বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের প্রজন্ম

April 24, 2023 | 3:56 pm

বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির হাজার বছরের এক গৌরবগাঁথা। ঐ গৌরবের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশিদার হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। আমার জন্ম ১৯৪৮ সালে ২ জানুয়ারী। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার অম্বর নগর গ্রামে। মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার। দাদা হাজী আতর আলী ছিলেন তালুকদার। প্রচুর জমি জমার মালিক। পিতা আলী আকবর চৌধুরী ছিলেন তার একমাত্র পুত্র। আলালের ঘরের দুলাল বলতে যা বুঝায়। যৌবনের প্রথম থেকেই বাবা সামাজিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হন। পরিচিত হন তৎকালীন নোয়াখালী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর সাথে। তাঁদের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। যার কারনে তাঁর নামেই রাখলেন আমার নাম। আমার সব ভাইদের নামের সাথে হক যুক্ত। আমি শুধু হায়দার। আমার বড় ভাই নুরুল হক চৌধুরী (যিনি কমরেড মেহেদী নামে পরিচিত) একজন ভাষা সৈনিক। তিনি ১৯৫২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে ২০ ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে নিজ এলাকায় কয়েক বন্ধু মিলে কাদামাটি দিয়ে নির্মান করেন একটি শহীদ মিনার। নোয়াখালী প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি আলমগীর ইউসুফের নেতৃত্বে একটি গবেষনায় দেখা যায় যে, এই শহীদ মিনারটি ছিল নোয়াখালীর ১ম শহীদ মিনার। তিনি সরকারীভাবে স্বীকৃত একজন ভাষা সৈনিক। আমি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের পরিবার একই সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার মতো বিরল মর্যাদার অধিকারী। আমাদের সবার জন্ম সময়টাই মনে হয় এর জন্য সহায়ক ছিলো।

বিজ্ঞাপন

জীবনের শেষ প্রান্তে বসে কতো স্মৃতি সামনে আসছে…

মনে পড়ে ১৯৬২ সালে ফেনী পাইলট হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। হোস্টেলে থাকি। স্কুল ছুটি। বাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে ফেনী ট্রাঙ্ক রোডে আসলাম। বড় ভাইয়ের বন্ধু মুহাম্মদ উল্ল্যাহ ভাইয়ের সাথে দেখা। তার সঙ্গে তৎকালীন প্রভাবশালী দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক মাহবুবুল হক সাহেব। তাঁরা মাইজদী যাচ্ছেন হোসেন শহীদ সোহওয়ারর্দীর জনসভায়। বললেন তুমিও চলো আমাদের সাথে সেখানে তোমার ভাই ও থাকবেন। আমিতো মহা খুশি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন আসবেন তখন শেখ মুজিব ও থাকবেন। এক সাথে দু’জনকে দেখবো। মাইজদী আসলাম। জনসভা শুরু হলো। কি একটা হই চই। একটা আওয়াজ মুজিব ভাই কই! শেখ মুজিব তখনো ষ্টেজে উঠেননি। একটু পরে মঞ্চে উঠলেন সুদর্শন একজন মানুষ। জনতার উদ্দেশ্য হাত নাড়লেন, জনতা শান্ত। জীবনে প্রথম দেখলাম। তাঁর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। কি কন্ঠস্বর। অসাধারণ বক্তব্য। জনতা মনমুগ্ধ হয়ে তার বক্তৃতা শুনলেন। সোহওরাওয়ার্দী সাহেবের বক্তব্য শেষে জনসভার সমাপ্তি। বড় ভাইয়ের সাথে অনেক জায়গায় ঘুরলাম। তিনি বললেন রাতে রেল স্টেশনে সোহরাওয়ার্দী সাহেব মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা হবে। তারপর বাড়ী যাব। আমি ভীষন উত্তেজিত। এত বড় মানুষগনের সাথে দেখা হবে আলাদা অনুভূতি। সময় মতো আমরা ষ্টেশনে গেলাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও শেখ সাহেব পাশাপাশি সেলুন। আমরা গেলে শেখ সাহেব বের হয়ে সোহারাওয়ার্দী সাহেবের সেলুন গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি গেটে আসলেন। শেখ সাহেব সোহরাওয়ার্দী সাহেব কে বললেন, স্যার জেলা ন্যাপের নেতারা দেখা করতে এসেছে। তখন জেলা ন্যাপের সেক্রেটারী সালাম ভাই। আমার বড় ভাই নুরুল হক চৌধুরী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সালাম ভাই একে একে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবার নামের আগে মিস্টার যুক্ত করলেন। সর্বশেষ সাক্ষাৎ প্রার্থী আমি। সালাম ভাই পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন ইনি মাস্টার রাজ্জাক। সোহরাওয়ার্দী সাহেব হেন্ডসেক করলেন আর বললেন এতো মিস্টারের মধ্যে মাত্র একজন মাস্টার। শেখ সাহেব আমার পিটে হাত বুলিয়ে দিলেন। কিশোর বয়স। এতো বড় মাপের মানুষের সামনে আসা স্বপ্নের মতো। আজও সেদিনের মধুর স্মৃতি ভুলতে পারি না। সেই থেকে দেশের সকল আন্দোলনে সক্রীয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। নেতা ও আদর্শের প্রতি এখনো অনুগত।

১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ হয়ে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান হলো। বাঙালিরা ভেবেছিলো মুসলমানদের রাষ্ট্র হলে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। কিন্তু ১৯৪৮ সালেই বুঝা গেল বাঙালিরা ব্রিটিশ এর হাত থেকে পাকিস্তানের উপনিবেশে প্রবেশ করেছে। ১৯৪৮ এর ২৩ ফেব্রুয়ারী আইন পরিষদে খাজা নাজিম উদ্দীন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করলেন। তৎকালীন সাংসদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বললেন পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষিরা সংখ্যা গরিষ্ঠ তাই বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত।

বিজ্ঞাপন

শেখ মুজিবুর রহমান তখন তরুন ছাত্র যুব নেতা। তিনি ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করতে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর নেতৃত্বে এই ৪৮ সালে ১১ মার্চ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চায় দাবীতে মিছিল বের হয়। সচিবালয়ের সামনে থেকে তাকে গ্রেফতার করার হয়। অবশ্য তুমুল আন্দোলনের কারনে দু’দিন পর তিনি মুক্তি পান। ১৭ মার্চ’৪৮ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ঘোষনা দিলেন টৎফঁ ধহফ টৎফঁ ঝযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ. ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকলো মানুষ সোচ্চার হলো। শেখ মুজিব কে গ্রেফতার করা হলো। তখন তিনি মাত্র ২৮ বছরের যুবক। পাকিস্তানীরা তাঁকেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করলো। সম্প্রতি অনুসন্ধানে দেখা গেছে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল এই দু’বছরে তাঁর বিরুদ্ধে ৩২১টি গোয়েন্দা রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠানো হয়। শেখ মুজিব যথার্থই বুঝেছিলেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা চলবে না। পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি পন্য পাট পাকিস্তানের মোট রপ্তানির ৭৫% ভাগ যার ১০০% ই বাংলাদেশেই উৎপন্ন হতো। অথচ পাকিস্তানের উন্নয়ন বাজেটের ২০% এর বেশী পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য খরচ হতো না। সমস্ত শিল্প কারখানা ব্যাংক বীমার মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা।

পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬% বাঙালি অথচ দেশের রাজধানি, সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর হেড কোয়ার্টার সব তাদের ওখানে। সিভিল সার্ভিসের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরো প্রকট ছিলো। সিএসপি, ইপিসিএস ইত্যাদিতে বাঙালী অফিসার ছিলো ৩% থেকে ৫%। সাধারণ কেরানী চাকরি ১০% এর কিছু বেশি ছিলো। ১৯৫৪ সালে নির্বাচন হলো বাংলার জনগন হক-ভাসানি সোহরাওয়ার্দী ডাকে নৌকা মার্কায় ভোট দিলো। কিন্তু শাসকগোষ্ঠি বাঙালী এই বিজয়কে মেনে নিতে পারেনাই। কিছুদিনের মধ্যেই সংবিধানের ৯২-ক ধারায় সংসদ বাতিল করা হলো। সামরিক অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন। সব নেতা জেলে। জেলে বসেই শেখ মুজিব আন্দোলনের ছক আঁকেন। তাঁর নির্দেশেই ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র ফেনী পাইলট হাই স্কুলে পড়ি। সিনিয়র ক্লাসের ভাই মাওলানা ওয়াইজ উদ্দিন ও জয়নাল হাজারীর নেতৃত্বে প্রায় মিছিল হতো, যোগ দিতাম। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের (ঐ সময় যাদেরকে বলা হত বেসিক ডেমোক্রেট) ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘোষনা করেন। আন্দোলনের অংশ হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে সম্মিলিত বিরোধী দল। বড় ভাইদের সাথে আমিও সে নির্বাচনের প্রচারে অংশগ্রহন করি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় দেখা যায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সম্পুর্ণ অরক্ষিত সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর কেউ এখানে নেই। ভারত আক্রমন করলে প্রতিরোধ করার কোন শক্তিই ছিলোনা আমাদের। বাংলার মানুষ নিরাপত্তহীনতায় ভুগলো।

১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে যোগদানের জন্য ঢাকায় এলাম। তখন চীন রাশিয়ার আদর্শিক দ্বন্দ্ব। যা আমাদের এখানেও সংক্রমিত হয়েছিল। সম্মেলন স্থল ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে গিয়ে দেখলাম মারামারি হওয়ার অবস্থা। পরে আমাদেরকে বলা হলো ইকবাল হলের ছাদের সভা হবে, গেলাম। সেখানে মতিয়ার চৌধুরীকে সভাপতি ও সাইফুদ্দিন মানিককে সাধারন সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। অপর পক্ষে রাশেদখান মেননকে সভাপতি করে আরেকটি কমিটি গঠিত হয়। এভাবে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া মেনন গ্রুপে বিভক্ত হয়। পরবর্তী সময় ১৯৬৮ সালে আমি নোয়াখালী জেলা ছাত্র ইউনিয়ন এর সভাপতি নির্বাচিত হই। ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ এর সকল সংগ্রামে সক্রিয় ছিলাম।

বিজ্ঞাপন

শেখ মুজিবর রহমান লাহোর প্রস্তাবের অনুসরেন সম্পুর্ণ স্বায়ত্বশাসন তথা ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যাবস্থার কথা ভাবলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুযারী লাহারো ৬ তফা দাবী উত্থাপন করলেন। ৬ দফার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো পাকিস্তান হবে ফেডারেল রাষ্ট্র। দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র ছাড়া সব ক্ষমতা থাকবে অঙ্গ রাষ্ট্রের হাতে। পাকিস্তান সরকার প্রমাদ গুনলো। পাকিস্তানের অনেক গনমাধ্যমে ও শেখ সাহেবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলো। লাহোর থেকে ফিরে আসলেন। ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি কাজে লেগে গেলেন। ২৩ মার্চ’১৯৬৬ ছয় দফা আওয়ামীলীগের জাতীয় কমিটির সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হলো। তা পুস্তিকা-আকারে জনগনের মধ্যে বিলি করা হলো। বাঙালী ৬ দফাকে মেগনাকার্টা বা মুক্তি সনদ হিসাবে গ্রহন করলো। পূর্ব বাংলার সাধারণ জনগন ৬দফার পক্ষে সমর্থন জানালো। শেখ মুজিব সহ আওয়ামীলীগের সব নেতাকে গ্রেফতার করা হলো। মনে পড়ে থানা পর্যায়ের ছোট নেতা ও বাদ গেলোনা। আওয়ামলীগের কেন্দ্রীয় অফিসে বসার মতো কোন নেতা কর্মী ছিলো না। পাকিস্তান সরকার মনে করলো সব তাদের নিয়ন্ত্রনে। কিন্তু কিছুদিন পর তাদের ভুল ভাঙ্গল। ৭ জুন’১৯৬৬ ছয় দফা ও শেখ মুজিব সহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দাবীতে হরতাল আহবান করা হলো। মুসলিমলীগার ও কিছু বাম নেতা মন্তব্য করলে এই হরতালে সাড়া মিলবে না। ৭ই জুন উল্টো চিত্র। ভোর না হতেই তেজগাঁ, আদমজি, বাওয়ানীসহ দেশের সকল প্রাপ্তের মিল কারখানা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় একটি রিকসা ও ছিলো না। পাকিস্তান সরকারের পুলিশ মিলিটারি মিছিলে গুলি চালালো। শ্রমিক নেতা মনুমিয়া সহ অনেকে নিহত আহত হলেন। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি শাসকরা দিশেহারা। সিদ্ধান্ত নিলো যেভাবেই হোক শেখ মুজিব ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে। ১৯৬৮ সালের ১ম দিকে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র খ্যাত রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রজু করা হলো। নেতারা সবাই জেলে। শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখলো। তাঁকে সাধারণ জেলে রাখার সাহস করে নাই সরকার। নেতা নাই কিন্তু আন্দোলন থেমে নেই। আমাদের স্বস্তি নেই। নির্দেশ আসার সাথে সাথে রাজপথে যত অত্যাচার আসুক না কেন সবাই নেমে পড়ি। ইতমধ্যে সব ছাত্র সংগঠন নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। সরকারি দল এন এস এফের (দোলন কামরানের নেতৃত্বে) একটি অংশ ও ছাত্র সংগ্রাম পরষদের যোগদিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ৬ দফা সম্বলিত এগার দফা দাবি প্রনয়ন করা হলো। শহর-গ্রাম ১১ দফার পক্ষে উত্তাল। আগরতলা মামলা চললো। শেখ সাহেবকে কোর্টে আনে নেয়। কিন্তু তিনি নির্ভিক। দৃঢ়চেতা। তিনি যেন নিশ্চিত ছিলেন পাকিস্তানিরা তার কিছুই করতে পারবে না। আদালতে ও দিব্বি পাইপ হাতে। নেতার মনোবল যখন তুঙ্গে থাকে তখন জনতা কিছুকেই ভয় পায়না। সেদিনের পরিস্থিতি যারা দেখে নাই তারা কি করে বুঝবে গণঅভ্যুত্থান কি? মিছিলে লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস, জল কামান, গুলি যত বেশি চলে মানুষের অংশ গ্রহন তত বাড়ে। ২০ জানুয়ারী ১৯৬৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন। আসাদের লাশের মিছিলে লাখ লাখ মানুষের অংশ গ্রহন। জনগনের কাছে আইয়ুব খাঁন নতি স্বীকার করলেন। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার হলো। ২২ ফেব্রুয়ারী’৬৯ শেখ মুজিব নি:শর্ত মুক্তি পেলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাদীতে ভূষিত করলো। সেইদিন থেকে তিনি আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু’। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। আইয়ুব বিদায় নিতে বাধ্য হলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন সেনা প্রধান ইয়াহিয়াহ খান নতুন রাষ্ট্রপতি হলেন। দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষনা করলেন। এল এফও নামে একটা (খবমধষ ভৎধসব ড়ৎফবৎ) কঠিন শর্ত জুড়ে দিলেন। যেখানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দেয়া হলো তিনি ইচ্ছে করলে নির্বাচিত সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু বললেন এলএফও থাকলে ও তিনি নির্বাচনে যাবেন। বাংলার জনগনের উপর ছিলো তাঁর অগাধ আস্থা। তিনি জনতার ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ নির্বাচন হলো। জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ১৬০টিতে জয়ী হলো বিভিন্ন কোটায় আরও ৭টি আসন লাভ করল। এতে মোট আসন দাড়ালো ১৬৭। আওয়ামীলীগ পাস্তিানের জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগুরু (তখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩১৩) দল হিসাবে তাদেরই সরকার গঠন করা কথা। ১৯৭১ এর ১৫ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় সংসদের প্রথম অধিবেশন আহবান করলেন ইয়াহিয়া, বাধ সাধলেন ভুট্টো। তিনি সময় চাইলেন নতুন তারিখ ৩রা মার্চ ৭১। ইয়াহিয়া একদিকে বঙ্গবন্ধুকে প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে অভিহিত করলেন অন্যদিকে তলে তলে ষড়যন্ত্রের জাল বুনলেন। ১লা মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে ইয়াহিয়া রেডিওতে ঘোষনা দিলেন। আমি তখন গ্রামের বাড়ীতে স্থানীয় হাই স্কুল মাঠে কয়েকজন গোল হয়ে বসে আগের দিনের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাৎ একজন এসে রেডিওর ঘোষনা আমাদেরকে জানালো। ওখান থেকেই স্লোগান শুরু হলো। ইয়াহিয়ার ঘোষনা মানিনা মানিনা। সংসদ বসতে হবে। ১১ দফা মানতে হবে। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো। শেখ মুজিবের পথ ধর বাংলার স্বাধীন করো। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকশ লোক জমা হয়ে গেলো। সবাই উত্তেজিত। মিছিল বাজার ছেড়ে বেগমগঞ্জ থানা হেড কোয়ার্টার চৌমুহনীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা। ছয় মাইল পথ হেঁটে দৌড়ে পৌছে গেলাম। মিছিলে তখন হাজার হাজার মানুষ। ওখানে গিয়ে দেখি চারদিকে থেকে স্বত:স্ফুর্ত মিছিল এসে লোকে লোকারান্য। ১৯৬৯/১৯৭০/১৯৭১ এ এটা ছিল সাধারণ চিত্র। ১৯ শে ফেব্রুয়ারী ৭১ আমাদের নিকবর্তী থানা সেনবাগে বিক্ষুদ্ধ ছাত্র জনতা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেওয়ার কারনে পুলিশ ও সেনা সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত এবং বহু আহত। আমরা খবর পেলাম সন্ধ্যার পর। সাথে সাথেই জড় হয়ে বিশাল মিছিল নিয়ে সেনবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। সময় সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেই সময় রাস্তা ঘাটের অবস্থা ছিল করুন। এর মধ্যেই হাজার হাজার উত্তাল জনতার মিছিল।

১৯৭০ এর নির্বাচনের ছোট্ট একটি গল্প বলি। ১৯৭০ এ লেখাপড়া শেষ করে কর্মজীবন নিয়ে ভাবছিলাম। তখন স্থানীয় স্কুলের হেড স্যার বললেন তুমিতো অবসর আছো কিছুদিন ক্লাশ নাও। আমি ও উৎসাহিত হয়ে যোগ দিলাম। ঐ খন্ডকালীন শিক্ষাকতার সুবাদে ৭০ এর নির্বাচনে পুলিং অফিসার হতে হলো। নির্বাচনের ডিউটি করার জন্য একটা স্কুলে গেলাম। ভোট শুরু হলো। দুপুর ১২টার দিকে একজন বৃদ্ধ লোক এলেন ভোট দিতে। তিনি চোখে দেখেন না। এ বিষয়ে নিয়ম হলো একজন স্বাক্ষীর সামনে তার অভিপ্রায় অনুযায়ী প্রিসাইডিং অফিসার সিল মারবেন। প্রিসাইডিং অফিসার ঐ আসনে সে সকল প্রার্থী ছিলো তাদের নাম উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করলোÑ এদের মধ্যে তিনি কাকে ভোট দিবেন। বয়স্ক চাচা রেগে গেলেন তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেন আমি এদের কাউরে ভোট দিব না। আমি মুজিবরকে ভোট দিমু। তখন প্রিসাইডিং অফিসার নৌকায় সিল দিলেন এবং উনাকে বুঝিয়ে বলেন মুজিব সাহেবের মার্কা নৌকা আমরা আপনার ভোট নৌকায় দিয়েছি। তিনি খুশি মনে বাড়ী ফিরলেন। এই ছিলেন শেখ মুজিব যিনি তৃণমূলের মানুষের হৃদয়ের স্থান করে নিয়েছিলেন।

এহেন পরিস্থিতিতে ৩রা মার্চ’৭১ পল্টনের জনসভা থেকে ঘোষনা হলো ৭ই মার্চ’৭১ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান থেকে পরবর্তী নির্দেশনা দিবেন। তখনো গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর জনসভায় আসতেই হবে। ঐ সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বড় করুন। রাস্তা ঘাট খুবই খারাপ। সড়ক পথে দাউদকান্দি, মেঘনা, কাচপুর ফেরী পার হয়ে ঢাকা আসতে হয়। রেলে চাঁদপুর, চাঁদপুর থেকে কোন রকমে লঞ্চে ঢাকা পৌছালাম। সদরঘাট থেকে মিছিল করে রেসকোর্স ময়দানে। সবার মনে একই কথা। কি বলবেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার ঘোষনা না অন্য কিছু। তবে নেতার প্রতি জনতার অগাধ আস্থা। তিনি যা বলবেন জনতা তাই মানবেন। কি এক কঠিন অবস্থা। দলের ভেতর উগ্র অংশ চাপ দিচ্ছিলো, স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়ার জন্য। অন্যদিকে পাকিস্তানিরা অপেক্ষা করছিলেন হটকারী কিছু করলেই চরম আঘাত হানবে। গোয়েন্দারা ঘুর ঘুর করছে। মাথার উপর সেনা হেলিক্যাপ্টর চক্কর দিচ্ছিলো। উদ্যানে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষ অবিরাম স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলো। ৩টার পর তিনি আসলেন মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। দশ লক্ষ জনতার সমাবেশ স্তব্ধ। বক্তৃতা শুরু করলেন। প্রত্যেকটি বাক্যের সাথে জয় বাংলা ধ্বনিতে উচ্ছাস প্রকাশ করছিলো জনতা। আটারো মিনিটে ভাষন শেষ হলো। স্বাধীনতার কথা, মুক্তির কথা, গেরিলা যুদ্ধের কথা সাথে সাথে সংসদ অধিবেশন ডাকার কথা সবই বললেন। কিন্তু তাকে বিচ্ছন্নতাবাদি দেশদ্রোহী অপবাদ দেওয়ার সুযোগ রাখলেন না। নির্মলেন্দু গুনের কাল জয়ী কবিতা, ‘‘স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’’, এখানে কবি বলেন, ‘গণ সূর্যের মঞ্চ কাপিয়ে কবি শুনালেন অমর কবিতাখানি, এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। এর মধ্যেই ৭ই মার্চের ভাষনে বাংলা সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের আবেগ ফুটে উঠেছে। ৫ই এপ্রিল ১৯৭১ বিশ্ব বিখ্যাত ঞযব ঘবংিবিবশ গধমধুরহব বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং নামে অভিহিত করে।

তারপরের পর্ব মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। এলাকায় ফিরলাম। ৯ মার্চ ৭১ নেতার নির্দেশ অনুযায়ী নিজ এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করলাম। জনাব ফয়জুল ইসলাম সভাপতি আমি সাধারণ সম্পাদক আমাদের প্রথম কাজ ছিলো সেনাবাহিনী, ইপিআর পুলিশ ও আনসার বাহিনীর অবসর প্রাপ্ত ও ছুটিতে থাকা লোকজনকে খুঁজে বের করা আর যুবকদের প্রাথমিক সামরিক ট্রেনিসং এর ব্যবস্থা করা। ডাক দেয়ার সেঙ্গ সঙ্গে প্রাক্তন সেনা ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা যোগাযোগ করলেন। ট্রেনিং মানে শারীরিক কশরত শুরু হলো। কিন্তু ট্রেনিং এর সরঞ্জাম কই পাবো। আপাতত বাঁশ দিয়ে কাজ শুরু হলো।

বিজ্ঞাপন

ইতোমধ্যে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসলেন। ১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সাথে সংলাপ করলেন। আমরা নিশ্চিত ছিলাম আলোচনায় কিচ্ছু হবে না। তারা আঘাত করবে। তাই হলো। ২৫ মার্চ’৭১ রাত ১১:৩০ মিনিট এ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হলো। নির্বিচারে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করল তারা। রাত ১২টা ২০ মিনেট বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন। রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেলো। ২৬ মার্চ’১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনার বার্তা প্রত্যেক জেলায় জেলায় মাইকে প্রচার করে আওয়ামীলীগ কর্মীরা। ঐ সময় রেডিও ছিল খবরের একমাত্র বাহন। আমি অনবরত রেডিওর নব ঘুরাচ্ছিলাম। হঠাৎ ২৬ তাং দুপুর ২টা কিছু পর চট্টগ্রাম রেডিও থেকে একটা তেজদীপ্ত কন্ঠ ভেসে এলে। চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগ নেতা এম.এ. হান্নান তিনি জানালেন রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহির বর্বোচিত আক্রমন শুরু করেছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত আহত। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন। জনগনকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আহবান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু নিরাপদ স্থান থেকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তখন কেউ জানতো না বঙ্গবন্ধু বন্দী হয়েছেন। ঐদিন বিকেলে সবাই জড় হলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকলাম।

এলকায় আমরা যুব বিগ্রেড গঠন করলাম। পাড়ায় পাড়ায় লাঠি নিয়ে পাহারা বসালাম। যাতে কোন দুষ্কৃতিকারী কোন অঘটন ঘটাতে না পারে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সেনারা নোয়াখালী দখল করলো। বড় বড় বাজারে মুসলিমলীগাররা লুটপাট চালালো। শত শত হিন্দু ও আওয়ামীলীগারদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জালিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হলো। হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলো। সিদ্ধান্ত হলো এলাকার যে সকল হিন্দু পরিবার ভারত যেতে চায় তাঁদেরকে নিরাপদে বর্ডার পার করে দেয়ার ব্যবস্থা করা। এরূপ ৪০/৪৫টি পরিবারকে আমরা বর্ডারে পৌছায়ে দিয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু স্কুলের হেড মাস্টার তাকে নিজে গিয়ে পৌছায়ে দিলাম।

জেলার কেন্দ্র থেকে নির্দেশ এলো যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে হবে। শত শত যুবক যোগাযোগ করলো। দেখে দেখে অন্তত: ২০০/৩০০জন পাঠালাম। জুলাই মাসের মাঝামাঝি নিজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মা যেন কিভাবে বুঝলো। কিছু বলবেন মনে হচ্ছে। কাছে গেলাম। বললাম আমার এখানে কাজ শেষ। এখন ট্রেনিং নিতে যাব। আজ রাতে রওয়ানা দেবো। তুমি কিন্তু কাঁদতে পারবে না। তিনি বুকে টেনে নিলেন। তবে চোখের পানি জোর করে বন্ধ রাখার কারনে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। রাতে বিদায়ের পালা। বন্ধু তাহের, সোবহান ভাই, নজরুল, খোরশেদ আরো ৩/৪জন। প্রচন্ড বৃষ্টি এর মধ্যেই বের হলাম। মা হারিকেন হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন। আঁচল মুখে ঢেকে রেখেছেন। হয়ত কান্না বন্ধ করার চেষ্টা। কাঁদলে যদি সন্তানের অমঙ্গল হয়। এমন অবস্থা বাংলার সব মায়ের। বৃষ্টি কাদার মধ্যে পায়ে হেটে ভারত এর বর্ডারে পৌছালাম, তারপর টিলা ডিঙ্গিয়ে চোত্তাখোলা নামক একটি জায়গায় পৌছালাম। চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ কোন জন মানুষের সাড়া নেই, এদিকে পেটে প্রচন্ড ক্ষুদা। কিছুক্ষন পর নজরুল একটি টিউবওয়েল এর খবর পেলো, সবাই সেখানে গিয়ে পানি পান করলাম। এর মধ্যে এক লোক কাঁঠাল নিয়ে আসলো, ১ টাকা দিয়ে বিশাল আকারের কাঁঠাল কিনলাম এবং তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিলাম। বিকালের দিকে এক দোকানির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ফেনীর তৎকালীন এম.এন.এ জনাব খাজা আহম্মেদ এর কাছে গিয়ে আগরতলা যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন ২-৩ দিন অপেক্ষা করতে হবে। ঐ দোকানির কাছে এসে একটি হাড়ি, আলু, চাল, সিদ্ধ করে তৃপ্তির সাথে খেলাম। ৩দিন পর খাজা সাহেবের সহায়তায় আগরতলা ক্রাফটস হোস্টেলে পৌছালাম। আগস্ট থেকে ট্রেনিং। আগরতলা থেকে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাবো। একটি কার্গো বিমান। রশি দিয়ে আসন তৈরী। কিছুদুর যাওয়ার পর ইঞ্জিন সমস্যা। কাছের এক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। কয়েক ঘন্টা রিপেয়ার পর গন্তব্যে পৌঁছালো সন্ধ্যা ৭টায়। সকাল থেকে কিছু খাওয়া নেই। বাঁশের তৈরী থাকার সিট। তাতেই গা এলিয়ে ছিলাম। ৯টার সময় খাওয়ার ডাক পড়লো। ভাত আর আলুর ঝোল। খেলাম পরম তৃপ্তির সাথে। মনে হলো জীবনে এতে ভালো খাওয়া খাইনি। ক্ষিদের জ্বালা এমনই নির্মম প্রথম বুঝলাম।

টানা দেড় মাস ট্রেনিং চললো। ৩০৩ রাইফেল, এসএলআর, এসএমসি, এলএমজি ৩” রকেট লাঞ্চার ডেমুলেশন এবং গেরিলা যুদ্ধের কৌশল যথা বুবিট্র্যাপ, ক্যামপ্লেজ ইত্যাদি। একজন ওস্তাদের কথা এখনো কানে বাজে। তিনি আসামের কোন এলাকার হবেন। বলতেন, গেরিলা কবি মরতা নেহি মারতা হ্যায়। এক গুলি এক দুষমন। তিনি বলতেন গেরিলা যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী অনেক শত্রু একসাথে মারতে গিয়ে নিজে মরবে না বেঁচে থাকলে বহু শত্রু মারার সুযোগ থাকবে। তাই গুলি কম খরচ করবে। ট্রেনিং শেষে বিলোনিয়ার পাশে এক বেস ক্যাম্পে আসলাম। সেখানে মটিভেশনের পর অক্টোবরে দেশে প্রবেশ করলাম। তারপরে যুদ্ধে অংশ গ্রহন। যুদ্ধকালীণ সময়ের কতো কতো মধুর স্মৃতি আমার বিবেচনায় নারীরাই এদেশের শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধা। মা সন্তানকে, স্ত্রী স্বামীকে, বোন ভাইকে যুদ্ধে পাঠাতে একটু ও দ্বিধা করেননি। প্রত্যেকটি মা বোন আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। নিজের খাওয়ার নেই ধার করে এনে আমাদেরকে খাইয়েছেন। মনে পড়ে নভেম্বরের মাঝামাঝি আমরা ১০/১১ জন দীর্ঘ ১০মাইল হেটে কাঁধে অস্ত্র গোলাবারুধ নিয়ে ভোর রাতে এক গরীব কৃষকের বাড়ীতে পৌঁছালাম। শীতের কুয়াশার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে গায়ে কাদা। মায়ের বয়সী একজন মহিলা এসে নিজের শাড়ীর আঁচল দিয়ে আমার গায়ের কাদা মুছতে লাগলেন। উনাকে নিবৃত্ত করতে কষ্ট হচ্ছিল। উনাদেরকে বললাম আমাদের সঙ্গে শুকনা খাওয়া আছে আপনাদের কিচ্ছু করা লাগবেনা। ব্যাস্ত্ হবেন না। পাশাপাশি দুটো চকি ছিলো শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। এলাকার ৪/৫ জন গেরিলা পাহারায় ছিলো। সকালে উঠলাম। হাতমুখ ধুয়ে সাথীদের বললাম আমাদের খাওয়া যা আছে বের করো খাবো। বাড়ীর কর্তা হত দরিদ্র মানুষটি এগিয়ে এলেন বললেন, বাবা আমার কিছু নাই। আমরা কয়জন মিলে সামান্য খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আসেন সবাই খাবেন। গিয়ে দেখি মুরগী, মাছ, ডাল সব আছে। দেখে আমাদের সবার চোখে পানি এলো। শেষ মুজিব নামে ঐ মহামানব বাঙালির মধ্যে এমন দেশ প্রেমের বীজ বপন করেছিলেন। আমি হলপ করে বলতে পারি বাঙালীর পুরুষ নারী নির্বিশেষে সকলের অকুন্ঠ সমর্থন না পেলে ৯ মাসে বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত করা সম্ভব ছিলো না।

অবশেষে বিজয়ের দ্বার প্রান্তে বাংলাদেশ। সারা দেশে মুক্তি বাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমনে পাকিস্তানিসেরা নাস্তনুবাদ। ৩ ডিসেম্বর’১৯৭১ পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলো। ভারতীয় সেনা ও মুক্তি বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্র বাহিনী গঠিত হলো। ৬ ডিসেম্বর’১৯৭১ ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিলো। মিত্র বাহিনী গঠিত হলো। মিত্র বাহিনী সারা দেশে পাকিস্তানীদের উপরে স্থলে, জলে, আকাশে, একযোগে ব্যাপক আক্রমন শুরু করলো। একে একে পাকিস্তানীদের বিভিন্ন ঘাটির পতন হতে লাগলো। ১৬ ডিসেম্বর’ ১৯৭১, বিকাল ৪টা ৩১ মিনিট: পাকিস্তানের ৯৪০০০ সৈন্যসহ জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পন করলেন। আমি তখন রনাঙ্গনে। তিনদিন আগেই থেকে আমরা বুঝেছিলাম এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমরা গুলি ফুটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলাম। আপামর জনতা ঘর থেকে বের হয়ে আমাদেরকে অভিনন্দন জানালো। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে চারদিকে মুখরতি।

এত আনন্দের মধ্যেও জাতি মন খুলে হাসতে পারলো না। কারণ বঙ্গবন্ধু নেই। কোথায় আছেন তাও কেউ জানেনা। সম্প্রতি এক পল্লী কবি একটা গান বানিয়েছেন- ‘‘যে কারিগর দেশ বানাইছে, সেই কারিগর নাই’’। আসলে সাধারণ মানুষের অনুভূতি তাÑই ছিল। সব বাঙালীর বুকে বেদনার ভার। সারেন্ডার এর আগে পাকিস্তানিরা দেশের সমস্ত রাস্তা ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, পোর্ট, বিমানবন্দর সহ সব স্থাপনা ধ্বংস করে গেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ লুট করে কাগজের নোটগুলিও পুড়িয়ে দেয়। ১৪ই ডিসেম্বর’১৯৭১ জেনারেল নিয়াজির নির্দেশে আলবদর আলশামসরা শত শত বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করে। জানুয়ারীর ৭ তারিখ সুখরব এলো। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাচ্ছেন। ১০ জানুযারী তিনি দেশে পৌঁছাবেন। স্বাধীনতা, মুক্তি পূর্ণতা লাভ করলো। তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় ফিরলেন জাতির পিতা। দেশের দায়িত্ব নিলেন। সব কিছু শূণ্য। রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূণ্য। পোর্ট ধ্বংস। রেল ধ্বংস। সড়ক ধ্বংস। খাদ্য গুনাম শুণ্য। ঘরছাড়া এক কোটি মানুষকে পুনর্বাসন করতে হবে। ঘর হারানোদের, ঘর করে দিতে হবে। তিনি ধীরস্থির। সব সামলালেন। রাস্তাঘাট চালু, পোর্ট চালু, সচিবালয়, সেনা, নৌবাহিন গঠন, বিমান বাহিনী গঠন, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি সহ হাজার হাজার কাজ করে গেলেন। আট মাসের মধ্যে নতুন সংবিধান। ১৪ মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন। বার্ষিক বাজেট প্রনোয়ন। প্রথম বাজেট ৭৮৫ কোটি টাকা। বর্তমান টাকার মানে ২০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। পঞ্চ বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সব করেন বিদ্যুৎ গতিতে। এর মধ্যে ৭৪ সালের বন্যা। নগদ টাকায় কেনা খাদ্য আসলো না। ষড়যন্ত্র। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। ব্যাপক অপপ্রচার। পাকিস্তানপন্থী আমলাদের অসহযোগিতা। তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন। সব দল মত এক করে বাকশাল গঠন করলেন। চারদিকে উন্নয়নের জোয়ার। দশ টাকার চালের দাম ৩ টাকায় নেমে আসলো। মানুষ স্বস্তি পেলো। শত্রুরা ভাবলো এখনই আঘাত না করলে আর সময় পাবে না। চরম আঘাত হানলো। জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো। অন্ধকার নেমে আসলো। ভাগ্যগুনে তার দুই কন্যা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গেলেন।

১৫ আগস্ট’ ১৯৭৫ আমি সিলেটে সরকারি একটা ব্যাংকে কর্মরত। একটি বেচেলর কোয়ার্টারে থাকি।
বাসার পাশে একটি পুকুরে গোসল করতাম। সকালের দিকে গোসোল করতে যাচ্ছিলাম। কয়েজন জড় হয়ে আছে। বললেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকে বললো ভূয়া খবর। আমি বললাম বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তারা কখনো রেডিও স্টেশন যেতে পারতো না। গোসল না করেই বাসায় ফিরলাম। আমার ৫/৬ জন থাকি এক সাথে। সবাই স্তব্ধ। কারে মুখে কথা নেই। একদিন পর জানলাম। বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা ছাড়া আর কেউ নেই। আশার আলো মিটিমিট করে জ্বললো। হয়ত একদিন তাদের মাধ্যমেই ফিরে পাব বাংলাদেশ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরলেন। আমি তখন জনতা ব্যাংক এলিফ্যান্ট রোড শাখায় কর্মরত। আমি শরীর খারাপের অজুহাতে সহকর্মীকে ভোল্টের চাবী বুঝিয়ে দিয়ে এয়াপোর্টের দিকে ছুটলাম। এয়ারপোর্ট তখন লোকে লোকারন্য। তারপর দলের দায়ীত্ব নিয়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে দলকে সংগঠিত করলেন এবং জনমত সৃষ্টি করলেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামীলী ক্ষমতায় আসল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলাম বুক ফুলিয়ে।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছাতো। সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গবেষনায় দেখা যায় বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় মাত্র সাড়ে তিন বছরে শত প্রতিকুলতার মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭% এর উপরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি যে সকল পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৯৯৫ সালেই মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যেতো। তাহলে অনুমান করা যায় ২০২১ সালে আমরা কোথায় পৌঁছাতাম।

বঙ্গবন্ধু কন্যা এখন প্রধানমন্ত্রী। পিতার মত চারিত্রিক দৃঢ়তা, দেশ প্রেম সবাই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। গত ১৫ বছরে তিনি দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আমি নিশ্চিত আগামী ৫ বছর পর আমরা ভিন্ন বাংলাদেশ দেখবো। নতুন প্রজন্ম এর ফল ভোগ করবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নও তাই ছিলো।

আমাদের প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা পেয়েছিলো বলেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বর্তমান সময়ে শেখ হাসিনা আছেন, তিনি দিয়ে যেতে পারবেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। সেদিন হয়তো আর দূরে নয়।

জীবনের শেষ বেলায় আমাদের প্রজন্মের যারা বেঁচে আছে তাঁদের একটিই স্বপ্ন এই দেশটি গড়ে উঠুক ছবির মতো, একটি স্বপ্নের দেশে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে, স্বাধীনতা সার্থক হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সভাপতি-রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা’৭১ জাতীয় কমিটি

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন