ক্রোয়েশিয়ার রূপকথার জন্ম যে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়
১৫ জুলাই ২০১৮ ১৭:৫৮
।। জাহিদ-ই-হাসান ।।
বিশ্বকাপের চতুর্থ কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে অংশ নেয়া ক্রোয়েশিয়া জানতো ফুটবলে প্রভাব বিস্তার করতে হলে তাদের কিছু একটা প্রয়োজন। লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচ, ইভান পেরেসিচ এবং মারিও মানজুকিচের মতো ‘বুস্ট ফুটবলার’ আছে নিশ্চয়, কিন্তু ব্যাকরুম দল বুঝেছিল তাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে।
কী করতে হবে ক্রোয়েশিয়ার? প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করাই ছিল তাদের সমাধান।
প্রত্যেক দলের ভিডিও বিশ্লেষক আছে কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার মতো সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রযুক্তি নেই কোন দলের। বিশ্বকাপের একমাত্র দল হিসেবে ক্রোয়েশিয়া স্ট্যাট প্রযুক্তি (Stats Insights Y=UK) ব্যবহার করছে।
শিকাগো ভিত্তিক এই প্রযুক্তি ফার্ম ১৯৯৯ সাল থেকে ফুটবল তথ্য পরিবেশন করে আসছে এবং জুনে তারা নতুন একটি ফুটবল প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে একটি দলের বিশ্লেষণ, খেলার ধরনের তুলনামূলক অবস্থা এবং খেলা পরিবর্তনের সেট-প্লে বিশ্লেষণ করে থাকে এ প্রযুক্তি। আপনি এর মাধ্যমে বলে দিতে পারবেন কিভাবে বিপক্ষ দল আচরণ করছে এবং করবে ও খেলবে।
এক ম্যাচ শেষ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে খেলাটিকে ব্যাখ্যা করতে ও বিশ্লেষণ করতে বিশেষজ্ঞরা পাঁচ ঘণ্টা সময় নেয়। তবে, এই নব্য প্রযুক্তি এক ক্লিকেই বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে ফেলে। পাঁচ ঘণ্টার এই কালক্ষেপণ নিমিষেই বেঁচে যাচ্ছে। এই বেঁচে যাওয়া সময়টা তখন কাজে লাগানো যাবে বিপক্ষ দলের শক্তি ও দুর্বল দিক কী সেটা পর্যবেক্ষণে।
এই প্রযুক্তি রবিবার মস্কোয় ফ্রান্স ম্যাচেও প্রভাব ফেলবে সন্দেহতীতভাবে।
এই স্ট্যাটস (Stats) প্রযুক্তির সহ সভাপতি ড. প্যাট্রিক লুসে জানান এর কার্যকারণ বৃত্তান্ত, ‘ভিডিও’র মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে এ প্রযুক্তি। এ বিশ্বকাপে আমরা সেটা করতে পারছি এবং ক্রোয়েশিয়াই প্রথম দল যারা এ প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে।’
‘আপনি যদি টিভির সম্প্রচার দেখেন তাহলে বুঝবেন তারা যা দেখায় এগুলোর কোনও অর্থই হয় না। তারা ম্যাচের পুরো গল্পটা বলতে পারে না। এই একটি দলের জয় ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। আমি সাধারণত একটা উদাহরণ দেই গত বিশ্বকাপের একটি ম্যাচের। ২০১৪ সালের সেমি ফাইনাল। জার্মানী ৭-১ গোলে জিতেছে কিন্তু আপনি যদি পরিসংখ্যান দেখেন, ব্রাজিল বেশি শট নিয়েছে, বেশি বিপদজনক সুযোগ তৈরি করেছিল। তবুও জার্মানী ৭-১ ব্যবধানে জিতেছে।’ যোগ করেন লুসে।
এই ম্যাচের সবচেয়ে আকাঙ্খিত ফলাফল হয়ে যাচ্ছে ‘প্রত্যাশিত গোল’। এবং দলটি কতগুলো সুযোগ তৈরি করলো। কিন্তু এখানে আরও গভীর বিশ্লেষণ আছে যেখানে খেলার অন্য জায়গাগুলো কিভাবে নিশ্চিত করা যায়।
এই বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে ইংল্যান্ডকে বিদায় করেছিল ক্রোয়েশিয়া। অতিরিক্ত সময়ে মানজুকিচের গোলে। কিন্তু খেলার ধরন অবাক করার মতো ছিল। প্রথমার্ধে ইংল্যান্ড আধিপত্য করেছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তারা সেভাবে জায়গা তৈরি করতে পারে নি।
কিছু সময় মনে হয়েছিল গ্যারেথ সাউথগেটের শিষ্যরা প্যাডেল থেকে তাদের পা সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে- ক্রোয়েশিয়া তাদেরকে উপলব্ধি করেছে এবং এটা এমন যে তারা ইংল্যান্ডকে লক্ষ্য বানানোর পথ পেয়ে গেছে এবং তাদেরকে আরও সহনশীল করে তুলেছে।
ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার ফিরে আসার বিশ্লেষণ ব্যাখ্যাটা শুনুন লুসের মুখেই, ‘ইংল্যান্ড পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে অনেক ভালো খেলেছে এবং অন্যান্য দলের চেয়ে পজেশন বেশি ছিল; ৫৩ শতাংশ বল দখল। ১.৫ শতাংশ হারে গোল অনুসারে প্রত্যেক ম্যাচে জালে বল জড়িয়েছে তারা এবং ম্যাচে হাই প্রেসের বেলায় তারা বেশি কার্যকরী ছিল। বল নিয়ন্ত্রণে তারা অনেক কিছু মেনে চলেছে। ডিরেক্ট প্লে বা ক্রসিং নির্ভর ছিল না তারা। পুরো বিশ্বকাপে এটাই ছিল তাদের খেলার ধরন। যাই হোক, ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটিতে, তারা বল দখলে পিছিয়ে ছিল এবং খেলার ধরনেও তারা অনেক সময় ব্যর্থ হচ্ছিল।’
এবং ক্রোয়েশিয়া ২৪টি শট নিয়েছে এবং অনেকবার সুযোগ তৈরি করেছে। সেই সুবাদে তাদের কাঙ্খিত গোল হার ছিল ২.৪ যেখানে ইংল্যান্ডের ০.৭।’ যোগ করেন তিনি।
এই ম্যাচ নিয়ে স্ট্যাট এডজের বিশ্লেষণ ছিল আরও বিস্তৃত। ইংল্যান্ডের দলীয় পারফরমেন্সের নিখুত ব্যাখ্যা তাদের বিশ্লেষণে–
এই ধরনের বিশ্লেষণ সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের খেলাগুলোতে দেয়া হয়। বাস্কেট বল, আমেরিকান ফুটবল এবং বেসবলে এই ধরনের গভীর বিশ্লেষণ দেখা হয়। কিন্তু ইউরোপের ফুটবলে এভাবে দেখা হয় না।
‘আমি কিছু মানুষকে বলতে শুনেছি যে, এই ধরনের বিশ্লেষণ ম্যাচ মেরে ফেলার জন্য। এবং ম্যাচের রোমান্স ছেটে ফেলছেন এর মাধ্যমে।’ লুসে উল্লেখ করে বলেন, ‘খেলা বিক্ষিপ্ত। এমন এলোমেলো নয় যেটা আপনি মনে করেন। মানুষ এখন প্রচুর ফিফা খেলছে কম্পিউটারে এবং গেম বুঝতে ও খেলতে এই বিশ্লেষণগুলো কাজ করে। জিনিসগুলো এগিয়ে যাচ্ছে এবং তথ্য ব্যবহার করে আপনি আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’
বিশ্বকাপের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রস্তুতি। চার-পাঁচ দিনের মাঝেই এক একটা ম্যাচ খেলতে হয়। ক্রোয়েশিয়া গেম প্লান তৈরিতে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচ উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, তারা অবিশ্বাস্যভাবে কেমন ফোকাস ও খেলার ধরন ঠিক রেখেছিল।
‘এমন পরিস্থিতিতে, আপনি পাঁচ ঘণ্টা একটা ম্যাচের বিশ্লেষণের পেছনে সময় দিবেন না যেটা সচারচর লাগেই।’ লুসে বলেন, ‘এর সাথে ইংল্যান্ডের আগের পাঁচটি ম্যাচও দেখতে হবে। মানুষের স্বাভাবিকভাবে আরও ২৪ ঘণ্টা লেগে যাবে। যা অর্থহীন এবং এজন্যই প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করে ভিডিওগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলতে পারে। একটি ক্লিকেই সব বিশ্লেষণ চোখের সামনে চলে আসবে।’
প্রযুক্তি মানুষের জায়গা দখল করতে আসে নি।
https://twitter.com/STATSInsightsUK/status/1017578622222249991
‘এর সবই কোচকে সহযোগিতা করে’ তিনি যোগ করেন, ‘বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণগুলো সাহায্য করে অনেক। ফুটবল অনেক প্রাসঙ্গিক একটি খেলা।’
এখন ক্রোয়েশিয়া তাদের মনোযোগ ফ্রান্সের দিকে নিয়েছে। বিশ্বকাপের এমন অর্জনে পিছিয়ে থাকবে না ১৯৯৮ সালের চমক দেখানো এই দল।
কাজটা সহজ হবে না মোটেও। ফ্রান্স এবারের বিশ্বকাপে ফ্যাভারিটদের তালিকায় প্রথম থেকে। ছয় ম্যাচের একটিও হারে নি এই দল এবং এখন পর্যন্ত নক আউট পর্বে কোন ম্যাচ অতিরিক্ত সময়েও জিততে হয়নি।
বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ফ্রান্স দলের দুর্বল দিক ও খেলার ধরনের উপর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এই প্রযুক্তির তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ফ্রান্সকে থামাতে কি প্রয়োজন এবং কিভাবে?
লুসে ব্যাখ্যা দিলেন, ‘খেলার ধরনে ফ্রান্স গতি দিয়ে খেলে। আমরা খেখেছি, তারা সাধারণ গতির হারের উপরে দৌড়েছে। প্রায় ৪২ শতাংশ। যখন আপনি কিলিয়ান এমবাপ্পে, পল পগবা এবং অন্তনিও গ্রিজম্যানকে দেখবেন সেটা করতে। কিন্তু এগুলো ভিডিওর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করতে পারবেন এবং বিশেষজ্ঞ হলে আপনি দ্রুত তাদের খেলার ধরন বুঝতে পারবেন।’
ফ্রান্সের এই জায়গাগুলো ভাঙতে সাহায্য করবে এই প্রযুক্তি। প্রত্যেক ভিডিওয়ের তথ্য আছে, এক ক্লিকেই যা দেখতে পারছে ক্রোয়েশিয়া। সেট-পিস স্টাডিতে করতে সাহায্য করবে এ প্রযুক্তি।
‘আমাদের অনেকগুলো সুপারিশ তৈরি করি এ তথ্যের মাধ্যমে। আমাদের শুধু প্রশ্ন করতে হবে এবং বিশেষজ্ঞরা সমাধান এনে দিবেন। অনেকগুলো সমাধান আছে। কিন্তু আমরা তাদের শুধু তাদের সহযোগিতা করবো।’
‘মানুষ এটা প্রতিদিন করে। নেটফ্লিক্স এবং আমাজন দেখেন। আমরা ঠিক এভাবেই কাজ করি। আমরা সুপারিশ তৈরি করে দেই অনেক এবং ফুটবলের উচিত এটার সাথে মানিয়ে চলা।’
ক্রোয়েশিয়া এই বিশ্বকাপের আন্ডারডগ হতে পারে, কিন্তু তারা এই দল নিয়ে সবকিছু করতে চায় যাতে ফুটবল ইতিহাসে একটি রূপকথার জন্ম হয়। সূত্র: ব্লেচার রিপোর্ট
ফ্রান্সের দ্বিতীয় না ক্রোয়েশিয়ার প্রথম?
ফ্রান্সের চেয়ে যেখানে এগিয়ে ক্রোয়েশিয়া
‘ফুটবল জ্ঞান বলছে ফ্রান্স জিতবে, মন বলছে ক্রোয়েশিয়া’
সারাবাংলা/জেএইচ