বিজ্ঞাপন

বাঙালির ফুটবল: প্রয়োজন একটা নিজস্ব ফুটবল শৈলী

May 24, 2018 | 10:49 am

বিশ্বকাপ ফুটবল আসছে। পাড়ায়, পাড়ায়, অফিসে অফিসে উন্মাদনা শুরু হয়েছে। উন্মাদনা সামাজিক মাধ্যমেও। ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা। এক সময় ক্রিকেটে এমনটা দেখা যেত – ভারত বনাম পাকিস্তান। তারপর যখন নিজেরা খেলতে শুরু করেছি, তখন থেকে এই বৈরিতা কমেছে। ফুটবলে অবশ্য সেই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। বাংলাদেশ আদৌ কোনদিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে, একথা স্বপ্নেও কেউ ভাবেনা। এক সময়ের তারকা খেলোয়াড় কাজী সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে ফুটবল ফেডারেশন বাংলাদেশের ফুটবলকে কতটা নিচের দিকে নিয়ে যাবে তার অনুশীলন চলছে অনেকদিন ধরেই।

বিজ্ঞাপন

বাঙালি বড় খেলায় ফেল, খুচরায় চ্যাম্পিয়ন। ফুটবল বড় খেলা, পাড়ায় পাড়ায়, অফিসে অফিসে উন্মাদনা সেই খুচরা খেলা। পায়ে না খেলে মুখে খেলা। আসল ময়দানে আমাদের ঘোর অনটন। খেলার রোমাঞ্চ আমরা অর্জন করতে চাই ক্ষুদ্রতর নানা পরিসরে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে যতই নৃত্য করি না কেন, আসল ফুটবলের প্রতিযোগিতার ধারেকাছে আমরা পৌঁছুতে পারি না। পাড়ায় খেলি, নিজের পাড়ায় বা নিজের চৌহদ্দিতে।আমাদের দৌড় সে পর্যন্ত।

অনুষ্ঠান, কলেজে -বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি, ক্লাবের পরিচালনা, ছোট ছোট বিভিন্ন ধরনের সংগঠন সব জায়গায় একে অন্যকে ঘায়েল করার কৌশল শেখা আমাদের সংস্কৃতি। সব জায়গায় একটা বিরোধী পক্ষ, জটিল-কুটিল পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সাহায্যে সেই পক্ষেকে ল্যাং মেরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াই আমরা।

‘আমরা-ওরা’ আমাদের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে জড়িয়ে রয়েছে। সে লেনিন হলে আমি মার্ক্স, ও নীল হলে আমি সাদা, সে নাস্তিক, আমি আস্তিক। নিজেদের সব চারিত্রিক সম্পত্তি নিয়ে প্রতি চার বছর পর আমরা লাফাই ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নিয়ে। সব মিলিয়ে সে এক ভয়ংকর অবস্থা। নিজের দেশের এক হাত পতাকা কখনো না উড়ালেও এই দুই দেশের পতাকা কত লম্বা করা যায়, তা খোদ ল্যাটিন এই দুই দেশের নাগরিকরাও কখনো কল্পনা করতে পারবে না। তুলকালাম হওয়ার পর খেলা শেষে দেখা গেলো এরা কেউ চ্যাম্পিয়ন হয়না, চ্যাম্পিয়নশিপ চলে যায় ইউরোপে।

বিজ্ঞাপন

ফুটবল বহু আগেই ঢুকে গিয়েছে বাঙালির অস্থিমজ্জায়। কিন্তু ফিফার বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশের বরাবরই তুচ্ছ। বাংলাদেশ দলের অধঃগতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই কদিন আগে ১৯২তম স্থানে থাকা দলটি পাঁচ ধাপ নেমে ১৯৭তম স্থানে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এটি সর্বনিম্ন র‌্যাংকিং। এর আগে কখনোই র‍্যাংকিংয়ে এত নিচে নামেনি বাংলাদেশ ফুটবল দল। মাত্র ৩৭ পয়েন্ট নিয়ে এই স্থানে রয়েছে লাল-সবুজের দল। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। শত বছর ধরে ফুটবল খেলা হচ্ছে এই মাটিতে। তার ব়্যাংকিং এতো খারাপ কেন? বিদেশি কোচ এনেও কোন লাভ হচ্ছেনা কেন?

এখন সবকিছুর আগে আমাদের ক্রিকেট। ফুটবলে আমরা মার খেয়েছি। ফুটবলের আয়োজন বলতে দু’টো গোলপোস্ট, একটা বল, বাইশটা পা৷ আর ক্রিকেটে কত কি লাগে! তবুও পারা গেলোনা। ক্রিকেটে আর ফুটবলে ফিটনেস দরকার, দরকার মাথারও। কিন্তু ফুটবলে শরীরটাও লাগে। শরীরে শরীরের ধাক্কা ধকল সইবার মতো পোক্ত শরীর নেই আমাদের। হয়তো এটা একটা কারণ। কিন্তু এটাই সব নয়। একটা বুনিয়াদি ফুটবল সংস্কৃতি ছিলনা কখনো। ‘স্কিল’ আমাদের কখনোই ছিলনা। যাদের খেলা দেখে আমরা একসময় মারামারি করেছি, তখন আসলে আমরা অন্ধকারে ছিলাম। কেবল টিভির বদৌলতে দুনিয়ার ফুটবল দেখার পর বুঝেছি আমরা তাদের পেছনে ছুটেছি। সাফ অঞ্চলেই কোন পারদর্শিতা দেখাতে পারিনি আমরা।

গরিবী এক সমস্যা। কিন্তু পুরোটা নয়। ইউরোপীয়দের মতো বিরাট ও তাগড়া শরীর, কিংবা ল্যাটিনদের মতো শক্তপোক্ত, বা আফ্রিকানদের মতো ষণ্ডামার্কা হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু একটা নিজস্ব ফুটবল শৈলীতো তৈরি করতে পারতাম। ব্রাজিলের কথাতো আমরা জানি। বস্তিতে খালি পায়ে খেলেই ব্রাজিলের তারকারা বেরিয়ে এসেছে৷ কারণ একটা নিজস্বতা তারা পেরেছে তৈরি করতে ইউরোপের মতো সম্পদশালী না হয়েও।

বিজ্ঞাপন

ফুটবলের উন্নতির জন্য বিনিয়োগ চাই। বিনিয়োগ করলে ফলাফল আসবে। এই বিনিয়োগ শুধু অর্থ নয়, মেধা এবং সততাও। এখানে তা নেই। দেশের ফুটবল নিয়মিত হয় না। আবার যা হয় তাও কেবল রাজধানী কেন্দ্রিক। স্কুল ফুটবল নিয়মিত হয়না, পাইওনিয়ার ফুটবল বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। জেলা শহরগুলাতে লীগ হয় না। প্রান্তিক পর্যায় থেকে কেন্দ্রে খেলোয়াড়ের সরবরাহ নেই। দিশেহারা অবস্থা আমাদের ফুটবলের। স্পনসর নেই বলে শুধুই হতাশা। চাইলে সব সম্ভব, কিন্তু চাওয়ার সততা আছে কিনা সে প্রশ্ন আছে। ফুটবলের এই মরণ দশার কিছু কারণের একটি হল, সারাদেশে নিয়মিত লীগ না হওয়া। দক্ষ সংগঠক নেই, আছে কিছু দলবাজ। দেশীয় ফুটবলার তৈরি করছিনা, উল্টো কতকগুলো নিম্নমানের বিদেশি ফুটবলাদের লীগে এনে খেলাচ্ছি আমরা।

আমাদের কাজি সালাউদ্দিন স্মার্টনেস চান। তিনি কথাবার্তায় ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে যা বলেন, তা এভারেজ বাঙালি অর্ধেক বোঝে, অর্ধেক বোঝেনা। তিনি শয়নে স্বপনে হয়তো ইউরোপীয় ফুটবলের অনুকরণ করেন। কিন্তু এ করে কোনো লাভ নেই। ফুটবলের নানা পরিকল্পনার কথা শুনিয়েই তিনি ও তার পরিষদ প্রায় এক দশক প্রায় পার করে দিয়েছেন। তাদের বলতে চাই খাঁটি বাংলায় ভাবুন আপনারা, বড় স্বপ্ন না দেখে একটু ছোট থেকেই শুরু করি না হয়। জেলায় জেলায়, স্কুলে স্কুলে টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আমাদের নিজস্ব ফুটবল শৈলী আবিষ্কার করি। আগে একটু নিজের দেশে ভাল ফুটবল খেলি, পরে পাশের পাড়ায় অর্থাৎ সার্ক অঞ্চলে যাই। বিশ্ব দরবার আমাদের থেকে যোজন যোজন দূরে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর-ইন-চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন