বিজ্ঞাপন

নজরুলের পুষ্পমালা

April 26, 2023 | 2:05 pm

মোকাররম হোসেন

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতায় লিখেছেন,
‘আমি দুর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল …’
কিন্তু তার এই বিদ্রোহের আড়ালে আছে দরদমাখানো নরম নিসর্গের আলাপচারিতা। আছে নন্দনকানন থেকে পারিজাতকে পাওয়ার বাসনা। তাই তিনি বইয়ের নামকরণে বেছে নিয়েছেন অনবদ্য পুষ্পরাজি। দোলনচাঁপা, ঝিঙেফুল, ফণীমনসা, রাঙা-জবা, মহুয়া আরও কত নাম। এসব পুষ্পসৌরভ তার রচনাকে সুরভিত করেছে বার বার। তার রচনাসম্ভারে নানাভাবে পুষ্প-বৃক্ষের প্রসঙ্গ এসেছে। কখনও উপমায়, কখনও সরাসরি। যেমন নার্গিস কখনও প্রিয়তমা, কখনও ফুল হিসেবে এসেছে। তিনি গেয়েছেন
‘বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে
ঝরা বন-গোলাপের বিলাপ শোনে॥’

বিজ্ঞাপন

নার্গিস মূলত ফুলের নাম। আমাদের দেশে গুলনার্গিস নামে একটি কন্দজ ফুল আছে। সেটি নজরুলের সেই নার্গিস নয় বলেই মনে করা হয়। তবে এই উপমহাদেশে নার্গিসের আগমন ও কদর সম্ভবত মোগলদের হাত ধরে। যা পৃথিবীজুড়ে নার্সিসাস নামেই বেশি পরিচিত। জানামতে আমাদের দেশে এ ফুল চাষ হয় না।

বিজ্ঞাপন

কাজী নজরুল গভীর ভাবনা-বোধ থেকে কোনো রূপসী নারীর পরণে পুষ্পালঙ্কার দেখেছেন, দেখেছেন কানে অর্জুনের ফুল আর গলায় কদমফুলের মালা-
‘অর্জুন মঞ্জরী কর্ণে
গলে নীপ-মালিকা’
অর্জুনকে বলা হয় নিগৃহীত সুন্দর। ওষুধিগুণ থাকায় অর্জুনের বাকল তুলে নেবার কারণে গাছটি শ্রীহীন হয়ে পড়ায় এমন নামকরণ। অর্জুনের ফল দেখতে কামরাঙ্গার মতো। কবিতায় উল্লিখিত ‘নীপ’ মানে আমাদের বহুল পরিচিত কদম।
বাংলার অবহেলিত বুনোফুলও তার কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি ফুলকে মেখলা সাজিয়ে দেখতেই বেশি আনন্দ পান। বাবলা ফুলের নাকচাবি আর নীল অপরাজিতার শাড়ি তাই উপমায় মূর্ত হয়ে ওঠে।

‘বাবলা ফুলের নাকচাবি তার
গায়ে শাড়ি নীল অপরাজিতার
চলেছি সই অজানিতার
উদাস পরশ পেতে।’
আবার খোঁপায় পরিয়েছেন অবহেলিত ধুতরা ফুল। ধুতরা ফুলের সৌন্দর্যও তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি গান বেঁধেছেন
‘কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো।
খোঁপা খুলে কেশ হল বাউল লো॥’

বিজ্ঞাপন


কোনো এক অভিসারের পথে কবি তার প্রিয়তমার জন্য পুষ্পার্ঘ্য কামনা করেছেন। তিনি চেয়েছেন তার মানসপ্রিয়া হেটে আসুক পুষ্পবিছানো পথ ধরে।
‘দিও ফুলদল বিছায়ে পথে বধূর আমার
পায়ে পায়ে দলি ঝরা সে ফুলদল
আজি তার অভিসার।’

আমাদের প্রিয় দুটি ফল আম এবং গোলাপজামের প্রসঙ্গও রয়েছে নজরুলের কবিতায়। আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল হলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে সম্ভবত আমই এগিয়ে আছে। গোলাপজামের ফুল যেমন সুদৃশ্য ফলও বেশ স্বাদু এবং সুগন্ধি। আবার আমের বউলও কিন্তু সৌন্দর্য এবং সুবাসে কম যায় না।
‘বউল ঝরে ফলেছে আজ থোলা থোলা আম
রসের পীড়ায় টসটসে বুক ঝরছে গোলাব জাম’
সাতভাই চম্পার পারুল কিন্তু একটি দুর্লভ ফুলের নাম। এই বিখ্যাত এবং দুর্লভ ফুলটি নিয়ে তিনি কাব্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথও তার রচনায় পারুলের প্রসঙ্গ এনেছেন অনেকবার।
‘সাতভাই চম্পা জাগরে
কেন বোন পারুল ডাক রে’


নজরুল কিশোরী রাধার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন
‘তুমি অপরাজিতার সুনীল মাধুরী
দু চোখ আনিলে করিয়া কি চুরি?
তোমার নাগকেশরের ফণী- ঘেরা মউ
পান করাল কে কিশোরী?’
উল্লিখিত পংক্তিমালায় কবি অপরাজিতা এবং নাগেশ্বরের কথা বলেছেন। নীল, সাদা এবং বেগুনি রঙের অপরাজিতা মূলত বর্ষজীবী লতানো গাছ। এর মধ্যে নীল অপরাজিতাই বিখ্যাত। আর নাগেশ্বর এই অঞ্চলের প্রাচীন ফুল। আমাদের কাব্য-কলা-উপমায় এর প্রসঙ্গ এসেছে বার বার।

বিজ্ঞাপন

খানিক স্পর্শে নুয়েপড়া লজ্জাবতীও কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি লিখেছেন
‘লজ্জাবতীর লুলিত লতায়
শিহর লাগে পুলক-ব্যথায়
মালিকা সম বঁধূরে জড়ায়
বালিকা-বধূ সুখ-স্বপনে’
নজরুল অসংখ্য গানে পুষ্পবৃক্ষের কথা বলেছেন। বলেছেন তাদের রূপ-মাধুরীর কথা। তিনি গেয়েছেন
‘পরো কুন্তলে, ধরো অঞ্চলে
অমলিন প্রেম-পারিজাত।’


এই পারিজাত মানে মান্দার। স্বর্গীয় ফুল। অন্যত্র তারই ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়
‘আনো নন্দন হতে পারিজাত কেশর
তীর্থ-সলিল আনো ভরি’ মঙ্গল-হেম-ঝারি॥’
অশোকের বর্ণাঢ্য রঙের কথা পাওয়া যাবে এখানে
‘অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে
রং পিয়াসী মন-ভ্রমর গুঞ্জে,
ঢালো আরও ঢালো রং প্রেম-যমুনাতে।’

নজরুল তার লেখনীতে তুলে এনেছেন আমাদের চারপাশের সমস্ত চেনা ফুলগুলো। যেসব ফুলের সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। যেমন চামেলি, জুঁই, শিউলি, চাঁপা, মালতী, টগর, বকুল, বেলি, শাপলা, পদ্ম, বৈঁচি, পলাশ, কেয়া, হাসনাহেনা ইত্যাদি। এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু পংক্তি তুলে ধরা হলো।
‘চামেলী কদম যূঁথী মুঠি মুঠি ছড়ায়ে
উতল পবন দে অঞ্চল উড়ায়ে।’

‘তোমার অশ্রু জলে শিউলি-তলে সিক্ত শরতে,
হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও দ্বার যদি রোধি।’

‘কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল
টগর যূথী বেলা মালতী
চাঁপা গোলাব বকুল।
নার্গিস ইরানী গুল॥’

‘মধুপ গুঞ্জরে মালতী-বিতানে,
নূপুর-গুঞ্জরণ নাহি শুনি কানে,
মোর মনমধুবনে মধুপ কানু কই’

‘বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি
যুথী বেলি।’

‘(সে) বলেছিল ডাগর হবে টগর-চারা যবে
লুকিয়ে এসে আমার হাতে বৈচি-মালা লবে (লো)।
আজ টগর গাছে ফুল ফুটেছে
পাগুন মাসের চাঁদ উঠেছে,
আঙিনাতে ফুল ছড়িয়ে কাঁদে পলাশ শাখা (লো)॥’

‘রিমি ঝিম রিমি ঝিম ঐ নামিল দেওয়া।
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া॥
ঝিলে শাপলা কমল
ওই মেলিল দল,
মেঘ-অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া॥’

বর্ষায় জুঁই-চামেলি-চম্পা-কেয়া প্রভৃতি ফুলের সমারোহ বেড়ে যায়। শরতের প্রভাত শ্বেতশুভ্র পবিত্রতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে ঝরা শেফালির পাপড়িতে। শিশিরসিক্ত হেমন্তকালে অল্পকিছু ফুল থাকে বাংলার প্রকৃতিতে; নজরুলের অল্পসংখ্যক কবিতা ও গান আছে হেমন্তকাল নিয়ে এবং সেসব গানে হেমন্তের ফুলের নামও আছে। আর বসন্ত মানে শতরকম ফুলের মেলা। নজরুলের কবিতা ও গানে বিভিন্ন ফুলের ব্যবহার ঋতুগুলোকে আলাদা ব্যঞ্জনা দান করেছে।

ক.
বসন্ত এলো এলো এলো রে

পিয়া পিয়া ডেকে ওঠে পাপিয়া
মহুল, পলাশ বন-ব্যাপিয়া।
সুরভিত সমীরণ চঞ্চল উন্মন
আনে নব-যৌবন প্রাণে ॥

খ.
আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী,

দুলে আলোছায়া বন-দুকূল
ওড়ে প্রজাপতি কল্কা ফুল
কর্ণে অতসী স্বর্ণ-দুল্
আলোক-লতার সাত-নরী ॥

গ.
মনের রঙ লেগেছে বনের পলাশ জবা অশোকে
রঙের ঘোর জেগেছে পারুল কনক-চাঁপার চোখে ॥
মুহু মুহু বোলে কুহু কুহু কোয়েলা, মুকুলিত আমের ডালে
গাল রেখে ফুলের গালে।


দোয়েলা দোল দিয়ে যায়, ডালিম ফুলের নব-কোরকে ॥
ফুলের পরাগ ফাগের রেণু ঝুরু ঝুুরু ঝরিছে গায়ে
ঝিরি ঝিরি চৈতী বায়ে।
বকুল বনে ঝিমায় মধুপ মদির নেশার ঝোঁকে ॥

ঘ.

তার লালসার রঙ জাগে রাঙা অশোকে
তার রঙিন নিশান দোলে কৃষ্ণচূড়ায় ॥
তার পুষ্পধনু দোলে শিমুল-শাখায়

বর্ষাকাল

ক.
এসো হে সজল শ্যাম-ঘন দেওয়া
বেণু-কুঞ্জ-ছায়ায় এসো তাল-তমাল বনে
এসো শ্যামল ফুটাইয়া যূথী কুন্দ নীপ কেয়া ॥

খ.
দুলিয়ে কেয়া ফুলের বেণী শাপলা মালা প’রে।
খেল্তে এলো মেঘ-পরীরা ঘুম্তী নদীর চরে।

বনে বনে কে বসালো যুঁই-চামেলীর মেলা ॥

গ.
রিমি ঝিম্ রিমি ঝিম্ ঐ নামিল দেওয়া।
শুনি’ শিহরে কদম, বিদরে কেয়া ॥
ঝিলে শাপলা কমল
ওই মেলিল দল,
মেঘ-অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া ॥

শরৎকাল

ক.
শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ
এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই।
বকুল-বনে এক্লা পাখি,
আকুল হ’ল ডাকি’ ডাকি’,


আমার প্রাণ থাকি’ থাকি’ তেমনি কেঁদে ওঠে সই ॥
কবরীতে করবী ফুল পরিয়া প্রেমের গরবিনী
ঘুমায় বঁধু বাহু-পাশে, ঝিমায় দ্বারে নিশীথিনী।

খ.
এসো শারদ-প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে ॥
দলি, শাপলা শালুক শতদল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল
নীল লাবণী ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য-পর্বতে ॥
এসো ভাদরের ভরা নদীতে ভাসায়ে কেতকী পাতার তরণী
এসো বলাকার রঙ পালক কুড়ায়ে বাহি’ ছায়াপথ-সরণী

হেমন্তকাল

ক.
হেমন্তিকা এসো এসো হিমেল শীতল বন-তলে
শুভ্র পূজারিণী বেশে কুন্দ-করবী মালা গলে ॥
প্রভাত শিশির নীরে নাহি’
এসো বলাকার তরণী বাহি’
সারস মরাল সাথে গাহি’ চরণ রাখি’ শতদলে ॥



আমন ধানের ক্ষেতে জাগে
হিল্লোল তবু অনুরাগে
তব চরণের রঙ লাগে কুমুদে রাঙা কমলে ॥

খ.
নটকানো-রঙ শাড়ি পরে কে বালিকা
ভোর না হতে কুড়াতে যায় শেফালিকা।

মৌমাছিদের সাথে সে চায় কমল-বনের তীর্থে যেতে॥

ছবি: মোকারম হোসেন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন