বিজ্ঞাপন

‘আমাদের বিশ্বমানের গিটারিস্ট আছে, বিশ্বমানের ভোকাল নেই’

May 23, 2018 | 1:00 pm

তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

সু-সমাচারকে সুরে রূপান্তরিত করে তিনি আমাদেরকে শুনিয়েছেন গান। আর আমরা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছি। তার সৃষ্টিকে লক্ষ্য করে ছুড়েছি ঘৃণার পাথর। তবুও তিনি মরে যাননি। আসমানি পাখির ডানায় চেপে উড়ে যাননি মেঘের শহর। প্রেমিকার হাতে খুন হয়ে যাওয়া জাহাজী বরং সাতরে পাড়ি দিয়েছেন বারুদের সমুদ্র। ঘৃণার জবাবে উপহার দিয়েছেন শব্দের অলংকার।

জিয়াউর রহমান জিয়া। শিরোনামহীন সভ্যতার চেনা হাসিমুখ, ধ্রুপদী যাদুকর। তার মগজভর্তি স্বপ্নের ফানুস, শব্দের মেঘমালা। কবিদের শবযাত্রায় হেটে যাওয়া উদাস কবিতা, যেন তিনি নিজেই অনুচ্চারিত কোন শোক, নিয়ন অসুখ।

গত শতকের শেষ দশক, ঘরের বাইরের রঙিন পৃথিবী দেখবেন বলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন গিটার। এক চোখে রৌদ্দুর, আর এক চোখে নীল রাত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন জীবনের চৌরাস্তায়। এখনো কি তিনি একা ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়েই আছেন? এখনো কি দেখছেন বর্ণমালার মিছিল, স্বদেশ আর হাসিমুখে একাকার হয়ে যাওয়া বিবর্ণ সাইনবোর্ড? এখনো কি তাকে ফেলে ছেড়ে যাচ্ছে লাস্ট বাস?


  • শিরোনামহীন কেমন আছে?

শিরোনামহীন খুবই ভাল আছে। আমরা মিউজিশিয়ানরা আসলে কাজ করতে চাই। আমরা গান করবো, রেকর্ড করবো, ডেলিভার করবো, স্টেজে পারফর্ম করবো, দিস ইজ কল্ড মিউজিশিয়ানস লাইফ। এখন শিরোনামহীন ভালো আছে কারণ আমরা এই কাজটাতেই ব্যস্ত থাকতে পারছি যেটা আমরা করতে চাই। শেষ তিন থেকে চার বছর আমরা কোনও নতুন গান দিতে পারিনি, যেকারণে আমরা মানসিকভাবে মনক্ষুন্ন ছিলাম। কিন্তু এখন সেটা করতে পারছি। সো উই আর ভেরি ফরচুনেট।

  • গত তিন বছরের গানের খরার কারণ কি ছিলো?

একটা গানের কাজ করতে গেলে সবাই মিলে করতে হয়। সবাই মিলে কাজ করার যদি কোন উপায় না থাকে অথবা যদি দেখা যায় যে কেউ অনেক বেশি ব্যস্ত, সে হয়তো সময় দিতে পারছে না, কাজটা করতে আগ্রহী না, তখন কিন্তু কাজটা হবে না। এরকম নানাবিধ কারণে গান করাটা হয়ে ওঠেনি। যাই হোক, এখন আমরা ভালো আছি কারণ আমরা কাজ করতে পারছি। এখন আমাদের সঙ্গে খুব বেশি ব্যস্ত মানুষও নেই। আমরা মিউজিকে ব্যস্ত হতে চাই। এখন আমরা সেটা পারছি। আমাদের ব্যান্ড মেম্বারদের মধ্যে সেই তৃষ্ণাটা আছে। কাজ করতে পারছি বলেই এখন নতুন নতুন গানও উপহার দিতে পারছি শ্রোতাদের।

  • আমাদের ধারণা ছিলো, বাংলাদেশের অন্য ব্যান্ডগুলোর তুলনায় আপনাদের বন্ধনটা জোড়ালো

দেশে বিদেশে যেখানেই যে ব্যান্ড করুক না কেন বন্ডিং ছাড়া তো আর ব্যান্ড হয় না। আমি মনে করি সব ব্যান্ডেই সবার মধ্যে ভালো বন্ডিং রয়েছে। আমাদেরও তাই ছিলো এবং আমি বিশ্বাস করি তাই আছে। আমরা যে লাইনআপটা নিয়ে চলছিলাম তার মধ্য থেকে কেবল একজন চলে গেছেন। বাকী চারজন কিন্তু আমরা একসঙ্গেই আছি। তার মানে আমাদের বন্ডিং কিন্তু বন্ডিং এর জায়গাতেই আছে। এমন হতো যে আমরা ভেঙ্গে দু’টুকরা হয়ে গেছি, কেউ কেউ তার সঙ্গে গেছে কেউ আমার সঙ্গে আছে! এটা হয়। এর আগেও কিন্তু শিরোনামহীনের লাইনআপে পরিবর্তন আসছে। একজন দুইজন চলে গিয়েছে। এটা ঘটতেই পারে। কিন্তু আমরা যেটাতে হার্ট হয়েছি, আনফরচুনেটলি, ব্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার পর ব্যান্ডের বিরুদ্ধে অযাচিত অভিযোগ আনা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে এটা করা হয়েছে বলেই বাংলাদেশের মানুষ হার্ট হয়েছে আমরাও হার্ট হয়েছি।

বিজ্ঞাপন

  • শিরোনামহীনের ভাঙ্গনের কি কারণ সেই প্রশ্ন আমরা করবো না। এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন হয়েছে, অনেক উত্তরও হয়েছে। আমরা জানতে চাইবো, এ ভাঙ্গনের প্রভাব শ্রোতাদের উপর কতটা পড়বে?

আসলে এটাকে বলে মিউজিক লিটারেসি। আমি যতো বেশি উন্নত দেশে যাবো, দেখবো সেখানে ব্যান্ড কি, ব্যান্ডের স্ট্রাকচার কি সেই আঙ্গিক বিবেচনা করে তাদেরকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হচ্ছে। আর যতো অনুন্নত দেশে যাবো বা যতো শিক্ষার অভাব এরকম জায়গায় যাবো ততো বেশি দেখবো যে ওইভাবে সম্মানটা তারা করতে পারে না। আমি এই বিতর্কে যাবো না। শুধু বলতে চাই, শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। প্রতিক্রিয়া এমন না যে তারা শিরোনামহীনকে নিয়ে খুব আচ্ছন্ন হয়ে গেছে বা ভোকালকে (তুহিন) নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। আমাদের দেশের একটা বড় বাস্তবতা হলো, একটা বড় জনগোষ্টি আসলে ব্যান্ড মিউজিকের কালচারটাই বোঝে না। যেমন সলো মিউজিকের ক্ষেত্রে আর্টিস্ট বলতে আমার শুধু গায়ককে মিন করি। কিন্তু ওখানেও তার সঙ্গে কেউ না কেউ বাজাচ্ছে, সেটা মিনই করি না, ব্যান্ডে যেটা করা হয়। পার্থক্যটা বেসিকেলি কোথায়? গান তো সেও গাইছে আমরাও গাইছি! পার্থক্যটা হচ্ছে যখন একটা গান সৃষ্টি করা হয়, প্রথম পার্ট হচ্ছে গানের সৃষ্টি, কথা এবং সুর থেকে গানটা ক্রিয়েট করা হয়। এরপর সেটাকে ডেলিভার করা হয়। নৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে আমার জানি একটা গানের দুইটা পার্ট। একটা ক্রিয়েশন, আরকেটা পারফর্মেন্স। যেটা রেকর্ডিং করা হচ্ছে সেটাকেও বলা হয় পারফর্মেন্স, ক্রিয়েশন না। সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর একটা গানের পারফর্মেন্সে সলো আর্টিস্ট এন্ড ব্যান্ডের মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্য আছে। সলো আর্টিস্টদের ক্ষেত্রে গায়কের জন্যই গানটা তৈরি করা হয়। কিন্তু ব্যান্ডের ক্ষেত্রে একটা গান ক্রিয়েট করে ফেলার পরে সেই গানটা হয় ব্যান্ডের গান। কারণ এখানে সবার দায় থাকে। সবাই নিজের অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করে এখানে কাজ করতে আসে, এখানে কোনও কিছুই গায়কনির্ভর না। ব্যান্ডে গায়কের সুরটা কিন্তু করে দেয়া হয়, কিন্তু গিটারিস্ট যে সলোটা বাজাবে বা অন্য কেউ যদি সলো বাজায় সেক্ষেত্রে সেটা নিজেদের ক্রিয়েট করে নিতে হয়। কেউ করে দেয় না। গানের সময় পেছনে কি বাজবে, প্লাকিং হবে নাকি রিদম হবে নাকি ডিস্টর্সন বাজবে, বেজ গিটারে কোনখানে কি কাজ হবে, প্রত্যেকটা জিনিশ কিন্তু যার যার ক্রিয়েশন। ভোকাল যদি গানের ক্রিয়েটর না হয়ে থাকে তাহলে সে শুধুমাত্র গানটা গাইছে। পুরো ব্যান্ড তাকে গাইড করছে। কিন্তু অন্যরা যে যা করছে সেখানে কেউ গাইড করে না। যার যারটা তাকে বানিয়ে নিতে হচ্ছে। এটা হচ্ছে সলো মিউজিক ও ব্যান্ড মিউজিকের পার্থক্য। ওই জায়গা থেকে আমরা ব্যান্ডের মানুষ যারা, তারা গোটা জীবনটা ব্যান্ডের পেছনেই দিয়ে ফেলি। এটা অনেকেই বোঝেন না। দুর্ভাগ্য যে এটা শ্রোতারাও অনেক সময় বোঝেন না, যারা ব্যান্ড করতে আসে তাদেরও অনেকে বোঝেন না।

  • এই না বোঝা থেকেই কি শ্রোতারা তুহিন আর জিয়াকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন? অনেকে কথা দিয়ে আক্রমণ করলো, গালাগাল দিলো! এই শ্রোতারা তো আপনার বানানো গান শুনে আপনাকে গাল দিচ্ছিল! তখন আপনার কেমন লাগছিলো, কি মনে হচ্ছিল? নিশ্চয় হতাশ হয়েছিলেন তাদের আচরণে?

অবশ্যই। হতাশ কে না হবে! কারণ যে মানুষটা আমাকে গালি দিচ্ছে সে প্রথমত ভাবেইনি যে যাকে গালি দিচ্ছি আমি আসলে তার গানগুলোই শুনছি! সে ধরেই নিয়েছে যার জন্য গালি দিচ্ছি তার গানগুলো শুনতেছি! মূল ব্যাপার হচ্ছে, এই গানগুলো তুহিনের না। যাকে বা যাদেরকে তারা গালি দিচ্ছে গানগুলো তার বা তাদের। দ্বিতীয়ত, তারা এটাও ভাবেনি, এই যে এই লোকটাকে একা তুহিনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি কিন্তু পুরো ব্যান্ড তো একসঙ্গেই আছে! তাকে যে গালটা দিচ্ছি তাহলে তার সঙ্গে সবাই কেন? ব্যান্ডের ড্রাইভারও শিরোনামহীনকে ছাড়েনি। কেন ব্যান্ডের প্রতিটা লোক থেকে গেল? উনি তো অসুস্থ, সিম্প্যাথি সিকিং করে বেড়াচ্ছেন, উনার অনেক অসুবিধা, তাহলে আমারও তো একটা সিম্প্যাথি উনার প্রতি আসা উচিৎ! অথবা এদের আসা উচিত। সবাই খারাপ? শুধু একজনই ভালো? এটা কিভাবে হয়! এটা কেউ ভাবেইনি। কারণ আমাদের দেশে আমরা সবাই চোখকে খুব বেশি বিশ্বাস করি। আমরা ফ্রন্টম্যানকে দেখি, পেছনের যারা কাজ করে তাদেরকে খুঁজে দেখি না! এটা নির্ভর করে শ্রোতাদের শিক্ষা আর মন মানসিকতার উপর। শুধুমাত্র সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকার ব্যপারটা মধ্যযুগীয়। এই ব্যপারটা পৃথিবীর সবদেশেই আছে, আমাদের দেশে হয়তো একটু বেশিই আছে, ওই জায়গাটা থেকে আমি যে গালিটা খাইছি সেটা ঠিকই আছে!

বিজ্ঞাপন
  • শিরোনামহীন থেকে বের হয়ে তুহিন দাবি করেছিলেন গানগুলো তার, আপনার কাছে কি মনে হয় যে তুহিনের এই দাবির কারণেই শ্রোতারা বেশি রেগে গিয়েছিল?

সে আসলে দুইটা কথা বলছিলো, দুইটা কথাই মানুষকে খুব রাগায় দিছিল। একটা কথা হচ্ছে যে এরা সবাই টাকার লোভি। এটা আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে। আমরা কিন্তু জানতাম আমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি টাকার লোভি! কিন্তু আমরা কখনো সেটা বলিনি। তার অভিযোগ ছিলো আমরা কর্পোরেট অনুষ্ঠানগুলোতে টাকার জন্য ইংরেজি গান গাই! কিন্তু আমরা তো এমন কিছু করিনি কখনো। সে সময় এগারোটা কনসার্ট করার কথা ছিলো আমাদের, কয়েকটার জন্য টাকা পয়সা এডভান্স করে দিয়েছিলো। আমি সেই টাকাগুলো কিভাবে ফেরত দিবো সেজন্য লোকজনকে ফোন করছিলাম, যাকে সে টাকা লোভি বলছে।

  • আপনাদের এতদিনের বন্ধুত্বের শেষটা এমন হলো?

শেষ হতেই পারে! একজন মানুষের আরেকজন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি, দুজন একই সাবজেক্টে পড়ছি, বন্ধুত্ব হবেই। উদাহারন হিসেবে বলছি, একজন হয়তো ভয়াবহভাবে ড্রাগ অ্যাডিক্ট, আরেকজন হয়তো ড্রাগের ধারে কাছেই কোনদিন যায় নাই। তাদের মধ্যেও বন্ধুত্ব হয়!

  • আমরা বরং লিরিকের গল্পে চলে যাই। এখানে আসার আগে আমি দুইজনকে জিজ্ঞেস করেছি, জিয়া ভাইকে কি প্রশ্ন করা যায়! এদের একজন সরকারি কর্মকর্তা, অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। দুজনেই আপনার লিরিক লেখার ইনফ্লুয়েন্স সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন? এই জানতে চাওয়াটা আমারও, আমাদের ধারণা লিরিকের জন্যই আপনাদের এমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা

লিরিকের জন্যই যে শিরোনামহীনকে সবাই পছন্দ করে ব্যাপারটা মোটেও এমন না। একটা গান আসলে টোটালটা নিয়ে তৈরি হয়। একটা গানে লিরিক ডেফিনিটলি একটা ভালো ভূমিকা রাখে। গানে একটা কথা বলা হয় যেটা মানুষের ভিতরে প্রবেশ করে। আবার ওইটা প্রকাশ করার জন্য দিয়াত গিটার বাজাচ্ছে, তুহিন কিছু গান গাইত এখন ইশতিয়াক গাইছে। আমি যদি দুঃখের একটা কথা লিখি আর সেটা যদি সুখের মিনিংয়ে উপস্থাপন করা হয় তাহলে কিন্তু হবে না। গানটার জন্য প্রত্যেকের একটা ভূমিকা থাকে যেটা হয়তো মানুষ অনুভব করতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

আর ইনফ্লুয়েন্স যেটা হয়েছে, আমি অনেক বেশি শহুরে লিরিক লিখেছি। এটা আমার সীমাবদ্ধতা। কারণ আমার গ্রামের বাড়ি ঢাকা। ছোটবেলা থেকে ওই অতটুকো জায়গা ছাড়া, আমার স্কুল সেইন্ট গ্রেগরী, নটরডেম কলেজ, এসব ছাড়া আমি কিছু চিনতামও না, যেতামও না। আমি ডানপিঠে ছিলাম না। যে কারণে পুরান ঢাকায় থেকেও আমি কখনো ঘুড়ি উড়াতে পারিনি। কিন্তু আমি অনেক পড়েছি। গুডবয় মার্কা ছিলাম। ফার্স্ট বেঞ্চে বসতাম। ওইখান থেকে আমার একটা সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এই সীমাবদ্ধতা আমার লেখায় চলে এসেছে, কারণ আমি শহরের বাইরে যেতে পারি না। কোনও কারণে কিছু মানুষ আবার আমার গান গ্রহণ করেছে। এটা আমার পরম সৌভাগ্য। কিছু গান আছে, খুব ভাল। ভালবাসার গান, এসব গান মানুষ শোনে। যেমন শরীফ উদ্দীনের ‘বোরখা পরা মেয়ে’ গানটা নিয়ে কোটি কোটি মানুষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমি ওটা লিখতে পারি না। এটা আমার সীমাবদ্ধতা।

  • আপনাদের নিয়ে মিষ্টি একটা অভিযোগ আছে, আপনাদের লিরিক বেশ কঠিন, বুঝতে কষ্ট হয়! বুঝতে হলে একটু চিন্তা করার দরকার পড়ে, বোধের দরকার পড়ে! তো গান লেখার সময়, শব্দ চয়ন করার সময় কি এটা মাথায় রেখেই করেন?

এটাই তো বললাম, এটা আমার সীমাবদ্ধতা। আমি লিরিক লেখার বেলায় সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছি লিওনার্দ কোহেন, সুমন চট্টোপাধ্যায় (কবীর সুমন), শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, পুর্নেন্দু পত্রী, সুনীল গাঙ্গুলী, শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, হেলাল হাফিজ থেকে। আমি কবিতা পড়েছি অনেক। এই প্রভাবটা আমার লিরিকে আছে। উপন্যাসও পড়েছি প্রচুর। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই সেবা প্রকাশনীর বই পড়া শুরু। আমি তো পুরান ঢাকার ছেলে, সেবার লেখকরা থাকতেনও ওদিকে। রকিব হাসানদের বাসায় গিয়ে আমি বসে থেকেছি। সেবার এমন কোন বই নাই যেটা আমি পড়ি নাই। তারপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ঢুকলাম, কলেজের শেষের দিকে, তখন হুমায়ূন আহমেদ বা নীল লোহিত খুব করে পড়া শুরু করলাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিটা আমি পড়ে শেষ করে দিয়েছিলাম। এটা বিশাল লাইব্রেরি। পড়ার প্রবণতাটা, মানে যে পড়বে সে ভালো লিখতেও জানবে। তার একটা স্ট্রাকচার তৈরী হয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি আসলে খুব সহজ লিখতে চাই। এই যে ‘ইচ্ছে ঘুড়ি’ বা ‘বন্ধ জানালা’ বা ‘হাসিমুখ’-এর শব্দগুলো কিন্তু সহজ। আমার মিনিংটা হয়তো রূপক। কিন্তু শব্দ তো সহজভাবেই লিখতে চাই। ওটা যদি না হয়ে থাকে তাহলে এটা আমার ব্যর্থতা।

  • জাহাজি শিরোনামে আপনাদের একটা গান আছে। সেখানে এক নাগরিক জাহাজির গল্প বলা হয়েছে। আমরা ধরেই নেই যে লাস্ট বাসে বাড়ি ফেরা সেই মানুষটা আপনি। আসলেই কি আপনি? বা এমন কেউ কি আছে এই শহরে? চেনেন তাকে? তার সঙ্গে কি আপনার কথা হয় বা দেখা হয়?

এটা আসলে আমি আমাকে নিয়েই লিখেছি। ওই সময়টা আমার প্রতিকূলে ছিলো। তখন বুয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে বা সেকন্ড ইয়ারে পড়তাম। আমাকে ছয়টা টিউশনি করে পড়াশোনা চালাতে হতো। আমি থাকতাম মিরপুরে, আর শেষ টিউশনিটা ছিলো পুরনো ঢাকায়। রাতের বেলায় ফেরার সময় যদি বাসটা মিস হয়ে যায় তাহলে আমি কিভাবে ফিরবো? তো আমার জন্য বাসের মামা দাঁড়িয়ে থাকতো। সেটাই ভাঙ্গাচুরা নিশ্বাসের গল্প। শেষ প্রশ্নের উত্তরটা হচ্ছে, ‘জাহাজি’ অ্যালবামটা প্রথমে আমরা র‌্যাবিট কমিউনিকেশন থেকে বের করেছিলাম। ওই প্রথম অ্যালবামের কাভারে একটা স্যুট টাই পরা মানুষের লাফ দেয়ার একটা ছবি আছে, ওই লোকটা হচ্ছে আসলে জাহাজি। এটা আমি অনুভব করি। এই মানুষটাকে আমি প্রতিদিনই দেখি। আই নো দিস পিপল। যে তার স্বপ্নকে একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে অল্প কিছু বেতনের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এটা ‘বাসস্টপেজ’ গানেও আমরা বলেছি, ‘কিছু স্বপ্ন বিক্রি করে যারা’।

  • আপনাদের আরেকটা বিখ্যাত গান হাসিমুখ, গানটাতে আপনারা বলেছেন, যেতে যেতে বহুদূর, বহুদূর যেতে চাই। এই বহুদূর জায়গাটা আসলে কতদূর?

যদি একশ মাইল হাঁটা যায় তাহলে আর এক মাইল। যদি দুইশ মাইল হাটা যায় তাহলে আর দুই মাইল। যদি এক মাইল হাঁটা যায় তাহলে আর কয়েকশ গজ। এই ‘বহুদূর’টা চমকপ্রদ একটা শব্দ। রবার্ট ফ্রস্টের একটা কবিতা আছে, ‘মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’, অনেকটা এমন। এটার আসলে কোন শেষ নেই। এটার শেষ হয় মৃত্যুর ভেতর দিয়ে। এর আগে পর্যন্ত আমাদেরকে কোনও না কোনওভাবে হাঁটতে হয়, এটা এক অবসরহীন সফর। যার যার জায়গা থেকে পৃথিবীর প্রতি কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেই দায়িত্ব পালন করাটাও বহুদূর যাওয়া।

  • সেদিন ঝড়ের রাতে আততায়ী খুন হলো প্রেমিকার হাতে– এই গানের আততায়ীটা কে?

সে এক আততায়ী যাকে প্রেমিকা খুন করে ফেলে। আততায়ীটা হচ্ছে… আচ্ছা এর পেছনের দর্শনটা আমি বলে নেই আগে, আমরা ইতিহাসের দিকে যদি দেখি। ইতিহাসে তাদেরকেই হিরো বানানো হয় যারা বিজয়ী। আর যে হেরে গেছে সে বিজয়ী অবস্থায় ছিল হিরো আর লুজার অবস্থায় ভিলেন। একটা সাইননোট লিখছিলাম যে, ইতিহাস আসলে একজন বিপ্লবীকে- বিপ্লবীর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে অথবা আততায়ীর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। আমার আততায়ী এমন।

  • ভাঙ্গনের পর যাদুকর শিরোনামে আপনারা প্রথম যে গানটা করলেন, এটা নিয়ে অনেক জল্পনা, অনেক আলোচনা! এখানে যাদুকর বলতে যাকে আপনি বোঝাতে চেয়েছেন সে কি আপনার পরিচিত কেউ বা আমাদের পরিচিত কেউ?

যাদুকর চরিত্রটা অবশ্যই আমাদের পরিচিত। যারা শুনছে তাদেরও পরিচিত। ঠিক যেমন জাহাজির একটা ব্যাখ্যা দিলাম ওই রকম। এমন চরিত্রও আমরা সবসময় দেখি। এটা নির্দিষ্ট করে কেউ না যে, আমি বলে দিতে পারবো সে। তবে যাদুকর আমাদের জন্য একটা নেতিবাচক চরিত্র।

  • এবার অন্য প্রসঙ্গে যাই, আমাদের ব্যান্ড সংগীত সংস্কৃতিতে কয়েক বছর ধরে বেশ অস্থিরতা চলছে। দলগুলো ভাঙছে, নিজেরা নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। ব্যান্ড কিন্তু ভাঙে, লাইন আপে পরিবর্তন আনে। পিংক ফ্লয়েড, মেটালিকার মতো গানের দলও ভেঙেছে। কিন্তু এই কাদা ছোঁড়াছুঁড়িটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

বিশ্বে অনেক নামি ব্যান্ডেই লাইন আপ পরিবর্তন হয়েছে। হচ্ছে। জোয়ে লিন টার্নার যখন চলে গেল বা ডিউ (ব্লাক সাব্বাথ) যখন চলে গেল বা ব্রুস ডিকিনসন যখন চলে গেল বা রজার ওয়াটার্স যখন চলে গেল তার মানে এই না ‘ডিপ পার্পল’, ‘আইরন মেইডেন’ বা ‘পিংক ফ্লয়েড’ ডুবে গেছে। এরা সাময়িকভাবে বিপন্ন হয়েছে কিন্তু তাদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হতে দেখিনি। মজার ব্যাপর হলো যারা গিয়েছেন, এই যে ভোকাল যারা, রজার ওয়াটার্সসহ এরা কেউ কিন্তু ব্যান্ড থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেছে এমন ভাবেনি। বরং তারা তাদের কাজ নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। পিঙ্ক ফ্লয়েডে রজারের অনেক গান আছে কিন্তু ব্যান্ড থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনি পিঙ্ক ফ্লয়েডের গানগুলো করেননি। হি নেভার ডিড ইট। যাদের উদাহারণ দিলাম এদের কেউ কখনো এই কাজটি করেননি। ওই ব্যান্ডকে ছেড়ে আসছে মানে ওখানে সে যা কন্ট্রিবিউট করছে তার সবই দিয়ে এসেছে। আর সে যদি গানগুলোর ক্রিয়েটর না হয় তাহলে তো এমন কাজ করার প্রশ্নই আসে না! নৈতিক আত্মসম্মানবোধ থাকলে এটা থেকে বিরত থাকার কথা। হাউ ক্যান আই? বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ব্যান্ডের ভোকাল, শুধুমাত্র ভোকালরাই দল ছেড়ে গিয়েছে, এটার একটা সুস্পষ্ট কারণ আমার কাছে আছে। প্রথমত, আমাদের দেশের শ্রোতারা ভোকাল ছাড়া আর কাউকে মূল্যায়ন করতে পারে না। এর জন্য আমি শ্রোতাদের দায়ী করবো না, দায়ী করবো আমাদের গণমাধ্যমকে। মিডিয়া এটা তৈরি করেছে। ভোকাল ছাড়া কাউকে ভ্যালু করাটা তারা একপ্রকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে! আমাদের দেশের মিডিয়ার একটা বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের একটা হিরোর প্রয়োজন। সো ওই হিরোটা বানাতে গিয়ে তারা ভুলটা করে বসে। এর প্রভাবটা পরবর্তীতে এই জায়গায় চলে আসে, ওই হিরোর গুণগান গাইতে গিয়ে অন্য কাউকে দমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা তৈরি হয়, যেটা তারা বুঝতেই পারে না।

আমি শেষ পর্যন্ত যেটা দেখলাম, যেমন কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি; অন্য ব্যান্ডগুলোর উদাহরণ আমি দেবনা, আমাদের নিয়েই বলি, আমাদেরকে নিয়ে আমাদের এক্স-ভোকাল কিছু অভিযোগ দিয়েছে, আমাদের টাকা লোভি বলেছে, আমরা সামাজিকভাবে যে মর্যাদার মানুষ, টাকা লোভি বললে আমাদের গায়ে লাগে। আমরা কিন্তু কখনোই কোনও জায়গায়, কোনও সাক্ষাৎকারে, চারটা মানুষ রেগে গিয়েও বলিনি তুহিন এটা করছে বা ওটা করছে। আমরা বলেছি, ‘না ভাই আমরা টাকা লোভি না’। আমার সবসময় আমাদের নিজেদেরকে ডিফেন্ড করেছি, অভিযোগ করিনি। আমাদের কি অভিযোগ নেই? কিন্তু আমরা একটি অভিযোগও করিনি! ওনার অভিযোগগুলো মিথ্যা বলেই আমরা সেটিকে ডিফেন্ড করেছি। এটাকে পর্যন্ত বলা হয়েছে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি! আমরা তো কাদা ছুঁড়িনি। আমি কি আমার নিজেকে ডিফেন্ড করতে পারবো না? নিজেদের ডিফেন্ড করাটাকেই যদি কাদা ছোঁড়া বলা হয় তাহলে এটা খুব কষ্ট দেয়। এটা অসংখ্যবার আমাদেরকে বলা হয়েছে, আমাদেরকে এমনও বলা হয়েছে, ‘এরা কথাই জানি কিভাবে বলে, বোঝায় যায় এরা বদমাইশ’! আমরা নিজেকে ডিফেন্ড করলে ‘বদমাইশি’ কিভাবে হয়? আত্মপক্ষ সমর্থন তো আমার অধিকার। এটা বিপন্ন করার অধিকার কারো নাই।

আমি সারাজীবনে বেশ কিছু সুন্দর গান তৈরি করেছি, এই কারণে সুন্দর বলছি যে শ্রোতাদের পাশাপাশি সিনিয়র মিউজিশিয়ানরা গানগুলোর প্রশংসা করেছেন। কিছু গান আছে যেগুলোর বয়স হয়তো পনের পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনো মানুষ শুনছে। মানে মানুষ গানগুলোকে ভালবেসেছে বা পছন্দ করেছে। সে গানগুলোর ক্রিয়েশন আমার করা। গানগুলো কিন্তু আমি কোন ব্যক্তির জন্য তৈরি করিনি। আমি সৃষ্টি করেছিলাম আমাদের ব্যান্ডের জন্য, শিরোনামহীনের জন্য। আমি আমার ব্যান্ডের গান হিসেবেই সেটাকে দেখতে চেয়েছি। এটা আমার চাহিদা এবং এটা আমার অধিকার। অনেকবার এই অধিকার বিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভোকালের নামে গান ইউটিউবে তুলে দেয়া হয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে উপস্থাপকরা বসে বসে বলতেছে, ‘হ্যাঁ, তুহিন ভাই আপনার গান!’ এভাবেই কথাগুলো আসে। এভাবেই বলা হয় বারবার। এটা হয়তো কম জানার কারণে হয়।

সাধারণ মানুষ কম জানতে পারে কিন্তু মিডিয়ার মানুষ যখন কম জানে তখন হতাশ লাগে। কিন্তু জানাটা তো তার জব, তার জানা উচিত! এটা তার দায়িত্বও! এই দায়িত্বটা না নেয়ার যে প্রভাবটা পড়বে সেটা বলছি, যে বাচ্চা ছেলেটি আজকে গিটার শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বা আমি যখন বাচ্চা ছিলাম তখন যেমন কমল ভাই (ওয়ারফেজ), বাচ্চু ভাই (এলআরবি) ওনাদের গিটার বাজানো দেখে, সঙ্গে অনেক বিদেশি গিটারিস্টদের দেখে শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, পরের প্রজন্মে কি আমরা গিটারিস্ট স্পেশালি মিউজিক ক্রিয়েটর পাবো? লুক এট দ্যা বিগার সিনারিও। আমরা ‘ক্লোজ আপ ওয়ান’ করছি সেখানে টেলেন্ট হান্ট হচ্ছে, কি টেলেন্ট? এটা কিন্তু টেলেন্ট হান্ট না! এটা পারফর্মেন্স হান্ট। ভোকাল! সে কি করবে? সে কাভার করবে অন্যদের গান। তাহলে আমরা নতুন গান কিন্তু ওখান থেকে পাব না। টেলেন্ট হচ্ছে যে পারফর্মেন্স করে। আমরা ক্রিয়েটরদের আরও পাব না কারণ মিডিয়া আমাদের শেখায় যে ক্রিয়েটরদেরকে গালি দিতে হয়! পরবর্তী প্রজন্মে আমরা আসলে কোন মিউজিশিয়ানকে ক্রিয়েটর হিসেবে পাব না। পাওয়ার অধিকার আমাদের নেই। এই অধিকার আমরা নিজেরা বিপন্ন করছি।

ইনফ্লুয়েন্স মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। যেমন আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন ইন্টারনেট ছিল না। আমরা হচ্ছি চিঠি লেখা যুগের মানুষ। আমি হাতে একটা চিঠি লিখে ম্যাক্স কাভালেরাকে (সেপুলতুরা, ব্রাজিল) পাঠিয়েছিলাম, তখন কলেজে পড়ি, সেই চিঠি উনি হাতে লিখে জবাব দিয়েছেন এবং একটা টি-শার্ট গিফট করেছেন। ওই সময় ওইটা পাওয়া আমার জন্য অভাবনীয় ছিলো বা আর্মি স্টেডিয়ামে অনেক মানুষের ভিড় ঠেলে কমল ভাইকে দেখতে গেছি, পরে গেছি সাদা টি-শার্ট, পকেটে করে নিয়ে গেছি মার্কার যাতে তার অটোগ্রাফ নিতে পারি। তখন এমন একজন মানুষের অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে পারাটা দূর্লভ ব্যপার ছিলো। কিন্তু ওই ঘটনাগুলো ডেফিনিটলি আমাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে বলেই আমি পরবর্তীতে মিউজিক করতে পারছি। আমাদের মিডিয়া মিউজিশিয়ান তৈরির ক্ষেত্রে এখন কি কোনও প্রকারের ইন্সপিরিশন তৈরী করতে পারছে? নাকি আমরা সবাইকে বুঝাচ্ছি যে, ‘ভাই শুধু মাত্র গান শিখেন। গান যদি গাইতে পারেন তাহলে আপনাকে ভ্যালু করা হবে নাহলে কিন্তু আপনাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হবে! এরকম চলতে থাকলে আমার ভোকাল ছাড়া আর কিছুই পাবো না।

আমাদের পাশের দেশে তাকালে দেখা যাবে যে ওদের অসম্ভব ভালো ভালো ভোকাল আছে। আমাদের দেশে নেই আমি সেটা বলবো না। কিন্তু ওদের সঙ্গে যদি তুলনা করি তাহলে আমরা অনেক পেছনে আছি। সারা বিশ্বের সঙ্গেই যদি তুলনা করা হয় তাহলে ভোকালে আমরা বেশ ভালই পিছিয়ে আছি। কিন্তু গিটারে সারা বিশ্বে আমরা নাম্বার ওয়ানে থাকলেও থাকতে পারি। আমাদের গিটারীস্টদের ইভেন শিরোনামহীনের গিটারিস্টকে মানে দিয়াতকে যদি পেট্রোচির (জন পিটার পেট্রোচি, ড্রিম থিয়েটার) পাশেও দাঁড় করিয়ে বাজাতে বলা হয়, তাহলে পেট্রোচি একবার ঘুরে তাকাবে যে কে বাজাচ্ছে দেখার জন্য! এটা আমরা নিশ্চিত। আমাদের দেশে বিশ্বমানের গিটারিস্ট আছে কিন্তু বিশ্বমানের ভোকাল নেই। ড্রামার পেয়েছি বিশ্বমানের, বেসিস্ট পেয়েছি। বেজবাবা সুমন যখন ঢুকে তখন ইয়াহামাতে বড় করে লেখা উঠে, ‘ওয়েলকাম বেজবাবা সুমন’। এটা কোন ভোকালের ক্ষেত্রে কখনো হয়নি। তো আমার এদেরকে পেয়েছিলাম কিন্তু সম্মান দিতে পারিনি। আমার মনে হয় এখন থেকেই মিডিয়াকে এটা নিয়ে ভাবা উচিত। যে আমরা কাদেরকে নায়ক বানাতে গিয়ে কাদেরকে অবমূল্যায়ন করলাম! আমার নতুন গান কিভাবে পাবো, যদি আমরা ক্রিয়েটরদের মেরে ফেলি! নতুন গান পাবো?

ছবি : আকাশ হক

  • এটা কি শুধুই মিডিয়ার দোষ? আমার মনে হয়, আমাদের সিনেমাও একসময় বহির্বিশ্বে প্রতিযোগিতা করার মতো ছিলো। পরবর্তীতে রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ, দলভুক্ত হয়ে ভাগ হয়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণে এতোটাই পিছিয়ে গেল যে সিনেমা নিয়ে এখন আর সেরকম আলোচনাও হয় না। গানের ক্ষেত্রেও কিন্তু এমন রাজনীতি চোখে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বেসবাবা-এলআরবি, মাইলস-এলআরবির কথা বলতে পারি। এর কারণেই কি আপনারা গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন না?

মোটেই না! ফিল্মেরটা নিয়ে আগে বলি, ফিল্মে তুমি যেটা বললা আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত। আমাদের ফিল্মটা যখন খুব ভালো অবস্থায় ছিলো, ‘তের নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ (পরিচালনায়, বশীর হোসেন)-এর মতো সিনেমা তখন আমরা পেতাম। এরপর আমরা ভাল সিনেমা পাইনি কেন? কারণ তাদেরকে তো মেরে ফেলা হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় কাদেরকে মারা হলো? আমরা যখন উনাদের হারিয়েছি, মানে তার যে টিম, ধরো তুমি ওনার কাছ থেকে শিখেছ, আমি তোমার কাছ থেকে শিখছি, এভাবে লিগ্যাসিটা তৈরী হয়! শিখে শিখে ইন্ডাস্ট্রিটা বড় হবে। ওইসময় আমাদের ফিল্মের যে অবস্থান আর বলিউডের যে অবস্থান তা কম্পেয়ার করলে দেখা যাবে আমাদের ফিল্ম একটু উঁচু হতে পারে বা সমান হতে পারে কিন্তু নিচে না। এখন তারা কোথায় চলে গেছে আর আমরা কোথায়! কারণ আমরা ওই মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওনাদেরকে মেরে ফেলা হলো। তার পরবর্তীতে আমরা ওই লিগ্যাসিটা যেহেতু পাই নাই, আমাদের ফিল্ম এতোটাই নিচে নামলো যে এটা আর তুলে দাঁড় করানোর অবস্থানেই যেতে পারলাম না।

এবার আসি মিউজিকের ক্ষেত্রে, এখানে একজন আরেকজনের প্রতিযোগি, সেটা আমি যাদের বিগ ফ্যান, যাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতাম, এখন তাদের সঙ্গে একই স্টেজে গাইছি, পারফর্ম করছি। এটাকে বলা হচ্ছে ফেয়ার মিউজিক। মানে আমি যে তার সঙ্গে কম্পিট করার যোগ্যতা রাখবো বা সাহস করবো এবং সেই প্রতিযোগিতাটা আমি দিবো। সেটা কিন্তু আমার মিউজিককে আরো বেটার করে। একজন আরেকজনের সঙ্গে মতাদর্শ নিয়ে কিছু কন্ট্রাডিকশন থাকবে, ব্যান্ডের নিজেদের পাঁচজনের ভেতরেই থাকে আর আরেক ব্যান্ডের সঙ্গে তো থাকতেই পারে। এইগুলো আসলে মিউজিশিয়ানদেরকে ছোট বা বড় করে না। এগুলো সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে ফোকাসিং! আমি যেটা বলছিলাম সেটা সম্পূর্ণ ডিফারেন্ট আঙ্গিকে, ইটস লাইক মিডিয়া আসলে সামটাইমস ফোকাসিংটাকে কেন্দ্রীভূত করে ফেলে। তারা ব্যান্ড বলতে যে একটা ইন্ডাস্ট্রি আছে সেটা তারা ভাবেই না। তারা ব্যান্ডকে ফোকাস করতে পারে না, ভোকালকে ফোকাস করে ফেলে। আমাদেরকেই বহুবার বলা হয়েছে ‘শিরোনামহীন এবং তুহিন আসছেন’, তখন এমন মনে হয় যে আমার শিরোনামহীন ব্যান্ডটা করি আর তুহিনকে হায়ার করে নিয়ে যাই! ব্যাপারটা তো এটাই দাঁড়ালো, আমার কাছে শুনতে তাই মনে হয়। যদিও আমি দেখতাম আমাদের ব্যান্ড মেম্বার কেউ একজন খুব খুশী হয়ে যাচ্ছে এটা শুনে। এই ফোকাসটা মিন এ লট টু ডেস্ট্রয় এন ইন্ডাস্ট্রি।

আমি বলতে চাই, আমাদের প্রাউড হওয়ার মতো জিনিস কিন্তু কম। এখন ক্রিকেট এসেছে। এর আগ পর্যন্ত একটা সেক্টর ছিলো যেটা নিয়ে প্রাউড হওয়া যেত, এন্ড দ্যাট ইজ নট মিউজিক, দ্যাট ইজ ব্যান্ড মিউজিক। আমাদের উপমহাদেশে কিন্তু বলার মতো ব্যান্ড নাই। পাশের দেশগুলোর ব্যান্ড মিউজিকের সঙ্গে তুলনা করলে, ডেফিনিটলি উই আর বেটার। স্পেশালি আমাদের গীটারিস্টরা, আমি আরেকবার বলবো আমাদের দেশ কিন্তু গীটারিস্ট বানিয়েছে। সেখানে মিডিয়া শুড ফোকাস রাইট নাউ, দিস মোমেন্ট! নইলে আমরা এই জায়গাটা হারিয়ে ফেলবো। আমি কৈলাশ খেরের সঙ্গে বাংলাদশের কোন ভোকালকে তুলনা করবো না কিন্তু পেট্রোচির সঙ্গে আমি দিয়াতকে তুলনা করবো! শুধু দিয়াত না, এই যে ছেলে-পেলে আন্ডারগ্রাউন্ডে বাজায়, তাদেরও তো গিটারের হাত দুর্দান্ত ভালো। এর কারণ অবশ্য ভোকালের জন্য ভালো ইন্সটিটিউট পাইনি আমরা কিন্তু গিটারে পেয়েছি। কমল ভাই একটা খুলেছিলেন, তারপর সাজ্জাদ একটা চালাচ্ছে।

  • ভোকালের কথা বলছিলেন, আপনাদের নতুন ভোকাল ইশতিয়াক সম্পর্কে মূল্যায়ন কি? তাছাড়া ওকেই কেন নিলেন? আরও অনেকেই নিশ্চয় শিরোনামহীনের ভোকাল হতে চেয়েছে?

একটা কথা কিন্তু আমি প্রথমেই বলছি যে আমাদের দেশে ভোকালের খুব ক্রাইসিস। যারা ভালো ভোকাল, আমাদের দেশে টপে আছে, তারাও আসলে মানের দিক থেকে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্টের অনেক নীচে আছে। যাই হোক, ইশতিয়াক কিন্তু দীর্ঘ একটা প্রসেসের ভিতর দিয়ে শিরোনামহীনে এসেছে। আমি এটাকে এপ্রিশিয়েট করবো ওর যোগ্যতা হিসেবে। কারণ আমরা যাচাই করেছি, অনেকগুলো অডিশন নিয়েছি, অনেকের ভিডিও দেখেছি, এমনকি ‘যাদুকর’ গানটা আমরা দুইজন ভোকালকে দিয়ে রেকর্ডিং করিয়েছি, এর মধ্য থেকে সিলেক্টেড হয়ে এসেছে ইশতিয়াক। ওর এচিটিউড ট্রু রকস্টারের মতো। তবে ওর একটা ব্যাপার আমি খেয়াল করেছি, যেটা ওর পার্সোনালিটির বেস্ট পার্ট, সে হচ্ছে ব্যান্ড করার মানুষ। এরপর থেকে স্টেজে সে গিটার নিয়েই হয়তো উঠবে। আমাদের মধ্যে কথা বার্তা হচ্ছে।

সারাবাংলা/টিএস/পিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন