বিজ্ঞাপন

ফিলিস্তিন যুদ্ধের ভুলে যাওয়া ৮ হাজার বাংলাদেশির কথা

May 17, 2018 | 9:15 pm

সন্দীপন বসু

। সন্দীপন বসু ।

বিজ্ঞাপন

একটি সাদাকালো ফটোগ্রাফ আর একটি কবরের নামফলক। সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ভুলে যাওয়া ইতিহাসের ভগ্নাবশেষ।  এ ইতিহাস ফিলিস্তিন যুদ্ধে অংশ নেওয়া ৮ হাজার বাংলাদেশির কথা।

সময়টা ১৯৮০ সাল।  কিংবদন্তি নেতা ইয়াসির আরাফাত যখন ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি গড়ার সংগ্রাম করছেন।  বরাররের মতো ইসরায়েলি সেনারা তখনও খড়গহস্ত।  নিরুপায় ইয়াসির আরাফাত মুসলিম উম্মাহর কাছে সাহায্যের আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামে ‘স্বেচ্ছাসেবী’ হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি তরুণ।

মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যম ‘আল আরাবিয়ার’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, লেবাননে অবস্থান নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তারা।  এদের সবাই অবশ্য যুদ্ধে অংশ নেননি। অনেকেই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সাহায্য করেছেন ওই যুদ্ধে।  চরম গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়া থেকে শুরু করে অস্ত্র-রসদ বহন এমনকি পাহারার কাজও করেছিল এসব বাংলাদেশি যুবকেরা।ওই যুদ্ধে মারাও গিয়েছিলেন শতাধিক বাংলাদেশি।  এই বীর বাঙালিদের মধ্যে কয়েকজনের কবর রয়েছে লেবাননে। জীবিতদের অনেকেই পরে পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি এমনই এক যোদ্ধার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় ফিলিস্তিনের সংবাদসংস্থা প্যালেস্টাইন নিউজ নেটওয়ার্কে (পিএনএন)। ১৯৮০ সালে লেবাননের সীমান্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের সিলেটের জকিগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসমাইল চৌধুরী আকরাম। এখন তিনি লেবাননের নাগরিক। কাজ করেন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেহরক্ষী হিসেবে।

পিএনএনের কাছে মোহাম্মদ ইসমাইল চৌধুরী আকরাম জানান, ১৯৭৮ সালের শেষদিকে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে স্বেচ্ছাসেবীরা লেবাননের ইরান দূতাবাসে ওঠে।  এমনই এক দলের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে চেপে এসেছিলেন তিনি। ওই দলে ছিলেন আরো প্রায় ৬০০ স্বেচ্ছাসেবী।

ইসমাইল চৌধুরী আকরাম জানান, লেবানন থেকেই বিভিন্ন দেশে আসা স্বেচ্ছাসেবীদের যোগাযোগ করানো হয় ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে থাকা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সঙ্গে।  পিএলও এই স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। পরের বছরই এই স্বেচ্ছাসেবীরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে অংশ নেন।

বিজ্ঞাপন

ইসমাইল চৌধুরী আরও জানান, বাংলাদেশি প্রায় আট হাজার যোদ্ধা বিভিন্নভাবে লেবাননে এসেছিলেন।  এদের মধ্যে একশ’র বেশি যোদ্ধা মারা যান। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবেই বাংলাদেশি এই স্বেচ্ছাসেবীদের মৃত্যু হয়েছে বলেও মত তাঁর। সংঘাতের পর লেবাননে জাতিসংঘের বাহিনী মোতায়েন করা হয় ১৯৮২ সালে। এরপরই বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা লেবানন ছাড়তে শুরু করেন।

দক্ষিণ লেবাননের শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পের পাশের কবরস্থানে।শহীদ কামাল মুস্তাফা আলীর কবর।  ছবি: আল আরাবিয়া

তবে অনেক যোদ্ধা লেবানন ছেড়ে দেশে অথবা ভিনদেশে ঠাঁই গাড়লেও ফেরা হয়নি অনেকের। এদের মধ্যে অন্তত একজনের শেষশয্যা হয়েছিল দক্ষিণ লেবাননের শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পের পাশে একটা কবরস্থানে। আল আরাবিয়ার প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে ওই বাঙালি বীরের কবর ও নামফলকের কথা। বাংলাদেশি সেই বীরের নাম কামাল মুস্তাফা আলি। তার পরিচয়ের বিস্তারিত কোনো কিছুই কবরের ওই নামফলকে নেই। শুধু আছে শহীদ সেই বীর আর তার জন্মভূমি বাংলাদেশের নাম।  ওই নামফলকে উল্লেখ আছে পবিত্র কোরানের একটি আয়াতও।  ‘সুরা আল ইমরান: ১৬’ উদ্বৃত করে উল্লেখ করা আছে- ‘আর যারা আল্লাহর জন্য শহীদ হন, তাদেরকে কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।’

বিজ্ঞাপন

পিএনএনের কাছে বাংলাদেশি যোদ্ধা ইসমাইল চৌধুরী আরো বলেন, বৈরুতের অলিতে গলিতে এখনও অনেক বাংলাদেশির বাস। এদের অধিকাংশকেই নাগরিকত্ব দিয়েছে লেবানন সরকার। সরকারি চাকরিও হয়েছে অনেকের। তবে লেবাননের বেতনে দিন কাটিয়ে অধিকাংশেরই দিন কাটাতে কষ্ট হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তবুও একটি স্বস্তি আছে বলে জানান ইসমাইল চৌধুরী। বলেন, ফিলিস্তিনের মুক্তির উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে এসেছিলাম তা পূরণ হয়েছে।  তবে দেশটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুব বেশি আশা করার কিছু নেই বলে মন্তব্য তার।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ওই যুদ্ধে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের প্রমাণ আছে যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের গ্রন্থাগারেও। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাতে লাইব্রেরি অব কংগ্রেস জানিয়েছে, প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশি যুবক সে সময় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পিএলও’র সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।

লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ১৯৮৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের দ্বিতীয়বার ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ সরকার তাকে জানায় প্রায় ৮ হাজার যুবক স্বেচ্ছায় ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করার কথা।  ইয়াসির আরাফাত নিজেও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন।  প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ফিলিস্তিনী সশস্ত্র সংগ্রামের বেশ কিছু নেতা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ওই লাইব্রেরিতেই রয়েছে ফিলিস্তিনের জন্য লেবাননে যুদ্ধ করা বাংলাদেশি যোদ্ধাদের একটি দূর্লভ সাদাকালো গ্রুপ ছবি। ১৯৮২ সালে ছবিটি তুলেছিলেন যুক্তরাজ্যের ফটোসাংবাদিক ক্রিস স্টিল পারকিনস।  তিনি তখন বৈরুত থেকে মধ্যপ্রাচ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ লড়ায়ের খবর সরবরাহ করতেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিবিসির সঙ্গে কথাও বলছিলেন পরকিনস। তিনি জানান ইসরায়েল লেবানন সীমান্তের উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধরত একদল বাংলাদেশি যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। সশস্ত্র এই দলটির সঙ্গে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ না হলেও তাদের একটি ছবি তুলেছিলেন পারকিনস। পরবর্তীতে ওই ছবিই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের একমাত্র আইকনিক ছবি হয়ে থাকে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিন পরস্পরের বন্ধু।  স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিনের নাম আছে প্রথম কাতারে। আর বাংলাদেশও একাত্তরের পর ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি, মর্যাদা ও সহযোগিতা করে আসছে।  বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক।  শেখ মুজিব তাকে বাংলাদেশের মানুষের ‘মহান বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

প্রতিদান দিয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাতও। মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী আরব বিশ্ব যখন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তখন ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়াতে ন্যাম সম্মেলনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছিলেন ইয়াসির আরাফাত। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন মুজিবুর রহমান এবং সেই সম্মেলনে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিলিত হন। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনি কোনো নেতার এত উচ্চপর্যায়ের বৈঠক।  একই বছরে তিনি আরব রাষ্ট্রগুলোসহ পাকিস্তানকে চাপ দিতে থাকেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য।

এরই মধ্যে শেখ মুজিব ঢাকায় পিএলও সরকারকে আমন্ত্রণ জানায় অফিস খোলার জন্য। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকায় পিএলও নেতা এবং কূটনীতিকরা আসেন এবং ফিলিস্তিনের প্রথম কোন দপ্তর খোলা হয় ঢাকায়। এ সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিকদের প্রায়ই অংশ নিতে দেখা যেত বলে জানা যায় ১৯৭৬ সালে ঢাকার আমেরিকান অ্যাম্বেসি থেকে পাঠানো এক বার্তায়।  যা ২০১৪ সালে ফাঁস করে সাড়া ফেলে দেওয়া মার্কিন গোপন নথি ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ওয়েবসাইট উইকিলিকস।

পরবর্তী সরকারগুলোর আমলেও বন্ধুত্বের সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।  রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার শাসনামলেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। প্রচণ্ড বৈরী সময়ে ইয়াসির আরাফাত একাধিকবার রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এসেছেন। অসংখ্যবার যাত্রা বিরতি করেছেন ঢাকার বিমানবন্দরে। সবশেষ ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন ফিলিস্তিনের এই কিংবদন্তি নেতা।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নিয়মিত অনুদান ও সমর্থন ছাড়াও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশ সরকার বরাবরই ছিল বেশ আন্তরিক। ১৯৮০ সালে ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে সরকার।  যেখানে একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে অস্ত্র হাতে দেখা যায় এবং তার পেছনে কাঁটাতারে ঘেরা ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা মসজিদের ছবি। এই ডাকটিকেটে ইংরেজীতে লেখা হয়, ‘আমরা বীর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের সালাম জানাই ।’ সবশেষ জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধনের সময়ে গাজা ইসরাইল সীমান্তে গুলিতে ৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর গতকাল বুধবারও (১৬ মে, ২০১৮) ফিলিস্তিনে ইসরাইলের শক্তি প্রয়োগের নিন্দা করে একে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজও বাংলাদেশ-ফিলিস্তিনের সম্পর্কের কথা যখন আসে, আসে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে বাংলাদেশের অকুন্ঠ সমর্থনের কথা- সঙ্গে সঙ্গেই আসে আশির দশকে দেশটির যুদ্ধে অংশ নেওয়া ৮ হাজার বাংলাদেশির নামও। যারা এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবিকতার মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন বহুকাল ধরেই।

সারাবাংলা/ এসবি

 

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন