রূপকথার মতো ক্যারিয়ার শুরু হলেও শেষটায় বড্ড অবিচার
২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:১৫
।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।
৭ জুলাই ১৯৮৪, বাংলাদেশের এক সময়কার ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন মোহাম্মদ আশরাফুলের জন্ম। তিন বছর আগে একই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন মহেন্দ্র সিং ধোনি। দুজনই নিজ নিজ দেশের জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ধোনি এখনও বিশ্ব ক্রিকেটের বড় নাম আর সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছেন আশরাফুল। দেশের ক্রিকেটের আশার ফুল হয়ে ফোটা আশরাফুল জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন আরও আগেই, লড়ছেন নতুন করে নিজেকে ফিরে পেতে। অন্যদিকে, ধোনি দিনকে দিন নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েই চলেছেন। আবারো জাতীয় দলের ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েছেন। কোনো তুলনা নয়, আশরাফুল-ধোনির মধ্যে মিল-অমিলের কিছু দিক সারাবাংলা.নেটের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
দেশের জার্সিতে আশরাফুলের টেস্ট ম্যাচ থমকে গেছে ৬১টি ম্যাচ খেলে। ওয়ানডে খেলেছেন ১৭৭টি আর টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ২৩টি। ধোনি ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ৯০টি, ওয়ানডে খেলেছেন ৩৩২টি আর টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ৯৩টি। সাদা পোশাকে না খেললেও ধোনি এখনও খেলছেন ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় দলে ব্রাত্য অ্যাশ।
ধোনির অনেক আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন আশরাফুল। ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল বুলাওয়াতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় আশরাফুলের। সবশেষ ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৩ সালের ৮ মে, সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, সেই বুলাওয়েতে। ২০০১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কলম্বোতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সাড়া ফেলেন আশরাফুল। ২০১৩ সালের এপ্রিলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে সবশেষ সাদা পোশাকে নেমেছিলেন অ্যাশ। ২০০৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নাইরোবিতে কেনিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় অ্যাশের। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনি খেলেছিলেন তার সবশেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। জাতীয় দলে আর কখনো ফেরা না হলে দেশের মাটিতে অভিষেক কিংবা দেশের মাটিতে বিদায় নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবেন আশরাফুল।
আশরাফুলের অনেক পরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসা ধোনির ওয়ানডে অভিষেক হয় ২০০৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর, চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে চেন্নাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল। সাদা পোশাকের সবশেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নে। ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি ভারতীয় জাতীয় দলে এখনও অটোমেটিক চয়েজ ধোনি।
টেস্টের অভিষেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ধোনি প্রথম ইনিংসে ক্রিজে ছিলেন ৮৩ মিনিট, খেলেছিলেন ৫৪ বল, রান করেছিলেন ৩০। ওয়ানডে অভিষেকে বাংলাদেশের বিপক্ষে এক বল খেলে কোনো রান না করেই সাজঘরে ফিরেছিলেন ধোনি। আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ধোনির সতীর্থদের সবারই অভিষেক হয়েছিল। সেই ম্যাচে ধোনি ২ বল খেলে কোনো রান না করেই বিদায় নিয়েছিলেন। নিজের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে আশরাফুল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫৩ মিনিট ক্রিজে থেকে ৫৩ বলে করেছিলেন ২৬ রান। আর দ্বিতীয় ম্যাচেই ইতিহাস লিখে করেছিলেন ১৬ বাউন্ডারিতে ১১৪ রান। ক্রিজে ছিলেন ২৪৮ মিনিট, বল মোকাবেলা করেছিলেন ২১২টি। মাত্র ১৭ বছর ৬১ দিন বয়সে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির মধ্য দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে অনন্য এক নজির স্থাপন করেছিলেন আশরাফুল। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস স্টেডিয়ামে ওই সেঞ্চুরির সুবাদে আশরাফুল যেমন নিজেকে চিনিয়েছেন তেমনি হয়েছিলেন টেস্টের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান। ওয়ানডে অভিষেকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আশরাফুল ৮ বলে দুটি বাউন্ডারিতে করেন ৯ রান। বল হাতে ৪ ওভারে ২৫ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন একটি উইকেট। আর নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট হাতে অধিনায়ক আশরাফুল ২০ বলে চারটি চার আর একটি ছক্কায় করেছিলেন ৩৬ রান। বল হাতে ৪ ওভারে ৩২ রানের বিনিময়ে তুলে নেন একটি উইকেট।
২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মাত্র ৪টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বমঞ্চে মাঠে নেমে যায় বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুল সেবার বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রথম ম্যাচেই ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে ক্রিস গেইল, সারওয়ান, ব্রাভোদের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেয় আশরাফুলের দল। সেই আসরে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ধোনি। ফাইনালে পাকিস্তানকে ৫ রানে হারিয়ে বিশ্ব শিরোপা উঠেছিল ধোনির হাতে।
একটু প্রথমশ্রেণির এবং লিস্ট ‘এ’ ম্যাচের পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। চলমান বিসিএলের ম্যাচ বাদে আশরাফুল ১৫৫টি প্রথমশ্রেণির ম্যাচ আর লিস্ট এ তে খেলেছেন ২৫২টি ম্যাচ। ধোনি ১৩১টি প্রথমশ্রেণির ম্যাচ আর ৪০৫টি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেছেন। যেখানে প্রথমশ্রেণিতে ২০টি সেঞ্চুরিতে আশরাফুলের ব্যাটিং গড় ২৯, লিস্ট এ তে ১০টি সেঞ্চুরিতে গড় ২৫.৫৭। আর ধোনির প্রথমশ্রেণিতে ৯টি সেঞ্চুরিতে গড় ৩৬.৮৪ এবং লিস্ট এ তে ১৭টি সেঞ্চুরিতে গড় ৫০.০১। প্রথমশ্রেণিতে ধোনির দ্বিগুণ সেঞ্চুরি থাকা আশরাফুলের রান ৭৯১৮, লিস্ট এ তে ৫৫৭৬। আর ধোনির প্রথমশ্রেণিতে রান ৭০৩৮ এবং লিস্ট এ তে ১২ হাজার ৭৫৩ রান। সবধরনের টি-টোয়েন্টিতে ধোনি ২৯৭ ম্যাচ খেলে কোনো সেঞ্চুরি না পেলেও আশরাফুল ৬৪ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে করেছিলেন ইনিংস সর্বোচ্চ অপরাজিত ১০৩ রান। আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ১০ হাজারের বেশি রান করেছেন ধোনি, আশরাফুলের রান থমকে আছে ৩৪৬৮তে। সাদা পোশাকে ধোনি থমকে গেছেন ৪৮৭৬ রান করে আর আশরাফুল থমকে গেছেন ২৭৩৭ রানে।
আইপিএলে ধোনি চেন্নাই সুপার কিংসকে নেতৃত্ব দিয়ে শিরোপা জিতেছেন। বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের জার্সিতে খেলে শিরোপা জেতার সুযোগ হয়েছিল আশরাফুলের। দুজনই দুই দেশের জমজমাট টি-টোয়েন্টির এই আসরে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিলেন। বিপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আশরাফুল প্রথমে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আট বছরের জন্য। এর মধ্যে স্থগিত নিষেধাজ্ঞা ছিল তিন বছরের। আপিলের পর শাস্তিটা কমে হয় দুই বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ পাঁচ বছর। শাস্তি কমানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে পাল্টা আপিল করেছিল বিসিবি ও আইসিসি। বিপিএল স্পট ফিক্সিংয়ের কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসা ‘সাপ’ নিয়ে উদাসীন ছিল বিসিবি। ক্ষমা চেয়েও পার না পাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আশরাফুল। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল, অস্বাভাবিক ছিল আশরাফুল আরও কয়েকজনের দিকে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ জানালেও সেটা সে সময় আমলে নেওয়া হয়নি। সাবেক এই দলপতি আরও বলেছিলেন, শুধু বিপিএল নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও অনেকেই ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে, ব্যাপারটি আর আগে বাড়েনি।
অপরদিকে, স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে আইপিএল থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস। সন্দেহের আঙুলটা ধোনির দিকেও উঠেছিল, কিন্তু সরাসরি ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তোলার সাহস তখন কেউ করেনি। এরপর তো ধোনির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৪ ইংল্যান্ড সফরের ভারতীয় দলের ম্যানেজার থাকা সুনীল দেব ওল্ড ট্রাফোর্ডের টেস্টটি নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। তার দাবি ছিল, ম্যাচ শুরুর আগে মেঘলা আবহাওয়া, বৃষ্টি ও পেসবান্ধব উইকেট দেখে সেদিন সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে টসে জিতলে বোলিং নেবে ভারত। কিন্তু মাঠে নেমে সবাইকে অবাক করে একক সিদ্ধান্তে ব্যাটিং নেন ধোনি। মাত্র ৪৬.৪ ওভারে ১৫২ রানে অলআউট হয় ভারত। ইনিংস ও ৫৪ রানে হেরে যায় ধোনির দল। সুনীল দেবের দাবি ছিল, শুধু ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচেই নয়, ওই সফরের বেশ কিছু ম্যাচেই এমন রহস্যময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ধোনি। সন্দেহের কথা ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডকে (বিসিসিআই) জানালেও তৎকালীন বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি। কারণ তার আইপিএলের দল চেন্নাইয়ের অধিনায়ক হিসেবে জড়িয়েছিলেন ধোনি। এমনকি ভারতীয় পাপ্পারাজ্জিরাও ধোনি-শ্রীনিবাসনের গোপন বৈঠকের ছবিসহ সন্ধান দিয়েছিলেন। আশরাফুল পার না পেলেও ধোনি পার পেয়েছেন সব অভিযোগকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আশরাফুল খেলেছিলেন ৮৩ বলে ১২টি বাউন্ডারিতে ৮৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। সেই ম্যাচে ১২৭ মিনিট ক্রিজে থাকা আশরাফুলের নতুন শট দেখে বিস্মিত হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্ব। আশরাফুলের শটের নাম হয়েছিল ‘অ্যাশস্কুপ’। এই শট প্রোটিয়াদের এতোটাই নাকানিচুবানি দিচ্ছিল যে প্রতিপক্ষের দলপতি গ্রায়েম স্মিথ বারবার ফাইন লেগের জায়গাগুলোতে ফিল্ডার নড়াচড়া করাচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো কাজেই আসেনি তাদের চেষ্টাগুলো। স্কুপ বা ব্যাটল সুইপ শটটার আবিষ্কারক ছিলেন আশরাফুল। এখন এই শটটিই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অনেক ম্যাচেরই মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তান হয়তো আশরাফুলকে অপরাধীর তালিকায় রেখেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে অ্যাশস্কুপ খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেট ব্যাটসম্যান মিসবাহ উল হক। ম্যাচটি হেরেছিল পাকিস্তান, নয়তো শিরোপাটি উঠতো তাদেরই হাতে। ধোনিরও নিজস্ব স্টাইলের শট ক্রিকেট বিশ্বে খ্যাতি পেয়েছে। ভারতীয় সাবেক অধিনায়কের শটটি নাম পায় হেলিকপ্টার শট। ইয়র্ক লেন্থে বল পেলেই তার ব্যাট চলে যায় পিছন দিকে। দুর্দান্ত ব্যাকলিফটে তিনি ব্যাকফুটে গিয়ে বল পাঠিয়ে দেন সীমানার বাইরে। কথিত আছে ক্রিকেট মাঠে ধোনির থেকে ভালো হেলিকপ্টার শট মারতে আর কোনো ব্যাটসম্যানকে দেখা যায়নি।
ধোনি পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ফলে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করেছেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তদন্ত করে ধোনিকে শাস্তি দিলেও দলের অ্যাসেট বিবেচনায় মাত্রাটা ছিল কম। আশরাফুলের প্রতিভা থাকলেও তার মধ্যে মিডিয়াপ্রীতির কারণে স্টারডম চলে এসেছিল। তার মধ্যে নিজের ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা চোখে পড়েনি। আর বোর্ড অতি উৎসাহী হয়ে তার অপরাধের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও মাত্রাতিরিক্ত শাস্তি দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয় ভক্তদের কাছে।
আধুনিক স্পোর্টস সাংবাদিকতার পিছনে বড় অবদান রাখা ফরহাদ টিটোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আশরাফুল আর ধোনির ব্যাপারে। কানাডার মন্ট্রিয়লে থাকা ফরহাদ টিটো নিজের মন্তব্যে তুলে ধরেছেন বিষয়টি। তিনি জানালেন, অধিনায়ক হিসেবে ধোনি অনেক অনেক এগিয়ে। ভারতের এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসেই অন্যতম সেরা। দলকে ম্যাচ জেতাতে ধোনির সুযোগ ছিল অনেক বেশি। কারণ তার দলে সব সময়ই তিনি পেয়েছেন একাধিক ম্যাচ উইনার পার্টনার। অসততার অভিযোগ ধোনির চেয়ে আশরাফুলেরটা গুরুতর এবং বেশি প্রমাণিত ছিল। ব্যাটিং পজিশন অনুযায়ী আশরাফুল ও ধোনির তুলনা চলে না। আশরাফুল টপ অর্ডার, ধোনি মিডল/লোয়ার মিডল অর্ডার। দু’জনকে দু’ভাবে ইনিংস গড়তে হয়। দু’জনকে দু’ভাবে ম্যাচ জেতাতে হয়। তবে জন্মগত প্রতিভার বিচারে আশরাফুলকে ধোনির চেয়ে এগিয়ে রাখা যায়। আশরাফুল কারো কাছে না শিখেই যেসব শট খেলেছেন, খেলছেন একদম বাচ্চা বয়স থেকেই। সেইসব খেলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে ধোনিকে। প্রচণ্ড পরিশ্রম আর সাহস ধোনিকে আজকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, বাংলাদেশের বদলে যাওয়া, ব্র্যান্ড দল হয়ে ওঠার পেছনে বড় একটা ভূমিকা ছিল আশরাফুলের। ২০০০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে সেঞ্চুরি, ২০০৫ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে মাটিতে নামানোর ম্যাচে সেঞ্চুরি, একই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫২ বলে ৯৪ রান, ২০০৯ সালে বুলাওয়াতে জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে ১০৩ বলে অপরাজিত ১০৩ রান, কিংবা বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম ১৫০ রান সবই আশরাফুলের হাত ধরে। বাংলাদেশের বেড়ে উঠার ইতিহাস স্মরণ করলে প্রথমেই চলে আসবে তার নাম। বাংলাদেশের অনেক স্মরণীয় জয়ের নায়ক হয়ে ভক্তদের মনে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছেন অ্যাশ। একটা সময় প্রবাদই রটে গিয়েছিল ‘আশরাফুলের ব্যাট হাসলে বাংলাদেশ হাসে’। মানুষের এই অপরিমেয় ভালোবাসার প্রতিদান নিজের ক্যারিয়ারে প্রতিফলিত করতে পারেননি আশরাফুল। রূপকথার মতোই যিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, শেষটা করেছিলেন নামের সাথে বড্ড অবিচার করে।
সেই আশরাফুল আজ ক্রিকেট থেকে বহু দূরে গিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম। ১২ বছরের লম্বা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাও তার রঙিন নয়। টেস্টে কিংবা একদিনের ক্রিকেটে তার ব্যাটিং গড় আহামরি তো নয়ই, মাঝারি মানেরও নয়। কিন্তু গড় দিয়ে তাকে বিচার করে ফেললে বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। কোনো বিতর্ক তার জনপ্রিয়তাকে আটকাতে পারেনি। এমনকি ফর্মহীনতা তার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র আঁচ ফেলতে পারেনি। নিজের দিনে তিনি যেন কোনো মহাকাব্যের মহানায়ক হয়ে ওঠতেন। কার্ডিফ, গায়ানা কিংবা জোহানেসবার্গের একেকটি ইনিংস তার একেকটি দৈত্য বধেরই গল্প।
২০০৭ এর পর থেকেই দলে সাকিব, তামিম আর মুশফিকদের মতো তরুণদের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। আশরাফুলও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। ২০১০ থেকেই দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন আশরাফুল। ২০১২ সালে কোনো ওয়ানডে ম্যাচ খেলারই সুযোগ হয়নি। কিন্তু তার মধ্যে যে আরো কিছু দেবার মতো বাকি ছিল সেটা তিনি প্রমাণ করেন ২০১৩ এর শ্রীলঙ্কা সফরে। গল টেস্টে ৪১৭ বলের ১৯০ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংসটি খুব সহজেই তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস হয়ে থাকবে। তবে, আশরাফুলকে বদলে দেওয়ার জন্য দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় কোচ জেমি সিডন্সকে। যিনি জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরই বলেছিলেন, আশরাফুল খেললে বাংলাদেশ জেতে—এই ধারণা বদলে দিতে চান। তাতে আশরাফুলের উপকারের চেয়ে অপকারই হয় বেশি। আগের কোচ ডেভ হোয়াটমোর যেখানে আশরাফুলের টেকনিকে সমস্যা দেখেননি সেখানে ভয়াবহ সমস্যা দেখতে পান সিডন্স। টেকনিকে পরিবর্তন করতে গিয়ে যে কৌশল বেছে নিয়েছিলেন সিডন্স, সেটি কাজে আসেনি।
সেই জেমি সিডন্স বাংলাদেশে থাকতে চেয়েও পারেননি। ২০০৭ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব নিয়ে ২০১১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। সিডন্স থাকতে চেয়েছিলেন এরপরও। কিন্তু তার সঙ্গে চুক্তি বাড়াতে রাজি হয়নি বিসিবি। ততদিনে হারিয়ে গেছেন সেই আগের আশরাফুল। যে সময় ভারতের কোচ গ্যারি কারেস্টেনের মূল কৌশলই ছিল খেলোয়াড়দেরকে তাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে দেয়া। ২০০৭ সালে গ্রেগ চ্যাপেল চলে যাওয়ার পর ধোনি কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন কারেস্টেনকে (২০০৭-২০১১)। যিনি কোচ থাকাকালীন ভারতের তিন ফরমেটের অধিনায়ক ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। বারবারই দলকে ধোনির একক সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন কারেস্টেন।
জাতীয় দলে আশরাফুলের ফেরা নিয়ে মনের কোণে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন তার ভক্তরা সেই ২০১৩ থেকে, আজও তা মিটিমিটি করে জ্বলছে। কে জানে, হয়তো আবার ফিরবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম মহাতারকা, বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রথম প্রেম মোহাম্মদ আশরাফুল।
সারাবাংলা/এমআরপি