বিজ্ঞাপন

কবি নজরুলের বাংলাদেশে ফেরার নেপথ্য কথা

May 25, 2023 | 2:25 pm

ফিচার ডেস্ক

স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ মাস পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশে আসার পর কবি আর বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি। এ দেশের মাটিতেই তার সমাধি হয়েছে। নজরুলের এই ঐতিহাসিক ফেরা সম্ভব হয়েছিল বাঙালির আরেক মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে। ইতিহাসবিদদের মতে বঙ্গবন্ধু ছাড়া নজরুলকে ঢাকায় আনা সম্ভব হতো না।

বিজ্ঞাপন

১৯৭২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সম্পূর্ণ বাকরহিত। তিন দশক ধরে বোধশক্তিহীন, নির্বাক এক কবি ঢাকায় এসে কোথায় ও কিভাবে থাকবেন সেটি তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি আলোচনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। পরে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাতি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ের কথা শুনে সানন্দে সহযোগিতা ও অনুমোদনের হাত বাড়িয়ে দেন। আর সে কারণেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় আনা সম্ভব হয়।

দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ থেকে প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সেই রাষ্ট্রীয় সফরে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় রাখা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবন কলকাতার রাজভবনের অতিথিশালায়। বিবিসির বর্ণনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তখন এ এল ডায়াস। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাকে বললেন, ‘দেখুন আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। কলকাতাতেই থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি যেমন আপনাদের কবি, তেমনি আমাদেরও কবি। আমাদের ভাষা এক। সংস্কৃতিও এক। কবি নিজে আগে বহুবার ঢাকায় এসেছেন। বাংলাদেশের অনেক শহরে গিয়েছেন। তো এবারে আমরা কবিকে ঢাকায় নিয়ে ধুমধাম করে তার জন্মদিন পালন করতে চাই।’ রাজ্যপাল এ এল ডায়াস সব শুনে বললেন, ‘এ তো ভালো প্রস্তাব। এমন তো হতেই পারে যে আমরা পালা করে কবির জন্মদিন পালন করলাম। একবার ঢাকায় আর পরেরবার কলকাতায়। তবে আমি এর অনুমতি দিতে পারবো না। আপনি বরং সরাসরি মিসেস গান্ধীর সঙ্গেই কথা বলুন ‘

বিজ্ঞাপন

পরদিনই মুজিব ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বললেন। আর এই সফরের মধ্যেই রাজভবনে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করলেন শেখ মুজিব। মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে তখন রাজভবনে এসেছিলেন কবির দুই ছেলে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ এবং পুত্রবধু কল্যাণী কাজী। তাদেরকেও বঙ্গবন্ধু জানালেন, বাংলাদেশ সসম্মানে কবি নজরুলকে দেশে নিয়ে সংবর্ধনা দিতে চায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার মতামত চাইলেন পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ও তার অত্যন্ত আস্থাভাজন কংগ্রেসি নেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের। তিনিও সম্মতি দিলেন। দুটো দেশের মধ্যে যে পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, সেটার ভিত্তিতেই শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ ভারত মেনে নিল। তবে এটাও ঠিক, দিল্লি ভেবেছিল কবির এই যাত্রাটা হবে সাময়িক। তিনি আবার কিছুদিন পরে ফিরে আসবেন।

কিন্তু শেখ মুজিবের এই চাওয়াই তো আর সব নয়। দুই দেশের মধ্যে এই ধরণের কাজের প্রক্রিয়া রয়েছে। উপরন্তু কবির কোনও পাসপোর্টও ছিল না। সেই কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হলো মুজিব দেশে ফিরে আসার পর। ফেব্রুয়ারি থেকে মে এই চার মাসে নজরুলকে বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আবদুস সামাদ আজাদ ও শরণ সিংয়ের মধ্যেও বেশ কয়েক দফা পত্রবিনিময় হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন মন্ত্রী মতিউর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক নারায়ণগঞ্জের কৃতি সন্তান মুস্তাফা সারোয়ারকে ভারতে পাঠানো হয়। সঙ্গে দিয়ে দেন সরকারি অফিসিয়াল পত্র। নজরুলকে ‘হে কবি’ সম্বোধন করে চিঠি লিখে দিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। চিঠিতে নজরুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। চিঠি লিখে দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদেরকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আশা করি কবিকে ছাড়া খালি হাতে আসবে না’।

বিজ্ঞাপন

এরপর বিদ্রোহী কবি নজরুল সরকারিভাবে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে—খবর প্রচারিত হতে থাকে রেডিও এবং টেলিভিশনে। এতে কলকাতায়ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ভারতের দমদম বিমানবন্দর থেকে কলকাতা প্রবেশ করতে হয় যে সড়ক দিয়ে, তার নাম ‘কবি নজরুল ইসলাম এভিনিউ’। এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি মন্ত্রী মতিউর রহমান এবং মুস্তাফা সারোয়ার। রাস্তার দুপাশে কিছু পোস্টার দেখতে পান তারা। তাতে লেখা ‘অসুস্থ কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না’। কলকাতার কয়েকটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই পোস্টার লাগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, কবি অসুস্থ তাই তাকে বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না— সংগঠনের কর্তারা এমন ডাক্তারি সার্টিফিকেটও যোগাড় করে রাখে। নজরুলকে বাংলাদেশে আনার বিপক্ষে চালাতে থাকে প্রচার-প্রচারণা। এমনকি বিক্ষোভও করা হয়।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার সিদ্ধার্থ রায়ের বৈঠক হয়। সেখানকার ‘রাইটার্স ভবনে’ অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় ভারতীয়দের প্রতিবাদের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাকে সেদিন খুব চিন্তিত দেখায়।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলও চিন্তায় পড়ে যান। যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর সে সময়ের রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ এবং অন্যতম সচিব প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী জানান যে, কবি নজরুলকে সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে যেতে না পারলে, বাংলাদেশেও বিক্ষোভ শুরু হতে পারে। কারণ, ইতোমধ্যেই রেডিও এবং সংবাদপত্রে প্রচার করা হয়ে গেছে যে, অমুক সময় কবিকে বহনকারী বিমানটি ঢাকায় অবতরণ করবে। এ খবর পেয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল উভয় সঙ্কটের পড়েন।

বিজ্ঞাপন

কলকাতায় বিক্ষোভ, অপরদিকে ঢাকায় প্রতিবাদের সম্ভাবনা—এই উভয় সঙ্কটের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সুসম্পর্ক। এ সম্পর্কের ফলেই নজরুলকে বাংলাদেশে দিতে রাজি হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে আবারও বৈঠক হয় ‘রাইটার্স ভবনে’। তবে শর্ত থাকে যে, কবির অসুস্থতার ব্যাপারে যাবতীয় দায়-দায়িত্ব গ্রহণ এবং একটা সময় পরে কবিকে ভারতে ফিরিয়ে দিতে হবে।

দ্বিতীয় বৈঠকের পরদিন ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভোরেই কবিকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেদিন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ বিমান। খুব ভোরেই কবিকে বিমানে ওঠানো হয়। এতে অন্যান্যদের মধ্যে সহযোগিতা করেন কবির দুই ছেলে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। বিমানবন্দরে দ্রুত ছুটে আসে কলকাতার ফটো সাংবাদিকরা, কিন্তু পাননি। কারণ ততক্ষণে কবিকে বহনকারী বিমানটি আকাশে উড়ে গেছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের পাশাপাশি পরে কলকাতায় বোমা বিস্ফোরণের খবরও পাওয়া যায়।

বিমানটি ৩০ মিনিটের মধ্যেই উড়ে আসে ঢাকায়। কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে ততক্ষণে লোকে-লোকারণ্য পুরো বিমানবন্দর এলাকা। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বায়াত্তরের আজকের দিনে নজরুলের দেশে ফেরার বর্ণনা আছে মোরশেদ শফিউল হাসানের লেখা ‘নজরুল জীবনকথা’ গ্রন্থে। “যুদ্ধে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তখনও তৈরি হয়নি। বেলা সাড়ে ১১টায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের বিমানটি অবতরণ করার পর আনন্দে উদ্বেল হাজার হাজার মানুষ স্বাগত জানাল প্রিয় কবিকে। জনতার ভিড়ে কবিকে অতিকষ্টে বিমান থেকে নামাতে হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ২৪ মে অসুস্থ কবি দেখলেন স্বাধীন বাংলাদেশকে। হাজারও মানুষের ভিড় ঠেলে অ্যাম্বুলেন্সে করে কবিকে নেওয়া হয়েছিল ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডে তার জন্য নির্ধারিত বাড়ি ‘কবি ভবন’-এ। এই বাড়িতেই পঁচাত্তরে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত কবিকে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।” সরকারের বরাদ্দ করা সেই বাড়িটি এখন নজরুল ইন্সটিটিউট।

কাজী নজরুলের সঙ্গে সেদিন তার পরিবারের সদস্যরা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন। বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী ও তার স্ত্রী উমা কাজী, ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ ও তার স্ত্রী কল্যাণী কাজী এবং তাদের সন্তানেরা এসেছিলেন কবির সঙ্গে। কবির ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডি কে রায়ও এসেছিলেন সঙ্গে।

ধানমন্ডির ‘কবি ভবনে’ নজরুল ছিলেন বছর তিনেক। প্রতিদিন তাকে দেখতে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমাত এই বাড়িতে। দর্শনার্থীদের ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়তো। ১৯৭৫ সালের ২৩ জুলাই কবিকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে, এখন যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে ভর্তি করা হয়। কবি ছিলেন ১১৭ নম্বর কেবিনে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট এই কেবিনেই কবি মারা যান। (পুণঃপ্রকাশ)

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন