বিজ্ঞাপন

রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে আশার আলো মেট্রোরেল

December 26, 2022 | 8:47 am

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রশস্ত, উচ্চতা, নকশার দিক থেকে প্রতিটি ভবন একইরকম। এমনকি প্রতিটি ফ্ল্যাটের সাইজ, পার্কিং, লেনও এক। তবে গোছানো পরিপাটি বাড়িগুলো দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন মরুর বুকে কোনো এক ভূতের আস্তানা! শীত মৌসুমে শুষ্ক মরুভূমি মনে হলেও শরতে পুরো এলাকা যেন সাদা মেঘের ভেলায় ভাসতে থাকে। সেই সঙ্গে লেকের টলমল জল এক ভিন্ন আবহ তৈরি করে। আর সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য খনিকের জন্য উপভোগ করতে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে যান ভ্রমণপিপাসুরা। কখনও কখনও স্থানীয়দের মাধ্যমে হেনস্থার শিকার হয়ে ফেরার ঘটনাও ঘটেছে। একসময় অপরাধের রাজ্য হিসেবে পরিচিত রাজধানীর দিয়াবাড়িতে দিয়া জ্বালাতেই এই বাড়িগুলো নির্মাণ করেছিলো সরকার। মধ্যম আয়ের মানুষের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা এসব ভবন বিক্রি করার ক্রেতা পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক)।

বিজ্ঞাপন

একদিকে যাতায়াতের ব্যবস্থা না থাকা, অপরাধীদের আনাগোনার কারণে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প থেকে। অন্যদিকে, যারা কিনে ফ্ল্যাট ফেলেছিলেন তারাও এক রকম বিপাকে পড়েছেন পয়সা বিনিয়োগ করে। এবার সেই অন্ধকারে আলোর দিশা দিতে যাচ্ছে মেট্রোরেল।

দেশের মধ্যম আয়ের মানুষদের আবাসন সুবিধা দিতে উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্প ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ১৮ নম্বর সেক্টরে ২১৪.৪৪ একর জমির ওপর ‘রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ, বি এবং সি এই তিন ব্লকে ৯ হাজার ৩০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৯টি ষোল তলা ভবনে ১৫ হাজার ৩৬ টি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। গত কয়েক বছরে এ ব্লকের কাজ শেষ হয়েছে সেখানে ৭৯টি ভবনে মোট ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট প্রস্তুত করা হয়েছে। বি ও সি ব্লকের কাজ শুরুর কথা রয়েছে। প্রস্তুত করা ফ্ল্যাটের মধ্যে কিছু বিক্রি হয়েছে। তবে যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় এ প্রকল্প তেমন সারা ফেলেনি।

জানা যায়, যে মধ্যম আয়ের মানুষদের আবাসন সুবিধা দিতে এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো তার কিছুই হয়নি। অনেকের ধারণা ছিলো ওই প্রকল্পের ফ্ল্যাট থাকবে ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। কিন্তু তা হয়েছে বিপরীত। নির্মাণাধীন এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দে রাজউকের দেওয়া কঠিন শর্ত মেনে একটা ফ্ল্যাট পেতে গুণতে হবে কোটি টাকা। যা মধ্য আয়ের মানুষের পক্ষে কঠিন। ফলে এই প্রকল্পে যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের বেশিরভাগই বিত্তশালী। যারা কম বিত্তশালী তারা বসবাস করতে গিয়েই পড়েছেন বড় বিপাকে।

বিজ্ঞাপন

যান্ত্রিক নগর জীবন থেকে সরে গিয়ে একটি শান্ত পরিবেশ প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে জীবন-যাপনের উদ্দেশে যারা এ প্রকল্পে ফ্ল্যাট কিনেছেন এবং বসবাস করছেন তারা পড়েছেন আরেক সমস্যায়। বড় সমস্যা যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ থাকা। অন্যদিকে এই এলাকার মনোরম পরিবেশে নিঃশ্বাস নিতে অনেকেই পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ঘুরতে আসেন। কিন্তু এখান থেকে নানা ধরনের নাজেহাল হয়ে যাননি এমন অভিজ্ঞতাও অনেকের রয়েছে।

জানা যায়, একসময় এই দিয়াবাড়িতে বিভিন্ন অপরাধচক্রের দৌরাত্ম ছিলো। কিশোর গ্যাং, ফিটিং পার্টি নামে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী ছিলো এখানে। তাদের হাতে নাজেহাল হওয়া, ছিনতাই, ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনা ঘটতো অহরহ। এসব কারণেও রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ৭০ শতাংশ ফ্ল্যাট খালি পড়ে রয়েছে। যে ত্রিশ শতাংশ বিক্রি হয়েছে তাদের কেউ কেউ ফ্ল্যাট বিক্রির ক্রেতা খুঁজছিলেন। কিন্তু মেট্রোরেল চালু হওয়ার খবরে তারা এখন আশার আলো দেখছেন।

বিজ্ঞাপন

এখানকার বাসিন্দা রফিকুল আলমের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের শুরুতে যে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হয় তখন তিনি এখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন। চাকরি শেষে শহরের জঞ্জাল থেকে একটু নিরিবিলি পরিবেশে জীবন কাটাতেই এখানে বাড়ি কেনা। কিন্তু এখানে ওঠার পর এক রকম ভুতূড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। সন্ধ্যা নামার পর এখানে মনে হবে মধ্যরাত নেমে আসে। তাছাড়া অপরাধীদের কারনে সন্ধ্যার আগেই সবাইকে ঘরে ফিরতে হতো। সব মিলিয়ে এবার মনে হয় সে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, কারণ হাঁটা দূরুত্বেই একটা মেট্রো স্টেশন রয়েছে।’

মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণ করা হয়েছে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। কারণ এখান থেকেই মেট্রোর যাত্রা শুরু। শুরুর স্টেশন উত্তরা কিন্তু মধ্য স্টেশন যে স্থানে সেখানে এই প্রকল্প থেকে হেঁটে যেতে প্রয়োজন হবে দশ মিনিট। ফ্ল্যাট মালিকরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হলে মনে হচ্ছে ফাঁকা ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি হয়ে যাবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও স্বস্তি ফিরবে।

ফ্ল্যাট মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন সকলে বসবাস করেন না। কেউ কেউ কিনে ফেলে রেখেছেন। আবার কেউ কেউ ভাড়াও দিয়েছেন। দেড় হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট ভাড়া এখানে ভীষণ কম। তার একটাই কারণ আশপাশে স্থায়ী কোনো বাজার নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকা। কম দূরত্বে যাদের অফিস কেবল সেসব পরিবার এখানে ভাড়া থাকেন। হয়তো মেট্রো শুরু হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।’

আগামী ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পরদিন ২৯ ডিসেম্বর থেকে যাত্রী পরিবহন শুরু করা হবে। প্রাথমিক ভাবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার রেলপথ খুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানসিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যাত্রী নিয়ে চলাচলের জন্য সব প্রস্তুতি শেষ, এখন শুধু অপেক্ষা।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর যানজট কমানোর পাশাপাশি দ্রুত যাতায়াতের উদ্দেশ্যে মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। এ লক্ষ্যে ২০১৩ সালে জাপান সরকারের প্রতিষ্ঠান জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করে সরকার। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়ন শেষে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। উড়াল ও পাতাল মিলিয়ে মোট ৬ ধাপে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু হয়। এরমধ্যে এমআরটি লাইন-৬ এর আওতায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার মেট্রোরেল পথের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর।

উল্লেখ্য, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনে চলমান এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিলো ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এরপর কমলাপুর পর্যন্ত যুক্ত হওয়ায় এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়। এরমধ্যে জাইকা ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে আর সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করবে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।

মেট্রোরেল সংক্রান্ত আরও সংবাদ:

সারাবাংলা/জেআর/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন