বিজ্ঞাপন

ফেব্রুয়ারি, আমাদের সংস্কৃতি এবং বাংলাভাষার প্রচলন

February 21, 2024 | 6:08 pm

আবু আফজাল সালেহ

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’ : পরিচিত এ গানে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস ফুটে উঠেছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গানটি রচনা করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বাঙালির প্রথম গর্বের বিষয় ভাষা-আন্দোলনে বিজয় অর্জনে মাতৃভাষা হিসাবে বাংলাকে টিকিয়ে রাখা। এই ভাষা আন্দোলনে বিজয়ই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ, বা বীজ রোপিত হয়। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে গর্বের স্বাধীনতা অর্জনে আমরা সক্ষম হই। বাঙালির কাছে একুশে মানেই ১৯৫২ সালের ২১-ফেব্রুয়ারির আন্দোলন। একটি দিনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর ইতিহাসে এত আলোড়ন, লেখালেখি, সাহিত্যরচনা আর দ্বিতীয় দিন নিয়ে নেই।

বিজ্ঞাপন

সংস্কৃতি মানুষের আত্মার কাজ করে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক আমাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতিবলয় তৈরি হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের গর্বের বিষয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন। ভাষা আন্দোলনে মূখ্য-চাওয়া ছিল মাতৃভাষা বাংলা টিকিয়ে রাখা। কিন্তু একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। না-হলে মাতৃভাষার আন্দোলনে বিজয় পাওয়ার পরেও আন্দোলন টিকে থাকত না। বলা যেতে পারে, স্বাধীনতা অর্জন করাটাও ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।

এদেশের জনগণের ভাষা ছিল সবসময়ই বাংলা। কিন্তু একাত্তরের আগের শাসকদের ভাষা সবসময়ই ছিল অন্য। সাতচল্লিশের আগে প্রায় দুশ বছর ছিল ইংরেজি। তার আগে কখনো সংস্কৃত, কখনো ফারসী বা ইউরোপীয় কোনো এক ভাষার লোকেরা এদেশের জনগণকে শাসন করেছে। আমরা যদি সাতচল্লিশ থেকে ভাষা-আন্দোলন করে বায়ান্নর একুশ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে এখনও হয়তো বিদেশি বা ভিন্নভাষার লোকেরা শাসন করত। উর্দু বা অন্যভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা হত। ভারতের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে হিন্দি সংখ্যালঘুদের ভাষা হয়েও ভারতের জাতীয় ভাষা। আর রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েও বাংলা অবহেলিত, পশ্চিমবঙ্গ তাই এখনও অবহেলিত রাজ্য। আমরা জানি, এশিয়ার মধ্যে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছে জাপানি ভাষা ও বাংলা ভাষা। এত-বড় গৌরবের বিষয় থাকতেও ভারতের বাংলা ও অনেক সংখ্যাগুরু জনগণের ভাষাকে বাদ দিয়ে হিন্দিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আসলে, বেশিরভাগক্ষেত্রেই রাজনৈতিক চিন্তা ও দু-একজনের ক্ষমতা ও ইচ্ছের ওপর অনেককিছু নির্ভর করে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা ভাষা-আন্দোলনে আমরা ব্যর্থ হলে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে গৌরবের অর্জনÑস্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়Ñহয়তো আরও দীর্ঘায়িত হতে পারত, আরও অনেক রক্ত ঢালতে হত।

ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে নড়েচড়ে বসি। আমাদের ব্যর্থতা আমরা এখনও বাংলা বানান স¤পূর্ণ একটি কাঠামোতে আনতে পারিনি। এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই রয়েছে। বাংলা একাডেমিকে আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিতে পারিনি। কবি-সাহিত্যিকদের হাতে বাংলা একাডেমির ক্ষমতা ও কর্তৃত্বভার দিতে ব্যর্থ হয়েছি। এটা আমাদের জন্য খুবই খারাপ একটা বিষয় বা উদাহরণ।

বিজ্ঞাপন

যার যার ক্ষেত্রে সেরকম/ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পদায়ন করলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সহজ হত। সরকারের ও আদালতের নির্দেশনা থাকলেও সর্বত্র বাংলাভাষার প্রচলন করতে পারিনি। বিভিন্ন রায়ের পাশাপাশি, অফিসে ইংরেজি চলমান। রাজধানীর অনেক সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। কথার মধ্যে ইংরেজি বলতে না-পারলে আনস্মার্ট মনে করা হয়।

আমরা এখন ইংরেজি ভার্সনে পড়তে আগ্রহী। যারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ও তাদের সন্তানদের ইংরেজিমাধ্যমে পড়াতে পারছেন না, তারাও মনে মনে কষ্ট পাচ্ছেন। বিপরীত অবস্থা খুব কমই হবে। বলা চলে, ব্যক্তিপর্যায়ে ইংরেজি শেখার আগ্রহ কেবল ধনীদের মধ্যেই বিস্তার করেনি কম-বিত্তবানদের মধ্যেও ইংরেজিমাধ্যমে একাডেমিক অর্জন করতে চান। না-পারলে নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন।

উর্দুর পক্ষে কেবল পাকিস্তানের জিন্নাহ বা নাজিমুদ্দিন বলেননি, এদেশের অনেকেও উর্দু চেয়েছিলেন, সেরকম চিন্তা-চেতনা ধারণ করতেন। এ অবস্থা এখনও বিরাজমান। আমাদের মহান স্বাধীনতা, অর্জন, ভাষা নিয়ে এদেশীয় বড় একটি অংশ ভিন্নমত পোষণ করে থাকে। এটার জন্য অবশ্য আমরাও দায়ী, রাজনীতিবিদিরাও দায়ী। কেউ কেউ স্বাধীনতাকে খ-িতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। পাঠ্যপুস্তক, ইতিহাস-বই, প্রচারমাধ্যম প্রভৃতিক্ষেত্রে বিভিন্ন ইতিহাস ও অর্জনের অধ্যায় বারবার পরিবর্তন করে থাকি। আমাদের অস্তিত্ব স্বাধীনতা নিয়েও এক হতে পারিনি। এটা জাতি হিসাবে আমাদের বিরাট ব্যর্থতা। এখানেও সাধারণ জনগন সবপক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

বিজ্ঞাপন

একুশে ফেব্রুয়ারি; আমাদের ভাষাশহিদ দিবসÑএকই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি স্মরণ করিয়ে এই দিন। বাংলা ভাষার আবেগ নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটা করেই পালন করি। কিন্তু আমাদের সারা বছরের কাজকর্মে সেই আবেগের প্রকাশ থাকে না। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের মাধ্যমে এ দিনটিকে বিশেষ করে তুলতে পারতাম। সংবিধানের প্রথম ভাগের ৩ নং ধারা মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। সে মোতাবেক ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ চালু করা হয়েছে। এ আইনের ধারা ৩(১) মোতাবেক, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ এই আইন প্রণয়নের পর থেকে জাতীয় সংসদের সকল আইন বাংলা ভাষায় প্রণীত হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বত্র বাংলায় লেখার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না। অফিস-আদালত, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রায় ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা অবহেলার শিকার, উপেক্ষিত। ভাষা শহিদগণও প্রাপ্য মর্যাদা পান না, বলা চলে আমরা দিতে পারি না। ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা নড়েচড়ে বসি। বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য আদালত ও সরকারের আদেশও আছে। কিন্তু পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও একই প্লাটফর্মে আসার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এসব করতে পারলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন সার্থক ও অর্থবহ হবে। বহু তাগের মাধ্যমে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা-কে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। বাঙালির ঐক্যবদ্ধতার কাছে পশ্চিমাদের চোখ-রাঙানো প্রতিহত করতে পেরেছি। এত ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে পাওয়া এ অর্জন রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাংলা বানান ও বাংলা উচ্চারণ শুদ্ধ করে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সর্বশেষ প্রণীত অভিধান সবসময় পাশে রাখব। উচ্চারণে আরও সতর্ক হবো।

বাইরের শত্রু সবসময়ই আমাদের ছিল এবং আছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বিদেশিশত্রুদের সঙ্গে দেশীয়-শত্রুদেরকেও মোকাবিলা করতে হয়। ফলে, প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে পিছিয়ে পড়তে হয়। অপার সম্ভাবনার এদেশকে আমরা সম্ভাবনাময় দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ভাষা-আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো ঐক্য আবার দরকার। তাহলে, বিশ্বমানচিত্রে শক্তিশালী জাতি হিসাবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব। সে সম্ভাবনা বা ক্ষমতা বাঙালির রয়েছেÑশুধু দরকার একতা, মিলিত-স্বর, কোরাস গান।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন