বিজ্ঞাপন

জেন্ডার ফ্লুইড ট্রেন্ড: কে সাজে কার সাজ!

January 22, 2019 | 3:12 pm

রাজনীন ফারজানা।।

বিজ্ঞাপন

হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ৫৩ বছর বয়স্ক সুপারস্টার আমির খান আর ৩৩ বছরের রনবীর সিঙের মাঝে বিশেষ একটা মিল আছে। না, সিনেমা সংক্রান্ত কোন মিল না। মিলটা ফ্যাশন চয়েস সংক্রান্ত। শারীরিক অবয়ব এবং ব্যক্তিত্ব মিলিয়ে দুজনই বলিউডের মাচো ম্যান। যেখানে আমাদের উপমহাদেশের বেশিরভাগ পুরুষ এবং পুরুষ সেলিব্রেটিরা জিনস, জ্যাকেট, ট্রাউজারস বা কুর্তা পাজামা পরেন সেখানে আমির খান এবং রনবীর সিং সম্পূর্ণ আলাদারকম ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করে আলোচনায় এসেছেন।

আমির খান নাক ফুটিয়ে বড় একটা নাকফুল পরেন। আর রনবীর সিং নাকে নথ পরে ফটোশুটই করেননি, বিভিন্ন পুরুষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান বা সিনেমার প্রমোশনে নিয়মিত স্কার্ট, লেহেঙ্গা কিংবা ফুলেল প্রিন্টের কাপড় পরে এসে সংবাদ শিরোনাম তৈরি করেন। যেখানে নাকফুল পরা ও ফুলেল কাপড় পরা মেয়েদের সাজগোজের অংশ হিসেবে ধরা হয়।

বিজ্ঞাপন

ভারতে দুই চারজন করে শুরু করলেও হলিউডে পুরুষ সেলিব্রিটিরা অনেকেই নাকফুল, স্কার্ট বা অন্যান্য তথাকথিত মেয়েদের ফ্যাশন অনুসরণ করে থাকেন। যেমন জনপ্রিয় ইংরেজ গায়ক জেন মালিক কান ও নাক ফুটিয়েছেন। নিয়মিত নানারকম নাক ও কানের গয়নাও পরেন তিনি। হলিউড অভিনেতা উইল স্মিথের ছেলে কারাতে কিড খ্যাত জ্যাডেন স্মিথও সাজগোজ ও পোশাক দিয়ে নিয়মিত শিরোনাম তৈরি করেন। স্কার্টই পরছেন তাই নয়, মাথায় টকটকে লাল গোলাপ দিয়ে তৈরি হেডব্যান্ড পরতেও দেখা গেছে তাকে।

সাধারণভাবে দেখা যায়। সমাজ ‘জেন্ডার স্পেসিফিক রোল’ এর মত ‘জেন্ডার স্পেসিফিক’ পোশাক ও সাজগোজ নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ নারী পুরুষের আলাদা আলাদা কাজ ও দায়িত্বের মত পোশাক এবং সাজগোজও আলাদা আলাদা হতে হবে। নারীরা শাড়ি, সালোয়ার কামিজ বা স্কার্ট পরবে। আর পুরুষরা আর যাই পরুক কিছুতেই স্কার্ট বা শাড়ি পরতে পারবে না।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু অতীতের দিকে একটু তাকালে দেখা যায় সতেরোশ শতাব্দীতে ফরাসী রাজা সপ্তম কিং লুইসের পরনে প্যাটার্ন ড্রেস, স্টকিংস বা পাতলা মোজা ও লম্বা কোঁকড়া চুল দেখা যায়। আবার আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে চারশ বছরের রাজত্ব করা মোঘল রাজা রাণীদের দেখা যায় সারা গায়েই ভারী গয়না পরতে এবং বড় ঘেরওয়ালা ভারী কাজের পোশাক পরতে।

যুক্তি আসতে পারে নারী ও পুরুষের আলাদা শারীরিক গড়নের কারণে পোশাক বা সাজগোজ আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সমঅধিকারের প্রসঙ্গে নারী পুরুষের পোশাকের স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ। সেই স্বাধীনতাই বারবার ফুটে উঠছে নানা আয়োজনে, নানা জনের পরনে।

তবে যুগ যুগ ধরেই নানা দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এখানে নারী পুরুষের পোশাকে বিশেষ পার্থক্য নাই। জাপানের কিমোনো, চায়নার হানফু, ইন্দোনেশিয়ার জাভানিজদের লুঙ্গির মত অনেক পোশাক আছে জেন্ডার নিউট্রাল।

জেন্ডার ফ্লুইড
একইভাবে স্কটিস ব্যাগপাইপাররা এখনও ‘কিল্ট’ নামক কুঁচি দেওয়া  চেকের স্কার্টই পরেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্কটিশ সৈন্যদলকেও দেখা যায় মোটা কাপড়ের স্কার্ট পরতে। অর্থাৎ অতীতে স্কার্ট শুধুমাত্র নারীদের জন্য নির্ধারিত পোশাক ছিল না।

বিজ্ঞাপন

জেন্ডার ফ্লুইড

প্রাচীন গ্রিসের ঐতিহ্যবাহী পোশাকেও নারী-পুরুষ ভেদাভেদ চোখে পড়ে না। পোশাকের ঝুল, কাট, এমনকি সাজগোজ এবং গয়নাও একইরকম।

জেন্ডার ফ্লুইড

সম্প্রতি বিশ্বের ফ্যাশন রাজধানী খ্যাত প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় জে কে রাউলিঙের ফ্যান্টাস্টিক বিস্টসঃ দ্য ক্রাইম অফ গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের প্রিমিয়ার। সিনেমাটির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ক্রিডেন্স বেয়ারবোন অর্থাৎ অভিনেতা এজরা মিলার সেদিন বিশাল একটা কালো পাখির বেশে রেড কার্পেটে হাজির হয়ে সাড়া ফেলে দেন। অদ্ভুতুড়ে এই পোশাকটি কোন জেন্ডারকেই নির্দিষ্ট করে না। এজরার এই পোশাকটি নতুন করে জেন্ডার নিউট্রাল বা লিঙ্গ নিরপেক্ষ পোশাকের বিষয়টি সামনে এনেছে।

জেন্ডার ফ্লুইড

জেন্ডার নিউট্রাল পোশাককে জেন্ডার ফ্লুইড পোশাকও বলা হচ্ছে। THE Phluid PROJECT  নামে একটা ফ্যাশন ব্র্যান্ড আছে যেখানে ক্যাটেগরিতে পোশাক কিংবা একসেসরি পছন্দের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ শিশু আলাদা করা নাই। পোশাকের নাম হিসেবে ক্যাটেগরি সাজানো। আবার একই পোশাক নারী এবং পুরুষ মডেলকে পরিয়ে ছবি দেওয়া।

টাইটানিক সিনেমার মাই হার্ট গোজ অন খ্যাত গানের শিল্পী সেলিন ডিওনও সম্প্রতি জেন্ডার ফ্লুইড পোশাকের ব্র্যান্ড শুরু করেছেন। সেখানে মেন, উওমেন, কিডস এবং উনিসেক্স এই চার ক্যাটেগরির পোশাক ও একসসেসরি পাওয়া যায়।

জেন্ডার ফ্লুইড

বর্তমান জেন্ডার ফ্লুইড পোশাকের ইতিহাসটা বেশ পুরনো। ষাটের দশকেই উইনিসেক্স ও ইউনিসেক্স পোশাক শব্দদুটো পরিচিতি পায়। ইউনিসেক্স অর্থাৎ নারী কিংবা পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট নয়। জিনস, টি শার্ট বা ট্রাউজারস, চাদর, স্পোর্টস শু ইত্যাদি আমাদের সবার পরিচিত ইউনিসেক্স পোশাক। ষাটের দশকে তরুণদের আন্দোলন ও পরে সত্তুরের দশকের নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের এধরণের পোশাক জনপ্রিয় হতে শুরু করে। নারীরা স্কার্ট ছেড়ে পুরুষদের মত প্যান্ট পরা শুরু করে। এর আগে পুরুষদের ঘোড়ায় চড়ার সুবিধার জন্য ট্রাউজারস পরার চলন শুরু হয়। এমনকি হাই হিল জুতোও পুরুষরা পরতে এই ঘোড়ায় চড়ার সুবিধার জন্যই। পরবর্তীতে হাই হিল শুধুমাত্র নারীদের আকর্ষণীয় পরিধান হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়।

আধুনিক বিশ্বে নারীরা প্যান্ট বা ট্রাউজারস পরছে এই বিষয়টাও একসময় ট্যাবু ছিল। ধীরে ধীরে সেই ট্যাবু ভেঙে এখন এগুলো মেয়েদের পোশাক হিসেবেই সমাদৃত। এখন সারা বিশ্বেই পুরুষরাও তাদের ইচ্ছামত পোশাক পরছেন ও সাজগোজ করছেন। আর ধীরে ধীরে তা সমাদৃত হতেও শুরু করেছে। লাল বা গোলাপি শুধু মেয়েদের রঙ নয় এখন আর। এখন ছেলেরা নানা রঙের শার্ট, গেঞ্জি বা পাঞ্জাবীর পাশাপাশি লাল বা সবুজ প্যান্টও পরছেন।

একটা সময় ছিল যখন মানুষ লজ্জা ঢাকতে গাছের ছাল বাকল পরত। সভ্যতার সাথে সাথে মানুষ কাপড় বোনা শেখে। প্রাচীন পোশাকের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেলাইবিহীন পোশাক পরত। একটা সময়ে মানুষ সেলাই করা রপ্ত করে এবং নানারকম পোশাক পরতে শুরু করে। আমরা যত বেশি আধুনিক হয়েছি নারী এবং পুরুষের সাজপোশাকের ভিন্নতা তত বেড়েছে।

কিন্তু এখন নারী ও পুরুষের কাজ, ভূমিকা সব ক্ষেত্রেই সমঅধিকারের বিষয়ে মানুষ সচেতন। ভেঙে পড়ছে  পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নির্ধারিত নিয়ম কানুনের বেড়াজাল। এসবের প্রতিফলন পড়ছে জেন্ডার নিউট্রাল সাজপোশাক, গয়না ও প্রসাধনের ব্যবহারে।

সারাবাংলা/আরএফ/ এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন