাপের বাড়ির অবস্থাও ভাল না, তবুও নিজ সংসারকে ভালবেসে এমন জুলুম করে!
এমন বউভাগ্যে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া প্রকাশ করে আজগর। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের ঘর আলো করে একটা বাচ্চা দেবে, এমন স্বপ্নই দেখে দুজনে। উধার-ধার, গায়-গিরস্তি করে আজগর আলী বছর তিনেক চালিয়ে নিয়েছে। গত বছর কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তার সুস্থ বাপটা মারা গেল! অবশ্য তার আগে বাবার চেষ্টা ছিল আরেকটা বিয়ে করার। অর্থনৈতিক অবস্থা অনুকূলে ছিল না বলেই বাবা পোষ মেনেছিলেন! বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ভাইবোনদেরও কিরিত-ছিরিত অবস্থা। মাথার উপরে ছেঁড়া কাপড়ের শিকভাঙ্গা ছাতাটাও আর রইল না। চারদিক থেকে ধেয়ে এল অভাব-অনটন। অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি খরায় মার যেতে থাকলে খেতের ফসল। এই অবস্থা চলতে থাকলে সংসার যে চিত্তিচান হয়ে যাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য চিত্তিচান হওয়ার বাকি রইলইবা কী! ছোট ভাইটা বাজারের রাইস মিলে চাকরি করে অল্প কিছু টাকার জোগান দিতে পারে। ছোট বোনটাও বিয়ালাক হয়ে উঠছে। ওড়না পরা শুরু করেছে দুই মাস থেকে। এমন অবস্থায় বাড়ির বাইরে গিয়ে আজগর আলীর নতুন কাজ খোঁজা জরুরি। বাবা-মা তো মরে গিয়ে বেঁচেছেন, বিপদে ফেলে গেছেন সবাইকে।
এদিকে ছোট ভাইটাও সুযোগ পেলে ভাবির সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরার চেষ্টা করে। দূর থেকে এসব চোখে পড়ে আজগর আলীর। নতুন চিন্তায় পেয়ে বসে তাকে! যদিও জানে, পুষ্প তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না। তারপরও বলা যায় না, সঙ্গদোষেই তো লোহা ভাসে! এর মধ্যেই কিনা খবর আসে নিজামের বউ ভেগে যাওয়ার। আজগর আলী চেষ্টা করেও একটা সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি। হুজুড়ের কাইতনপড়া, তেলপড়া পানিপড়াও কাজে আসেনি। সন্তানসন্ততি থাকলে নিজেকে বুঝ দিতে পারত, পুষ্প বাচ্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু এখন!
আজগর আলীর দোটানা অবস্থা বুঝতে পেরেই বোধহয় একদিন পুষ্প বলে, আমনে আবার ঢাকা-চিটাঙের দিগে চলি যান। আঙ্গোর লাই ছিন্তা করন লাইগ্দ ন। সোলেমান তো ঘরে আছেই।
যে সোলেমানকে পুষ্প সম্ভাবনা বা সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছে, আজগর সেটাকেই দেখছে বাধা হিসেবে। সোলেমান আজকাল নায়িকাদের ভিউকার্ড কিনে এনে বালিশের নিচে রাখা শুরু করেছে। এসবও নজর এড়ায় না আজগরের। পুষ্পর কথায় আশ্বস্ত না হয়ে আরও গভীর পানিতে হাবুডুব খায় সে। কী করবে, কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে, বিদ্যাশ বেহ্যাঁচ কোথায় গিয়ে উঠবে; এসব ভাবতে ভাবতেই পেরেশান সে। রিজিয়া পালিয়ে গেলে পেরেশানি বাড়ে আরও। আজগর মনে মনে ভাবে, নিজামের বউ-শোক কমে এলে সে কিছু টাকা ধার চাইবে। চেষ্টা করবে জুতার ব্যবসাটা আবার দাঁড় করানোর। ময়মুরব্বির কথাও মনে পড়ে তার। তারা বলতেন, যদি পড়ে কহর/ না ছাড়িও শহর। আচানক মায়ের মৃত্যুটা না হলে এতদিন নিশ্চয়ই শহর তাকে বুকে টেনে নিত।

চার.
রোকিয়ার বিয়ে হয়েছিল ভাল জায়গাতেই। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। বছর মাথায় ফিরে আসতে হয়েছে বাপের বাড়িতে। কাবিনের সব টাকার উশুল নিয়েছে। টাকাগুলো রেখে দিয়েছে নিজের কাছেই। কোথাও থেকে ভাল একটা সম্বন্ধ এলে তখন তো অনেক টাকা লাগবে। রোকিয়া যখন লাখ টাকার বান্ডিল ঘরে রেখে ঘুমায়, তার ভাইবউয়েরা বেগুন-কইডা ধুন্দুল-ঝিঙ্গা তরকারি, হাতা-লতা এলিচা-মলিচা শাকের সংস্থান করতেও হিমশিম খায়। ডাইলে-চাইলে খিচুড়ি রান্নাও দিনকে দিন তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। ভাই-ভাবিরা নিজেদের অভাবের কথা বলে বারবার টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয়; একটা টাকাও রোকিয়া ভাঙবে না। ভাল একটা সম্বন্ধ এলে কি ভাইয়েরা তাকাতে পারবে তার দিকে? অনেকটা বিরক্ত হয়েই সবাই জুদা করে দেয় তাকে। মনে কষ্ট পেলেও রোকিয়া পিছু হঠে না। নিজের জন্য আলাদা ঘর, পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগও বুঝে নিয়েছে কড়ায়-গণ্ডায়।
ভাইয়েরা তার দিকে না তাকালে সে একা কেন মানবতা দেখাবে! নিজেই এখন ফসল ফলায়, নিজেই রান্নাবান্না করে খায় আর অপেক্ষা করে ভাল একটা সম্বন্ধের। বিভিন্ন জায়গায় লোক লাগিয়ে রেখেছে। এতদিনে রোকিয়া বুঝে গেছে, ভাইয়েরা তার বিয়ে দেবে না। তারা আছে জমানো টাকাগুলো লুটপাট করে খাওয়ার ধান্দায়। যা করার রোকিয়ার নিজেকেই করতে হবে। কইতরী খালাকে বলে রেখেছে। অবসর সময়ে তার ঘরে গিয়ে সুখ-দুঃখের গল্প করে আসে। কইতরী খালাও তার মতোই অভাগা। জোয়ানতিকালে খালার স্বামী তারই ছোট বোনের হাত ধরে পালিয়েছিল। এখন শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকে। বাপের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ হয়েছে খালার। এমন মীরজাফর বোনের চেহারা দেখবেন কোন চোখে! বাধ্য হয়ে কইতরী খালা স্বামীর বাড়ি ছেড়ে একচুলও নড়েনি কোথাও! খালা এখন বেড়ানোর ছলে এই গ্রাম ওই গ্রামে গিয়ে দোজবরা পাত্র খোঁজেন। আবিয়াইত্যা পাত্র পাওয়া তুলনামূলক কঠিনই হবে। এতিম বা মিসকিন কোনও ছেলে পাওয়া গেলে ভাল হতো, যে কিনা ঘরজামাই থাকতে পারবে। খালা মাঝে-মধ্যে রোকিয়াকেও সঙ্গে নেন। বোরকাপরা রোকিয়া তখন দেশ-দুইন্যা দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভবিষ্যৎ সুখের চিন্তায় তার পায়ে বেজে ওঠে সোনার নূপুর!
খেত-খামারের কাজ কী কষ্টের! না করেও উপায় নেই। অনাথ রোকিয়ার দিকে কেইবা ফিরে তাকাবে! সে খেয়েছে কি খায়নি, ইদ্রিসপুর গ্রামের কারও কিছু যায়-আসে না। তার দিকে সুদৃষ্টিতে তাকিয়ে খাওয়া-পরার কথা জিজ্ঞেস করার মানুষের বড়ই অভাব। সব সীমার, পাত্থরের দিল! বাইরের লোকের কথা কী বলবে, অসুখ-বিসুখেও তার ভাই ও ভাইবউয়ের কখনও একটু পানিও এগিয়ে দেয় না!
জৈষ্ঠ্য মাসের গরমে নারকেল গাছের নিচে বসে কাঁচা আমের ভর্তা বানিয়ে খায় রোকিয়া। আর নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দিনে দিনে কমে আসছে সঞ্চয়ের টাকা। একটা ভাল সম্বন্ধ এলে কীভাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। খাঁ-খাঁ মাঠে ছাগল চরছে। সেদিকে তাকিয়ে নিজেকেও এমন বিরান প্রান্তর মনে হয়। গতবার পুবের বিলের ধান নষ্ট হয়ে গেছে বন্যার পানিতে। বন্যা অনেকদিন পর্যন্ত ছিল, পানির নিচে জালা পচে গেছে। ধানের থোড় চোখে দেখার আগেই জালা নষ্ট হওয়াটা কী কষ্টের; কলিজা ফাটানো শ্রম সবই বিফলে গেল! তেত্তিয়া বছরের সব ফসল জ্বলে গেছে খরায়। এমন আরেকটি দুর্যোগ রোকিয়া পার করেছে চাষাবাদের প্রথম বছরে। ওইবার বন্যায় ডুবে খেতের সব পাকা ধান পচার উপক্রম হয়েছে। শেষমেশ অল্প কিছু উদ্ধার করতে পেরেছে। সবুজ কচি ধানচারা আর সোনালি ধানের এমন মৃত্যুর কথা মনে পড়লে বুক জ্বালা করে রোকিয়ার। হালের টাকা, সারের খরচ, দশ গাবুরের টাকাও গচ্ছা গেছে। কেলার গোডা হইসা হইসা, বদিল্লার গোডা তিনশ টেঁয়া।
বাধ্য না হলে কি রোকিয়াকে এত কষ্ট করতে হয়। দিনের পর দিন খেতে গিয়ে নিড়ানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার থেকে সেচের পানি দেওয়া সবই করেছে সে। অথচ এই কর্মিক মানুষকে নিয়েও ঘরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই। তাদের ৪৭ গিরির বড় বাড়ি। বিশাল মোচতাক মুড়ার পর বাড়ির কাছারিঘর পেরোলেই মসজিদ। একেকবার একেক কারণে ফসল মার যাচ্ছে, মানুষ বাঁচবে তাহলে কী খেয়ে? বাড়ির ছেলে-বুড়ো থেকে ময়মুরব্বিরাও হুজুরকে দোয়া করতে বলেন। এখন আল্লার রহম ছাড়া আর কোনও উপায় নাই। জুম্মার নামাজের বয়ানে হুজুর বললেন, আল্লাহর গজব নাজিল অইব না কা? বাড়ির মাইয়োলারা যদি খেতে-খামারে কাম করে! বেপর্দা চলা চলে! মেয়ারা, আগে নিজেগো সমাজ-নমাজ ঠিক করেন। তারপর আল্লারে দোষ দিয়েন! ইঙ্গিতটা যে রোকিয়ার উদ্দেশেই বুঝতে পারে অনেকেই। কুদ্দুস মাঝি আপনজনের দাবি নিয়ে রোকিয়াকে সব জানিয়ে দেয়। সতর্কবার্তা দিয়ে এও বলে, কয়েকদিন যেন একটু পর্দা-পুশিন্দার মধ্যে থাকে। অতি উৎসাহী কারও কারও ভাবগতিক সুবিধার মনে হয়নি তার কাছে।
কুদ্দুস ভাইয়ের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা বোধ করে রোকিয়া। নিজের বাড়ির লোকেরা তাকে আপন মনে না করলেও আরেক বাড়ির ঠিকই তার প্রতি মায়া অনুভব করা লোক আছে। সবই অদৃষ্টের লীলাখেলা।
ওয়াজের পরদিন দুপুরে বড় একটি খোরা নিয়ে হুজুড়ের বউয়ের কাছে যায় রোকিয়া। একই বাড়ির মানুষ, সকাল হলেই একজন আরেকজনের মুখ দেখে। হুজুড়ের বউ সামনে এলে বলে, চাচি, আঁর ভাতের চাইল শেষ অই গেছে। একসের চাইল উধার দিতেন হাইরবেন নি?
চাচি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আঙ্গো ঘরে হাঁচগা মাইয়া, চাইরগা হোলা। চাইল থায় নি? তুই বুঝস না? হরু ত চাইল আছিল না একদম। হোলাহাইনরে আডার জাউ রাঁধি খাবাইছি। মাইনষের দিল শক্ত অই গেছে। ঈমান-আমলের ছিন্তাও কমি গেছে। আগে ত মিলাদ মাফিলে বোলাইলে হুজুড়ে কিছু টেঁয়া-হইসা হাইত। অন মিলাদ মাফিল কই! দেখস না, হোলাহাইন কেমনে সারাদিন হইসামিল খেলে! হেদায়েত নাই।
আঁই কিছু অইলেও ইগিন বুঝি। কিন্তু হুজুর তো ইক্কিনিও বুঝে না!
তোর চাচায় তোরে কিছু কইছে নি?
বেডাগো সামনে বয়ানে কইছে। আঁই জমি-জিরাতে গেলে, হাতরে নামি কাম কইল্লে বেলে হেই মেয়ার সমইস্যা অয়। অন আঁর কাম গিন হেতনে করি দিব নি? নাকি যেতাগোর তুন বিচার দিছে, হেতারা কইরব! নিজে করি-কুলাই নিজে রাঁধি নিজে খাই, ইয়ানেও শত্রু লাগি গেছে!
কিছু মনে করিছ না। হেই মেয়ার বয়ান হেই মেয়া কইরব, তোর কাম তুই করবি। অন যে তোর ঘরে চাইল নাই, হুজুড়ের বয়ান কি হেডের ভাত জোগাইব নি? নাকি হেই মেয়া তোর লাই অগগা জামাই খুঁজি আইনব!
এমন কথায় উল্টো মন খারাপ করে রোকিয়া। চাচির চার ভাই, সবচেয়ে ছোট ভাই এখনও আবিয়াইত্যা। লাড়িচাড়ি সে চাচিকে একটা সম্বন্ধ পাতানোর কথাও বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাচি এত পাষাণ, কোনও কথা কানে তোলে না। ভাবটা এমন, জজ-ব্যারিস্টারের মেয়ে ছাড়া ভাইয়ের বিয়ে দেবে না!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোকিয়া বলে, কী করিউম চাচা, বেকে শুধু তাল দেয়, আম দেইন্যা কেও নাই! সব দোষ রোকিয়ার, আর কারওগো কোনও পাপ নাই। বেকে মালান সাব আর আজি সাবের মাইয়া! দুধে ধোয়া তুলসি হাতা।
চাচি তাকে শলা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, তুই একবার আনোরার মার কাছে যা ছাই। আনোয়ারার বাবা গতকাল গঞ্জ থেকে এক বস্তা চাল কিনে এনেছেন, এমন কথা জানিয়ে দেন চাচি। কিন্তু আনোয়ারার মা জেঠির কাছে গেলে শুনতে হয় আঙ্গোও চাইল নাই রে, আইজ চাইর দিন ধরি। উধার করি চলিয়ের। তোর জেডার ব্যবসা-বাণিজ্য অন বালা ন। ম্যালা লস খাইছে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রোকিয়া। গত দুই বছর যাবত জেঠা আঙুল ফুলে কলা গাছ না হলেও টমেটো গাছ হয়েছেন। এটা শুধু সে কেন, গোটা ইদ্রিসপুর গ্রামের মানুষ জানে। জেঠা তক্কে তক্কে থাকেন, কে বিপদে পড়ে জমি বিক্রি করতে চায়। তখন সেই জমি কিনে নেবেন কম টাকায়। সুহৃদ হয়ে পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে কাছে যাবেন। তারপর মোল্লা পাম দি বিক্রির ফাঁদে ফেলবেন। এভাবেই সাত বছরে তিন কানি নাল জমি কিনে ফেলেছেন তিনি।
রোকিয়া কিছু না বলেই ঘরে ফেরে। তার ঘরে অন্তত একমাসের চাল মজুদ আছে। চাচি-জেঠির মন চাইতেই খোরা নিয়ে বেরিয়েছিল! মনে মনে ভাবে, বয়ানকারী মালান সাবের কাছে একশ টাকা ধার চাইবে একদিন!

বিজ্ঞাপন

পাঁচ.
স্বামীকে বিদেশে পাঠিয়ে শান্তি মেলেনি মালেকার, নিজে গিয়েও স্বস্তি পায়নি। জমি বন্ধক দিয়ে মামাশ্বশুরের হাতে তুলে দিয়েছে নগদ তিন লাখ টাকা, বাকি টাকা খবীর বিদেশে গিয়ে বেতনের টাকা থেকে আস্তে-ধীরে শোধ দেবে। এমন কথার ভিত্তিতেই খবীরকে বিদেশে নিয়েছেন মামাশ্বশুর। কিন্তু ওই নেওয়া পর্যন্তই। যে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল, মামা সেটা দিতে পারেননি। খবীরের আকামা, কফিল থেকে শুরু করে কোনও কিছুতেই মামার গরজ নেই। অথচ টাকা নেওয়ার আগে তার কথাগুলো ছিল কী সুন্দর! গ্রামের একরাম আদম বেপারীর অনেক বদনাম। কাউকে কাউকে বিদেশে যোগসাজশ করে বন্দি রেখে মুক্তিপণের টাকা আদায় করেছে, এমন কথাও ইদ্রিসপুর গ্রামের আকাশে-বাতাসে ভাসে। সেই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে একরাম দালালের কাছে যায়নি মালেকা। আপন মামার হাতেই ভাগ্নেকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছে। সেই আপন মামারও কংস মামা রূপ! বিদেশ-বিভূঁইয়ে শেষপর্যন্ত ভিন গ্রামের আরেকজনের শরণ নিতে হয়েছে খবীরকে। তার এই দোলায়মানতার মধ্যেই মামা একবার দেশে এসেছেন। খবীরকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। খবর পেয়ে মালেকা ছুটে গেছে মামার কাছে। মামা তাকে কী রে, আছততি ভালা-টালা বলে সেই যে অন্দরমহলে ঢুকে গেলেন, আর বেরোলেন না। ঘণ্টাখানেক পরে মালেকা খবর পেল, মামা ভেতরে ঘুমাচ্ছেন! খালি মুখেই ফিরতে হলো তাকে। খবীর যে মোবাইল ফোনে তাকে মিথ্যা কিছু বলেনি, সেটাও প্রমাণ হয়ে গেল এমন বেইনসাফি আচরণে।
দেড় বছর বেকার থাকার পর বিদেশে লুকিয়ে-চুরিয়ে কাজ শুরু করল খবীর। মামার সঙ্গে ভাল-খারাপ কোনও সম্পর্কই রইল না আর। মামা তো তাদের এড়িয়ে চলা করেছেন প্রথম থেকেই। মালেকা দেশ থেকে কল করলে ফোন রিসিভ করেন না। কথা অনুযায়ী মামা কাজের ব্যবস্থা করে দেননি, মালেকা এটা মামিকে জানাতেই তিনি উল্টা চেতা চেতেন তোগো কি লাইঙ্গার অভাব আছে নি? হিয়ানে কতজনের লগে তোর জামাইর চিন-পরিচয়! অন কি আর মামুরে লাগব নি!
বড় বিপদে পড়ে আসামির মতো লুকিয়ে-চুরিয়ে ছুটা কাজ শুরু করে খবীর। তাও তো বেশিদিন করার সুযোগ পেল না। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে একদিন উপর থেকে নিচে পড়ে যায় খবীর। পঙ্গু হয়ে ফেরে দেশে। নানাবিধ অনিশ্চয়তার মধ্যে এমনিতেই সে অন্ধকার দেখত চোখে, পঙ্গু হওয়ার পর অন্ধকার ঘনীভূত হলো আরও।
বাধ্য হয়ে এবার মালেকা নিজেই বিদেশে যায়। তার বোকাসোকা স্বামী সুস্থ অবস্থায় কিছু করতে পারেনি। এখন তো আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল। তাকে টেনে নিতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত। সৌদি আরবের এত সুনাম শুনেছে মালেকা, কাউকে পরাস্ত করতে প্রবাদ আউড়েছে হেতে কি আরবের খোরমা খাজুর নি; সেই পবিত্র ভূমিতেই কিনা এমন অপবিত্র কাজ চলে! কাগজে-কলমে গৃহকর্মীর চাকরি লেখা থাকলেও সে আদতে যৌনদাসীর চাকরি পায়। একই ঘরের বাবা ও ছেলের মনোরঞ্জন করতে হতো। এমন অনাচারে গৃহকর্ত্রীরও কোনও হেলদোল বা চিন্তা নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক! স্বামী-সন্তানের খাদ্য গ্রহণের মতোই নির্ভেজাল একটা বিষয় এটা! অকামে বেয়াহা লুচ্চাদের মধ্যে দ্বিধা কাজ না করলেও মরমে মরে যেত মালেকা। এসব নাফরমান-বেদ্বীনের কি মউতের ভয় নাই! নীরবে চোখের জলে বুক ভাসাত মালেকা। এর মধ্যেই দেশে সব কথা খুলে বলতে সমর্থ হয় সে। আদম বেপারী একরামের শত বদনাম থাকুক, সে মালেকার পাশে এসে দাঁড়ায়। দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করে।
ক্ষুব্ধ খবীর নিজের বেহাল দশা নিয়ে যতটা না চিন্তিত, বউয়ের অসম্মানে আরও বেশি লজ্জিত। মালেকা বিদেশে থাকতেই খবর জানাজানি হলে মা ও বোনের অনেক কটুকথা হজম করেছে সে। বিদেশ থেকে ফেরার দিনে, পাড়াপ্রতিবেশির নানান কথার জবাব দিয়ে মালেকা যখন একটু আজার পায়, শায়িত খবীরের পা দুটো চেপে ধরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে কাঁদে। বিব্রত খবীর বউকে উঠে আসতে বলে। মালেকা তার পাশে চৌকিতে বসলে বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় খবীর। বলে, রেন্ডিগিরি করি খাইতে অইলে বিদ্যাশে যাইতে অয় না রে, মালেকা। সব জাগার মইধ্যেই লুচ্চা ব্যাডারা আছে। যা অইবার অইছে, অন সব ভুলি যা গই।
তুঁই আঁরে মাফ করি দিও। আবার শুরু হয় মালেকার ফুঁপিয়ে কান্না।
খবীর এবার বউকে বাধা দেয় না। কেঁদে-কেটে হালকা হোক। মুখে বলে, তোর তো দোষ নাই রে মালেকা বানু। সব দোষ আঁর কয়ালের। উত্তরহাড়ার রহিম উদ্দিন খবর কইছে, হেলাল পাগলা যদি কারওগোরে একবার হুমাই দেয়, যত বড় পঙ্গুই অক, ভালা অই যায়। দোয়া কর, আঁর হেলাল পাগলার চিকিৎসা নিমু। শরীল ভালা অইলে তোর আর এত কষ্ট করণ লাগ্দ ন। আঁই ধরিউম সংসারের হাল।
কাঁদতে কাঁদতেই মালেকা স্বামীর বুকের উপর ঘুমিয়ে পড়ে। খবীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বউকে দেশে ফেরাতে পেরেছে অনেক কষ্টে। এর মধ্যে একরাম দালালকে দিতে হবে এক লাখ টাকা। পুরো টাকা এখনও বাকি। ধর্ষিতা মালেকা দেশে ফিরে পরিবারের সবাইকে যেন গণধর্ষণের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয় খবীর।
মালেকাও ভেবে পায় না, নিজের ও মাজুর মানুষটির পেট পালবে কীভাবে! শ্বশুর-শাশুড়িকেইবা কী বুঝ দেবে! ঘুম ভাঙলে এসব দুশ্চিন্তা জেঁকে বসে। নিদ্রা-জাগরণেও তাকে তাড়া করে সৌদি আরবের দুঃসহ স্মৃতি, এতগুলো টাকা বেহাত হওয়ার আতঙ্ক। মালেকার মনে হয়, যদি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারত তাহলে মুক্তি পেত ক্ষুধা-তৃষ্ণার ঝামেলা থেকে! তার আর ভাল লাগছে না, কুত্তার জীবন টেনে নিতে।

ছয়.
রাজা মিয়ার বউ কখন যে রাগান্বিত আর কখন নরম-মোলায়েম হয় বুঝতে পারে না অনেকেই। খোদ রাজা মিয়াও বোধকরি বউকে চিনতে পারেনি। বিয়ের পরপরই বিদেশে যাওয়ার টক উঠেছিল, তখন আতিকা তখন ছিল মারমুখী। রাজা মিয়া যেই না বলত, তোর বাপেরে কই কিছু টেঁয়া লই দে। আঁই বিদ্যাশ করি দিয়ালাইউম।
তখন আতিকা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বলত, খবরদার, বিদ্যাশের কতা কইলে এক কোবে কল্লা হালাই দিমু। আঁর আব্বা-আম্মা ত বিদ্যাশি জামাই ছাই বিয়া দেয় ন।
ঘোর বিদেশবিরোধী সেই আতিকার পাল্টে যেতে সময় লাগেনি। ইতোমধ্যে আদম বেপারী একরাম দালালের সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক পাতিয়েছে সে। একরামের উদ্যোগেই রাজা মিয়াকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। রাজা মিয়া বিড়বিড় করে বলে, এই আছিল তোর মনে! আঁরে বিদ্যাশ হাডাই দি আজাইর অই গেলি!
আতিকা কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে তার আঁচল ভিজে যায়। রাজা মিয়াকে বলে, সুযোগ হাইলে আঁর লাইও ভিসা হাডাই দিও। তোঁরে ছাড়া থাকতে হাইরতাম ন।
রাজা মিয়া বিদেশে গিয়ে ভাল চাকরি পেয়েছে। একরাম ভাইয়া শুনিয়েছে আতিকাকে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেও কোনও টাকা পাঠাতে পারেনি রাজা মিয়া। বাঁশের বেড়ার ঘরে তাদের বাঁধাই-করা বড় একটা রঙিন ছবি ঝোলানো। বিয়ের কিছুদিন পরে গঞ্জে গিয়ে স্টুডিওতে তুলেছে। সেখান থেকে একটা ছবি বড় করে গ্লাসে বাঁধিয়ে এনেছে। আতিকার খুব বেশি বিষন্ন লাগলে ছবিটা নামিয়ে এনে আঁচল দিয়ে মোছে। মুছতে মুছতে বুকে জড়িয়ে ধরে। ফটোফ্রেম তার তৃষ্ণার্ত বুকের উপশম কতটা দিতে পারে, এটা হয়তো ফটোফ্রেম কিছুটা বুঝতে পারে; আতিকাও নিশ্চয়ই কিঞ্চিত উপশম পায়।
আরও একজন বোধহয় আতিকার নিঃসঙ্গতা উপলব্ধি করেনিজের বুকে অতল জলের বুদবুদের আনাগোনা টের পান। ভাবনা-চিন্তায় রাখেন আতিকাকে। তিনি সোবহান মোল্লা খালু। এক রাতে পাড়া ঘুমিয়ে পড়লে সোবহান মোল্লা ধাক্কা দেন আতিকার দরজায়। ফিসফিসিয়ে বলেন, কই গো বউ, ঘুম গেছ নি?
সবে চোখ লেগে এসেছিল, এমন অবস্থায় দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে পোশাক সামলায় আতিকা। তারপর দরজার কাছে গিয়ে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে, কে লা?
মৃদু কণ্ঠে জবাব আসে, আঁই তোঁর সোবান খালু। দুয়ার খোলো।
দুয়ার খুলে সোবহান মোল্লাকে দেখে অবাক হয় আতিকা। বলে, কিল্লাই আইছেন?
এমনে। তোঁর খোঁজখবর লইতাম আইছি। আহা রে, তুঁই কত কষ্টে আছ! ছিন্তা করি আঁর কইলজাকান হাডি যায়।
আঁর কোনও কষ্ট নাই, খালু। আর কিছু কইবেন নি?
না। কোনও কিছু লাগলে আঁরে কইও। আনি দিমু।
আইচ্ছা।
মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দেয় আতিকা। বাকি রাত সে ঘুমাতে পারে না। তার শ্বশুর-শাশুড়ি কেউ নেই। এক মায়ের এক ছেলে হিসেবে আলাদাভাবেই থাকে তারা। তার চাচাতো-জেঠাতো জা আছে, তবে তেমন কারও সঙ্গেই সম্পর্ক ভাল নেই। হাঁস-মুরগির অনধিকার প্রবেশ ও ছাগলের গাছে মুখ দেওয়া নিয়ে সারা বছরই ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে।
পরদিন আবার সোবহান মোল্লা এসে হাজির, পরোপকারী ব্রত নিয়ে। আতিকা তাকে আশ্বস্ত করে কিছু লাগলে অবশ্যই বলবে। কষ্ট করে খালুকে আসতে হবে না। সে-ই বাড়িতে গিয়ে বলে আসবে। কিন্তু আতিকার আগমনের কোনও লক্ষণ না দেখে আরও চারদিন পরে খালু নিজেই হাজির। এবার আরেকটু গভীর রাতে। ফিসফিসিয়ে বলেন, বউ, দুয়ার খোলো।
আতিকা দরজা খোলে না। বলে, আমনে যান। আঁর কিছু লাগ্দ ন। অনুনয়-বিনয় করেও যখন দরজা খোলা হয় না, সোবহান মোল্লা বলেন, খোলো কইছি। নইলে আঁই বেড়া ভাঙ্গি অইলেও হাঁদাইউম।
ঠিকই তিনি বেড়া ধাক্কাতে শুরু করেন। আতিকা শঙ্কিত হয়, নরম বেড়া একটু ধাক্কাতে ঠিকই ভেঙ্গে যাবে। ভয়ে-আতঙ্কে দরজা খোলে সে। এবার পান-খাওয়া লাল দাঁত কেলিয়ে হাসেন সোবহান মোল্লা। বলেন, কই গো, তুঁই তো কিছুর লাই কইলা না?
আঁর বেগ্গিন আছে।
জামাই তো নাই!
জামাইও আছে। চিডি দিছে সামনের বছর আইব।
এটা মিথ্যা করে বলে আতিকা। যদিও রাজা মিয়া এখনও চিঠি দেয়নি। পোস্ট অফিসে গিয়েও সে খবর নিয়ে এসেছে। খালু এবার অন্য লাইনে হাঁটেন। বলেন, তোঁর ছায়া-বেলাউজ-বেসিয়ারের মাপ দিও ছাই। আঁই তোঁরে কিনি দিউম।
আঁর বেক আছে। দরকার নাই।
থাকলে আছে। আঁই ত উফহার দিউম, বুইজছ নি, উফহার!
এই যাত্রায় অনেক কষ্টে আতিকা রক্ষা পায়। সে ভয় দেখায়, খালু এসব করলে চিক্কুইর দিয়ে লোক জড়ো করবে। অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও খালু বিদায় নেন। তবে হাবভাবে বোঝা যায়, আতিকার এমন আচরণে তিনি অসন্তুষ্ট।
দুইদিন পরে আবার আসেন সোবহান মোল্লা। এবার তিনি মাটির ঘরেই বসে পড়েন। আতিকা তাকে কিছুতেই ওঠাতে পারে না। সোবহান মোল্লা পানের অমৃত রস কোঁত করে গিলে ফেলে বলেন, আঁর তোঁর কাছে কী ছাই তুঁই বুঝো না, আতিকা রানি?
আতিকা বলে, বুঝি না তো। আমনে কী ছান? আপনের মরণের ডর নাই? এক ঠ্যাং ত কবরে গেছে গই।
মরি তো যাইউমই, তার আগে তোঁর ইক্কিনি উপকার করি যাই। এসব বলে অগ্রসর হন সোবহান মোল্লা। ঝাপটে ধরার চেষ্টা করেন আতিকাকে। একসময় পেরে ওঠে না আতিকা। ভেঙে যায় তার সমস্ত প্রতিরোধ-ব্যূহ। শক্ত হাতের বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে সোবহান মোল্লার ঘাড়ে মরণকামড় বসিয়ে দেয়। এবার গলা-কাটা পাঁঠার মতো তড়পাতে থাকেন সোবহান মোল্লা। তার বক্ষ বিদীর্ণ আর্তচিৎকার রাতের নিঃশব্দতাকে ভেঙে দিয়ে পৌঁছে যায় অনেক দূরে। সবার আগে এসে উপস্থিত হয় আতিকার চাচাতো-জেঠাতো দেবর ও তাদের বউসহ ছেলেমেয়েরা। হাতে হারিকেন নিয়ে এসেছে তারা। ততক্ষণে আতিকাও কুপি জ্বালিয়েছে। সোবহান মোল্লার আর্তচিৎকার এখন বিলাপে রূপ নিয়েছে। সাদা পাঞ্জাবিতে দেখা মিলছে ছোপ ছোপ রক্তের। প্রতিবেশিরা ঘরে ঢুকে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না। সমস্বরে প্রশ্ন আসে কী অইছে গো?
আতিকা সোবহান মোল্লার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলে, চইত মাইস্যা কুত্তা হাগল অইছে। কুত্তা দৌড়ান।
এবার যেন দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারে রবাহুতরা। সোবহান মোল্লা কোঁকাতে কোঁকাতে এবার উঠে দাঁড়ান। বলেন, আল্লার গায় এই বেইনসাফি সইত না। আঁই ভালার লাই আইছি। আর আঁরেই বেইজ্জতি করি দিলি তুই, রাজার বউ!
দুইদিন পরে সালিশ বসে গ্রামে। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মসজিদ কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও দুজন উপদেষ্টাও উপস্থিত হয়েছেন। আরও আছেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। সোবহান মোল্লার এমন ভীমরতিতে ছেলে-বুড়ো সবাই অবাক হয়েছে। যে মানুষটা জামাতের সঙ্গে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, তার এ কী হাল! মসজিদ কমিটির সভাপতি এখলাস হোসেন সালিশের সূচনা করেন। সোবহান মোল্লার উদ্দেশে বলেন, মাইজ রাইতে আমনে রাজা মেয়ার বউর কাছে গেছিলেন কিল্লাই?
সোবহান মোল্লার ঘাড়ের ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, আঁই হেতির ভালার লাই গেছি।
কী ভালা?
আঁই হেতির ভালার লাই গেছি।
রাজা মেয়ার ঘরে যাই আমনে কী কইচ্ছেন?
এবারও তার অভিন্ন জবাব, আঁই হেতির ভালার লাই গেছি।
বারবার তার একই জবাবে সালিশিরা বিরক্তি বোধ করে। আর উপস্থিত নানা বয়সী নারী-পুরুষ মুখ টিপে হাসে।
শেষমেশ মসজিদ কমিটির ইমাম আতিকাকে প্রশ্ন করেন, মা জননী, তুঁই ক ছাই সোবহান মোল্লা তোঁর কী ভালা কইরতে ছাইছিল?
মুখ ঝামটে জবাব দেয় আতিকা কুত্তার ভালা তো কুত্তার মতোনই অইব!
ছোট মুখে বড় কথা, এমন জবাবে উপস্থিত সবাই চমকে গেলেও মুখ ফুটে কেউ আতিকার বেদ্দপির কথা বলতে পারে না। ঠিকই তো, সোবহান মোল্লা নিজেকে ওই জায়গাতেই নামিয়ে এনেছেন!
উপস্থিত সোবহান মোল্লার ছেলেমেয়েরাও নাখোশ। ক্ষুব্ধ পাঁচ সন্তান ভাবে আব্বা কেন বুড়ো বয়সে এসব করে!
সোবহান মোল্লার বড় ছেলে মাইনুল রবকান্ধা গ্রামে তার বন্ধু-স্ত্রী ডলির সঙ্গে বাইল দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল এতদিন, বাবার অকা-ে মনে হচ্ছে আপাতত ওই চেষ্টায় বিরতি রাখাই ভাল। যদিও নিজের মনকে শেষপর্যন্ত বোঝাতে পারে না সে, ডলি ভাবির ঢলঢলে মুখ, টসটসে শরীরটা ভাসতে থাকে মাইনুলের মনের সবিটুকু পর্দাজুড়ে।

সাত.
যার ছেলে বিয়ে উপযুক্ত হয়ে উঠছে, তার সঙ্গে গ্রামের বউঝিরা সচরাচর মশকরা করে না। সম্মান বা ভয় দেখিয়ে দূরত্ব বজায় রাখে। কুদ্দুস মাঝির ছেলেও বিয়ালাক হয়ে উঠেছে। সত্যিকার অর্থে বাবলু তার ছেলে নয়। বড় ভাইয়ের ছেলে। কিন্তু বড় ভাই সাপের ছোবলে মারা যাওয়ার পর থেকে মাসুম বাচ্চাটা তাকেই বাবা বলে ডেকে এসেছে। এমন সম্বোধনে ভাবি অস্বস্তি বোধ করলেও আশ্বস্ত করেছে কুদ্দুস মাঝি বড় ভাবি মার সমতুল্য। কিন্তুক হোলাহাইনের বাপও থান লাগে। নইলে হিগুন মনমরা অবস্তায় বড় অয়। ভাবি আর বাধা দেননি। কুদ্দুস মাঝিকে বাপ মেনে ও জেনে বড় হয়েছে বাবলু।
বিদেশ থেকে কত টাকা নিয়ে এসেছেন কুদ্দুস মাঝি, কেউ জানে না। তবে তার সংসারে অভাব কারও চোখে পড়েনি কখনও। প্রথম থেকেই ভাবির সংসারও চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। জোছনা ভাবির আগের চেয়েও সুন্দরী হয়ে ওঠাটাও নজর এড়ায়নি অনেকেরই। বিশেষ করে মহিলারা সুযোগ পেলেই জোছনাবন্দনা কিংবা কুৎসায় মাতার চেষ্টা করে। আতিকাও একদিন ঠাট্টা করে জোছনাকে বলেছিল, ভাবি, এক্কিনি ইমুই আইয়েন ছাই। আমনের গালের লগে আঁর গাল ঘষি লই। দেই আমনের মতো সোন্দর অইতাম হারি নি!
কুদ্দুস ভাইয়ের সঙ্গেও আতিকা সুযোগ পেলেই বাইছলামি করে। কুদ্দুস ভাইও টিপ্পনি কাটে কী গো রাজা মিয়ার বউ রানি বেগম, আর কতদিন আঙ্গো রে একলা রাইখবা! রাজা-রানির দেশে প্রজার বেইল নাই?
আতিকা একেক সময়ে একেক জবাব দেয় সময় য়োক! আকাশে তো জোছনা বিবি আছেই! প্রজা তো দেই রানির মাতার উফরে উডি বই থায়!
আজ মাঝদুপুরে কুদ্দুস মাঝিকে সামনে দেখে নিচুকণ্ঠে প্রস্তাব দেয় আতিকা ভাইছা, বাজারে যাইবেন কোন দিন? আঁরে এক প্যাকেট মায়াবড়ি আনি দিতেন হাইরবেন নি?
কুদ্দুস বোঝার চেষ্টা করে আতিকা তার সঙ্গে মশকরা করছে কিনা। বোঝা না-বোঝার মধ্যেই বলে, রাজা মিয়া তো খিঁচ মারি বিদ্যাশে হড়ি রইছে। তুঁই বড়ি খাওবা কার লাই?
আঁর লাই খামু। বড়ি খাইতে ওজর লাগে না!
কুদ্দুসকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আতিকা ঘর থেকে কিছু টাকা এনে গুঁজে দেয় হাতে। কুদ্দুসও গোপনীয়তা বজায় রাখতে টাকাগুলো সামলে নিয়ে হুবের হাতরের দিকে হাঁটা ধরে। মরিচ বুনেছে সেখানে, খেতটা দেখে আসা জরুরি।
কুদ্দুস মোড় ঘুরলে কোত্থেকে যেন বেরিয়ে আসে আতিকার জেঠাতো দেবরের বড় মেয়ে জুলেখা। জুলেখা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, মায়াবড়ি লাগব চাচি! আঁরে কইলেই হাইত্যা!
আতিকা অবাক হয় তুই বৈতালি ছুটকিয়া, বড়ি দি কী করস?
জুলেখা রহস্যময় হাসে। জবাব দেয় না। আতিকা এবার তাড়া দেয় আরে কতা কছ না কা? নাকি কোনও হোলার লগে বেনরাইনে লাইন মারছ?
এবার মুখ খোলে জুলেখা আরে না, এমনে রাখছি। সক করি!
ইয়ান বুঝি সকের জিনিস?
এবার ছায়া ঘনায় জুলেখার মুখে। বলে চাচি, সইত্য করি কছাই তোমরা কি আঁর বিয়া দিতা ন?
দীর্ঘশ্বাস পড়ে আতিকার। বিয়ে মানেই তো অনেক টাকার মামলা। ওর বাবা-মা সংসার সামলেই তো কূল পায় না। এটা ঠিক, জুলেখা বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে আরও আগেই। এখন বিয়ার হানি গাত হড়লে জুলেখা জড়ি-বাদলিয়া দিনের হলিশাকের মতন তরতরাই বাড়ি উইঠব উরফের দিগে। সংকটের কথা না তুলে আতিকা প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে অনগার হোলারা ভালা ন। দেছ না, ঘনঘন বিয়া ভাঙি যায়! বিয়া না ভাঙলেও মাইয়ারা চলি যায়। ধ্বজভঙ্গ রোগ বাঁধাই রাখছে এমন হোলাহাইন ম্যালা রে, জুলেখা!
বিয়া ভাঙি যায় দেয় বুঝি মাইনষে বিয়া কইরত ন আর! রোগ থাইলে রোগের ওষুধও আছে।
আতিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ছিন্তা করিছ না। আঁইও তোর লাই হোলা খুঁজুম। কুদ্দুস ভাইয়ের হোলা রে তোর হছন্দ অয় নি?
ধুর, কী যা তা কন! বলে দৌড়ে পালায় জুলেখা। আতিকা এতেই বুঝে যায়, জুলেখার মনে রঙ ধরে আছে আরও আগ থেকেই!

বিজ্ঞাপন

সাত.
মায়াবড়িটা লুকিয়ে এসে জুলেখা কুদ্দুস মাঝিকে মোড়া দেয়। বলে, বইয়েন, ভাইছা।
ঘর থেকে এনে দেয় দুইটা বিস্কুট, এক খোরা মুড়ি আর এক গ্লাস টিউবওয়েলের ঝকঝকে সাদা পানি। কুদ্দুস খেতে থাকলে আরেকটা মোড়া এনে আতিকা বসে। বলে, হোলার বিয়া খাবাইবেন কোন দিন?
কুদ্দুস ঢকঢক করে পানি খায়। তারপর অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, রাজা-রানির তো রাজকইন্যা নাই। তাইলে কার লগে বিয়া করাইউম?
যুইগ্য মাইয়া আছে। আমনে রাজি থাকলে কন। সম্বন্ধ হাডাই।
না রে, বইন। অন ন। আরও হরে চিন্তা করিউম। হোলা অনঅ বেলাইনে রই গেছে। আইল্যা-জাইল্যা কিচ্ছু বানাইতাম হারি ন।
ভাবি-ছিন্তি ছান। ভালা মাইয়াগার বিয়া অই গেলে হরে কিন্তুক কাঁঈদবেন!
অবাঞ্ছিত এমন আলাপ ভাল ঠেকছে না বলে উঠে পড়ে কুদ্দুস। কিন্তু বাড়িতে এসে সে যে অভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়বে ভাবতে পারেনি। বাবলু তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে বলে, আব্বা, আমনের লগে আঁর এককান কতা আছে।
ক।
লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বাবলু বলে, আঁরে বিয়া করাই দেন। যৌতুক লন। হরবাড়ির টেঁয়া দি বিদ্যাশ যামু।
বিদ্যাশ যাবি কিল্লাই। দ্যাশে কী সমস্যা?
গায়-গিরস্তি আর ভালা লাগে না। গাধার মতন খাডি, তারপরও ফসল মাইর যায়। জড়ি-বাদলি, রঈদণ্ডখরা একেক বছর একেক সমইস্যা!
কুদ্দুস অবাক হয়। এখনকার ছেলেগুলো সবকিছু নগদানগদি চায় কেন! হঠাৎ লায়েক হয়ে ওঠা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, হরবাড়ির টেঁয়া দি বিদ্যাশ যাবি! বউ উডাই আইনতেও তো ম্যালা টেঁয়া খরচ অইব।
বউ হেতাগো বাড়িত থাক। ইঁয়ানে থাকলে তো আমনেগো ভাত-কাড় দ্যান লাগব!
কুদ্দুস মাঝি কখনও ছেলেকে অভাব বুঝতে দেয়নি। তারপরও ছেলে কীভাবে এতটা বৈষয়িক হয়ে উঠল। কুদ্দুস একবার ঘরের দরমার দিকে তাকায়, আরেকবার ছেলের দিকে; চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করে ভবিষ্যতের চিত্রনাট্য কেমন হতে পারে! যেসব লোকজন বিদেশে যায়, তাদের ঘরে পাকা দালান ওঠে ঠিক, কিন্তু সুখও চাপা পড়ে দালানের ইট-পাথরের নিচে। নিজেও বিদেশে ছিল বলে এসব তার ভালভাবেই জানা। বিদ্যাশে সবার হুরি হড়ে না। সবদিক চিন্তা করে কুদ্দুস বলে, বিয়ার ছিন্তা বাদ দি কদিন শান্তিতে থাক। তোর খেত-খামারিও করণ লাগ্দ ন।
আইচ্ছা। বিয়ার ছিন্তা বাদ। আমনে নিজেই টেঁয়া দেন, ডুবাই যামু!
এত টেঁয়া নগদে কোনাই হাইউম? আইচ্ছা, তোর মার লগে আলাপ করি ছাই।
কুদ্দুস মাঝি বড় ভাবির সঙ্গে আলাপ করার আগেই খবর পান জুলেখাকে সঙ্গে নিয়ে বাবলু পালিয়েছে। তারা এখন জোছনার বড় বোনের বাড়িতে আছে। খালা-খালু যদি সম্মনি না দেন, কাজী যদি বিয়ে না পড়ান, তারা কোর্ট ম্যারেজ করবে।
কুদ্দুস মাঝি কূলকিনারা করতে পারে না, একদিনের মধ্যেই কীভাবে এত বড় অঘটন ঘটে যায়। তবে কি এর নেপথ্যে থেকে আতিকা কোনও কলকাঠি নেড়েছে! আতিকা কোন পাত্রীর কথা বলতে চেয়েছিল, শোনা দরকার ছিল। ছেলের চিন্তা বাদ দিয়ে কুদ্দুস মাঝির মনে আরেকটা চিন্তা ঠাঁই নেয়। আতিকা কোন কাজে লাগাবে মায়াবড়ি! আতিকার প্রতি যুগপৎ মায়া ও বিবমিষা নিয়ে কুদ্দুস মাঝি ঘর ছাড়ে। কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হবে তাকে, দ্রুতই!

আট.
দিনে দিনে প্রাচুর্যের ছোঁয়া লাগে ইদ্রিসপুর গ্রামে। নতুন নতুন ভবন ওঠে। তিনতলার ছাদে বউ-ঝি ও বাড়িতে বেড়াতে আসা ঝিয়ারিরা এখন ধান শুকায়। আতপ চালের গুঁড়িও শুকাতে দেয়। আচার খল্লি আমসির নিরাপদ জায়গাও ছাদ। মাটির কাছে যেতে না পারলেই বাঁচে বর্তমানের বউয়েরা। এ ইদ্রিসপুর গ্রামের একদিকে প্রাচুর্য থাকলেও আরেকদিকে দারিদ্র্য পিছু ছাড়ে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ অসাম্য পরিস্থিতিতে কারও লুঙ্গি খোলার উপক্রম হয় আর কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে লাইঙ্গা কব্জা করে রাখার! হাসি-কান্নার মধ্যেই ইদ্রিসপুর গ্রামের লোকজন ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাংক থেকে কিস্তির টাকা তোলে। সময়মতো সেই টাকা পরিশোধ করতে না পারলে আবার ঘর ছোলাই লই যায়, পালা হাঁস-মুরগি গরু-ছাগল বেহাত হয়ে যায়, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যাংকের শক্তিশালী কর্মীবাহিনী। এই দারিদ্র্য, ব্যাংকের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতেই কেউ কেউ বিদেশের পথ খোঁজে। যদিও বিদেশে আগের মতো শান্তি-স্বস্তি এখন আর নেই। তবুও কী করবে নিরন্ন বিপন্ন মানুষ, একটা উপায় তো খুঁজে বের করতে হবে!
প্রবাসীর সংখ্যা যেমন আরও বাড়তে থাকে গ্রামে, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মোবাইল ফোনের সংখ্যাও। বউদের কেউ কেউ চেনা-অচেনা বেডার সঙ্গে খোশগল্পে মাতে। দূরের কেউ কেউ ইথারে তাদের রঙিন স্বপ্ন দেখায়, ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না এমন সংসারের গল্প বলে। এসব গল্পে বুঁদ হয়ে থাকতে বউ-ঝি ও বৈতালিরা একাধিক মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম কেনে। এ সিমগুলোই হাতে তুলে তাদের দেয় স্বপ্নলোকের চাবি; আবার স্বপ্নভুবনের চাবি খুঁজতে গিয়ে কারও কারও সামনে নরকের দরজাও খুলে যায়। নানাভাবেই স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের চিত্র আঁকা হতে থাকে বাসিন্দাদের মনে। কার হুরি হড়ব আর কার হুরি হইড়ত ন; শানবাঁধানো ঘাটলায় বসে এমন সুদূরপ্রসারী চিন্তায় আকুল-ব্যাকুল হয়ে ইদ্রিসপুরের মেয়েরা মায়েরা বোনেরা বউয়েরা বৈতালিরা ঝিয়ারিরা…!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ছোটকাগজ সম্পাদক

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন