বিজ্ঞাপন

কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা [পঞ্চম পর্ব]

April 24, 2023 | 5:45 pm

মনি হায়দার

[পঞ্চম পর্ব]

বিজ্ঞাপন

মি. আগা খান?
কুকুরেরা মি. আগা খানের বেডরুম দখল করে লেজ গুটিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে। সাদা-কালো রঙের দাঁতাল কুকুরটা সবার সামনে। বোঝা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে কুকুরদের নেতা হচ্ছে এই সাদা-কালো দাঁতাল কুকুরটা। আগা খানের চারজন স্ত্রী সামনে বসা, খাটের নরম বিছনার ওপর।
কুকুর নেতার ডাকে তাকায় মি. আগা খান, কি বলবে বলো।
এই বাড়িটা তোমাকে ছাড়ার নোটিশ দিয়েছিলাম আরও একমাস আগে।
আমাকে নোটিশ দেওয়ার তোমরা কে? তোমরাতো কুকুর। কুকুরের কথা কেন শুনতে হবে?
ডান পা দিয়ে মুখের নীচটা একটু আচঁড়ে নেয় সাদা-কালো দাঁতাল কুকুর, তোমার কথা ঠিকই। আমরা কুকুর, একবর্ণও মিথ্যা নয়। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে তোমাদের গ্রাস করছি। নিশ্চয়ই টের পেয়েছো, তোমার খান ভিলার আশেপাশে বেশ কয়েকটা বাড়ি আমরা দখলে নিয়েছি।
রেগে ওঠে আগা খান, কিন্তু কেনো?
তোমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা বাধ্য নই। তোমাকে স্পষ্ট করে জানাই, আমরা যে সব বাড়ি দখল করেছি, প্রত্যেকটা বাড়ি অবৈধভাবে দখলে ছিল। সেই অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করে বাড়িগুলো দখল নিয়েছি।
আমার বাড়ি অবৈধ নাকি? আমার কাছে জমির দলিল আছে।
তোমার কাছে জমির দলিল আছে, জানি। কিন্তু আমরা আরও জানি, এই দলিল ভুয়া।
কি বলতে চাও তুমি?
এই বাড়ির দলিল ভুয়া। এই জামির মালিক ছিলেন সৈয়দ হারুন। তুমি তাকে চিনতে? চিনতে না?
একটু সময় নিয়ে জবাব দেয় আগা খান, না। আমি সৈয়দ হারুন নামের কাউকে চিনি না।
কুকুরটা দাঁত বের করে হাসে, তাকায় পেছনে সারিবদ্ধভাবে বসা কুকুরদের দিকে। ওরাও হাসছে। বিছানার উপর বসা আগা খানের চার স্ত্রীর মধ্যে প্রথম স্ত্রী শাকিলা পারভীন চোখ তুলে তাকায়। শাকিলা পারভীনের বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি। শরীর এখনও অটুট গাঁথুনিতে। কিন্ত প্রেসার আর ডায়বেটিকসের কারণে প্রায়ই ক্লান্ত থাকে। সৈয়দ হারুনের প্রসঙ্গ এলে শাকিলা পারভীন তাকায় আগা খানের দিকে। আগা খানও তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
শাকিলা পারভীন, প্রশ্ন করে সাদা-কালো কুকুরটা, আপনি কি সৈয়দ হারুনকে চেনেন?
চুপচাপ ধরনের শাকিলা পারভীন নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে না, কাঁদতে শুরু করে।
জয়নাব লতা ধাক্কা দেয় শাকিলা পারভীনকে, কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেনো?
যদিও একটি বাড়ির চারতলায় চারজন থাকে, কিন্তু আগা খানের পারমিশন ছাড়া কেউ কারও সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে না। ঈদের দিন কিংবা আগা খানের জন্মদিনে সবাই ছাদে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে। টুকটাক গল্পগুজব করারও সুযোগ পায় চার সতীন।
ওনাকে কাঁদতে দিন মিসেস জয়নাব লতা, উত্তর দেয় কুকুরটা, সাদা-কালো।
কিন্তু কি হয়েছে ওনার? উনি কাঁদবেন কেনো সৈয়দ হারুনের প্রসঙ্গে? প্রশ্ন তোলে দ্বিতীয় স্ত্রী মিসেস করুণা বিধি।
তোমরা চুপ করবে? খেঁকিয়ে ওঠে আগা খান।
চুপ করলে কি হবে মি. আগা খান। আপনার রায় আজকেই হয়ে যাবে।
তুমি আমাকে কি মনে করো? তোমরা আমার বাড়িতে আসবে, আমার মান সম্মান নিয়ে খেলবে, আমি কিছু বলবো না, মনে করেছো? আমার বাড়ির চারপাশে একশ লোক পাহারায় আছে অস্ত্রসহ, যারা এক কিলোমিটার দূর থেকে দক্ষ শিকারি স্যানাইপার। এক ট্রিগারে তোমাদের শেষ করে দেবে।
ওরা কেউ বেঁচে নেই মি. আগা খান!
আগা খান অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় সাদা-কালো দাঁতাল কুকুরটার দিকে, অসম্ভব। আমার লোকেরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। আর বিদেশ থেকে ওয়েল ট্রেনিং নেওয়া।
হতে পারে, আমরাও কম ট্রেনিং নিইনি মি. আগা খান। কুকুরদের মাঝখানে বসা একেবারে কালো কুকুরটা বলতে শুরু করে, কুকুরটা আকারে খুব বড় নয় কিন্তু শারীরিক বৈশিষ্ট্যে খুব বলশালী মনে হয়, তোমার একজন অস্ত্রধারীও বেঁচে নেই।
অসম্ভব!
কালো কুকুরটা লাল লম্বা জিহ্বা বের করে হাসে, বেশ কিছুক্ষণ হাসে কালো কুকুর, সঙ্গে যোগ দেয় রুমের মধ্যে বসে থাকা সারিবদ্ধ কুকুরেরা। গোটা রুম কুকুরের কদাকার ভয়াবহ হাসির দমকে ভরে যায়। ভয়ে, অশরীরী ভয়ে শিউরে ওঠে মি. আগা খান, আগা খানের চার স্ত্রী-শাকিলা পারভীন, করুনা বিধি, জয়নাব লতা এবং দিলরুবা ছন্দা। ভয়ে, ত্রাসে গলা শুকিয়ে যায়।
খেকিয়ে ওঠে আগা খান, কি শুরু করেছো তোমরা? থামো!
রুমের কুকুরগুলো হঠাৎ থেমে যায়। রুমে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। ভয়ে, আতঙ্কে হাঁসফাঁস করে আগা খানের চারজন স্ত্রী― শাকিলা পারভীন, করুণা বিধি, জয়নাব লতা আর দিলরুবা ছন্দা। চারজন স্ত্রীর সামনে এতোদিনের বাঘ স্বামী আগা খান বিড়ালের এই পরিপ্রেক্ষিত মেনে নিতে পারছে না। প্রবল ক্রোধ শরীরের মধ্যে দাপিয়ে ওঠে। ইচ্ছে হচ্ছে, রুমের প্রত্যেকটা কুকুরের গলা কেটে…
মি. আগা খান, আপনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পারেন, যদি আমাদের উপর আপনার আস্থা না থাকে!
জানালা দিয়ে কি দেখব?
দেখবেন আপনার লোকদের মৃতদেহ। দেখে, আপনি নিশ্চিত হোন, আমরা কি করতে পারি, আর কি পারি না― খুব ঠাণ্ডা গলায় বলে কালো কুকুর।
চার চারজন স্ত্রীর সামনে কুকুরদের এই বেইজ্জতিতে ক্রুদ্ধ আগা খান জানালা খুলে নিজের বাড়ির উঠোনে চোখ রাখে। দেখতে পায়, পোষা মানুষগুলো রক্তাক্ত বা থেতলানো শরীরে পড়ে আছে। অধিকাংশের গলার নলি নেই। মানে কুকুরেরা আক্রমণ করে গলার উপর…। ভয়ে তীব্র শীতলপ্রবাহ নামে শরীরের মেরুদন্ড জুড়ে। শরীরের শক্তি কর্পূরের ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায়। নিজেকে হালকা তুলার মতো লাগছে মি. আগা খানের। এতগুলো নিজের মানুষ হারিয়ে গেল? কতো শ্রম আর অর্থের বিনিয়োগে এদের তৈরী করেছিলো!
বসুন মি. আগা খান!
কালো কুকুরের আদেশে বিছানার উপর বসে আগা খান। তাকায় স্ত্রীদের দিকে। স্ত্রীরাও তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে। কুঁকড়ে যায় আগা খান। জীবনে এ কোনো অভিশাপ নেমে এল! সেই যে ত্রিশ বছর আগে ব্যবসা শুরু করেছিল, দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে সব কিছুই নিজের ইচ্ছে মতো সাজিয়ে নাচিয়ে নিয়ে গেছে, যা করতে চেয়েছে, করেছে। সেই আগা খান―
আমাদের হাতে সময় কম মি. আগা খান, বলতে শুরু করে সাদা-কালো কুকুরটা। আপনি আমাদের নোটিশ অনুসারে কাগজপত্র রেখেছেন এই বাড়ির?
না!
কেনো?
আমি তো নিশ্চিত ছিলাম, আমার লোকদের আক্রমণে তোমরা বাড়ির আশেপাশেও আসতে পারবে না।
বুঝেছি। কিন্তু আমরা আপনার কাগজপত্রের অপেক্ষা না করেই নিয়ে এসেছি। সাদা-কালো কুকুর ইঙ্গিত করলে পাশের একেবারে ছাই রঙের কুকুরটা গলায় ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে এক বান্ডিল কাগজ বের করে আগা খানের সামনে বাড়িয়ে ধরে। কাগজগুলো হাতে নিয়ে আগা খান হতভম্ব। সবই এই বাড়ির কাগজ! কোত্থেকে কিভাবে পেলো? কুকুরদের সাংগঠনিক তৎপরতায় মুগ্ধ আগা খান।
এই দলিল এবং রেকর্ড তো আপনারই? প্রশ্ন করে ছাই রঙের কুকুরটা।
মাথা নাড়ায় আগা খান, হ্যাঁ আমারই জমির কাগজপত্র।
কিন্তু এই দলিলে আপনার সিগনেচার ঠিক থাকলেও মি. সৈয়দ হারুনের সিগনেচার ঠিক নেই।
আগা খান ছাই রঙের কুকুরের দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে। আর রুমের সবকটা কুকুরও তাকিয়ে দেখে আগা খানকে। আগা খানের চার স্ত্রীর মধ্যে শাকিলা পারভীন ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। শাকিলা পারভীনের হঠাৎ কান্নার শব্দে তিন সতিন বিস্মিত। আর আগা খান ম্রিয়মান চোখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মি. আগা খান, আপনাকে আগেই জানিয়েছি, আমাদের সময় কম। আপনার সিগনেচার ঠিক থাকলেও সৈয়দ হারুনের সিগনেচার ঠিক নেই কেনো? প্রশ্ন করে ছাই রঙের কুকুর।
আগা খান তাকিয়ে থাকে কুকুরদের দিকে, প্রতিটি কুকুর পেছনে লেজ গুটিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে সামনের দুটি পায়ের উপর। প্রত্যেকে জিহ্বা বের করে ঝিমাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ঝিমাচ্ছে না, অপেক্ষা করছে নির্দেশের। সাদা-কালো কুকুরের নির্দেশ পেলে পলকে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আপনি বলতে পারছেন না!
মি. আগা খান বিমর্ষ যন্ত্রনায় মুষড়ে পড়ে।
শুনুন আগা খান, আপনি ইট বালুর ব্যবসা শুরু করছিলেন আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। সেই সময়ের ক্ষমতাসীন সরকারের এক মন্ত্রীর সঙ্গে আপনার সর্ম্পক গড়ে ওঠে। সেই মন্ত্রীর প্রভাবে আপনি দ্রুত লোকাল সরকারের অনেকগুলো সরকারি বাড়ি নির্মানের ঠিকাদারী ভাগিয়ে নিয়ে, খুব দ্রুত কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। গড়ে ওঠে আপনার ক্ষমতার বলয়। তৈরি করেন আগা বাহিনী। এই সময়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে সৈয়দ হারুনের সঙ্গে। সৈয়দ হারুন ব্যবসায়ি হলেও সহজ সরল ছিলেন। তার বাড়িটার পিছনের দিকের বাড়িটার মালিক ছিলো এক পুলিশ কর্মকর্তা ইকরার হারিরি। পুলিশের জোরে করিম জাফর এই বাড়িটি দখল নিতে চাইলে সৈয়দ জাফর আপনার সাহায্য চায়। আমি ঠিক বলছি মি. আগা খান?
মি. আগা খান হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে, মগজের বিন্দু বিন্দুতে জাগে তীব্র তৃষ্ণা। এক গ্লাস হলে মন্দ হতো না, নিজের অতীতের ঘটনাবলী শুনতে শুনতে পান করা যেত।
সৈয়দ জাফরের সঙ্গে চলে এলেন আমপুরার এই বাড়িটিতে। তখন এই বাড়িটি ছিল সাড়ে আটকাঠার উপর দোতলা একটা বাড়ি। নিচটা পাকা হলেও দোতলায় ছিল টিন। কিন্তু গোটা বাড়িটা ছবির মতো সাজিয়ে রাখতেন সৈয়দ হারুনের স্ত্রী শাকিলা পারভীন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, বিকেলের দিকে আমার বাড়িতে আসে মি. আগা খান― কুকুরের সংলাপের মধ্যে ঢুকে পড়ে শাকিলা পারভীন। আমি তিনটে বিড়াল পালতাম। বিকেলে বারান্দায় বসে বিড়ালদের খাবার দিচ্ছিলাম। দেখি, বাড়িতে তখন বাড়ির নাম ছিল শাকিলা ভিলা। সৈয়দ হারুন আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। আমরা প্রেম করেই বিয়ে করেছিলাম, অবশ্যই পারিবারিকভাবে। তো দেখি, বাড়ির গেট দিয়ে কালো রঙের নতুন ঝকঝকে একটা গাড়ি ঢুকছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ভাবলাম, দখলে নিতে চাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা ইকরার হারিরি আসলো নাকি! না, দেখি গাড়ি থেকে নামছে আমার স্বামীর সঙ্গে লম্বা চওড়া এক পুরুষ। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সৈয়দ হারুন, আমার বন্ধু আগা খান। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর সরকারের উঁচুমহলের সঙ্গে আছে যোগযোগ। ইকরার হারিরির গ্রাস থেকে আমাদের বাড়ি রক্ষা করবে। আমি অভিভূত। বড়ো কষ্ট করে করা এই বাড়ি রক্ষা করে দেবে আগা খান।
আমি নাস্তার আয়োজন করলাম। দুই বন্ধু হেসে গল্প করে নাস্তা খায়। সন্ধ্যার আগে যাবার সময়ে আগা খান আমাকে বলে যায়, ভাবি আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার বাড়ি আপনারই থাকবে। আর পুলিশ কর্মকর্তা ইকরার হারিরির ব্যপারটা আমি দেখছি। মানুষটা কথায় এমন একটা জোর বা আশ্বাস ছিল, আমি বিশ্বাস করেছিলাম, ইকরার হারিরির আগ্রাসী হাত আর আমাদের শাকিলা ভিলায় পড়বে না। আমার ধারণা সঠিক ছিল, কারণ আগা খান আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার সাত কি আটদিনের মাথায় গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায় সেই পুলিশ কর্মকর্তা ইকরার হারিরি। আমাদের বুকের উপর থেকে ভয়ের পাথরটা নেমে যায়। দিনচারেক পরে সৈয়দ হারুনের সঙ্গে আবার বাসায় আসে আগা খান।
আমি কৃতজ্ঞতায় বিমূঢ় আগা খানের প্রতি। অনেক পদের রান্নার আয়োজন করি বাড়িতে। রাতে দুই বন্ধু খাওয়া দাওয়া শেষে ড্রয়িংরুমে বসে। সৈয়দ হারুন আমার স্বামী ডেকে বলে, এক বাটি মাংস আর ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল দিয়ে যাও। আমি তো জীবনে সরাসরি মদ পান করা দেখি নাই। আমি আমার স্বামীর আদেশানুসারে বাসার ভেতর থেকে এক বাটি মাংস আর ফ্রিজের এক বোতল ঠান্ডা পানি এনে দেখি, আগা খানের গাড়ির ড্রাইভার চমৎকার লম্বা একটা বোতল নিয়ে হাজির গাড়ি থেকে। আমি বুঝলাম, এটা মদের বোতল। দুজনে পান করবে। আমার খুব খারাপ লাগলেও মেনে নিলাম। মনে মনে ভীষণ কৃতজ্ঞ ছিলাম আগা খানের প্রতি। না হয় একদিন পানই করলো বন্ধুর বাড়িতে। করুক না। আমি বেডরুমে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠে দেখি আগা খান নেই। সৈয়দ আমার পাশে ঘুমিয়ে।
ঘটনার সাত কি আট দিন পরে রাতে সৈয়দ হারুন বাড়ি ফিরে আসে না। বিয়েব পর সৈয়দ হারুন কোনোও রাতে বাইরে থাকেনি। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। আমি সকালে ফোন দিলাম আগা খানকে। আগা খান অবাক। পাল্টা প্রশ্ন করে, বাড়ি ফেরেনি সৈয়দ হারুন? আমরা মতিঝিলে একটা বৈঠকে ছিলাম বিকেল পর্যন্ত। বৈঠক শেষে হারুন চলে যায় গাড়িতে, আমি চলে যাই আমার অফিসে। ভাবি, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দেখছি―
আমি আশ্বস্ত ছিলাম। ধারণা ছিল, আগা খান নিশ্চয়ই সৈয়দ হারুনের ব্যাপারে একটা পজিটিভ খরব দেবে। হ্যাঁ খবর সে দিয়েছিল, কিন্তু সৈয়দ হারুনের ডেডবডির।
ডেডবডির? আঁতকে ওঠে করুনা বিধি, আগা খানের দ্বিতীয় স্ত্রী।
হ্যাঁ, আমাকে ফোনে জানায় আগা খান, ভাবি একটা দুঃখের খবর দিচ্ছি আপনাকে। সৈয়দ হারুন আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু আর বেঁচে নেই।
আমি চমকে উঠি, কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ ভাবি। যা সত্য সেটাই জানাচ্ছি আপনাকে। পুলিশের আইজিকে গতকাল আমি হারুনের নিঁখোজের ব্যাপারটা জানাই। এই একটু আগে পুলিশের এ আইজি ফোনে জানায়, সুরাগ নদীর পারে একটা লাশ পাওয়া গেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে যাই। এবং দেখতে পাই, লাশটা আমার প্রিয় বন্ধুর।
আমি শোকে পাথর হয়ে যাই। কি করবো কি করবো না ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না, আমার এই গভীরতম দুঃখ ও শোকের সময়ে নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে দেখা দেন মি. আগা খান। দেখতে দেখতে আমাকে প্রায় গ্রাস করে ফেলে এবং এক রাতে আমার বাড়িতে এসে জানায়, শাকিলা! আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমি হতভম্ব, বলে কি লোকটা! আমি অবাক হয়ে বলি, এ আপনি কি বলছেন? আমি আপনার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর বিধবা স্ত্রী!
শাকিলা! আমি প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি, তোমার বাড়ির বারান্দায় বিড়ালকে খাবার দিচ্ছ, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তোমাকে কামনা করে আসছি। আর সৈয়দ হারুনকে মেরে আমি আমার পথ পরিষ্কার করেছি। তুমি চাইলে আমাকে ভালোবাসতে পারো, না ও বাসতে পারো― আমার কোনোও সমস্যা নেই। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই আমাকে জাপটে ধরে…।
শাকিলা পারভীনের হু হু কান্নায় গোটা রুম স্তব্দ। কুকুরগুলোও বিষন্ন। আগা খানের বাকি তিন স্ত্রী করুনা বিধি, জয়নাব লতা আর দিলরুবা ছন্দা আগা খানের দিকে তাকায়। আগা গান বিহব্বল চেতনার চোখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখছে, দেওয়ালের রঙ।
শাকিলা পারভীনের শোক একটু কমলে, আমাকে জোর করে বিয়ে করে মাসখানেক পরে। বিয়ের মাসচারেক পরে একটা দলিল এনে রাখে আমার সামনে। হাসতে হাসতে বলে, তোমাকে বলা হয়নি, তোমার আগের স্বামী মি. সৈয়দ হারুন মারা যাওয়ার আগে আমাকে বাড়িটা বিক্রি করে যায়। দেখো দলিল…
আমি কি করবো? দলিলটা হাতি নিয়ে দেখি, সই সৈয়দ হারুনের না। বুঝতে পারি, সবই ষড়যন্ত্র! আগে থেকে প্রি-প্ল্যানড সব।
কালো কুকুর মাথা নাড়িয়ে বলে, শাকিলা পারভীন! আপনার স্বামীর হয়ে ওই দলিলে কে স্বাক্ষর করেছিলো জানেন?
কি করে জানবো? জানার আগ্রহও আমার ছিল না। বুঝে গেছি, জেনেও কোনোও লাভ নেই। এই কুমিরের সঙ্গে কিছুতেই কিছু করতে পারবো না আমি।
জেনে রাখুন, রেজিস্ট্রি অফিসে আপনার স্বামী সৈয়দ হারুনের জায়গায় দাঁড়িয়ে স্বাক্ষর করেছিলো মি. দিগ্বিজয় রায়।
আমপুরা ওয়ার্ড কমিশনার? প্রশ্ন করে জয়নাব লতা।
হ্যাঁ, কালো কুকুরটা সমর্থন করে।
সাদা-কালো কুকুর হাই তোলে, মি. আগা খান। প্রমান হলো যে, এই বাড়ি দখল করে আপনি পাঁচ তলা বাড়ি বানালেও সব অবৈধভাবে করেছেন। এবং এই বাড়ি আপনার না। সুতরাং আমরা দখলে নিলাম― এই মুহূর্ত থেকে। আপনি চলে যান।
এখনই?
হ্যাঁ, এখনই, এই মুহূর্তে…।
সঙ্গে সঙ্গে এতোক্ষণ অপেক্ষারত কুকুরেরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে খাটের দিকে। ভয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায় মি. আগা খান, আমার স্ত্রীরা?
ওরাও যাবে আপনার সঙ্গে।
আগা খানের চারজন স্ত্রী শাকিলা পারভীন, করুণা বিধি, জয়নাব লতা ও দিলরুবা ছন্দা খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়। কুকুরেরা ঘুরে পিছনে গেলে আগা খান চারজন স্ত্রীসহ রুম থেকে বের হয়ে আসে। পেছনে কুকুরেরা। আগা খান চারজন স্ত্রীসহ সিঁড়ি ভেঙ্গে নামে। কুকুরেরা পেছনে পেছনে নামে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন