বিজ্ঞাপন

ফারুক আহমেদ-এর গল্প ‘মহানগরের ভ্রমণগুলো যেমন হয়’

May 2, 2022 | 5:37 pm

মোতাহার মাসের একটি দিন এই রাস্তাটাকে ভয় পায়। কখনও কিছু হয়নি, তবু। এখানে এসে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দেয়। আজকে সেই ভয়টাই বাস্তবায়িত হলো। কোত্থেকে তিনটা লোক ঝড়ের গতিতে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সাইকেলটাকে আটকে একটা ছুরি মোতাহারের ঊরুর কাছে চেপে ধরে হাত ইশারায় বলল, যা আছে দিয়ে দাও। এখানের ব্যাপারটা যেতে যেতে হঠাৎ নদীর শুকিয়ে সরু হয়ে যাওয়ার মতো। ফেলে আসা পাঁচশ মিটার পেছনে হর্ন, যানবাহনের হুঙ্কার, মানুষের কোলাহল এমন যে, মনে হয় শব্দ মানুষকে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু এখানে এসে তা শুকিয়ে গতি হারিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মোতাহার বহুদিন ধরে এমন একটা ঘটনার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। ফলে সে ততটুকু ভড়কে যায়নি, যতোটুকু যাওয়ার মতো। সে একটু দম নিয়ে লোকগুলোকে দেখার চেষ্টা করে। অন্ধকারে যেটুকু আন্দাজ করতে পারে, তাতে তিনজনের কাউকেই চেনা বলে মনে হয় না। ছুরিখানা এর মধ্যে ঊরুতে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেছে। এবার মনে হয় যন্ত্রটা জিন্স প্যান্ট কেটে মাংসে ঢুকে পড়েছে। আবারও ইশারা করে, দিয়ে দাও বন্ধু। এর মধ্যে পাশ দিয়ে একটা মোটরসাইকেল চলে যায়। ওরা যেভাবে ঘিরে আছে, সব ইশারায় বলছে, তাতে কারো সন্দেহ হওয়া কঠিন। মনে হবে জড়াজড়ি করে চার বন্ধু কিছু একটা করছে। এমতাবস্থায় আর দেরী করার অর্থ, জীবনটাকে ছুরির নীচে ফেলে দেওয়া! ততটুকু রিস্ক না নিয়ে পকেট থেকে সে টাকাটা বের করে আনে। তখনই ঊরুতে চেপে ধরা লোকটার মুখে এসে ঘুষিটা পড়ে। ঘুষিটা এতোই জোরালো যে, লোকটা ছিটকে যায় পাশের ড্রেনে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দু’জন দৌড় লাগায়। এ দৌড় সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো উস্তাদ ঘুষিটা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিষ্য দুজন দৌড় লাগানোর জন্য যেন তৈরিই ছিল।

পুরো ব্যাপারটাই মোতাহারের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় শুরু থেকে এ পর্যন্ত যা ঘটলো।

-কী হয়েছিল? ভয় পেয়েছিলে খুব? ভয় নাই, হাহা।

বিজ্ঞাপন

কথাগুলো একটানা বলে মানুষটি হাঁটা দেয়। মোতাহার এর কোন উত্তর দিতে পারে না। মানুষটাও উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যায়। মানুষটাকে দেখে বিস্ময়ে মোতাহারের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে। লোকটার চলে যাওয়ার দিকে সে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।

২.

একটা ব্রেঞ্চে বসে মোতাহার আর কানন দম নিচ্ছে। পাশে ভাইবোনের মতো গলাগালি করে দাঁড়িয়ে আছে দু’টা সাইকেল। তাদের এই বসার জায়গা থেকে দেখা যায় হাতিরঝিলের অর্ধেক। অন্যটা দালানের ভাঁজে পড়ায় এখান থেকে নজরে সীমার ধরা পড়ছে না।

বিজ্ঞাপন

মোতাহার গতকাল রাতের ঘটনাটা ভুলে গেছে। সে আজকের ডেলিভারির গল্পটাই কাননকে বলতে শুরু করে। ‘জানো আজকে বিকালবেলা পিজ্জা দিতে গেলাম যে বাসায়, সে বাসার একটি মেয়ে অর্ডার করেছিল পিজ্জাটা। তোমার বয়সী হবে, রিসিভ করতে বাসার নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন চোখ আমি দেখিনি কখনো। আমার দিকে তাকানোর পর আমি একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলাম। কী যে সুন্দর, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।’
কানন হঠাৎ নড়েচড়ে বসে। মনে হলো, ক্লান্তি আর নাই। সে চোখ বড় বড় করে জানতে চায়, ‘তারপর কি হলো?’

-আরে বলো না, আমি ভুল করে ৫০ টাকা কম নিয়েই চলে আসতেছিলাম। তারপর আবার ফোন করে ডেকে টাকাটা দিল, তখন আমার আরো বেশি লজ্জা লাগছিল।

-তাই! তোমার কেন এমন লজ্জা লাগছিল?

-এমনি। বলে মোতাহার চোখ পিটপিট করে হাসে।

বিজ্ঞাপন

-তারপর কী হলো।

-তারপর আর কী হবে। এবার হাহা করে হাসতে থাকে মোতাহার।

– তোমার চরিত্রে যে একটা গন্ডগোল আছে, এটা আমি বুঝতে পারি।

– তাই নাকি? কাননের হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলে, শোন, আজকে বালির গল্প শোনাব তোমাকে?

-বালি! সেটা আবার কোথায়? বালিকার গল্প থেকে বালির গল্প, শয়তান একটা।

-আরে, ইন্দোনেশিয়া। দারুণ এক জায়গা। কিছুদিন আগে সৌদি বাদশা অবকাশ যাপনে গিয়েছিল। বিরাট বহর নিয়ে। আমরাও যাব বছর দুই পরে, বুঝলে?

কানন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে, আচ্ছা বল তাহলে। চোখেমুখে থাকা বিরক্তির ভাঁজ সরে গেছে।

-দাঁড়াও। বলে মোতাহার উঠে সাইকেলের কাছে যায়। ওখানে রাখা ব্যাগ থেকে ক্রিম দেওয়া দুটো বন আর এক বোতল পানি নিয়ে রাখে দু’জনের মাঝখানে।

-শোন, বালি এয়ারপোর্টে নামাটাই একটা অ্যাডভেঞ্চার। ভারত মহাসাগরের বিশাল নীল পেটের ওপর নিয়ে নামতে হয়। রাতে মহাসাগরের নীচে শহরটা জ্বলতে থাকে। আর তুমি এয়ারপোর্টের সীমানায় যখন ঢুকবে, দেখবে তোমার বিমানের চাকা প্রায় পানি ছুঁয়ে ফেলল বলে। ভয় এবং শিহরণ। দারুণ এক ব্যাপার না, বল?

– হুম দারুণ। বল, তারপর কী।

কুটা শহরে আমরা উঠব, এটাই বড় শহর, সাগরের প্রায় সমান্তরাল। এয়ারপোর্ট লাগোয়া শহরটাই বালির প্রাণ। মাসাজ পার্লার, বড় বড় মার্কেট, বার, রেস্টুরেস্ট আর নানা রকম হোটেল-রিসোর্টে ভরপুর। যদিও মনে হয় ১০ ফিট উঁচু ঢেউ এলেই ডুবে যাবে শহরটা। ডুবে গেলে তো দুজন হাত ধরাধরি করে ভেসে যাব। তার আগে এর সাদা বালির বিচ আমাদের দেখতে হবে। কত বড় বড় ঢেউ, আহা। এখানে প্রথম রাত আমরা ডিস্কোতে যাব, পাবে যাব, আর সাদা বালি-নীল জলের সৈকতে শুয়ে থাকব পাশাপাশি। তবে দ্বিতীয় দিন সোজা চলে যাব উবুদ। আর কোথাও না।

-উবুদ, এটা আবার কেমন নাম।

-হাহা, এটাই নাম। টিলা আর জঙ্গল, খরস্রোতা নদী। শিল্প আর শিল্পীর শহর। রবীন্দ্রনাথ গিয়ে এসব শিল্প দেখে খুব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আফসোস করছিলেন, নন্দলাল কেন এলো না বলে। নন্দলাল কে চিনেছো তো?

-না, কে বল তো?

-হা হা, চেনার দরকার নাই। উবুদ যাব তোমাকে নিয়ে শিল্পীদের দেখাতে, সেখানে মানুষগুলোর অর্থ নাই, কিন্তু শিল্প আছে। এজন্য বাড়িগুলোর দেয়াল-দরজা অপরূপ, এসব কথা রবীন্দ্রনাথই বলেছেন। তুমি এসব দেখে আরও বেশি আমার প্রেমে পড়বে। তুমি যে আঁকতে পছন্দ করো এটা আরো বেশি তোমাকে আঁকড়ে ধরবে। দেশে ফিরে তুমি আবার আঁকতে শুরু করবে। আমাদের টাকা নাই, এই ব্যাপারটা বিকালের রোদেও মতো মিলিয়ে যাবে তখন। আর আমি খরস্রোতা নদী ঘিরে জঙ্গলে যেসব, তার থেকে একটা রিসোর্ট ভাড়া করব। সেখানে আমরা থাকব, সেখানেই সুইমিংপুলে সাঁতার কাটব। দু’জন বিয়ারে চুমুক দিয়ে তোমাকে কবিতা শুনাব। আমি যে কবিও সেটা তুমি ওখানে গেলে জানতে পাবে। তোমার জন্য ক্যানভাস আর ইজেল জোগাড় করব, আমি বই নিয়ে যাব। অন্তত দু’দিন রিসোর্টে থেকে বেরুব না। এক মিনিটের জন্যও বের হব না। বারান্দায় তোমার ইজেল থাকবে। পাশে বসে আমি বই পড়ব। সঙ্গে কফি, বিয়ার, ওয়াইন, পাখির কিচিরমিছিল, খরস্রোতার শব্দ- এসব নিয়ে থাকব। সামনে চোখ ভওে থাকবে জঙ্গল আর সবুজ পাতার সমারোহ।

এরপর যেদিন বের হব, সেদিন কমলার বাগানে যাব ঘুরে বেড়াতে তোমার হাত ধরে।
-সত্যি! সত্যি যাব! তুমি কবি, এটা তো বলোনি কখনো!

-একদম সত্যি, এর সবকিছু। বাংলাদেশের ছেলেগুলো যখন প্রেমে পড়ে, তখন সবাই কবি। শোন, উবুদ থেকে যাব মাউন্ট বাতুর। এক ঘন্টার পথ বা তার থেকে একটু বেশি। দু’জন পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়াব মরে যাওয়া আগ্নেয়গিরির সামনে। আমাদের দেখে আনন্দে হয়তো সে জেগেও উঠতে পাবে!

-ও না, কী বলছ তুমি, জেগে উঠবে কেন! কানন মোতাহারের আরো কাছ ঘেঁষে বসে। মনে হয় সত্যি সে ভয় পেয়েছে।

-আরে ভয় পাচ্ছো কেন, আমি থাকব না। ওখানে গেলে শীত। দেখবে কিছুক্ষণের মধ্যে তুমি গরম থেকে শীতের দেশে চলে এসেছো। আর মনে হবে এক রহস্যময় আদিগন্তে এসে পড়লাম আমরা। বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে লাভা পড়ে পুরোটা কালো হয়ে আছে, গাছপালা মরে গেছে। চূড়ার মুখটাও পুঁড়ে কুচকুচে কালো, তবু আশ্চর্যরকমভাবে এর কাছাকাছি কয়েকটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। চারদিকে বিশাল এক শূন্য সৌন্দর্য বিরাজ করছে। শক্ত করে হাত ধরে থাকব আমরা, পুরোটা ঘুরে ঘুরে চোখে গেঁথে নেব। মুগ্ধতার কারণে ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট কথা বলবে আমাদের। ওই মৃত আগ্নেয়গিরির নীচে, ওর পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে। দূর থেকে মনে হবে রেখার মতো। এ দেখে আমাদের অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সে পথ ধরে নেমে অপরূপ একটা লেক। লেক ঘিরে অনেক রিসোর্ট। এসবকিছুই মুগ্ধ করে দেয়ার মতো। হয়তো সেখানেও থেকে যেতে পারি আমরা কয়েকটা দিন, যদি ইচ্ছে হয়।

-সত্যি! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

-একদম সত্যি, আমরা যাব, আমাদের দিনগুলো ঘুরে যাবে এক সময়। আমরা হাত ধরে এসব প্রকৃতির ভেতর নিজেদের সমর্পণ করব। আচ্ছা দাঁড়াও, এবার বনগুলো আমরা খেয়ে নিই। এই বলে মোতাহার কাননের হাতে একটা বন উঠিয়ে দিয়ে অন্যটার প্যাকেট খোলে ফেলে। তখন হাতিরঝিল লেকের পানি বেয়ে একটি জলযান চলে যাচ্ছে দেখা গেল। মনে হলো একটা হাঁস সাঁতরিয়ে সামনে এগোচ্ছে, আর ওটার পেছন পেছন সন্ধ্যা এসে লেক জুড়ে নেমে পড়ছে।

কানন বনে কামড় দিয়ে বলে, আচ্ছা, তুমি কী করে জানলে এমন, কী দারুণ বর্ণনা দিলে, বালি কি এমনই তুমি যেমনটা বললে, না সব তোমার চাপাবাজি।

-কী বলছ, চাপাবাজি হতে যাবে কেন?

-তুমি তো যাওনি কখনো, গতকাল যে রুমার কথা বললে, সেটা ঠিক আছে। ওটা তো দেশের ভেতরেই। যেতেও পারো। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব!

-শোন, আমি রুমাও যাইনি। বাসায় বসে নানাকিছু দেখে স্টোরি তৈরি করি। যদি ডিটেইল করা না যায়, তাহলে আমরা এই পার্কে বসে ভ্রমণটা করব কীভাবে, বল। রুমাও তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব বলে রেখে দিয়েছি।

-হুম, এসব কিছু তাহলে সত্যি? তুমি কিন্তু দারুণভাবে বল, মনে হয় আমরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

-আমাকে দারুণ করেই তো বলতে হবে। এই যে, রুমা, বালি, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন এইগুলো একেকটি স্বপ্ন, একেকটি সন্তান। তোমার হাতে একেকটি সন্তানকে আমি তুলে দিচ্ছি। কখনো আমাকে রেখে চলে যেতে চাইলেও সন্তানের মায়া তো কাটাতে পারবে না। আমার কাছেই থেকে যাবে তখন।

কথাগুলো বলে মোতাহার শব্দ করে হাসতে থাকে। হাসিটা একটা বড় পিকআপ সামনে দিয়ে যেতে যেতে গিলে ফেলে। ছোট গাড়ি গেলে হয়তো এমনটা হতো না। পার্কটা একদম রাস্তা ঘেঁষে, একদিকে পার্ক, অন্যদিকে লেক, মাঝখানে রাস্তা। এখানে শব্দ সাধারণত এতো তীব্রভাবে ঢুকে না। লোকজনও কম থাকে। কয়েকটা ব্রেঞ্চ ছাড়া বিশেষ কোন আকর্ষণ নেই এই জায়গার। ফলে লোকজন না আসার এ সুযোগটা মোতাহার আর কানন নেয়। রোজ রোজ এসে হাপিয়ে পড়াটাকে তাড়ায় এখানে বসে।

-তুমি একটা পাগল। এই বলে কানন মোতাহারের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে।

৩.

-মোতাহার তোমার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে।

-ভাই, কী বলেন, কী অভিযোগ।

-বসের কাছে বিচার এসেছে, তুমি খাবার ডেলিভারি দিতে গিয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে অভব্যতা করেছো।

-বলেন কী ভাই, এটা কিভাবে হয়! কী একটা শব্দ বললেন ঠিক মতো বুঝতেই পারলাম না।

-বুঝো নাই, তুমি বিটলামি করছো। বড় রকমের বিটলামি।

-বলেন কী? বিটলামি এটা কেমন অপরাধ, সত্যি অভিযোগ হয়েছে?

-হ্যাঁ, হয়েছে তো। ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেইন এসেছে। এর আগেও এমন অভিযোগ এসেছিল তোমার নামে, প্রমাণও পেয়েছে ম্যানেজমেন্ট। বলেছে, কাল থেকে তোমাকে না আসতে। এই নাও চিঠি। আগামী মাসে এসে এ ক’দিনের বেতনটা নিয়ে যেও।
মোতাহারের মাথা ঝিম ধরে গেলে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সুপারভাইজার মাহবুব একটু দম নেয়। এরপর আবারও চিঠিটা মোতাহারের দিকে বাড়িয়ে দিলে বলে, নাও, নিয়ে বাসায় চলে যাও।

-যদি না নিই?

-মানে!

মোতাহার চোখ লাল করে মাহবুবের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাহবুব মোতাহারের এ চেহারা দেখে ইতস্তত করতে থাকে। তখন মানুষটা এসে ঢুকে। এই আগুন্তুককে দেখে মাহবুব থতমত, ভাই আপনি, স্লামাইকুম।

উত্তর না দিয়ে আগত অতিথি বলে, কী হয়েছে দেখি? বলে কাগজটা মাহবুবের কাছ থেকে টান দিয়ে নিয়ে নেয়।

-মাহবুব কী হয়েছে, এদিকে আয়। অনেকটা আদেশের স্বরেই কথাগুলো বলে মানুষটা।
এ কথার পর দুজন ভেতরের রুমে চলে যায়। মোতাহার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর মাহবুব ফিরে এসে বলে, মোতাহার, আজকে বাসায় রেস্ট করো গিয়ে, যাও। কাল চলে এসো। টেনশন নাই তোমার। যাও, ওকে?

মাহবুবের কথার পর মোতাহার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অন্যদের হুড়োহুড়ি দেখে। সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত, এর ভেতর থেকে নিজেকে বের করে আনে সে। বেরিয়ে সাইকেলে প্যাডের দিয়ে বাসার দিকে রওনা হয়। আজ আর কাননের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে না।

বেড শেয়ার করে যার সঙ্গে, সেই হানিফ রাতে ফিরে এসে মোতাহারকে বলে, তুমি করছটা কী? সবাই তোমারে নিয়া হাসাহাসি করতাছে।

-কেন, হাসাহাসি করার কী আছে?

-তুমি জানো না, কেন?

-করুক, আমার তাতে কী হয়েছে। উত্তরে মোতাহার এই সিদ্ধান্ত জানালে হানিফ খুব রেগে যায়, বলে, অন্য কোথাও তো তোমার চাকুরি হবে না। তুমি ফুড ডেলিভারির কাজ আর সহজে পাইবা না। এই রিপোর্ট তো বাজারে ছড়াইয়া পড়ব। তারপর চলবা কী কইর‌্যা। আর ঘটনাটা তো কাননও শুনছে।

হানিফের কথাকে মোতাহার একদম পাত্তা দেয় না। সে জোর করে নিজের পাশে হানিফকে বসিয়ে, প্রথম দিন সন্ধ্যার গল্পটা শুনায়, তারপর আজকের ঘটনাটা।

হানিফ বলে, তুমি কী বলতে চাইতাছো, বল তো।

-শোন তাহলে। বলে মোতাহার দুইটা ছবি ছিল আমাদের বাড়িতে, পাশাপাশি, একটা পাঞ্জাবি পড়া, আরেকটা শার্ট গায়ে। একই বয়সের। মানে ছোট বয়সের ছবি। মাকে জিজ্ঞেস করলে বলত, তুই আর তোর ভাই, তোরা অবিকল এক চেহারার। তোর ভাই ঢাকা থেকে আসবার সময় ট্রেনে হারাইয়া গেছে। তুই বড় হয়া ঢাকা গেলে ওরে খুঁইজা বার করিস। মা এসব কথা খুব গম্ভীর হয়ে বলত। মার কথা শুনে আমি যখন কাঁদো কাঁদো, তখন মা, শব্দ করে হাসতে শুরু করতো। বলত, আরে বোকা, এটা তো, তুই-ই। তোর দুইটা ছবি। খালারাও মার মতো করে বলত। আমার মন খারাপ হলে তারাও হেসে কুটিকুটি। কিন্তু আমার মনখারাপটা অনেক সময় ধরে থেকে যেতো। আমি বড় হয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতো, আরে বোকা এ দুটা তো তুই-ই, সত্যি তুই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না। আমার মনে হতো, আমি যাতে মন খারাপ না করি, সেজন্য মা আমাকে সত্যটা বলছে না। এখন তো কাউকে জিজ্ঞেস করার নেই। মা নেই, বাবা তো আরও আগে নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখো আমার ভাইকে আমি পেয়ে গেছি। আর দেখো তার কী ক্ষমতা! আমাকে যে আগলে রাখতে চাইছে। যে আমাকে আড়াল থেকে দেখে, নজরে রাখে।

হানিফ মোতাহারের পাশ থেকে উঠে পড়ে আচ্ছা, এজন্য এ মাসে এখনো বাসা ভাড়া দিতো পারো নাই। এজন্যই তুমি আমার কাছ থেকে ধার নিচ্ছো। তার মানে তোমার বেতনের টাকা ছিনতাই হইছে! তোমার চাকুরি চলে যাওয়া কেউ বাঁচাতে আসতে শুনি নাই। তোমার কী হইছে মোতাহার, কও তো। তুমি কি ঠিক আছো!

হানিফ কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে কাপড় খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাপড় বদলে শাওয়ার নিতে চলে যায় বাথরুমে।

৪.

পার্কে বসে মোতাহার কাননের অপেক্ষায় থাকে। এলে একটা চমকও পাবে কানন। দেখবে মোতাহার তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে জানে সন্ধ্যায় কানন এমনি হলেও আসে এখানে। কাজ শেষে একদিন কাননকে মোতাহার এখানেই পেয়েছিল। পর পর দু’দিন যখন ঘটলো ব্যাপারটা, তখন দুজনের কথা হয়। তারা যে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, এটা তো প্রথম দিন দেখেই চিনে ফেলে। এরপর কথা আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠলে, তারা তাদের বিষন্নতা, গ্লানি, ক্লান্তি দূর করার একটা পথ বের করতে সক্ষম হয়।

মোতাহার অপেক্ষা করে করে সন্ধ্যা হয়ে এলে, একটা বন খেয়ে ফেলে, সঙ্গে বোতলের অর্ধেক পানি। কিন্তু কানন আসে না। আরেকটু অপেক্ষা করে, সে ক্ষুধা এবং রাগ একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। তখন সে কাননকে ফোন করে। কিন্তু কাননের নাম্বারে কল ঢোকে না। এমন একটা অবস্থায় মোতাহার বেঞ্চে বন এবং অর্ধেক পানির বোতলটা রেখে পার্ক থেকে বেরিয়ে পড়ে।

সে কাননের জন্য গত দুদিনে একটা ভ্রমণ তৈরি করেছে। মালেশিয়ার লাংকাউই। মেইলল্যান্ড না, ওখানকার একটা দ্বীপ। অপরূপ। মোতাহারের ইচ্ছে ছিল, ওটা নিয়ে আজ অন্তত তিরিশ মিনিট বক্তৃতা করবে কাননের সামনে। বক্তৃতা মানে বিবরণ। ফাঁকে ফাঁকে কাননের প্রতিক্রিয়া, মুখভঙ্গি দেখে নেবে। কী অপরূপ সব ভিডিও, গল্প পড়ে রেখেছে সে। কিন্তু কাননকেই তো পাওয়া গেল না। সে একটা ব্যাকুলতা অনুভব করে। ফলে এক ঝটকায় পার্ক থেকে বেরিয়ে স্বপ্নতাড়িতের মতো বনানীর দিকে সাইকেল চালাতে শুরু করে। মনে হয় একবার অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখা যাক, কাননের আজকে বাড়তি ডিউটি পড়লো কী-না।

অফিসের কাছাকাছি যে ক্যাফেটা। যার বাইরে লতানো গাছের বেষ্টনী। যার পুরোটাই, নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত স্বচ্ছ কাঁচঘেরা। সেখানে এসে মোতাহার দাঁড়িয়ে পড়ে। একদিন কাননকে নিয়ে এই ক্যাফেতে বসার যে ইচ্ছা, বাজেটের কারণে তা বিলম্বিত হয়ে যাচ্ছে। কোনমতেই টাকাটা জমানো যাচ্ছে না। সে ক্যাফের সামনে এসে সাইকেলটা দাঁড় করায়। ভেবে নেয় কার কাছে কাননের কথা জিজ্ঞেস করবে। ক্যাফের ভেতরের সবগুলো টেবিল এখান থেকে দেখা যায়। সেদিকে একবার মোতাহারের চোখ পড়লে, সে কাননকে দেখতে পায়। মুখজুড়ে হাসি, পাশে বসা একটা ছেলে। এই দৃশ্য দেখে মোতাহারের মাথা ঘুরে যায়। মনে হয় সে এক্ষুণি ভেতরে ঢুকে একটা চিৎকার দিয়ে উঠবে। আস্তে আস্তে নিজেকে শান্ত করে। ভরাট চোখে ভালোমতো দেখে নেয় এবার। দেখে সেই মানুষটি, সেই ছেলেটি, যে তার ভাই, যে হারিয়ে গিয়েছিল শৈশবে, যে অবিকল তার মতো বা মনে হয় সে নিজেই। যার ছবি বাড়িতে সহোদর, পাশাপাশি রাখা আছে।

মোতাহারের রাগ নেমে যায়। কানন যে অসাধারণ একটি মেয়ে, সে আরেকবার এই ব্যাপারটা টের পায়। তখন ঘুওে ফিরে তার মায়ের কথা মনে পড়ে। সে তার ভাইকে খুঁজে পেয়েছে, এই কথাটা তো মাকে তার জানানো দরকার। কিন্তু মাকে সে কীভাবে পাবে। মা জানতে পারল না, তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে তার ভাই খুঁজে পেয়েছে। বাবাও জানতে পারলো না। কিন্তু সে জেনেছে।

তার আর একা একা লাগছে না। কাননকে এই সন্ধ্যায় সে পাশে না পেয়েও তার আর একা লাগছে না।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন