June 7, 2018 | 3:15 pm
তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ এক ছিল। এরপর আস্তে আস্তে মানুষ যখন গোষ্ঠিতে থাকা শুরু করলো, মানে নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ ক্ল্যান বা গোষ্ঠি তৈরী করলো, দলবদ্ধ হয়ে বাঁচতে শুরু করলো। তখনো কিন্তু সম্পদের ধারণা আসেনি। এরপর শুরু হলো এনসিয়েন্ট কম্যুউনিজম, মানে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকবে, ফলমূল সংগ্রহ করবে, শিকার করবে, তারপর সবাই একসাথে খাবে। এরপর এলো জমানোর ধারণা। তখনকার সমাজটা ছিলো এরকম, হয় ফিস্ট (খাদ্য-উৎসব) না হলে ফাস্ট (উপবাস)। এ থেকে এলো সম্পদ জমানোর ধারণা। মানুষ তখন কিছু প্রাণীকে গৃহে পোষার চেষ্টা শুরু করলো। যাতে খাদ্যসংকটের সময় খাওয়া যায়। এরপর দেখা গেল যারা বেশি শক্তিশালী, যারা বেশি উপার্জন করছে, তারা বললো, আমি বেশি উপার্জন করছি আমি কেন সমান ভোগ করবো? আমি বেশি এনেছি, বেশি খাবো। তখন ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এলো। এরপর আস্তে আস্তে হায়ারার্কি তৈরি হলো, ছোট-বড়ো বা উচু-নীচুর স্ট্যাটাস তৈরি হলো।
এরই ধারাবাহিকতায় আজকে এসে, আদিম যুগে যেমন রাজা-বাদশার একটা ধারণা ছিল সেটা চলতে লাগলো কর্পোরেট কালচারে। এখানে কেউ হয়তো একলাখ টাকা বেতনের চাকরি করে, তার একধরনের জীবন-যাপন। আরেকজন হয়তো পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে তার আরেকধরনের জীবন-যাপন। আমরা মানুষগুলোকে তার পদ-পদবী আর আয় দিয়ে আলাদা করে ফেলছি। সামাজিক অবস্থান দিয়ে মাপার চেষ্টা করছি। শ্রেণী তৈরি করছি। সেখান থেকে আমরা একটা গল্প বলতে চাইলাম যেখানে কাল্পনিক ইউটোপিয়ান একটা জাহাজ হবে, সেই জাহাজটাই হয়ে উঠবে একটা দেশের প্রতিচ্ছবি। একটা দেশে যেমন একজন কুমার-কর্পোরেট-কামার থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ আছে, এই জাহাজেও আমি এমন নানারকম মানুষ আনার চেষ্টা করলাম যারা এই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই জাহাজে আমরা আনলাম দুজন বেকার যুবককে, যারা দশ বছর ধরে চাকরির পরীক্ষা দিতে জাহাজে করে ঢাকা আসছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। আনলাম একজন অন্ধ শিল্পী, যাদুকর, নব্য ধনী হওয়া এক পরিবার, পুরনো এক এলিট, একজন পিম্প যিনি লঞ্চে মেয়ে সাপ্লাইয়ের কাজ করেন। নানারকম মানুষ, তাদের শ্রেণী, অবস্থান, অহংবোধ দেখানোর চেষ্টা করলাম।
আপনার ভেতর যে রক্ত সেটা যেমন লাল, আমার রক্তটাও কিন্তু লাল, কালো মানুষদের রক্তও কিন্তু লাল। আপনার ক্ষুধা লাগলে যেমন হয় আমারও তেমন হয়। এই মানুষগুলোর সহজাত প্রবৃত্তি যেমন কাম, ক্ষুধা, গন্ধ এইসব জায়গায় সব মানুষ কিন্তু এক। তৃষ্ণা লাগলে আপনার যেমন কষ্ট হয়, আমারও তেমন কষ্ট হয়। আপনার কামের অনুভুতি এবং আমার কামের অনুভুতি প্রায় একইরকম। সেইখান থেকে আমি মনে করলাম আসলে এই জার্নির মধ্যে কি হলে পরে মানুষ আবার এক জায়গায় দাঁড়াবে। তখন আমি ক্ষুধার ধারণাটা পেলাম। আমরা যে একটা কাল্পনিক পোশাক পরে থাকি সেই পোশাকটা কখন খুলে পড়ে? এখান থেকে ক্ষুধার ধারণাটা আসলো এবং রকেটে এমন একটা অবস্থা তৈরী হলো। তখন এই যে রকেটে দুই হাজার লোক ছিল, এরা শুরু থেকে, নানা রকম স্ট্যাটাসে বিলং করছিল কিন্তু যখন খাবারের সংকট দেখা গেল তখন সবাই একই লাইনে এসে দাঁড়ালো। এবং তাদের শরীর থেকে কাল্পনিক আরোপিত জামাগুলো আস্তে আস্তে খসে পড়তে শুরু করলো। তখন একজন ব্যবসায়ি আর লঞ্চের খালাসির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকলো না।
আমি আমার জায়গা থেকে গত আড়াই বছরে চিত্রনাট্য লেখা, দৃশ্যধারণ, সম্পাদনা শেষে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। এখন লেখক ধরেন লিখতে লিখতে একটা সময় সে তার ভাষাটা আবিষ্কার করে। একটা সময় জীবনানন্দ লিখতেন কিন্তু তার লেখাগুলো হতো নজরুলের মতো, উনি পরে বুঝতে পারলেন আসলে আমার লেখা তো আমার মতোই হতে হবে। সেই লেখার করণকৌশল তাকে আয়ত্ব করতে সময় লেগেছে। এখন লেখক তার শুধু মাত্র কলমে লিখে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটা প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু চলচ্চিত্রকার তার গল্পটা বলতে গেলে অনেকের আশ্রয়গ্রহণ করতে হয়। আমাকে গল্পটা বলতে হয় আলো দিয়ে, ক্যামেরা দিয়ে, চিত্রনাট্য দিয়ে, সংলাপ দিয়ে, সংগীত দিয়ে; তো এইরকম এত বিষয়ের উপর আশ্রয় নিয়ে আমি আমার গল্পটা বলি। সেক্ষেত্রে হয় যে, আমারও তো এই গল্প বলাটা শিখতে সময় লাগবে। সিনেমায় আমি এখনো শিশু পর্যায়ে রয়েছি। অভিজ্ঞতা কম বিধায় প্রতিনিয়ত শিখছি। সেই অর্থে আমি স্মার্ট লোকও না। ছোটবেলায় পড়েছি ডিরেক্টরকে হতে হয় ক্যাপ্টেন অফ দ্যা শিপ, তাকে ডিকটেটরের মতো শাষন করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমার কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। গল্প বলার ক্ষেত্রে আমার সবসময় মনে হয়েছে আমি লার্নিংয়ের মধ্যে আছি, চলচ্চিত্রে আমার ভাষাটা খোঁজার চেষ্টা করছি। এটা আসলে আমার শুরু। মানে আমি শিখছি।
আমার মতো করে আমি পেয়েছি কিন্তু আমি কল্পনায় যেরকম জায়গায় ছবিটা দেখেছিলাম, যেহেতু স্বপ্নটার কাছে আমাকে যেতে হলে এই ক্যামেরা, শব্দ, আলো, সংগীত, সংলাপ; এগুলোর মাধ্যমেই তো পৌঁছাতে হবে। তো সেই জার্নিটাতে আমাকে আরও দক্ষ হতে হবে। তারপরও বলবো ‘কমলা রকেট’ একেবারেই ইউনিক। পৃথিবীতে কোথাও এই জনরার কাজ বা এই গল্পটা যেমন করে যায় এরকম কাজ হয়নি বলে আমার মনে হয়। এটা আমারই ভাষা এবং কখনোই মনে হবে না যে এটা অন্য কোন ছবি বা অন্য কোন ভাষায় এরকম কিছু দেখেছেন।
আপনি যখন অন্যের মতো হতে চাইবেন তখন আপনার নিজের সম্ভাবনা কিন্তু অনেক ছোট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আমি আমার কাছেই বশ্যতা স্বীকার করেছি। আমার যে অক্ষমতা, আমার সীমাবদ্ধতা গুলোর ভেতরেই আমি থাকছি। এখান থেকে আমি আমার গল্প বলার চেষ্টা করেছি। আমি এবং শাহাদুজ্জামান (কমলা রকেটের গল্পকার) আমরা নিজেরা নিজেদের চোখ দিয়ে নিজের মতো করে গল্পটা দেখেছি। এর মধ্যদিয়ে আমরা আমাদের চারপাশের গল্পটা আনার চেষ্টা করেছি। আপনি যখন আপনার নিজের গল্প বলবেন, আপনার মায়ের গল্প বলবেন, আপনার ভাইয়ের গল্প বলবেন তখন সেটা আর অন্য কারও গল্প হবে না। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি সেটা আরও কতোটা স্মার্টলি বলা যেতে পারে। এখানে গল্পটা আমাদের, জল ও জীবন আমাদের। এখানে চারপাশে তাকালে যে মানুষগুলোকে দেখা যায় এটা সেই মানুষগুলোর সিনেমাটিক গল্প। এজন্য কমলা রকেট আলাদা।
বাংলা সাহিত্যে আমি প্রথমে খেয়াল করলাম সৈয়দ ওয়ালীওল্লাহ্ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে লেখেন। ওনার লেখা পড়লে মনে হয় যেন বাংলাদেশের নদী, গ্রাম আর মানুষ দেখছি। এর পরবর্তীতে পাবেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদুল জহিরকে। আমি গল্প বলতে চেয়েছিলাম সমসাময়িক বাংলাদেশের গল্প। সেখানে আমি অনেক দিন থেকেই শাহাদুজ্জামানের গল্প পড়ছি, আমার মনে হয়েছে এই সময়ের যথার্থ অনুবাদ তিনিই করতে পারবেন। সে জন্য আমি শাহাদুজ্জামানের গল্প নির্বাচন করেছি।
এই ছবিটার প্রতি ওনার যে দরদ এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমি অভিভূত! উনি শুরু থেকে আজকে পর্যন্ত আমাদেরকে সময় দিয়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবিটা নিয়ে কথা বলেছেন। কোন একটা ডায়লগে হয়তো আমাদের মিলছে না তখন আলোচনা করেছি। একটা জায়গায় এসে সম্মত হয়েছি। উনি আমার জন্য একটা অন্যরকম সাপোর্ট ছিলেন। এই ছবিটার কাজ করতে যেয়ে এই লোকটাকে মনে হয়েছে আমার শরীরেরই একটা অংশ হয়ে গেছেন। প্রত্যেকটা সময় আমি ওনার সাহায্য পেয়েছি। চিত্রনাট্য করার সময় কিছু চরিত্রের প্রতি আমার দূর্বলতা ছিল, যেমন বেকার যুবকগুলোর চরিত্রকে বড় করে ফেলছিলাম, উনিই এগুলোকে ছোট করেছেন। আসলে উনি তো আমার থেকে জীবন অনেক ভালো বোঝেন বা শিল্পের পরিমিতির ব্যাপারটা আমাদের থেকে ভালো জানেন। ফলে উনি বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। তার কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
আসলে আমি তো অভিনেতা ছিলাম না কোনকালে। ফারুকী ভাই আমাকে দিয়ে পিঁপড়াবিদ্যা করিয়েছিলেন। আমি খুবই লাজুক মানুষ, ক্যামেরার সামনে সবসময় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। এখনো তেমনি আছি। আমি আসলে লেখক হতে চেয়েছিলাম। পরে মনে হলো সিনেমায় আরও সুন্দর ভাবে গল্পটা বলা যায়। হয়তো আমার লেখার মতো এতো যোগ্যতা নাই। আমি যে গল্পটা বলতে চাই সেটা লিখে বলা হয়তো আরও কঠিন। সেক্ষেত্রে আমি মনে করলাম চলচ্চিত্র নির্মাতাই হতে হবে। নির্মাতা হতে হলে যেমন মানুষ হতে হয় সেটা আমাকে হতে হচ্ছে। পুতুল নাচানোর বিষয়টা হচ্ছে… (হাসি) আমি একটা গল্প বলতে চাই সেটা বলতে গেলে যা লাগে সেটা তো আমাকে করতেই হবে। এতো মানুষ, এতো আয়োজন, এগুলো মেনটেইন করার মানুষ কিন্তু আমি না। কিন্তু ছবিটা যেহেতু বানাতে চাই তাই এগুলো মেনটেইন আমাকে করতে হচ্ছে।
আমার আসলে একটাই চাওয়া, সেটা হচ্ছে আমি যেন প্রতি দেড় বছরে একটা করে ছবি বানাতে পারি। এখন আমার চারটা স্ত্রিপ্ট রেডি। এরপর কাজ শুরু করবো। আমি আসলে সিনেমাটা বানাতে চাই। আমার একটাই স্বপ্ন যেন বসে না থাকি। কাজ করার সুযোগ যেন পাই। ছবি যেন বানাতে পারি। ছবিগুলো একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদম আলাদা হবে। মানুষ, দৃশ্য, দৃশ্যপট সব বদলে যাবে, গল্প বদলে যাবে। এরকম করে আমি আমার জীবনে পনেরটা ভালো ছবি বানাতে চাই।
ভাল ছবি বলতে আমি আমার চারপাশে যে জীবন দেখি এই জীবনের অনুবাদ করতে চাই। এটা আমার চলচ্চিত্রের দর্শনও বলা যায়। আমার জীবন, আমার দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমার ছবি দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন। আসলে আমাদের চারপাশে আমরা যা দেখি তার সব তো আর শিল্প না, সব কথা তো আর ফিল্মের ডায়লগ না। এরমধ্য থেকে ছেঁকে নিংড়ে জীবনের কথাগুলো শিল্পী তার গল্পে ঢুকায়। সে যেমন সম্ভাবনার কথা বলে তেমনি হতাশার কথাও বলে। সবমিলিয়ে সে আসলে জীবনের জয়গানের কথা বলে। আমি আমার অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে চাইনা। আমি যা দেখেছি, এই দেখাটাকে আবার যেভাবে দেখতে চাই সেটাকে আমি চলচ্চিত্রে প্রকাশ করবো। এটাই সবসময় থাকবে আমার সিনেমায়।
আমি আমার নিজের মতো করে একটা মাধ্যম সেট করে নিয়েছি। সেটা হচ্ছে যে আমি খুব বিগ বাজেটের সিনেমা কখনোই বানাবো না। আমি এমন একটা খরচের মধ্যে সিনেমা বানাবো যেটা কমার্শিয়ালি সাকসেস না হলেও কিছু যায় আসে না। আমার খুব প্রিয় একজন নির্মাতা নুরি বিলগে সিলান (ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া), ওনার ছবিগুলো দেখবেন কান (চলচ্চিত্র পুরস্কার) পেয়েছে দুইবার। বাংলাদেশে যে সিনেমাগুলো হয় দেখবেন প্রায় আশি থেকে একশ জনের মতো লোক থাকে একেকটা টিমে। কিন্তু বার-পনের জনের টিম নিয়েও নুরি তার কাজটা বেশ ভালোভাবেই শেষ করতে পারেন। এখন আপনি যদি এক কোটি টাকা দিয়ে ছবি বানান তাহলে সেই ছবিটা বিশ কোটি টাকা ব্যবসা করলে টাকাটা প্রযোজকের হাত পর্যন্ত উঠে আসবে। তো আমি খুব কম বাজেটের সিনেমা বানাবো যাতে হলের উপর নির্ভর না করতে হয়। হলের লোক ছবিটি দেখে অবশ্যই বিনোদিত হবে। এতে করে যদি ছবিটা ব্যবসায়িক সাফল্য পায় তাহলে তো খুবই খুশি হবো আমি। না হলেও যাতে আমার ছবি বানানো থেমে না থাকে। সেক্ষেত্রে আমি গল্পের প্রতি অনুগত থেকেই এগোবো।
আমার স্বপ্ন ছিলো ট্রেনে চড়ে দূরের কোন শহরে পড়তে যাবো। ছয় বছর ধরে শুধু ট্রেনে যাবো আর আসবো। আমার বাড়ি থেকে সবচেয়ে দূরে ছিলো চট্টগ্রাম আর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ওখানে যেতে হলে ঢাকা পর্যন্ত আমাকে যেতে হতো বাসে। সিদ্ধান্ত নিলাম খুলনা বা রাজশাহীতে পড়বো। রাত জেগে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম যেন খুলনায় আমি ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই, যেন সুন্দরবনের ওপর একটা উপন্যাস লিখতে পারি। তিনি আমার প্রার্থনা শুনলেন, আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম। পড়াশোনা শেষ করে সবাই করে চাকরি, আমি চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি। গিয়ে টিউশনি শুরু করলাম। এখান থেকে টাকা জমিয়ে আমি বাংলাদেশ ঘুরতাম। ভাবতাম ত্রিশের আগেই গোটা দেশটা ঘুরে দেখবো এবং আমি দেখেছিও। বাংলাদেশের সবগুলো থানায় আমি গিয়েছি এবং থেকেছি। আর মাঝে মাঝে ঢাকায় সিনেমার বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হয়ে ক্লাশ করেছি।
এরমধ্যে সরয়ার ফরুকী ভাইয়ের সঙ্গে টেলিভিশন সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পেলাম। এরপর একটা এনজিওতে ঢুকলাম। কিন্তু ক্লাশ সেভেনে থাকতে আমার মাথায় একটা পোকা ঢুকে গেছে, আমি কাল্পনিক এক জগৎ বানাবো, সেটা তো আর হচ্ছে না। আমি অভিনয় করলাম কিন্তু এটা তো আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমি থাকবো আবার আমি থাকবো না কোথাও। দেখলাম যে ডিরেকশনেই সেটা সম্ভব। আপনি থাকছেন আবার আপনি কোথাও নেই। এখন এটা করতে হলে টাকা পাবো কই? এর মধ্যে আমার দুই ছাত্র আমাকে বললো ওরা টাকা দিবে। ওদের টাকায় ছয়দিন ধরে একটা নাটক বানালাম। এই নাটক ডিভিডি করে চ্যানেলগুলোতে দিলাম। কেউ কিনলো না। দুই বছর পর এটিএন বাংলা থেকে একদিন ফোন দিলো, আমি তখন কুমিল্লায়, ইট ভাটার ওপর রিসার্চ করি। নাটকটা বিক্রি হলো দুই লাখ টাকায়। আমি খুব খুশি হয়ে ঢাকায় এলাম। আমার মধ্যে একটা বিশাল শক্তি চলে এলো। মোশারফ করিম ভাইকে বললাম একটা গল্প আছে। উনি শুনলেন। নিজেই টাকা দিলেন। চারদিন অভিনয় করে এক টাকা পারিশ্রমিক নিলেন না। এই মানুষটা আমাকে অন্যরকম স্নেহ করেন। নাটকটা চ্যানেল আই দেখালো। মোশারফ ভাই আমাকে দিয়ে সিনেমা বানানোর জন্য ইমপ্রেসকে বললেন। আমি ছবি বানালাম।
আমার জীবনটা আসলে মিরাকলের মতো, সবকিছু দৈব ভাবে ঘটে যায়। ছবি বানাবো এতটুকো জেনেই আমি পাংশা রাজবাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলাম। এরপর কিভাবে ছবি বানায়, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে টাকা দেয় এসবের কিছুই জানতাম না আমি। কিন্তু হয়ে গেছে। আমি ঢাকায় এসেছি এগারো সালের মাঝামাঝিতে, এখন আঠারো সাল। এরমাঝে প্রকৃতির কি কৌশলে জানি আমাকে দিয়ে একটা ছবি বানিয়ে নিয়েছে।
সিনেমা বানানো হচ্ছে এমন একটা দূর্ঘটনা যেখানে কোন কিছুই নির্মাতার হাতে থাকে না। হঠাৎ একটা চোরা বাতাস এসে নায়িকার চুলগুলো উড়িয়ে দেবে, একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে তীরে, আপনি সবসময় চাচ্ছেন কিন্তু আপনি পাবেন না। এটা নির্মাতার হাতে নেই। বিষয়টা হচ্ছে আপনি যদি সৎ ভাবে কোন কিছু চান তাহলে সব পেয়ে যাবেন। কারণ সিনেমার নির্মাণে পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে কিছু করা যায় না। আপনি চাচ্ছেন খুব জোছনা কিন্তু সেদিন জোছনা নাই। ঘাটে একশ নৌকা চাচ্ছেন দেখবেন একটা নৌকাও নাই, চাচ্ছেন তীব্র কুয়াশা, সে বছর কুয়াশাই পড়বে না। কিন্তু আবার কিভাবে কিভাবে যেন সবকিছুই যথাসময়ে ঢুকে পড়বে ফ্রেমের ভেতর।
সিনেমা বানানোর ইচ্ছেটা প্রবল ছিল আমার। প্রকৃতি কিভাবে যেন সেটা টের পেল এবং আমাকে সিনেমা বানানোর সুযোগ করে দিলো।
সারাবাংলা/টিএস/পিএ