বিজ্ঞাপন

বিলেতে সাড়ে তিনদিন!

June 2, 2023 | 3:31 pm

রহমান মৃধা

এবারের বিলেত ভ্রমণ কিছুটা ভিন্ন ধরনের তথ্য বহন করেছে। মাত্র সাড়ে তিন দিনে বেশ কিছু ছোটবড় শহর সহ খুঁটিনাটি কিছু ঘটনা হৃদয়ে বড় আকারে দাগ ফেলেছে। প্রযুক্তির যুগে ঘরে বসেই বিশ্ব ভ্রমণের সুব্যবস্থা রয়েছে অনলাইনের মাধ্যমে। ইচ্ছে করলেই যখন যেখানে খুশি যাওয়া বা দেখা সম্ভব তবে বাস্তবে এবং সামনে থেকে দর্শনে যে অনুভূতি জাগ্রত হয় সেটা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণতা পায়না।

বিজ্ঞাপন

ভ্রমণে অনেক ছোটখাটো ঘটনা ঘটে, যেমন হঠাৎ রাস্তায় বড় আকারে ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেল। কি ব্যাপার? জানা গেল রাস্তায় দুটো গাড়ি হঠাৎ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। আবার যেমন দেখা গেল অনলাইনে প্লেনের চেকিংয়ের সময় পার হয়ে যাওয়ায় পুরো পরিবার প্লেন মিস করে এয়ারপোর্টে বসে ধুকে ধুকে কাঁদছে। এধরনের ঘটনা সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও ঘটে থাকে। সব ধরনের বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরে আমরা অতীতের কথাগুলো পুরনো স্মৃতিগুলো ভুলে যাই, আবার নতুন উদ্যোগে কোন জায়গায় নতুন করে ভ্রমণ করি, এটাই জীবন। জীবন চলছে তার গতিতে এবং চলতে থাকবে যতদিন বেঁচে থাকব আমরা ভূবনে।

বহু বছর পর নতুন করে লন্ডনে আবারও থিয়েটার দেখলাম, একটানা তিন ঘন্টা তবে মাঝে কিছুক্ষণ বিরতি ছিল আর তৎক্ষণাৎ সবাই ধুমধাম করে নানা জাতীয় পানীয় খাবার থেকে শুরু করে কথোপকথনে লেগে গেল। আবার ঘন্টা বাজতেই থিয়েটারে মনোযোগ। ছোটোবেলায় বাংলাদেশে যেমন যাত্রা গান দেখেছি, বলতে গেলে একই ধরনের অনুভূতি। পার্থক্য শুধু এদের বিনোদন বিলেতের প্রাসাদের পরিবেশে আর আমাদের সবুজ-শ্যামল বাংলার গ্রামের উন্মুক্ত মাঠে। তাছাড়া এখানেও সেই এক ঝাঁক ডানাকাটা পরী এসে রং বেরংয়ের নাচ গানে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। আমাকেও রাখার চেষ্টা করেছিল বটে তবে সারাদিন দৌড়াদৌড়ির পর নিঝুম ওই সন্ধায় মিটি মিটি আলোর মাঝে পুরো সময়টিই নাকি আমি নাক ডেকে ঘুমিয়েছি এমন মন্তব্য করেছেন যাদের সাথে বসে লন্ডনের পিকাডিলি থিয়েটারে অনুষ্ঠিত মিউজিক্যাল শো মুলা রুস (Moulin Rouge) দেখেছি। থিয়েটার শেষে হোটেলে ঢুকেই ঘুম কারণ সকালে উঠে গাড়িতে বিলেত প্রবাসী বন্ধু নাজমুলের সহধর্মীনি রুবি হুদা, মেয়ে আইনা, আমি এবং আমার স্ত্রী মারিয়াসহ যাত্রা দিতে হবে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন এবং ওয়ারউইক ক্যাসেল, ওয়ারউইকশায়ারের উদ্দেশ্যে।

নাজমুল থাকে লন্ডনের সাউথ ওয়েস্টে আর আমরা উঠেছি ইস্ট লন্ডনে। ট্রাফিক এত ব্যস্ত যে দুই ঘন্টা লেগে গেল লন্ডন শহর ছাড়তে। তারপর মটর ওয়েতে উঠতেই রাস্তায় জ্যাম, কি করা? শেষে গ্রামের ছোট রাস্তা ধরে ধীর গতিতে যেতে যেতে পথে বিলেতের প্রাকৃতিক সৌন্দয্যকে উপলব্ধি করতে করতে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভনে এসে পৌঁছেলাম।

বিজ্ঞাপন

শুধু অনুভবে হৃদয়ে মনে করিয়ে দিল সেই প্রায় ৪৫৯ বছর আগের এক মহামানবের কথা যে এসেছিল ভবে সাহিত্যের এক রসাল চেতনা নিয়ে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (জন্ম ২৩ এপ্রিল, ১৫৬৪; মৃত্যু: ২৩ এপ্রিল, ১৬১৬) ছিলেন একজন ইংরেজ কবি ও নাট্যকার। তাকে ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের একজন অগ্রণী নাট্যকার মনে করা হয়। মন প্রাণ উজাড় করে দেখলাম তার প্রাণের গ্রাম। শেক্সপিয়ার মরেছে তবে মরেনি তার সাহিত্য, তাইতো প্রতিদিন আমাদের মত হাজারও মানুষ গোটা বিশ্বের নানা প্রান্তে থেকে আসে তার গ্রামের বাড়িতে। শেক্সপিয়ারের বাড়ির মাত্র আট মাইল দূরে রয়েছে হাজার বছর আগের এক ক্যাসেল, নাম ওয়ারউইক ক্যাসেল। ফিরতে পথে সেখানেও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে অক্সফোর্ডের পথ ধরে সন্ধায় লন্ডনে ফিরে এলাম। সকালে রয়েছে পরবর্তী আয়োজন সেটা হলো নতুন প্রজন্মের বিয়ের অনুষ্ঠান। আমার ছোট ভাই শাহীন সেও লন্ডন প্রবাসী, বহু বছর ইস্ট লন্ডনে আছে। শাহীনের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের বিয়ে, বিশাল পার্টির আয়োজন করেছে। তিনশোর বেশি মেহমান সেই পার্টিতে অংশগ্রহন করছে। শুধু বিয়ে নয় সব ধরনের পার্টিতে বিশ্বের সকল বাঙালীদের একটি জিনিসের মধ্যে মিল খুঁজে পেলাম সেটা হলো লিখা রয়েছে বিয়ের কার্ডে শার্প ১২.৩০-এ অনুষ্ঠান শুরু হবে কিন্তু ১৩.৩০ এর আগে কেও সেখানে আসেনি এবং এ নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো মাথা ব্যাথা নেই। পরে অনুষ্ঠান শুরু হলো, শুরু হলো খাওয়া দাওয়া এবং ছবি তোলার পালা। লন্ডনের বিয়ে, ভেবেছিলাম নানা দেশের লোকজন সহ বিলেতিরাও থাকবে কিন্তু না শুধু বাংলাদেশিরাই সে বিয়েতে ছিল। বিয়ে পর্ব শেষ হলো বটে তবে আমার মাথায় যে জিনিসটা আমাকে ভাবাতে শুরু করল সেটা হলো গোটা বিশ্বের সর্বত্রই কম বেশি বাঙ্গালীদের বসবাস। তারা সবকিছুই ম্যানেজ করে বেশ ভালই আছে। কিন্ত এ সত্ত্বেও ইন্টিগ্রেট হতে পারেনি। আর এই না পারার জন্য শুধু যে বাঙ্গালীরাই দায়ী তা নয়, এ দায় ভার সেসব দেশের রাষ্ট্রেরও রয়েছে।

ভাবুন গত দশ বছর ধরে রোহিঙ্গা জাতি বাংলাদেশে বসবাস করছে। তারা বিদেশি এবং আমাদের দেশ থেকে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধাসহ নানা ধরনের সাহায্য পেলেও যেমন বাঙ্গালীয়ান হওয়া খেকে বঞ্চিত হয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে হয়ত না মিয়ানমার বা না বাংলাদেশি হয়ে জীবন যাপন করছে। পরে কোন একদিন যদি বিশ্বের থেকে সাহায্য না পায় তখন শেষে খাতা কলমে বাংলাদেশী নাগরিক হবে বটে কিন্তু কোনোদিন কি বাংলাদেশী হতে পারবে? এই না পারার জন্য শুধু কি রোহিঙ্গা জাতি দায়ী থাকবে, নাকি আমারও? বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা আর বিশ্বের নানা দেশে বসবাসকারী দূরপরবাসি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক ছাড়া আছে কি অন্য কোনো পার্থক্য তাহলে? শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি ( হ্যামলেটের জীবনের চরম দ্বিধা দন্দ্ব যেমন ফুটে উঠেছে, তার স্নেহময় পিতার মৃত্যুশোক না কাটতেই মা যখন পিতার হত্যাকারী-চাচাকে বিয়ে করেন, তখন উন্মাদপ্রায় হ্যামলেটের মধ্যে প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। তখন পিতার হত্যাকারীকে হত্যা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ) “টুবি ওর নট টু বি দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন?” এবং একই সময় মাকে উদ্দেশ্য করে এও বলেছিলেন -দূর্বলতা, তোমার নাম নারী। শেক্সপিয়ার ৪৫৯ বছর পরেও মানুষের কাছে আজও প্রানবন্ত, আধুনিক। তার এই কালজয়ী কিছু রচনার জন্য তিনি হয়ত আজীবন থাকবেন মানুষের অন্তরে। তবে আমার ভাবনায় শুধু একটি প্রশ্নই থেকে গেলো সেটা হলো -বিশ্বের নানা বর্ণ, নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে সত্যিকার ইন্টিগ্রেশন আদৌ হবে কি কোনোদিন? – টুবি ওর নট টু বি দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন?

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন