বিজ্ঞাপন

মালেকা পারভীন-এর গল্প ‘হয়তো প্রায়শ্চিত্ত, হয়তো ক্ষমা…’

January 31, 2018 | 4:50 pm

(‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-/তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!’…কুড়ি বছর পরে/জীবনানন্দ দাশ)

বিজ্ঞাপন

‘‘কুড়ি বছর, কুড়িটি বছর আগের হারিয়ে ফেলা সময়

আর স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ ওঠা-নামা করে যাওয়া

কত শত ইংরেজি ক্ল্যাসিক গান; তুর্কী তরুণেরা শুনতো

বিজ্ঞাপন

তখন বেশুমার: কেনি রজার্স, ক্লিফ রিচার্ড, জর্জ মাইকেল

আর এরকম অসংখ্য মেলোডিয়াস মিউজিক্যাল নামগুলো

ছিল যেন সেই সঙ্গীতময় দিন-রাতসকালে জপতে থাকা

বিজ্ঞাপন

নিরবচ্ছিন্ন একনিষ্ঠ প্রার্থনার শব্দাবলী প্রেমপূর্ণ মুগ্ধতায়।

আমিও ওই দলে আলগোছে মিলেঝিলে ছিলাম ছন্দানুরাগী;

‘গিল্টি ফিট হ্যাভ গট নো রিদম’ চিৎকারে যে তরুণ

কাঁপিয়েছিল হৃদয়, সেই গানপাগলা গায়ক জীর্ণ জানুয়ারির

বিজ্ঞাপন

শীতার্ত এক সকালে পালিয়ে গিয়ে বনে গেল বিশ্বস্ত প্রতারক…”

এতটুকু লিখবার পর কী-বোর্ডের ওপর উপমার হাতের দশটা আঙ্গুল এসে দলামোচড়া পাকিয়ে থমকে থাকে। নিশ্চল, নিশ্চুপ। গতকাল বা আজ ভোর রাতের স্বপ্নটা দেখার পর থেকে বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে ভাবছিল, আজ যা হোক অনেক কিছু লিখে ফেলবে তার সেই বেসুরো গায়ক থেকে প্রেমহীন প্রতারকে পরিণত হওয়া প্রেমিককে নিয়ে।

পালিয়ে যাবার জন্য বছরের যে মাসটা ফারুক বেছে নিয়েছিল, সেই জানুয়ারির (নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর ফাঁকে ডিসেম্বরের শেষ সন্ধ্যায় একসাথে প্রেমপূর্ণ সময় কাটাবার পরপরই) শীতার্ত সংকীর্ণতার সাথে তার ওই হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মধ্যে উপমা একটা যোগাযোগ আবিষ্কার করেছে। কিন্তু এখন তো জানুয়ারি নয়; নভেম্বরের নাতিশীতোষ্ণ নির্বিকার ভাবলেশহীনতা। কিন্তু তবুও সে এলো, তবুও সে আসে ফিরে ফিরে জোর হাতে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে।

এভাবে ফারুক বারবার আসে স্বপ্নের দায়হীন শর্তহীন অবস্থার সুযোগ নিয়ে; প্রায়শ্চিত্তের সূত্র মেনে না এসে পারেনা যেন। যদিও বহু বছর আগে ঠিক যখন কাপুরুষতা নামক কালব্যাধির আক্রমনে সে নিজের কাছে পরাস্ত হলো, পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ খোলা ছিলনা। সত্যি কথা বলতে কী, ভালোবাসার মতো গুরুভার সম্পর্কটি টেনে নিয়ে যাবার মতো যথেষ্ট মানসিক পরিপক্কতা তার ভেতরে কখনোই ছিলনা। উপমার এটা বুঝতে ঢের সময় লেগেছে।

ক্রমাগত ঘনীভূত হতে থাকা পারস্পরিক সম্পর্কের দৃশ্যপট থেকে আচমকা ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে বটে; কিন্তু এর পর থেকে (প্রথমদিকের কয়েক বছর বাদ দিলে) নিয়মিত বিরতিতে উপমার অবচেতনের দুয়ারে এসে কড়া নাড়তে থাকে সে। যেন এভাবে আসতে তার ভেতরে এতটুকুও দ্বিধা বা সংকোচ কাজ করেনা। আর তাই সে আসে বারবার স্বপ্নের উন্মুক্ত প্রবেশদ্বারের সুযোগটুকুর সদ্ব্যবহার করে; না এসে যেন পারেনা। সে যেন এভাবেই আসতে থাকবে যতদিন উপমা তাকে সত্যিকার অর্থে ক্ষমা করে না দেয়।

গতকাল বা আজ ভোর রাতেও যেমন সে এলো। কেমন একটা অদ্ভূত মায়ালাগা আবেশের অশরীরী আবহ তৈরি করে। অশরীরী,কারণ তার শরীরের সবটুকু দৃশ্যমান ছিলনা। কেবল ওই স্মিত হাসি জড়ানো ক্রমাগত সিগারেটে পুড়িয়ে ফেলা পুরু ঠোঁটজোড়ার আড়ালে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখের নির্ণিমেষ চাহনি। এতটুকুই। অথচ এই এতটুকু স্বপ্নের ঘোরও যেন এখনো কাটেনি বা কাটতে চায়না।

স্বপ্নের ঘোরে বন্দী থাকা অবস্থাতেই উপমার বারবার মনে হচ্ছিল, উঠে বসে সে আজ অনেক কিছু লিখে ফেলবে। লিখে ফেলবে যতটুকু সে ওই মায়াময় আচ্ছন্নতার মধ্যে উপলব্ধি করেছে, যতটুকু ফারুকের সাথে তার কথা বলাবলি হয়েছে বা হয়নি, সবটুকু আজ শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লিখে ফেলবে। একটা গল্প না হয় একটা কবিতা।

আর এখন সবটুকু ঘোর কেটে যাবার পর সকালের গা-চিটমিটে কটকটে আলোয় সবকিছু কেমন বিরক্তিকর আর অসহ্য লাগছে তার কাছে। রুঢ় বাস্তবতাজাত অতীতের সমস্ত মিথ্যে আর প্রতারণা আর অভিনয় যেন তাদের ঘৃন্য নগ্ন চেহারা নিয়ে তার মনের পর্দায় একের পর এক ভেসে উঠছে। এখন তার মনে হচ্ছে, সে যেন আর কিছুই লিখতে পারবেনা। যেন তার কিছুই লিখবার নেই। স্বপ্ন আর সত্যি বেশিরভাগ সময় এক অপরের সাথে সাংঘর্ষিক, বিপরীত অর্থে সম্পর্কিত। সে বুঝতে পারে সুস্পষ্ট বোধের আলোয়।

আজ এতোদিন বাদে মরে যাওয়া, যদি সত্যি হয়ে থাকে যা সে জেনেছে, প্রতারক প্রেমিকের কথা আর কীইবা বলার থাকতে পারে। আবার নতুন করে তার কথা ভেবে অযথা সময় নষ্ট করারও কোন অর্থ থাকতে পারেনা। কিন্তু বাধ সেধেছে গতকাল বা আজ ভোর রাতে আচমকা দেখে ফেলা স্বপ্নটা। স্বপ্ন অবশ্য আচমকা আসে, আচমকাই যায়। তবে কিছু কিছু স্বপ্ন যেন বিশেষ কোন অভিপ্রায় নিয়ে চেতন-অবচেতনের দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়; কিছু একটা বলবার উদ্দেশ্যে স্মরণ-জানালার কপাট জড়িয়ে ধরে থেকে যেতে চায়। সেটা নিয়ে খানিকরকম নাড়াচাড়া করলে মনের আরশিতে শক্তপোক্তভাবে আঁচড় কেটে দেয়। তারপর তাকে আর ভোলা সম্ভব হয়না। এরকম স্বপ্নের আসল উদ্দেশ্যটাই বোধ করি এমন থাকে যে,যে কোন প্রকারে মন-মন্দিরে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজাটা আটকে দেওয়া যাতে আর কিছুতেই সে বিস্মরণের গহবরে হারিয়ে না যায়। যেমন গতকাল বা আজ ভোর রাতের স্বপ্নটা।

গত ন’টা মাস ধরে অদ্ভূত এক মানসিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে উপমা। এমন একটা ব্যাখ্যাতীত অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে সেটা যে কারো কাছে বলে নিজেকে একটু হালকা করবে সে উপায়ও নেই।অবশ্য তার মনের কথা শেয়ার করবার মতো কেইবা আছে! অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য যে,তার এমন কোন একান্ত প্রিয়জন নেই যাকে আপন বলে ভাবা যেতে পারে, বন্ধু হিসেবে আশ্বস্ত হওয়া যেতে পারে। যার কাছে গিয়ে হাঁফ ফেলে কিছু সুখ-দুঃখের আলোচনা করা যেতে পারে এমন কেউ নেই। নেই মানে নেই। সে ছিল ‘সারা জীবন দলছুট’; আজও তাই রয়ে গেলো।

যেদিন থেকে তার কানে অস্পষ্টভাবে কেউ এই খবরটা দিয়েছে যে হতভাগা ছেলেটা এই পৃথিবীতে আর নেই,সেদিন থেকে এক নামহীন অস্থিরতা উপমার হৃদয়কোনে তাঁবু গেঁড়েছে। মাঝখানে তের-চৌদ্দ বছরের সম্পূর্ণ যোগাযোগহীনতা। কেউ কারো কোন প্রকারের খবর নেয়নি,জানেনি। অন্ততপক্ষে উপমার কাছে ফারুকের ব্যাপারে কোন সংবাদ ছিল না। এমনকি ছিঁটেফোটা ধরনের কোন ছোটখাট খবরও না।একটা সময় যে মানুষটার চব্বিশ ঘন্টার রুটিন তার নখদর্পনে ছিল, নিয়তির চক্রে জীবনের চাকা ঘুরিয়ে তাদেরকে পৃথিবীর এমন দু’প্রান্তে নিয়ে ফেলেছে যেখানে তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে সেই খবরই তাদের কারো কাছে নেই।তারপর একদিন আচমকা, কোনরকম প্রসঙ্গের অবতারণা ছাড়াই, উপমা জানলো, প্রেম আর ঘৃণা ভরা এই পৃথিবী থেকে ফারুক তার জীবন-যাপনের যাবতীয় আয়োজন গুটিয়ে নিয়ে অজানা ভুবনে ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে।হয়তো।

আহা, সুখের সুলুক সন্ধানে কত কিছুই না করলো ছেলেটা? এক প্রেমিকা থেকে আরেক প্রেমিকা, মাঝখানের বিরহকালে মাদকের আশ্রয়,যেহেতু প্রথম প্রেমিকার আরেকজনের সাথে ঘুরে বেড়ানোর খবর তার কানে এসে পৌঁছায়; এক ফাঁকে সমবেদনার ছলে সেই প্রেমিকার বড় বোনের সাথে কয়েক দিনের মাখামাখি; এর মাঝেই বিবিধ অনুরাগিনীদের কারো কারো সাথে কিছু ভালো লাগার সময় কাটিযে ঘরে ফেরা ইত্যাদি কাহিনীর শুরু আছে,শেষ নেই। কেননা, এই শেষগুলো কখনো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।যায়নি বলেই এতোগুলো বছর পরেও উপমাকে সেই ভুলে থাকা অধ্যায়ের পাতাগুলি আরেকবার নাড়াচাড়া করতে হয়। কিছুটা কৌতূহলে,কিছুটা অনিচ্ছায়,কিছুটা বুকভরা বেদনায়। আর কিছুটা একটি ‘কেন’র উত্তরের খোঁজে।

তারপর আবার মনে হয় বেশ কিছুটা সন্দেহ আর দ্বিধার মিশেলে। সত্যিই কি ফারুক সেখানে চলে গেছে যেখানে যাওয়ার রাস্তাটা কেবল ওয়ান-ওয়ে হয়ে যায় সবার জন্য? যে কারণে বুঝতে পারা যায় না চলে যাওয়া মানুষগুলো ঠিক কোথায় গিয়ে পৌঁছায়,থামে সেই কানাগলির শেষে। জানা যায়না, সেই নিরুদ্দেশে বেমালুম হারিয়ে যাওয়ার পর তারা কোথায় থাকে, কেমন থাকে, কাদের সাথে থাকে।নিদেনপক্ষে পরোক্ষ যোগাযোগেরও যদি একটা সুযোগ থাকতো, কোন একটা দূরবর্তী অস্পষ্ট মাধ্যম বা উপায়! আশ্চর্য, কিছুই নেই!তারপর, জীবন থেমে গেলে সব যেন একরাশ শূন্য নীরবতা; যেন কোথাও কেউ কখনো ছিল না এর মতো  দৃঢ়-কঠিন নিশ্চিতি!

না, কোন উপায়ই নেই। নিশব্দে শ্বাস টানতে থাকা মানুষগুলোর পক্ষে এমন কোন অলৌকিক পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়না। কোন বুজুর্গ পদ্ধতি সেই অজানা অদৃশ্য জগতের কোন সংবাদ বাতলে দিতে পারেনা।মৃত্যূ-দরজার ওপারে কারো নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর তার কোন সম্ভাব্য ঠিকানার খোঁজ-খবর সম্পর্কিত কিছুরই আর হদিস মেলেনা।

এসব ভাবতে ভাবতে উপমা নিজের উপরে খানিকটা বিরক্ত হয়ে ওঠে। এসব অর্থহীন চিন্তা-ভাবনায় অহেতুক সময় নষ্ট করার কোন যৌক্তিকতা সে খুঁজে পায়না। কিন্তু আসলেই কি অর্থহীন? নিজের মনের বিরুদ্ধে হলেও এটা সে অস্বীকার করতে পারছে না যে, ব্যাপারটা গত নয় মাস ধরে থেকে থেকে বেশ কিছু সমযের জন্য তাকে অতীত আর বর্তমানের এক রোলার কোস্টারে বেশুমার গতিতে ঘুরিয়ে আনছে।

যখন এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোন খবরই সে জানেনা। একটা উৎস থেকে সংবাদটা অস্ফুট স্বরে তার কানে এলো। সে নীরবে শুনলো। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার অবয়বে বা অভিব্যক্তিতে। কেবল একবার তার মনে হলো, খবরটা যাচাই করে নিতে হবে। অথবা কবে-কখন জাতীয় খানিকটা বিস্তারিত। যেহেতু তার পক্ষে জানবার কোনরকম কারণ বা মাধ্যম ছিল না। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা বটে তার শারীরিক ভাষায়; কিন্ত্ত যাচাই করে নেবার যে তাৎক্ষণিক ইচ্ছেটা মুখ্য হয়ে উঠলো তার কাছে অপ্রত্যাশিত খবরটা শোনার সাথে সাথে,তাহলে কি অবচেতনের আড়ালে হলেও এমন কিছু শুনতে চায়নি সে কখনোই?কে জানে!মন তো চিরকাল আশ্চর্য রহস্যে মোড়ানো এক চির অচেনা আধার!

খবরটা জানবার আগ পর্যন্ত তের-চৌদ্দ বছরের মতো একটা লম্বা সময় চলে গেছে যখন ফারুকের সাথে উপমার কোন ধরনের যোগাযোগ ছিলনা। ফারুক তার খবর যেমন রাখেনি, তেমনি নিজের ব্যাপারেও কোন কিছু জানতে দিতে চায়নি। অগোচরে যদি কোন খবর সে নিয়েও থাকে, উপমার তরফে তা জানবার কোন রাস্তা খোলা ছিলনা। আর অপমানজাত সেই কষ্টের তীব্রতা এতো বেশি ক্রিয়াশীল ছিল যে উপমার দিক থেকেও সামান্য পরিমাণ আগ্রহ বা ইচ্ছা কাজ করেনি।নতুন করে আগ্রহ তৈরি করবার বা পুরনো আবেগটাই জিইয়ে রাখবার মতো তেমন কোন আকর্ষণও আর ফারুকের ভেতরে দৃশ্যমানভাবে অবশিষ্ট ছিল না। না তার কথায়,না তার আচরণে; এমনকি তার সেই হৃদয়-মোচড়ানো হাসিতেও না কেবল যে হাসিটুকু দেখবার জন্য একসময় উপমার মনে হতো সে এই দুনিয়ার সবকিছু উপেক্ষা করতে পারবে।কেবল সেই হাসিটুকু প্রাণভরে উপভোগ করবার জন্য সে বারবার ছুটে গেছে ফারুকের কাছে হৃদয়ের সব আকুলতা নিয়ে। ধূসর হয়ে যাওয়া কোন এক দূর অতীতের পথে ফেলে আসা অগণিত দিন-ক্ষণ-তারিখের পঞ্জিকা ধরে। হায়,কোথায় সেসব হৃদয়-উচাটন-করা পাগলামি-ভরা ভালোবাসাবাসিময় সময়!

এখন ফারুক আসে উপমার কাছে হাতজোর করে।ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে। অন্তত উপমার তেমনটাই মনে হয়। তা না হলে সে কেন আসে এভাবে কিছুদিন পর পর।বহুদিন আগে ভালোবাসতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে পালিয়ে যাবার পর এভাবে এখন তার আসাটাও কেমন অদ্ভূত লাগে। খুব বেশি কাছে আসবার সাহসটুকুও যেন সঞ্চয় করে উঠতে পারেনা সে। কেবল দূর থেকে অথবা কোন আড়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে উপমার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।কিছুক্ষণ। চোখে তার অনেক কিছু বলবার আকুতি ঝরে পড়ে।ঠোঁটে মৃদু কম্পন। তারপর হাওয়া।এক নামহীন অদৃশ্য গহবরে।তারপর আবার আসে ভিন্ন কোন পটভূমিকায়। যদি সম্ভব হতো উপমার পক্ষে কিছু বলা,তাহলে তাকে এভাবে আসতে নিষেধ করতো সে।‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ কেউ না।উপমাও না।

এক জানুয়ারির সকালে চোরের মতো পালিয়ে গেলো ফারুক। পালিয়ে যাওয়ার আগে অবশ্য কিছুটা নিখুঁত অভিনয় করে বোঝাতে চেয়েছিল,ফিরে আসবে শীঘ্রই। না,ফিরে সে আর আসেনি। উপমাকেও ফিরে যেতে দেয়নি তার কাছে।তার সেই অসম্ভব হৃদয়গ্রাহী অভিনয়!আজও মনে হলে উপমার ভেতরটা বেদনায় কুঁকড়ে আসে।অথচ দু’বছরের সম্পর্কের সবটা যে অভিনয় ছিল তা তো নয়। কিছুটা ছিল। সেটা বুঝে উঠতে অবশ্য তাকে পার করতে হয়েছে অনেকগুলো দিন।তার কাছ থেকে ফারুকের নিজেকে আদ্যোপান্ত গুটিয়ে নেওয়া পর্যন্ত।

উপমাকে কোনকিছু জানতে বা বুঝতে না দিয়ে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলার পুরো হিসাব-নিকাশ ফারুক করে ফেলেছিল সম্পূর্ণ নিজের মতো করে।জানুয়ারির সেই সকালে বিদায় নিতে আসবার আগেই। ঘুণাক্ষরেও টের না পাওয়া বলে যে একটা কথা আছে উপমার ঠিক আক্ষরিক সেই উপলব্ধি হয়েছিল যখন গোটা ব্যাপারটা ধীরে ধীরে তার কাছে উন্মোচিত হতে থাকলো।প্রথম দিকে সে বিশ্বাসই করতে পারেনি, ফারুক তার সাথে এমন আচরণ করতে পারে! অথচ, তাই সে করেছিল-কোন কারণ ছাড়াই একজন বিশ্বস্ত প্রেমিক থেকে নিষ্ঠুর প্রতারকে পরিণত হয়েছিল। যাকে বলে রাতারাতি।অথবা, নিজের পক্ষে বলবার জন্য হয়তো তার কোন কারণ থাকলেও থাকতে পারে। তবে সে তা কখনোই খোলাসা করেনি উপমার কাছে।উপমারও তা জানা হয়ে উঠলো না আজও।

এতো চমৎকার পারস্পরিক বোঝা-পড়ার মধ্য দিয়ে যে একটা সুন্দর সম্পর্ক তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল, তা হঠাৎই নিজের একক সিদ্ধান্তে ভেঙ্গে দিতে ফারুক দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি। তাদের সেই ভালোবাসার স্বপ্নের প্রাসাদ ছেলেমি কান্ডে সে গুড়িয়ে দিয়েছিল হৃদয়হীন কাপুরুষের মতো। কাপুরুষই বটে।মুখোমুখি কিছু বলবার কোন সাহস তার কখনো ছিলনা। না জানুয়ারির সেই সকালে বিদায় নেবার আগে, না পরে একাধিকবার যখন উপমা তার সামনাসামনি হয়ে আসল কারণটা জানতে চেয়েছে।না, কখনোই কিছু বলতে পারেনি ফারুক।

আর আজ যদি সে সত্যি সত্যি নিরুদ্দেশে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তার সাথে সাথে সেই না বলা কারণ বা কথাটাও চাপা পড়ে গেলো চিরদিনের জন্য। হায়,উপমার আর কোনদিনই জানা হবে না কী কারণে ঠিক কোন সময়টায় ফারুক সেই হটকারী সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিল। যদি একবার তাকে বলতো তার ভেতরের টানাপোড়েনের কথা, হয়তো তাদের বিচ্ছেদপর্বটা অন্যরকম হতে পারতো! প্রেমিক ফারুককে প্রতারকের চেহারায় ভাবতে আজও উপমার ভীষণ অস্বস্তি হয়। অথচ একদিন এই প্রতারিত ফারুককেই নিখাদ ভালোবাসার জালে জড়িয়ে ডুবন্ত অবস্থা থেকে টেনে তুলেছিল সে! হায়, মানুষ কী অবলীলায় কত কিছু ভুলে যায়! কী সহজে এক রুপ থেকে আরেক রুপে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে! শুধু দোষ হয় ক্যামিলিয়নের!

উপমার স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিনটির কথা যেদিন তারা দু’জন প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হলো একে অপরের। নিজেদের ভালো লাগার বিষয়টা পরিষ্কার করে নেবার জন্য। ভালোবাসার মিশেলে অনেক স্বপ্ন আর অনেক প্রতিশ্রুতি সহযোগে। উপমাকেই মুখ খুলতে হয়েছিল আগে, যেহেতু ফারুকের ভেতরে ছিল এক রাশ দ্বিধা আর বেশ খানিকটা আত্ম-বিশ্বাসের অভাব। জীবনের প্রথম ভালোবাসায় প্রতারিত হওয়ার কারণেই তার ভেতরে জন্ম নিয়েছিল সেই আত্ম-বিশ্বাসের সংকট।

‘আমি কি তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারবো, উপমা? তুমি আরেকবার ভালো করে চিন্তা করে দেখো।স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে অযথা অকারণে কষ্ট পাবে….’ আনুষ্ঠানিক ভালোবাসা প্রকাশের মাহেন্দ্রক্ষণে ফারুক তাকে এমনটাই বলেছিল।

‘তুমি শুধু এই হতাশার গহবর থেকে আমার হাত ধরে উঠে এসে একটা সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করে নাও। আমি আর কিছুই চাইবো না তোমার কাছে। ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে, ফারুক আর তোমার কষ্টটাকেও। সারা জীবন তোমার পাশে থাকতে চাই।’ ফারুকের দ্বিধান্বিত মানসিক দোলাচলের জবাবে এভাবেই দৃঢ় প্রত্যয়ের উচ্চারণে উপমা তাকে আশ্বস্ত করেছিল।

আর তারপর রাত জেগে লিখেছিল তিন পাতার লম্বা চিঠিটা।তাদের প্রথম প্রেম-পত্র। সবকিছু কেমন স্পষ্ট মনে পড়ে আজও। এতো বছর বাদেও।চিঠিটা ছিল প্রেম আর ভালোবাসার বয়ানে মোড়ানো বেশ কিছু শর্তযুক্ত একটা চুক্তিনামার মতো। ফারুক মুগ্ধ হয়েছিল সেই চিঠি পড়ে। বিশেষ করে শেষ পাতার ওই তিনটা লাইন তাকে এক কথায় পাগল করে দিয়েছিল।উপমা চিঠিটা শেষ করেছিল একটি কথাই তিন সত্যির মতো করে তিনবার বলেঃ‘সিগারেট খাওয়া চলবেনা। সিগারেট খাওয়া চলবেনা। সিগারেট খাওয়া চলবেনা।’ মুগ্ধতার রেশটুকুতে আরেকটুখানি স্থায়িত্ব দেবার ইচ্ছায় ফারুক তার ফিরতি পত্রে দাবি করে বসেছিল চিরকালের প্রেমিক মনের আকুতি:‘আমাকে ভোলা চলবেনা। আমাকে ভোলা চলবেনা। আমাকে ভোলা চলবেনা।’

হায়, কে কাকে ভোলে! ভালোবাসার সব প্রতিশ্রুতি আর দাবিকে পায়ে দলে একদিন ফারুকই ভুলে যেতে পারলো সব। অথবা ভুলে যাওয়ার অভিনয় বা চেষ্টা। গতকাল বা আজ ভোর রাতের স্বপ্নে তার সাথে আরেকবার দেখা হবার পর থেকে সেই পুরনো প্রশ্নটা আবার উপমাকে ক্ষতবিক্ষত করে যাচ্ছে বারবার। ফারুক কি সত্যিই কোনদিন ভালোবেসেছিল তাকে?গত কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছে সে। অসংখ্য ঘটনা, ছোট ছোট মুহূর্ত, বলা-না বলা কথা,বন্ধুদের আচরণ সব বিচার-বিশ্লেষণ করে অবশেষে নিজের জন্য একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে উপমা। যেহেতু তার ভালোবাসায় কোন খাদ ছিলনা, ছিলনা কোন অভিনয়ের চাতুরি,কাজেই নিজেকে বোঝাবার জন্য এমন একটি ব্যাখ্যার তার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। তবু সেটি কেবলই একপাক্ষিক ব্যাখ্যা। এখানে ফারুকের কোন অংশগ্রহণ নেই। অথচ সম্পর্কটা তো ছিল দু’জন মানুষের। এসব ভাবতে ভাবতে উপমা আবার নিজের ভেতর সেই অস্থিরতা টের পায় যখন কোন ব্যাখ্যাই আর তাকে সন্ত্তষ্ট করতে পারেনা।

এই ভীষণ অস্থিরতা, এই অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কেবল ওই একটি চিন্তাই কিছু সময়ের জন্য তার ক্ষতে সান্ত্বনার প্রলেপ দেয়ে এটা বলে যে, এভাবে তার স্বপ্নের ভেতরে ফারুকের নিয়মিত আসা-যাওয়ার একটাই কারণ হতে পারে; সে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে। অনুশোচনা আর পরিতাপের আগুনে পুড়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করছে।কিন্ত্ত এভাবে প্রায়শ্চিত্ত করবার চেষ্টা করলেই কি অতীতের সব ভুল শুদ্ধ হয়ে যাবে?অথবা ফিরে পাওয়া যাবে সব যা হারিয়েছে সারা জীবনের জন্য? উপমা জানে,কিছুই আর ফিরে পাওয়া যাবে না। যা হারায়,তা যায় চিরকালের তরে। তবু যদি এই প্রায়শ্চিত্ত তাকে এতটুকু ভালো রাখে, তবে তাই হোক। সে আসুক,বারবার ফিরে আসুক তার স্বপ্নের দরজায় করাঘাত করতে। নীরবে, নিশব্দে। জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করে। গতকাল বা আজ ভোর রাতের মতো। হয়তো একদিন উপমা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারবে। আজ থেকে কুড়ি বছর পরে। হয়তো….

সারাবাংলা/পিএম

 

 

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন