বিজ্ঞাপন

আমি মেজর হায়দারের কথা বলছি

May 26, 2023 | 5:28 pm

রাহাত মিনহাজ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিকেল আনুমানিক ৪টা ৪৫ মিনিট। পরাজয়ের গ্লানিতে বিষণ্ণ, বিমর্ষ লেফটেনেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করতে। পাশে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, মুক্তি বাহিনীর উপ-প্রধান আব্দুল করিম খন্দকার। আর বাম পাশে গেরিলা কমান্ডার মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার। গেরিলা কমান্ডারের গায়ে সামরিক জ্যাকেট, কাঁধে অস্ত্র, হাত মুষ্টিবদ্ধ। মেজর হায়দার দুই নম্বর সেক্টরের (ঢাকাসহ বেশ কিছু অঞ্চল) দায়িত্বরত প্রধান হিসেবে ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তখন দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার, পরে কে ফোর্সের প্রধান খালেদ মোশাররফ কসবা যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালে মেজর হায়দার একজন কমান্ডার হিসেবে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। সে সময় তাঁর ছোট বোন মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ড. সিতারা বেগমও সেখানে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চের উত্তাল সেই দিনটিতে হায়দার ক্যান্টনমেন্টেই ছিলেন। সন্ধ্যার দিকে পাক সেনারা তাঁর অফিসার্স মেসে অভিযান চালালে কয়েক মাইল ক্রলিং করে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি ফিরে আসেন। এরপর যোগাযোগ করেন চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে। যে রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ। তাঁর সাথে হায়দারের দেখা হয় ৩০ মার্চ সিলেটের তেলিয়াপাড়ায়। প্রথম সাক্ষাতেই মুক্তিযুদ্ধ ও ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে দুই বীর যোদ্ধা একমত হন। দুজনের মধ্যে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়। যা অটুট ছিল তাদের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। খালেদ ও হায়দার জানতেন, একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে। যে যুদ্ধের মূল হাতিয়ার হবে গেরিলা যোদ্ধারা। খালেদ মোশাররফ হায়দারকে এই গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেন।

মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে ২৫ মার্চের পর দলে দলে ঢাকার অগ্রসর তরুণেরা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছিলো। সেই অকুতোভয় যুবকদের প্রথম প্রশিক্ষণ শুরু হয় ত্রিপুরার মতিনগরে। যোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তা স্থানান্তরিত হয় মেলাঘরে। যেখানে হায়দারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন হাজার হাজার যোদ্ধা। যাদের মধ্যে ছিলেন কিংবদন্তীতূল্য মুক্তিযোদ্ধা রুমি, বদি, আজাদ, চুল্লু, আলভী, গায়ক আজম খান, মায়া, গাজী, ফতেহ চৌধুরিসহ আরও অনেকেই। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা অবরুদ্ধ ঢাকায় অবিশ্বাস্যসব অভিযান চালায়। যাতে ভেঙ্গে পড়ে পাক সেনাদের মনোবল। আর মুক্তির আশায় উদীপ্ত হয় অবরুদ্ধ ঢাকার কোটি বাঙালির প্রাণ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর-২ এর অধীনেই বেশি তরুণ-যুবক যুদ্ধ করতে আসে। ঢাকা থেকে আসা চিন্তা চেতনায় অগ্রসর এই তরুণরাই ছিল হায়দারের প্রধান হাতিয়ার। তাদের থাকা-খাওয়া আর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে মেজর হায়দারকে হিমশিম খেতে হয়। এদিকে মুজিবনগর সরকারের একটি অংশ অপপ্রচার চালায় যে, সেক্টর-২ বামপন্থীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। কমিয়ে দেওয়া হয় অস্ত্র ও লজিস্টিক সরবরাহ। এমন পরিস্থিতিতে ছেলেরা শত কষ্ট সহ্য করে, কাদা-জলে একাকার হয়ে হায়দারের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। একজন নিবেদিত প্রাণ, উদার, দেশপ্রেমিক হায়দারই পেরেছিলেন তাদের দুর্ধর্ষ গেরিলাতে পরিণত করতে। নভেম্বরে কসবা যুদ্ধে খালেদ মোশাররফ গুরুতর আহত হলে মেজর হায়দারকে সেক্টর-২’র দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি এ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন ১৬ ডিসেম্ব পর্যন্ত। শুধু তাই নয় স্বধীনতার পর ঢাকা শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, গেরিলাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন হায়দার। এছাড়া ভারতীয় বাহিনীর সাথে গেরিলাদের বেশ কয়েকটি ঘটনা উত্তেজনা ছড়ালে হায়দার তা বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রশমন করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকাল সোয়া আটটায় ঢাকা বেতার থেকে একটি বিশেষ ঘোষণা পাঠ করেছিলেন তিনি। তাতে তিনি বলেছিলেন, আমি মেজর হায়দার বলছি। প্রিয় দেশবাসী আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক। সকল গেরিলাদের প্রতি আমার নির্দেশ আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখাতে হবে। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। আল-বদর, আল-শামসদের ধরিয়ে দিন। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে টেলিভিশনেও একই ধরনের আহ্বান জানান মেজর হায়দার।

বিজ্ঞাপন

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেজর হায়দারকে পোস্টিং দেওয়া হয় কুমিল্লা সেনানিবাসে। এই পোস্টিং তার কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা সেক্টর-২ এর অধীনে ছিল। তাই ঢাকাতেই তাঁর পোস্টিং হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। যাই হোক, কুমিল্লাতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ১৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেন হায়দার। একজন মেজর পদবীর সেনা কমকর্তা হয়েও তিনি ঐ রেজিমেন্টের প্রধানের দায়িত্ব পান। ১৯৭৪ সালে তাঁকে লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে তাঁকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে বদলি করা হয়। নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আগেই তাঁকে আবার বদলী করা হয় বান্দরবনের রুমা ক্যাম্পে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াবহ এক হত্যাযজ্ঞে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতার অবৈধ পালাবদল ঘটায় ফারুক-রশীদ খুনীচক্র। মনে রাখা প্রয়োজন, সেনা কমান্ডকে ভঙ্গ করে কর্নেল ফারুক ও রশীদ চক্র এই নৃশংস হত্যাকা- ঘটিয়েছিা। এ সময় ফারুক ও রশীদ ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিলের অধীনে। অর্থাৎ তারা সারাসরি শাফায়াত জামিলের কমান্ডকে ভঙ্গ করে। এরপর খন্দকার মোশতাককে সামনে রেখে বঙ্গভবন থেকে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছিল খুনি চক্র। তাদের সেনা কমান্ডে ফেরাতে সেনাবাহিনীর সিজিএস বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও ঢাকার ব্রিগেড কামান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল একটা পাল্টা প্রচেষ্টার পরিকল্পনা করেন। যার সাথে কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না এ.টি.এম. হায়দার। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ ও শাফায়াত জামিল একটি অভ্যুত্থান ঘটান। এদিকে ঐ দিনই বাবার একটি জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে ঢাকার আসেন হায়দার। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে হায়দার ঢাকায় পৌছান ৪ নভেম্বর রাতে। উঠেন তাঁর বড় বোনের মতিঝিলের বাসায়। পরদিন ৫ নভেম্বর তিনি তার বাবাকে নিয়ে নারয়ণগঞ্জ যান। সেখানে কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাবা-ছেলে ঢাকায় ফেরেন। পরদিন অর্থাৎ ৬ নভেম্বর সকালে হায়দার বাবার জন্য বাজার করেন। এরপর রাত সাড়ে আটটার দিকে বাড়ি থেকে বের হন। পরিস্থিতি ঘোলাটে থাকায় তাঁর বোন বারবার নিষেধ করলেও সে কথা রাখেননি হায়দার। বান্দরবান থেকে হায়দার কেন হঠাৎ ঢাকায় আসেন সে বিষয়ে সে বিষয়ে ভিন্ন তথ্যও পাওয়া যায়। মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম তাঁর ‘সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছে, হায়দার ছিলেন অবিবাহিত। তাই বিয়ের পাত্রি দেখতে তিনি ঐ সময় ঢাকায় এসেছেন।

যাই হোক, ৩ নভেম্বরের পালাবদলের চেষ্টা শুরু হওয়ার পর সেই রাত অর্থাৎ ৬ নভেম্বর রাতে খালেদ ও শাফায়েত জামিলের সাথে হায়দারের দেখা হয় বঙ্গভবনে। যদিও তখন পরিস্থিতি খালেদের প্রতিকূলে যেতে শুরু করেছে। জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা কর্নেল (অব.) তাহেরর নেতৃত্বে নতুন এক অভ্যত্থান শুরু করে। যা শুরু হয় রাত বারোটার পর। সৈনিকরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে। ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই অফিসারের রক্ত চাই’ এমন ভীতিকর শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ঢাকা সেনানিবাস। বিচ্ছিন্নভাবে ১৩ জন অফিসার প্রাণ হারান। এ সময় সেনানিবাসে ফারুক-রশীদের অনুগত ইউনিটগুলোও সক্রিয় ছিল। তারাই মূলত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁর বাসা থেকে মুক্ত করে। এদিকে সেনানিবাসের এমন পরিস্থিতির খবর পেয়ে একসাথে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন খালেদ, হায়দার ও হুদা। শাফায়েত জামিল বঙ্গভবনের দেওয়াল টপকাতে গিয়ে আহত হন। এদিকে ভোরবেলা খালেদ, হায়দার ও হুদা আশ্রয় নেন খালেদের বিশস্ত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে। কর্নেল নওয়াজিশ তখন এই রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

খালেদ-হুদা-হায়দার ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে পৌঁছার পর পরিবেশ মোটামুটি শান্তই ছিল। সকালে তাদের জন্য নাশতার ব্যবস্থা করেছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। কিন্তু এরপর সেনানিবাস থেকে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ক্যাপ্টেন জলিলের নেতৃত্বে একদল সেনা গিয়ে সৈনিকদের উত্তেজিত করে তোলে। অনেকেই উল্লেখ করেছেন এ সময় ক্যাপ্টেন আসাদও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় খালেদ ছিলেন খুবই ধীর-স্থির। কিন্তু কর্নেল হুদা বিচলিত ছিলেন। চরম মুহূর্তে হায়দার ক্যাপ্টেন জলিলকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু উত্তেজিত, উদ্ধত জলিল ও তার সঙ্গীদের কিছুতেই নিবৃত করা যায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক দল সেনা নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তীতূল তিন বীর যোদ্ধাকে।

আর গুলি করার আগে ক্যাপ্টেন জলিল মেজর হায়দারের পরনে থাকা কমান্ডো জ্যাকেটটি খুলে নেন। যেমন একটি জ্যাকেটি পড়েই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল এ.কে. নিয়াজীকে নিয়ে আত্মসমর্পণ মঞ্চের দিকে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন গেরিলা যোদ্ধাদের গুরু মেজর এ.টি.এম. হায়দার। বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.টি.এম. হায়দার হত্যার বিচার চাই। বিচার চাই খালেদ মোশাররফ ও নাজমুল হুদা হত্যাকা-ের।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকাত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন