বিজ্ঞাপন

আরব আমিরাত-ইসরাইল সমঝোতা ও তুরস্কের দ্বৈতনীতি

August 17, 2020 | 9:09 pm

আতিকুল ইসলাম ইমন

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইল তাদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্কের ইতি টেনেছে। অর্থাৎ, ইসরাইল ও আরব আমিরাতের সম্পর্ক এখন থেকে দুই আরব প্রতিবেশীর মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মিশর ও জর্ডানের পর আরব বিশ্বের তৃতীয় কোনো দেশ হিসেবে ইসরাইলের সঙ্গে এমন চুক্তি করলো সংযুক্ত আরব আমিরাত।  যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক উদ্যোগে এ সমঝোতায় ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে দখল বন্ধ করবে বলে শর্তে রাজি হয়েছে ইসরাইল।

বিজ্ঞাপন

দুই দেশের এমন সমঝোতায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় দেখিয়েছে আরব বিশ্ব। কোনো কোনো দেশ আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও কিছু দেশ তীব্র সমালোচনা করেছে। গত বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) সমঝোতার খবর প্রকাশ্যে আসতেই আরব বিশ্ব এ নিয়ে কার্যত দুই ভাগ হয়ে গেছে। সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন ব্লক এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক ও ইরান ব্লক। ফলে ইসরাইলের সঙ্গে আরব আমিরাতের শান্তি চুক্তি হলেও গোটা আরব বিশ্বে মত-ভিন্নতা প্রবল হয়ে উঠেছে। আরব আমিরাতকে ইতিমধ্যে কড়া কথাও শুনিয়েছে ইরান ও তুরস্কের মতো কিছু দেশ। পক্ষান্তরে জর্ডান, মিশরের মত দেশগুলো ইসরাইল ইস্যুতে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া যাবে বলে আরব আমিরাতকে সাধুবাদ জানিয়েছে। তবে উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

সমঝোতার নিন্দা করেছে যারা

মূলত ইরান ও তুরস্ক ব্লকের দেশগুলো আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তুরস্ক সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ভাবছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। এছাড়া আংকারার একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে নিয়মিতই মন্তব্য করে যাচ্ছেন। দেশটি আরব আমিরাতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং কড়া ভাষায় আরব আমিরাতের সমালোচনা করেছে। তুরস্ক এ সমঝোতাকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তুরস্কের পার্লামেন্টের প্রধান মোস্তফা সেন্তোপ শনিবার পার্লামেন্টে এ সমঝোতার তীব্র সমালোচনা করেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ইরানও আরব আমিরাতের এ সিদ্ধান্তকে ‘বিশাল বড় ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী আরব আমিরাতের এ সিদ্ধান্তকে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

আরব আমিরাতের সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপ হামাস এ সমঝোতার নিন্দা জানিয়েছে ও আরব আমিরাতের এমন পদক্ষেপকে ‘ভীতুদের পদক্ষেপ’ বলে বর্ণনা করেছে। এছাড়া আফ্রিকার দেশ ঘানা এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে।

আরব আমিরাত ও ইসরাইলের এমন সমঝোতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইসরাইলের পশ্চিম তীরে ইহুদি সেটলার গ্রুপ। এ সমঝোতার ফলে ওই এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপন আটকে যাওয়ায়ই এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে গ্রুপটি।

বিজ্ঞাপন

নিন্দার জবাবে আরব আমিরাতের প্রতিক্রিয়া

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানীর মন্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছে আরব আমিরাত। রোববার সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে  প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীর মন্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়েছে দেশটি। একই দিন ইরানের রাষ্ট্রদূতকে আরব আমিরাত হুশিয়ারি দিয়েছে, আরব আমিরাত ইরান দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আরব আমিরাত কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, অভ্যন্তরীণ এমন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ভবিষ্যতে যেনো ইরান মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে।

তুরস্কের সমালোচনার কোনো প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাত না জানালেও দ্য গালফ করপোরেশন কাউন্সিলের মহাসচিব ড. নায়েফ আল হজরাফ তুরস্কের নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরাইল-আরব আমিরাত সমঝোতা দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ ও গালফ অঞ্চলের শান্তির বিষয় উল্লেখ করে তুরস্ককে এমন প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন শান্তি স্থাপন করতে হলে গালফ অঞ্চলের দেশগুলো একে অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

আরব আমিরাত-ইসরাইল সমঝোতা স্বাগত জানিয়েছে যারা

বিজ্ঞাপন

আরব আমিরাত ও ইসরাইলের সমঝোতাকে আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই স্বাগত জানিয়েছে। তবে সৌদি আরব এ বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।

মিশর এ সমঝোতার ভুয়েসি প্রশংসা করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি বলেন, ফিলিস্তিনের ভূমি দখল বন্ধ করতে এবং এ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র, আরব আমিরাত ও ইসরাইলের এ সমঝোতাকে আমি স্বাগত জানাই।

এ সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছে জর্ডানও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরাইল যদি ফিলিস্তিনের ভূমি দখল বন্ধ করে তবে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। এছাড়া বাহরাইন, ওমান এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। আরব বিশ্বের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও জাতিসংঘ এ সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছে।

আংকারার দ্বৈতনীতি

আরব আমিরাত ও ইসরাইলের সমঝোতার বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইরান ও তুরস্ক। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুরস্কের এমন প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কেননা দীর্ঘদিন ধরেই খুদ ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। আরব আমিরাত একই ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া যখন শুরু করল তখন তুরস্কের এমন প্রতিক্রিয়া মূলত দেশটির দ্বৈতনীতিরই বহিঃপ্রকাশ।

মিডিল ইস্ট সেন্টার ফর রিপোর্টিং অ্যান্ড এনালাইসিস এর নির্বাহী পরিচালক সেথ জে. ফ্রাঞ্জমেন সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আরব নিউজকে বলেন, ইসরাইল ইস্যুতে তুরস্কের নীতি কপটতায় পরিপূর্ণ। আরব আমিরাত এখন ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করায় তুরস্ক দেশটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, অথচ ইসরাইলের সঙ্গে বহু আগে থেকেই তুরস্কের স্বাভাবিক সম্পর্ক বিরাজমান।

১৯৪৯ সালে ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দুই দেশের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব অবিশ্বাসের ঘটনা ঘটলেও গত বছর তুরস্ক ও ইসরাইলের বাণিজ্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইসরাইল হলো তুরস্কের শীর্ষ দশ রফতানি বাজারের একটি।

ফ্রাঞ্জম্যানের মতে, আরব আমিরাত-ইসরাইলের সমঝোতা নিয়ে তুরস্কের মন্তব্যগুলো মূলত দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ভাবমূর্তি বাড়ানো ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।

তিনি বলেন,  আংকারার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আরব বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর এ কাজে আংকারাকে বারবার ইসরাইল বিরোধী মনোভাব দেখাতে হবে- ঠিক যেমন ইরান করেছিলো। ইরান বা তুরস্ক কোনো দেশই আসলে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কিছুই করছে না।

সারাবাংলা/আইই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন