২২ গজ থেকে ২২ বছরের যুদ্ধ, অতপর ২২তম প্রধানমন্ত্রী
১৮ আগস্ট ২০১৮ ১৪:৫০
।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।
সব জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে অবশেষে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন দেশটির বিশ্বকাপ জয়ী সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবনে শনিবার (১৮ আগস্ট) সকাল ১০টায় তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসাইন। শুক্রবার (১৭ আগস্ট) জাতীয় পরিষদের ভোটে প্রার্থী ছিলেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির নেতা ইমরান খান এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এর প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ। জাতীয় পরিষদের নব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইমরানকে ভোট দেন ১৭৬ সদস্য। অন্যদিকে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শাহবাজ পান ৯৬ ভোট।
ইমরান খানের সঙ্গে ২২ সংখ্যাটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে একাধিক জায়গায়। ক্রিকেটে ২২ গজের আঙিনা কাঁপিয়ে ইমরান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২২তম। ২২ গজের আঙিনা থেকে বেরিয়ে ১৯৯৬ সালে সরাসরি ঢুকে পড়েছিলেন রাজনীতির আঙিনায়। তৈরি করেন নিজের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। গত ২২ বছর ধরে রাজনীতির খাতিরে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। টানা ২২ বছর ধরে নিরলস ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল অবশ্য পেয়েছেন ইমরান। আমেরিকার সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী অবস্থানের কারণে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা দেশের শিক্ষিত ও তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের জার্সিতে ব্যাটে-বলে যে সাফল্য তুলে এনেছিলেন, পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সাফল্য পাবেন কি না সেটা সময়ের হাতে তোলা থাক।
লাহোরের জামান পার্কের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর জন্ম নেন ইমরান খান। সরকারি চাকুরিজীবী প্রকৌশলী বাবার কনিষ্ঠ সন্তান ইমরান খান ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। চাচাতো ভাই মাজিদ খান এবং জাভেদ বুরকির অনুপ্রেরণায় ক্রিকেটে হাতেখড়ি। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি বার্মিংহামে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক হয় ইমরানের। ১৯৭৪ সালের ৩১ আগস্ট নটিংহ্যামে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় ওয়ানডেতে। এর পরে তার পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সারা দুনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের মহা-নায়কদের কাতারে স্থান করে নেন তিনি।
টেস্ট ক্যারিয়ারে পাকিস্তানের হয়ে ইমরান খেলেছেন ৮৮ ম্যাচ আর ওয়ানডে খেলেছেন ১৭৫টি। প্রথমশ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন ৩৮২টি আর লিস্ট এ ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৪২৫টি ম্যাচ। সাদা পোশাকে ইমরানের নামের পাশে রয়েছে ৩৮০৭ রান আর ৩৬২ উইকেট, ২৩ বার নিয়েছেন ৫ বা তার বেশি উইকেট, ৬ বার নিয়েছেন ১০ উইকেট। ওয়ানডেতে ৩৭০৯ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ১৮২ উইকেট। ৩০টি সেঞ্চুরি আর ৯৩টি হাফ-সেঞ্চুরিতে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে ১৭৭৭১ রানের পাশাপাশি নিয়েছেন ১২৮৭ উইকেট। লিস্ট এ ক্যারিয়ারে ১০১০০ রানের সঙ্গে তার ঝুলিতে আছে ৫০৭ উইকেট। ১৯৮১ সালে জাতীয় ক্রিকেট দলের নেতৃত্বে এসে পুরো পাকিস্তান দলের কাঠামোই বদলে ফেলেন ইমরান। ক্রিকেটে নিরপেক্ষ আম্পায়ার নিয়ে আসার প্রবক্তাও তিনি। তার যাদুকরী নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে খাদের কিনারা থেকে উঠে এসে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে পাকিস্তান।
১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৯৬ সালে রাজনীতির ময়দানে আসেন ইমরান খান। দুর্নীতি বিরোধী স্লোগানে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। মুদ্রার ওপিঠও দেখা হয় তার। ১৯৯৭ সালে তিনি নির্বাচনে দুটি কেন্দ্র থেকে দাঁড়ালেও দুটিতেই হেরে যান। এমনকি নিজ জেলা মিয়াওয়ালিতে তাকে কেউ ভোট দিয়ে জেতাননি। তবুও থেমে যাননি ইমরান। নিজের পায়ের নিচের মাটি তিলে তিলে শক্ত করার যুদ্ধে নামেন। ২০০২ সালে নির্বাচনে জয়ী হন ইমরান খান। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট হয়ে পারভেজ মোশারফ তৎকালীন সেনা প্রধানের পদে থেকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছিলেন। ইমরান খান ওই নির্বাচনের বিরোধিতা করে ওই বছরের ২ অক্টোবর ৮৫ জন পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে পদত্যাগ করেন। সেবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হয়ে মোশারফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ইমরান খানকে গৃহবন্দী করা হয়। ওইসময় তিনি কিছুদিন হাজতবাস করার পর মুক্তি পান।
২০১২ সালে এশিয়া সোসাইটির জরিপে ‘এশিয়া’স পারসন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন ইমরান। এরপর ২০১৩ সালে পাকিস্তানের ১০তম নির্বাচনে ইমরানের দল দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আসন জেতে। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপি হৈ চৈ ফেলে দেয়া পানামা পেপারসে নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের অবৈধ সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। ইমরানের হাতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মোক্ষম হাতিয়ার চলে আসে। সুপ্রিমকোর্ট নওয়াজ শরীফকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ও আজীবন রাজনৈতিক যেকোন পদের অযোগ্য ঘোষণা করেন। নওয়াজ শরীফের অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার এ মামলার বাদী ইমরান খানের প্রচেষ্টা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। তার ‘নতুন পাকিস্তান’ স্লোগান তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে।
শুধু খেলা বা রাজনীতি নয়, ব্যক্তি জীবনের নানা খবর দিয়েও বরাবরই সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ইমরান খান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনবার বিয়ে এবং বিবাহ বহির্ভূত বহু সম্পর্কের কারণে প্লেবয় হিসেবে খ্যাতি পান তিনি। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া ইমরান খানকে একসময় পশ্চিমের সাংবাদিক-বিশ্লেষকরা দেখতেন অক্সফোর্ডে পড়া একজন রমণীমোহন প্লেবয় হিসেবে, যিনি ক্রিকেট খেলার অন্ধিসন্ধি যেমন জানতেন, তেমনি চিনতেন লন্ডনের নাইটক্লাবগুলো। সবশেষ ৬৫ বছর বয়সে ভবিষ্যতবক্তা বুশরা মানেকাকে তৃতীয়বার বিয়ে করেন তিনি। এর আগে ব্রিটিশ সেলিব্রেটি জেমিমা গোল্ডস্মিথকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করার পরও পরকীয়ার কারণে সেই সংসার ভেঙ্গে যায় ২০০৪ সালে। পাকিস্তানি টিভি সঞ্চালক রেহাম খান দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। সেই সংসার টিকে মাত্র ১০ মাস। চলতি বছর পাঁচ সন্তানের জননী বুশরা মানেকাকে বিয়ে করেও সমালোচিত হন ইমরান।
এবার পাকিস্তানের ১১তম জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তার দল আসন সংখ্যার বিচারে সর্ববৃহৎ দলে পরিণত হয়। জাতীয় নির্বাচনে ইমরানের এই জয় পাকিস্তানের চিরাচরিত ‘প্রথা’কে ভেঙে দিয়েছে। কারণ এতদিন পর্যন্ত দেশের ক্ষমতা গিয়েছে পিএমএল-এন-এর হাতে, অথবা বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-র হাতে। কিন্তু ইমরান ক্ষমতায় এসে সেই দীর্ঘ ‘প্রথা’ ভেঙে চুরমার করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত একটি দেশ হাতে পাচ্ছেন ইমরান। তবে এ অবস্থা থেকেই একটি নতুন পাকিস্তান গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। ইমরানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে হাজির হন সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার নভজ্যোত সিং সিধু, পাকিস্তানের সাবেক তারকা রমিজ রাজা এবং অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম।
প্রথম কোনো ক্রিকেটার হিসেবে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। তার হাত ধরেই হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতেও দেখা দিতে পারে নতুন সম্ভাবনার হাতছনি। ব্যাটে-বলে পাকিস্তানকে শক্ত হাতে একসময় নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়ক এখন পরমাণু শক্তিধর দেশটির হাল ধরতে যাচ্ছেন।
সারাবাংলা/এমআরপি