বিজ্ঞাপন

হারানো হীরা

April 24, 2023 | 6:40 pm

রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান

সেদিন সকালটা বেশ ফুরফুরে টাইপ ছিল। অল্প অল্প শীত। সাথে মায়ের হাতের ধোয়া ওঠা পুলি পিঠা। বিটন মামা বেশ আগ্রহ নিয়ে পিঠা খাচ্ছেন। হাতে অবশ্যই খবরের কাগজ। আমাদের বাসাটা অদ্ভুত একটা বাসা। এই বাসাতে সব ধরনের খবরের কাগজ আসে। জাতীয় দৈনিক তো বটোই। আরও আসে আঞ্চলিক খবরের কাগজ। বাবার খুব পছন্দ। বাবা বলেন. জাতীয় দৈনিকে অন্য অঞ্চলের থবর গুলো চাপা পরে যায়। এর থেকে ভাল দু একটা আঞ্চলিক খবরের কাগজ ঘরে রাখা। সারা দেশ সম্বন্ধে জানা যাবে। আর আমার কাজ সকালে উঠে সেই খবরের কাগজ পরা। এর অবশ্য দুটো কারণ আছে। কারণ নম্বর এক, বাবা হঠাৎ হঠাৎ জিজ্ঞেস করবেন, দৈনিক পূর্বাঞ্চলে ব্যাক লীড কি রে? নাহলে বিটন মামা খাবারের টেবিলে দুম করে বলে বসবেন, মিত্যা, আজকের কোন স্টোরিতে রহস্য খুঁজে পেলি।
তখন যদি উত্তর দিতে না পারি. তাহলে তো আলাপটাই জমবে না। তাই আলাপের জন্য আগে থেকেই পড়ালেখা করে বসি। কে জানে কখন কোনটা কাজে লাগে। ছুটির দিনেও এভাবে তৈরি থাকি আমি। আমাকে মনে আছে তো? নাম মিতি। আর আমার মামা বিখ্যাত রহস্য বিশারদ চৌধুরি শাহ ইমতিয়াজ ইবনে রাশিদ খালেদ রউফ ওরফে বিটন। আমাদের বিটন মামা। গেল মৌসুমে মামার রহস্য রাশি বেশ একটা জমজমাট ছিল না। সেই গানচুরিটাকে আসলে কেইস বলতে নারাজ মামা। কারণ সেটা ছিল বন্ধুদের মাঝে। আলম মামাকে সঙ্গে নিয়ে একটু মারমার কাটকাট না হলে মামার ভাল লাগে না। এর মাঝে যা যা মামা করেছেন কোনটাই তার মতে যুৎসই ছিল না। আড়তে খুনের বিষয়টাও পানির মত পরিষ্কার ছিল। এখন মামা মনোযোগ দিয়ে খবর পড়ছেন। কে জানে হয় তো এখান থেকেই পেয়ে যাবেন নতুন রহস্যের খোঁজ। আমি মামার দিকে তাকিয়ে একটু হা করেছি একটা কিছু বলবো, এমন সময় দরজায় টোকা। এই টোকাটা আমি চিনি। লাফাতে লাফাতে প্রায় চলে গেলাম দরজার কাছে। যেতে যেতে দেখলাম মামার ঠোটের কোনে হাসি। কি টেলিপ্যাথিরে বাবা!
দরজা খুলে সামনে দাঁড়ানো আলম মামাকে দেখে আমার হাসিটা আরও চওড়া হলো। পুলিশের দুধর্ষ অফিসার আলম আর আমার মামা বিটন, রহস্য সমাধানে এই মানিকজোড় তুলনাহীন।
মামা এসে আলম মামাকে জড়িয়ে ধরলেন। কি হে আলম, ভুলেই গেলে। শুনলাম ডিপার্টমেন্টে অনেক ভাল ভাল অফিসার নিয়েছো?- বলে হাসলেন বিটন মামা।
আলম মামা: অবশ্যই। অপরাধকে শায়েস্তা করতে দল বড় করতেই হবে…
বিটন মামা: তা হলে তো আমার ছুটি..
আলম: সে আর হচ্ছে না বন্ধু। আমরা সারাদিন অসংখ্য কেসের পিছনে দৌড়াই। আর তুমি একটা স্পেশাল কেস নিয়ে গবেষণা করো। তোমার এই গবেষণা আমাদের প্রয়োজন। অনেক খুটি নাটি বিষয় আছে যেটা তাড়াহুড়োর জন্য আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। তোমার যায় না..
বিটন মামা: ব্যাপার কী বলত? কোনও কেস আছে নাকী?
আলম মামা: সে তো আছেই। কিন্তু কেসটা বড় ঝামেলার। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
বিটন মামা: আচ্ছা! কোন কেসটা, মানিকগঞ্জের সেই চুরি? নাকী উত্তরার হারানো হীরা?
আলম মামা: মানিকগঞ্জের চোরকে ধরে ফেলেছি।
বিটন মামা: তাহলে উত্তরার হারানো হীরা?
আলম মামা: হ্যাঁ তাই। কিছুতেই অনেক কিছু খাপে খাপে মিলছে না।
বিটন মামা: তাহলে কি এখান থেকে আমার এন্ট্রি হচ্ছে?
আলম মামা: সেটাই তো চাইবার জন্য এলাম বিটন..
এতটুকু শুনেই আমি খুশিতে হাত তালি দিয়ে উঠলাম। না হয় এবার ঢাকার আশে পাশেই রহস্যের ঘনঘটা। তাতে ক্ষতি কি? জমজমাট একটা রহস্য তো পাওয়া গেল। বিটন মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রে মিত্যা.. রেডি? আমি একগাল হেসে বললাম, সে তো কবে থেকেই। যাদের জন্য আমরা নতুন
আমার নাম মিতি। গোয়েন্দা গল্পে সহকারীরা তোপসে, সন্তু আবার শহীদ, কামাল হলেও বিটন মামার সাথে আছি আমি। এখনও জটায়ুর মত গল্প না লিখলেও ওয়েব সিরিজ করার ইচ্ছে আছে আমার। তাই টুকে রাখি গোয়েন্দাগিরির সবকিছু।
বিটন মামার নামের ইতিহাস আগেই বলেছি। বিশাল নামের চাপে বেছে নিয়েছেন ডাকনাম। তবে নামের রহস্য যে অন্যরকম তা বলে দিয়েছিলেন আমার নানাভাই।
আসল গোয়েন্দা ছিলেন তিনি। পুলিশের বড় কর্তা ছিলেন। চুরি হোক , ডাকাতি হোক – কিভাবে যেন ধরে ফেলতেন।
সেই থেকে রহস্যেও পোকা ঢুকে মামার মাথায় হয়ে গেল এক গোলকধাধার বাগান। সেখানে মামাই একমাত্র, যার কৌশলে পানির মত স্বচ্ছ হয়ে সামনে আসে রহস্যেও সমাধান।

বিজ্ঞাপন

যাকগে আমাদের বিটন কা- সমগ্রতে আরও কিছু গল্প আছে যা বলে দেবে মিতি আর বিটনের চালচিত্র।
রহস্য সমাধানে যাবার আগে বলি- আমি কারাটে শিখেছি, কোনও কিছু ভুলিনা। মামা বলে আমার নাকী ফটোগ্রাফিক ব্রেইন।
তাহলে? দেখা হচ্ছে – উত্তরায় ..
উত্তরের উত্তরায়
উত্তরার ভেতরে। এখনও আবাসিক এলাকাটা ভরে ওঠেনি। সেখানে একটা প্রাসাদটাইপের বাসা বানিয়েছেন মমিনুল বারী। পেশায় আইনজীবি। দির্ঘদিন ধরে প্র্যাকটিস করছেন। তার নিয়মিত মক্কেল আছে যারা তাকে রীতিমত গুরুর মত মানেন। তার এই বিশাল বাসাটা আসলে পৈত্রিক সম্পত্তির একটা অংশ মানে জায়গাটা ছিল বাড়িটি করেছে তিনি। থাকেন দুই ভাই আর তাদের পরিবার। বড় ভাই আমিনুল বারী ছোটখাটো ব্যবসা করেন। মমিনুল বারীর তুলনায় কিছুই না তার আয়। কিন্তু ছোটভাই বড়ভাইকে সেই তুলনা করার সুযোগই দেন না। নিজে থেকেই বড়ভাইকে মিরপুরের একটা পুরানো বাসা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন। নিজের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের পাশের ডুপ্লেক্সে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। একতলা ও দোতালা মানে এই ডুপ্লেক্সের উপরে অবশ্য আরও চারটে চারটে আটটি ফ্ল্যাট আছে যেটার পাঁচটির ভাড়া পান মমিনুল বারী এবং বাকি তিনটির ভাড়া পান আমিনুল বারী। যেহেতু বাসা বানানোর জন্য কোনও খরচ করতে পারেননি বড়ভাই তাই তিনি কম ফ্ল্যাটের ভাড়া নেন। এই নিয়ে মমিনুল বারীর স্ত্রী রেখার ভিষণ রাগ। নিজের বানানো বাসার ভাড়া আরেকজনকে কেন দিতে হবে, সেটা তার ভিষণ রাগের কারণ। আর মমিনুল সাহেবের কথা হলো, বাবা তো জায়গাটা না রাখলে বাসাই বানানো হতে না। আর জায়গা তো তাদের দুজনের। ধরে নেওয়া যাক, একটা ফ্ল্যাটের টাকা বড় ভাই বাসা বানানোর জন্য প্রতিমাসে বিনিয়োগ করেছেন তাহলেই তো হলো।
মমিনুল বারীর ভাঈদের গল্প পথে যেতে যেতে বলতে লাগলেন আলম মামা। বিটন মামা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। এতোটুকু শোনার পর আমার আগ্রহ একটু কমে গেল। এতো টিভি সিরিজের মতন ভাই ভাই গ্যান্জাম গল্প! একবারেই বোঝা যায় কে কী করেছে। বিটন মামা মনে হয় আমার মনের কথাটা ধরতে পারলেন। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন আলম মামাকে, তাহলে এখন ঘটনাটা কী?
আলম মামা লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, ঘটনাটা প্যাচ খেয়েছে গত সপ্তাহে। যখন মমিনুল বারীর ছোট ছেলের বিদেশ যাওয়া উপলক্ষ্যে পার্টি দেওয়া হয়। মমিনুল সাহেবের তিন ছেলে মেয়ে। বড় মেয়ে চিত্রা হলো উকিল। থাকেন গুলশানে। স্বামী এবং একটি সন্তান আছে। মেজো ছেলে চয়ন, কোনও কাজ করে না কিন্তু বিবাহিত। বাবা মা ছেলেকে শোধরানোর জন্য বিয়ে দিয়েছে। খামাখা মেয়েটাকে ঝামেলায় ফেলেছে। তার স্ত্রীর নাম রিমি। থাকেন একসাথেই। আর ছোট ছেলে চপল। বিবিএ করেছে। এমবিএ করতে একমাসের মধ্যে বিলেত যাচ্ছে।
বিটন মামা ফিক করে হেসে দিলেন। বললেন, আলম এখনও বিলেত? তুমি দেখি প্রাচীনকালের গোয়েন্দা গল্পের মত করে ইতিহাস বলছো।
আলম মামা: তা একটু বলি বটে। বোঝই তো। প্রায় দিনই ওসব পড়ি আর নিজেকেও একটু গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাবি আর কী।
আলম মামার কথা হেসে উঠালাম আমিও। আর মামাও। গল্পটা শেষ হলো না তার আগেই আমরা হাজির সেই প্রাসাদের সামনে। কি চমৎকার বাসা রে বাবা। সামনে দুটো মস্ত বড় পিলারও আছে। আর এতো বিশাল জায়গা। এজন্যই দুই ইউনিটেই ডুপ্লেক্স করা গেছে আর কী।
আমরা গাড়ি থেকে নামতেই একজন কন্সটেবল এসে সালাম ঠুকলেন। আলম মামা জিজ্ঞেস করলেন, কেউ বাসা থেকে বের হয়নি তো?
কনসটেবল মাথা নেড়ে জানালেন, নাহ কেউ বের হয়নি। ঠিক আছে, বললেন আলম মামা। এবার এগিয়ে গেলেন বাসার দিকে। মমিনুল বারীর বাসাতেই ঢুকলেন একেবারে। ঢুকতেই তাকে দেখা গেল। মমিনুল বারীর মাথায় চুল একটু কম। পরেছেন সাদা পাঞ্জাবি। হালকা শীতের জন্য মনে হয় উপরে একটা চাদর জড়িয়ে রেখেছেন। পাশে ভ্রু কুচকে বসে আছেন তার স্ত্রী রেখা। এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। চোখে মুখে সেই ছটা আজও আছে। পুলিশ গোয়েন্দার আসার ব্যাপারটা তার বিশেষ পছন্দ হয়নি এটা তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল।
তাদের পিছনে বোকা বোকা চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে আছে চয়ন। বাড়ির বড় ছেলে। বারীর বড় ছেলে বললেও ভুল হবে না এদফা। এই ছোট্ট জিনিষটা মাথায় আসতেই আমি হেসে ফেললাম। মনে মনে ঠিক করলাম। এটাকে অবশ্যই ব্লগে টুকে রাখতে হবে। এমন আবিষ্কার ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না।
কল্পনার জগৎ থেকে দ্রুত ফিরে এলাম বাস্তবে। এখন যতটা সম্ভব কেসে মনোযোগ দিতে হবে। কেসটা এখনও শোনাই হয়নি। আলম মামাকে দেখে বারী সাহেব একটু নড়েচড়ে বসলেন। মনে হয় এবার বারী সাহেবই বলবেন বাকিটুকু।

ফুর্তির ফাঁকে চিচিং ফাঁক
বারী সাহেব বিটন মামার দিকে তাকিয়ে একটু দ্বিধায় পরে গেলেন। কি বলবেন ভাবছেন মনে হয়। আলম মামা তার কাজটা সহজ করে দিলেন।
আলম মামা: বারী সাহেব, ইনি ইমতিয়াজ। রহস্য বিশারদ। আমাদের সাথে কাজ করেন।
বিটন মামা হেসে একটু খুক খুক করে গলাটা সাফ করে নিলেন। হাত বাড়ালেন বারীর দিকে। বারী সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন।
বিটন মামা: চৌধুরি শাহ ইমতিয়াজ ইবনে রাশিদ খালেদ রউফ, আমার পুরো নাম এটা।
আমি বেশ মজা নিচ্ছি। মামার এমন দৈর্ঘ্যর নাম শুনে প্রথমে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বিষয়টা আমার বেশ মজাই লাগে। বারী সাহেবও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মামা তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন,
তবে কাজের ক্ষেত্রে সবাই আমাকে ইমতিয়াজ বলেই ডাকেন।
মমিনুল বারী: বসুন, ইনসপেক্টও সাহেব আপনিও বসুন।
আমরা সবাই কাঠের সোফাটা বসলাম। সোফাটা বেশ দামী। আমি একনজর ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। নাহ, বেশ সম্পদশালী তারা। ঘরের প্রতিটা আসবাব দামী। আবার সৌখিনও বটে। দেওয়ালে পেইন্টিংস। শোকেসে দামী শোপিস। একটা পিয়ানো আছে। পাশে স্বচ্ছ পলিথিনে ঢাাকা একটা ড্রামসেট। আমি সেদিকে অনেকক্ষণ তকিয়ে থাকলাম। কোনও এক অদভুত কারণে প্রথম প্রশ্ন আমিই করে বসলাম, আচ্ছা এখানে মিউজিকের শখ কার?
রেখা: আমার ছোট ছেলে, চপলের।
আমি: উনি কি এখন আর এগুলো বাজায় না?
মমিনুল বারী: হ্যাঁ হ্যাঁ বাজায়। আমাদের রিন্টে গেট টুগেদারেও বাজিয়েছে। পিয়ানো। তারপরেই আমি ঢেকে রাখতে বলেছি চয়নকে।
বিটন মামা: কেন? ওহ!ওই তো বাইরে যাচ্ছে? পড়তে, তাই না?
রেখা: হ্যাঁ। লন্ডনে যাচ্ছে।
বিটন মামা: বাহ.. তা ব্যাপারটা কী একটু খুলে বলবেন?
মমিনুল বারী: কেন নয়? বলার জন্যই তো আপনাকে ডাকা। মানে আপনাদের। আমার ছোট ছেলের ফ্লাইট আগামী সপ্তাহে। তাই ভাবছিলাম একটা ছোট পার্টির ব্যবস্থা করি। তাই দুই দিন আগে একটি পার্টির আয়োজন করি। আমার বাসাতেই। সবাই ছিল তাতে। আমাদের আত্মীয় স্বজন। চপলের বন্ধুরা। চয়নের শশুড়পক্ষের অতিথি। আর আপনারাতো জানেনই, আমার বড় ভাই আমার পাশের বাসাতেই থাকে।
আলম মামা: তারপর কী হলো?
রেখা: হলো আর কী! আমরা নিচে মেহমানদারী করছি , আর উপর থেকে চুরি হয়ে গেল আমাদের মূল্যবান সম্পদ!
বিটন মামা: মূল্যবান? কি সেটা।
বিটন মামার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বারী সাহেব স্ত্রীর ঝাঝালো কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হলেন।
মমিনুল বারী: আহ রেখা এভাবে খেকিয়ে বলো না। এনাদের উপর রাগ দেখিয়ে লাভ কী?
আলম মামা: কোনও সমস্যা নেই। আমরা উনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। এখন একটু বলবেন, কী সম্পদ খোয়া গেছে?
মমিনুল বারী: ডেকেছি যখন তখন তো আর বলতে ক্ষতি নেই। আমাদের পূর্বপুরুষের কিছু বনেদি খাস জমি ছিল ঢাাকার আশেপাশে। সেগুলো আমরা দুই ভাই মিলে বিক্রি করে দিয়েছি। আর কিনেছিলাম মূল্যবান পাথর!
বিটন মামা: মানে?
মমিনুল বারী: মানে, জমি তো আর আজকালকার দিনে বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। তাই আমরা সুদূর আফ্রিকা থেকে আসা পাঁচটি হীরা কিনি। কারণ হীরা সহজে ব্যাংকে রেখে দেওয়া যায়। আবার ধরুন প্রয়োজনে বিক্রি করে দিলাম..
বিটন মামা: পাঁচটা হীরার দাম কেমন?
মমিনুল বারী: একেকটা হীরা এক কোটি টাকা।
আমার মুখটা হা হয়ে গেল! বলে কী! কয়টা হীরা চুরি হলো তাহলো.. আমি নিশ্চিত বিটন মামাও মনে মনে ঢোক গিলছেন।
বিটন মামা: হীরাগুলো কী চুরি গেছে?
মমিনুল বারী: জি
বিটন মামা: কয়টা?
মমিনুল বারী: সবগুলোই।
বিটন মামা: কে কে জানতে এই হীরার ব্যাপারে?
মমিনুল বারী: আমার পরিচিত সবাই জানতো.. আমার অফিসের পিয়নও জানতো
বিটন মামা: আর এ বাসার সবাই?
রেখা: না জেনে উপায় আছে., সব কথা চিৎকার করে বলবে..
মমিনুল বারী: আহ রেখা..
বিটন মামা: আপনার যাবতীয় কাগজ পত্র চেক করব.. আর কে কে হীরার কথা জানতো, সেটা নিয়ে আমরা ইনভেস্টিগেট করব। আমাদের সন্দেহের তালিকায় সবাই আছে। আপনারা প্লিজ কেউ এ বাসা থেকে বের হবেন না।
এতটুকু কথার পর পুরো ঘরে নীরবতা। মমিনুল বারীর পরিবার দাবী করছে ঘরভরা মানুষের মাঝে পাঁচ পাঁচটি হীরা চুরি গেছে! যার দাম পাঁচ কোটি টাকা! এই লোকটির এখনও হার্ট ফেইল কেন হয়নি সেটাই বুঝতে পারছি না। বিটন মামার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। আর চয়ন এবং তার স্ত্রীর চেহারা দেখলাম আরও কালো হয়ে গেল! দুজনই মুখ নীচু করে রেখেছে। আমি মনে মনে সীদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। এরাই হীরা চোর।
হীরার তেলেসমাতি
আমরা এখন ফিরে আসছি বাসার দিকে। আসার আগে মামা মমিনুল বারীর বাসা তন্ন তন্ন করে দেখেছেন। হীরাগুলো রাখা ছিল মমিনুল বারীর শোবার ঘরে। ঐ ঘরে একটা স্টীলের আলমিরা আছে। সেটার মাঝে আবার একটা ছোট্টা সিন্দুক। সেখানে ছিল। মজার বিষয় হলো। সিন্দকে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিল যেটা চোর নেয়নি। সিন্দুকের চাবি থাকে বারী সাহেবের বিছানার দুই তোশকের মাঝে। চোর চাবিটা বের করে সিন্দুক খুলে শুধু হীরাগুলো নিয়েছে। এরপর আলমিরা খোলা রেখেই চলে গেছে। তারমানে তার তাড়াহুড়ো ছিল! আরেকটি বিষয় সম্বন্ধে মামা একেবারে নিশ্চিত, এই চুরিটা বাসার মানুষই করেছে। যারা হীরার কথা জানে। এবং হীরার দামও জানে। সমস্যা হলো, চোর যদি পার্টির রাতে হীরা নিয়ে চলে যায়, তাহলে তাকে ধরা একটু মুশকিল হবে। আর চোর যদি ঐ বাসারই বাসিন্দা হয়, তবে হীরাগুলো এখনও ঐ বাসাতেই আছে। কিন্তু চুরি করবে কে!
গাড়িতে বসে সে আলাপটাই হচ্ছিল। চোর হতে পারে আমিনুল বারী নিজেও। ব্যবসায় টানাটানি। আবার ভাইয়ের অনুগ্রহে বসবাস। এমনও হতে পারে হীরার লোভ সামলাতে না পেরে নিয়ে নিয়েছে। আমিনুল বারীর সন্তান চারজন। অমি আর অরু। দুই বোন। দুইজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। একজন পদার্থ বিদ্যায়। আরেকজন বোটানি। আর বাকি দুটো ছেলে। বড় ছেলে, অয়ন যাযাবর ধরনের। অনেক আগে থেকেই বাসার বাইরে বাইরে থাকে। গানবাজনা করে। আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড করে। ছোটটি একেবারে ছোট। বলা যায় আমিনুল বারীর বয়স কালের সন্তান। কলেজে আছে সে। নাম অপু। এই হলো আমিনুল বারীর পরিবার। তার স্ত্রী শায়লা রেখার থেকেও এক ডিগ্রী উপরে। সারাটা সময় স্বামীকে বকার উপর রাখেন। বিটন মামা যখন জেরা করতে গেলেন, তখনও বেশ হম্বি তম্বি করছিলেন। তখন আলম মামা কিছু কড়া কথা বলাতে একটু নরম হয়েছিলেন।
বিটন মামার গম্ভীর মুখ দেখে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না।
আমি : মামা .. কেসটা কিন্তু খুব একটা কঠিন কিছু না।
বিটন মামা: সেকী .. তুই সমাধান পেয়ে গেছিস নাকী?
আমি: মনে হয়..
আলম মামা: যা ওে বিটন.. তোকে আর আমাদের লাগবেই না। মিতি এখন থেকে সব কেস নেবে।
আমি: ইশ তোমরা মজা করছো কেন! এমনও তো হতে পারে, আমার ধারনাই ঠিক!
বিটন মামা: অবশ্যই , বলনা..
আমি: আমার ধারণা, মমিনুল বারীর বড় ছেলে চয়ন হীরাগুলো নিয়েছে।
বিটন মামা: কেন মনে হলো?
আমি: কারণ, এই বাসায় ও হলো এমন যার কোনও কিছু করার নেই। তাহলে এটাই কী ভাল না যে পাঁচ কোটি টাকার হীরা মেরে দেয়, আর পরে কোনও এক সময় বের করে নেয়?
বিটন মামা: পয়েন্ট হ্যাজ..
মাঝে মাঝে মামা এমন গুবলেট করা ইংরেজিতে কথা বলেন। শুনে আমি হেসে ফেললাম।
বিটন মামা: কিন্তু মিত্যা। দরকার তো আমিনুল বারীরও। আর চয়ন কোথায় লুকাবে হীরাগুলো!
আমি: কি জানি মামা, আমার তো আমিনুল বারীকে দেখে মনে হয়নি যে উনি নেবেন। এক নিতে পারে অয়ন। যে সেদিন এসেছিল পার্টিতে। আর নিতে পারে চয়ন। বাহ নামেও মিল।
বিটন মামা: হ্যাঁ হ্যাঁ.. চাচাতো ভাঈদের মাঝে মিল থাকতেই পারে। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর কোথায়?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কোনটা?
বিটন মামা: চয়ন হীরা নিলে রাখবে কই?
আমি: এমন কোনও জায়গায় যেখানে রিসেন্টলি কেউ হাত দেবে না। যদি..
বিটন মামা: যদি?
আমি: যদি সে কাউকে দিয়ে হীরাগুলোকে বাসা থেকে বের করে দেয়!
মামা আমার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। যাহ বাবা! আমি কিন্তু একদম বোকা হয়ে গেলাম! তারমানে আমার ধারনা সবই ভুল! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আর কিছুই বললাম না আমি। রাস্তার জ্যামের দিকে মনোযোগ দিলাম।
সাধুর একদিন
আমাদের পরদিন আবার উত্তরাতে যাবার কথা। আমি সকাল সকাল তৈরি। মা টেবিলে নাশতা দিচ্ছেন। আর আমি শুনলাম বিটন মামা ফোন করলেন আলম মামাকে।
বিটন মামা: হ্যাঁ আলম.. কি অবস্থা, যাচ্ছো নাকী উত্তরায়? না না.. সব ঠিক.. আচ্ছা শোন, ঐ বাসা থেকে কেউ বের হয় নি তো? বের হয়েছে? কে?.. ময়লা ফেলার লোক.. অহ! আর? অয়ন বের হয়েছে? ওর পিছনে কন্সটেবল আছে? থাকবে বলো.. কে এসেছে বললে? বাইরে থেকে খাবার আসছে? আচ্ছা…না না আমি আজকে যাচ্ছি না.. আমার একটু বাইরে কাজ আছে .. তুমিও যেও না.. বরং বলো তুমি এদিকে আসতে পারবে নাকী? এই ধরো আটটার দিকে.. হ্যাঁ কফি খাবো.. আচ্ছা.. ফোন দিও রাখলাম!
মামার কথা শুনে একটু যে অবাক হইনি তা নয়। কেস চলার সময় মামার কফি খাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন কে জানে! তারমানে হয় কেসটা সুবিধার নয়। অথবা মামাও ধরে ফেলেছেন যে চয়ন আর তার স্ত্রীই চোর। মানে আমি মিতি সফল.. ইয়েস!!
কফি উঈদ ডিডেক্টিভ
আলম মামা: আমাদের কিন্তু কফি খাওয়ার কথা ছিল..
বিটন মামা: শশশ আস্তে আলম.. এই তো এখানে সিনেমাটা শেষ হলে ফের কফি খেতে যাব।
আলম মামা: এখানে কিসের সিনেমা সেটাই তো বুঝতে পারছিনা..
বিটন মামা: বন্ধু, যেখানে দেখিবে ছাই.. উড়াইয়া দেখ তাই!
আলম মামা: তা এই ডাস্টবিনে কি এমন মানিক পাবো?
বিটন মাম: মানিক না হলেও, হীরা পেতেই পারো..
আলম মামা: বলো কী?
বিটন মামা: হমম ওয়েট!
উত্তরার সুনসান রাস্তায় রাত নয়টায় ঘাপটি মেরে বসে আছে বিটন মামা। সামনে একটা বড় ডাস্টবিন। বিটন মামার বদ্ধমূল ধারণা ডাস্টবিনের মাঝেই আছে হারানো হীরা। দেখা যাক কতটুকু সত্য।
আধাঘন্টা বাদে চাদরে মোড়া একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল ডাস্টবিনের দিকে। ছায়ামুর্তীটি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হলো কেউ আছে কি না। এবার একেবাওে ডাস্টবিনের মাঝে পা রাখলো। লোকটির হাতে একটা ছোট্ট টর্চ লাইট। লাইটটা দিয়ে কি যেন খুঁজছে সে। একটা বড় পলিথিন টাইপ ময়লার ব্যাগ বের করলো। পারলে পুরোটা ঢুকে যায় ভেতরে। এরপর বের করে আনলো কৌটা টাইপের কিছু..
আলম মামা ইশারা করলেন, বিটন মামাও উঠে দাঁড়ালেন। যবনিকা এই ডাস্টবিনেই।
দুজনে বিড়ালের মতো শব্দ না করে এগিয়ে গেল ডাস্টবিনের সামনে। ওদিকে ঐ লোকটিও তার হাতের জিনিষ নিয়ে বের হতে তৈরি। লোকটি ঘুরতেই বিটন মামা সাথে ধাক্কা খেল প্রায়। টর্চের আলোতে তার চেহারা স্পষ্ট দেখা গেল! বিটন মামা হেসে উঠলেন। বললেন, আইডিয়াটা জোশ.. বিটন গোয়েন্দা খোশ! এামার সেই পুরানো স্টাইলে মিলানো ভাষার কথা!
যাই হোক, এই পুরো ঘটনাটাই আমি শুনেছি পরদিন। মামার কাছ থেকে। ব্লগে তুলবোই। কিন্তু এখনও বলার দরকার ছিল .. তাই না?
হীরা চোর কে?
বিটন মামা সকালে উঠে পুরো এলাকা চক্কর দিয়ে এলেন। সকাল সকাল দৌড়ানো তার অভ্যাস। না হলে ফিটনেস থাকে? এসেই লেবু পানি খেয়ে খবরের কাগজ পড়লেন। তার প্রিয় গাছে পানি দিলেন। মা ততক্ষণে উঠে নাশতা বানাচ্ছেন। আজকে মায়ের অনলাইন শপের অফলাইন মেলা। তাই মা জলদি জলদি নাশতা বানাচ্ছেন। আর বাবা তাকে সাহায্য করছেন দুপুরের রান্না তৈরিতে। মাকে সাহায্য শেষে বাবা বের হয়ে যাবেন অফিসের উদ্দেশ্যে। খিচুরিই হচ্ছে মনে হয়। গন্ধ তো তাই বলে। আমি ঘুম থেকে উঠেই খিচুরির গন্ধ পেয়ে হীরার কথা ভুলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে খাবার ঘরে আসতেই মামা আমার দিকে তাকালেন।
বিটন মামা: এতো বেলা করে ঘুমালে হবে? সকালে উঠে একটু মার্শাল আর্ট প্র্যাকটিস করলেও তো পারিস!
আমি: কাল থেকে..
বিটন মামা: এই কাল যে কত কাল ধরে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে!
আমি: সরি মামা…সত্যি কাল থেকে..
বিটন মামা: ঠিক আছে। আর শোন .. তোকে তো থ্যাংকসও দেওয়া হয়নি।
আমি: থ্যাংকস? কেন?
বিটন মামা: হীরা চুরির ঘটনায় তুই দুইটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিস।
আমি ভীষন অবাক হয়ে বললাম, আমি?
বিটন মামা: হ্যাঁ.. তুই..
আমি খুশি খুশি কথায় জানতে চাইলাম, তাহলে চয়নই চোর?
বিটন মামা: সে তো একটু পর জানা যাবে..চল রেডি হয়ে নে। আলম আসছে। আমরা উত্তরার উদ্দেশ্যে বের হবো।
আমি তো লাফাতে লাফাতে তৈরি হচ্ছি। গোয়েন্দা হিসেবে আমার সফলতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
শেষ দৃশ্য
মমিনুল বারীর ড্রয়ইং রুম। গম্ভীর মুখে বসে আছে বাসার সব সদস্য। তার মেয়ে চিত্রাও এসেছে স্বামী সহ। আছে সেদিনের পার্টির সকল অতিথি। আমিনুল বারীর সন্তানরাও। অয়নকেও নিয়ে এসেছে পুলিশ। একটু চাদর জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে অয়ন।
বিটন মামা সবার দিকে নজন বোলালেন। পাশে আলম মামা। একটু গলা খাকারি দিলেন বিটন মামা। আমি বুঝলাম। এবার শুরু হবে রহস্য ভেদ।
বিটন মামা: দেখুন গতকাল রাতেই আমি চোরকে ধরে জেলে ঢুকাতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আপনাদের সবার সামনে বিষয়টা ক্লিয়ার করার দরকার।
এতটুকু বলা মাত্র আমিনুল বারীর স্ত্রী শায়লা চটে উঠলেন, কী বলবেন আর? রেখা তো আমাদের উঠতে বসতে চোর বলে! আপনিও বলে আমাদের জেলে ঢুকান..
বিটন মামা: আপনি রাগ করবেন না মিসেস আমিনুল। এখানে আমরা কারও ব্যক্তিগত শত্রু নই, মিত্রও নই। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে অয়নের কাছে।
অয়ন: বলুন..
বিটন মামা: আপনার বয়স চয়নের মত। আপনি সংসারের দ্বায়িত্ব না নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়ান কেন? আপনি কি জানেন চুরির অভিযোগে ধরা খাওয়ার যথেষ্ট কারণ আপনি তৈরি করে রেখেছন?
অয়ন: সেতো জানি.. কিন্তু এটাও ঠিক অনেক শিল্পীরই সংসারে মন টেকে না।
বিটন মামা: কিন্তু বাবা মায়ের চিন্তাটা তো বুঝবেন? যাকগে চিন্তাতে মনে হলো, চুরির কথা মাথায় আসতেই মনে হয়, কার জন্য হীরাগুলো পরবর্তীকালে কাজে আসবে.. মানে কার প্রয়োজন?
আলম মামা: ঠিক তাই, কারণ প্রয়োজন হলেই তো চুরি করবে..
বিটন মামা: ঠিক তাই.. আর এই লিস্টে আছে আমিনুল সাহেব, অয়ন, মমিনুল সাহেবের বড় ছেলে চয়ন এবং মিসেস মমিনুল।
মিসেস মমিনুল পারলে তেড়ে আসে আরকী।
রেখা: আমি কেন চুরি করব?
বিটন মামা: করতেই পারেন.. যাতে বড় ভাইকে ভাগ দিতে না হয়..
চয়না: কিন্তু আমি কেন করব?
বিটন মামা: কারণ আপনি এই বাসার একমাত্র অসহায় মানুষ এই মুহুর্তে। যে কিছুই করেন না। আর অয়নের কারণটাতো বলেই দিলাম।
আমিনুল বারী: আপনি এই বুড়ো বয়সে আমাকে চোর বানাবেন?
বিটন মামা: আমি শুধু সন্দেহের কথা বলেছি। আর কিছুই না। আপনি মন খারাপ করবেন না। এখন আসি আসল কথায়। আমার সহকারী, মিতির একটা কথায় আমার কিছু জিনিস আগেই মনে হয়েছিল। পরে সেদিন অনুষ্ঠানে আসা সবার বাসা সার্চ করে আমি নিশ্চিত হই যে হীরাগুলো এই বাসাতেই আছে। কারণ, আপনাদের গৃহকর্মীর কাছে জেরা করে আমরা জানতে পারি, অনুষ্ঠানের দিন বাড়ির লোক ছাড়া আর কেউই উপরের তলাতে উঠেনি। তাহলে এ বাসার সদস্যরাই এই গল্পের মূল নায়ক। এমন কী আমিনুল সাহেব ও তার পরিবারও নয়।
তারপর মিতি আমাকে গল্পে গল্পে জানালো, হীরাগুলো বাসায় এমন জায়গায় আছে যেখানে কেউ আপাতত হাত দেবে না। মিতির ধারণা পিয়ানোর মাঝে হীরাগুলো লুকানো। যা চয়ন পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছে। অতএব চয়ন চোর।
আমার মুখে তখন বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো। মামা আমার দিকে তাকালেন। আবার শুরু করলেন,
বিটন মামা :কিন্তু আমার কথা হলো, চয়ন হীরা নিলে পিয়ানোতে রাখবে কেন? এখানেও তো পুলিশ খুঁজতে পারে। অথবা শশুড়বাড়িতে পাঠাতেও পারে। কিন্তু গত দিনদিনে আমাদের যাবতীয় রিসার্চ বলে এমনটি ঘটেনি। চয়ন অনুষ্ঠানের দিন পুরোটা সময় নীচে ছিল তা আমাদের জানিয়েছে গৃহকর্মী। আর চয়নের স্ত্রীর উপরে যাওয়ার পারমিশন নেই। কারণ ওরা নীচেই থাকে। ঐ যে পাশের ঐ রুমে।
বিটন মামা হাত দিয়ে রুমটা ইশারা করলেন।
রেখা: তাহলে কি হীরা আমি নিয়েছি?
বিটন মামা: তার থেকে বড় কথা হলো, হীরা ছিল কোথায়? বা আছে কোথায়? হীরা এমন একটি জায়গায় আছে যেখানে চোখের সামনে থেকেও নেই হীরাগুলো। আমাদের একটা ধারনা হয়ে গেছে যে এককোটি টাকা দামের হীরা মানে বিশাল বড়। সেটা নাও হতে পারে। ছোট ছোট আকারেরও হতে পারে যা মিশে থাকতে পারে একই রকম দেখতে অন্য কিছুর সাথে। আর এমন জায়গায় আছে যেখানে আমরা অতটা মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। যেমন ধরেন বাথরুম বা রান্নাঘর? এমন যখন ভাবছি, তখনই শুনলাম, এই বাসা থেকে কেউ বের না হলেও ময়লা ফেলা হয়েছে। কন্সটেবলকে বলা হয়েছে রান্নাঘরের ময়লা। ওদিকে আবার বাসায় খাবার ডেলিভারি হচ্ছে! তাহলে যে বাসায় কেনা খাবার আসছে, সে বাসা থেকে কি বিশাল বড় সাইজের ময়লা ফেলা যুক্তিযুক্ত? এখানে একটু খটকা ছিল আমার! নিজের খটকা মেটাতে পাশের ডাস্টবিনে ওঁত পেতে বসতেই ধরা পরলো সে, যে ডাস্টবিন থেকে ময়লা নয় হীরাগুলো তুলতে এসেছিল..
আলম মামা ঘাড় ধরে ঘরে আনলেন মমিনুল সাহেবের অফিসের সেক্রেটারিকে।
রেখা: সাজ্জাদ তুই?
বিটন মামা: আরে কি করছেন। এই ছেলে তো সিনেই ছিল না। মাত্র এলো। বেচারা অনুরোধের ঢেঁিকি গিলতে গিয়ে যে মার হজম করেছে তার পরে আর বকা দেওয়ার দরকার নেই। ঠিক না মমিনুল সাহেব?
এবার মমিনুল সাহেব উশখুশ করতে লাগলেন। আমি হা করে তাকালাম।
বিটন মামা: আপনি নিজের হীরা এভাবে নিজে চুরি করবেন এটা ভাবতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু পরে আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স আর পসরার অবস্থা জেনে নিশ্চিত হলাম কাজটা আপনিই করতে পারেন। এতে দুটো লাভ হবে। এক, ভাইকে ভাগ দিতে হবে না। দুই, হীরাগুলোকে উচ্চ দামে বিক্রি করে সারাজীবন পার করতে পারতেন। কিন্তু এটা না করলে কী চলত না? হ্যাঁ, আমি জানি চলত না। কারণ অনেকেই জানে না, গত আট মাস ধরে প্রতি মাসে চয়নের ডায়ালাইসিসের কারণে আপনার প্রচুর খরচ হচ্ছে। আরও পাঁচটা লাগবে। আর চপলকেও মোটা খরচে বিদেশে পাঠাচ্ছেন। আপনার টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছিল..
মমিনুল বারী: হ্যাঁ শুরু হয়েছে। আমি ভাইয়াকে বলতে পারছিলাম না কারণ ওর টানাটানি আমার থেকেও বেশি। আর আর আমি লোভে পরে গিয়েছিলাম। শেষ জীবনে একটু আরামে থাকতে চেয়েছিলাম..
আমিনুল বারী: আমাকে বললইে পারতি..
মমিনুল বারী: পারতাম না। তুমিও জানো, আমাদের বাসায় যুদ্ধ লেগে যেত। আর সত্যি কথা যেটা আমি আসলে হুট করে কাজটি করে ফেলেছি..
এদিকে আমার তো ছটফট লাগছে। হীরা আসেল কোথায় ছিল?
আমি: মামা হীরা আসলে কোথায় ছিল?
বিটন মামা: ও হ্যাঁ। এটা গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন। হীরা আমাদের চোখের সামনেই ছিল। রান্নাঘরে। রান্নাঘরে চিনির বিশাল দুইটা কৌাটা আছে। সেখানে পাঁচটি হীরা এবং চিনি মাখামাখি করে ছিল যা আমাদের কারও চোখে পরেনি। আর সেদিন রান্নাঘর দিয়ে ময়লার আড়ালে ফেলে দেওয়া হয় কৌটা দুটো। যা ডাস্টবিন থেকে তুলে আনার জন্য সাজ্জাদকে দশ হাজার টাকা দেয় মমিনুল বারী। আর আমরা তাকে হাতে নাতে ধরি ডাস্টবিনের সামনে।
আলম মামা: আর জানতে পারি বাকি সব ঘটনা..
এই হলো হীরা চুরির সমাধান পর্ব। চোর ধরার ক্ষেত্রে আমার ধারনা সঠিক না হলেও মামাকে সমাধানে সাহায্য করেছে সেটা ভাবতেই ভাল লাগছে। এই বা কম কীসে!

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন