ফিরে দেখা আলোচিত-সমালোচিত বাংলাদেশের ক্রিকেট
২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:৪৯
।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।
বিদায়ের পথে আরও একটি বছর। ২০১৮ সালকে বিদায় দিয়ে ২০১৯ সালকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় প্রত্যেকটি মানুষ। পুরনো জীর্ণতাকে পেছনে ফেলে নতুন শপথ, নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুন বছরকে নতুন করে রাঙ্গিয়ে নেবার প্রত্যয় সবার। বাংলাদেশ ক্রিকেটেরও একটি সফল বছরের সমাপ্তি হলো। সফল সমাপ্তি এই অর্থে বলা যে, এই বছরে প্রাপ্তির পাল্লা অনেকাংশে সমৃদ্ধ। ২০১৮ বছরটিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট মনে রাখবে অনেক দিন।
ওয়ানডে ম্যাচ:
১৯৮৬ সাল থেকে ওয়ানডে ক্রিকেট খেললেও ২০১৮ সালে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক সাফল্যই মিলেছে বাংলাদেশের। ভালো-মন্দ দুটি দিক মিলিয়েই বছর শেষ করেছে বাংলাদেশ। এ বছর টাইগাররা খেলেছে ৪৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এর মধ্যে টেস্ট খেলেছে ৮টি, ওয়ানডে খেলেছে ২০টি আর টি-টোয়েন্টি খেলেছে ১৬টি। তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে জিতেছে ২১টি ম্যাচ। আরও একবার খেলেছে এশিয়া কাপের ফাইনালে। হারিয়েছে পূর্ণশক্তির দলগুলোকে। এরমধ্যে পাঁচবার ওয়ানডে খেলেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এ বছর পাঁচ ম্যাচের কোনোটিতেই বাংলাদেশকে হারাতে পারেনি জিম্বাবুয়ে। গত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে সিরিজ জিতে আসে টাইগাররা। ক্যারিবীয়ানদের বিপক্ষে সবশেষ খেলা তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও ২-১ ব্যবধানে জেতে টাইগাররা।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও খেলেছে চারটি ম্যাচ, সেখানে দুটিতে জয় আর দুটিতে পরাজয় লাল-সবুজদের। আফগানিস্তান আর ভারতের বিপক্ষে দুটি করে ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। যেখানে আফগানদের একটি ম্যাচে হারালেও অপরটি হেরে যায় গত এশিয়া কাপে। আর সেই আসরের ফাইনালে এবং গ্রুপ পর্বে ভারতের কাছে দুটি ম্যাচই হারে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে চলতি বছর একটি ম্যাচ খেলে সেটিতে জয় পেয়েছিল টাইগাররা। এ বছর দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা হয়নি বাংলাদেশের।
টেস্ট:
২০১৮ সালে বাংলাদেশ খেলেছে মাত্র আটটি টেস্ট। সাদা পোশাকে টাইগারদের জয় তিনটিতে, পরাজয় চারটিতে আর একিটি ম্যাচ ড্র হয়। এরমধ্যে সর্বোচ্চ চারটি ম্যাচ খেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেছে দুটি করে টেস্ট। ক্যারিবীয়ানদের বিপক্ষে দুটিতে জিতলেও দুটি টেস্টে হেরেছে বাংলাদেশ। লঙ্কানদের বিপক্ষে একটিতে পরাজয় আর অপরটিতে ড্র করে। এদিকে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের একটি ম্যাচে হারলেও অন্যটিতে জেতে টাইগাররা।
২০১৭ সালে মোট ৯টি টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ। যেখানে মাত্র দুটি টেস্টে জিতেছিল বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে দুটি টেস্ট খেলার সুযোগ হলে বাংলাদেশ জিতেছিল একটিতে, হেরেছিল একটিতে। দুটি ম্যাচই হয়েছিল ইংলিশদের বিপক্ষে। তার আগের বছর, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পাঁচটি টেস্ট খেলেছিল। প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান, ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা। সেবার একটি ম্যাচেও জেতার সুযোগ হয়নি। পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি ম্যাচ হারলেও বাকি চারটিতেই ড্র করেছিল টাইগাররা।
টি-টোয়েন্টি:
২০১৮ সালে টাইগাররা মোট ১৬টি টি-টোয়েন্টি খেলেছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ছয়টি ম্যাচ খেলেছে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চার ম্যাচের দুটিতে জিতেছিল বাংলাদেশ। আফগানদের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল। আর ভারতের বিপক্ষেও তিনটি ম্যাচের তিনটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। মোট ১৬ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে লাল-সবুজদের জয় ৫টিতে।
নতুন বছরে পা রাখার আগে পেছন ফিরে দেখা যাক ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঘটে যাওয়া কিছু আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা। দেশের ক্রিকেট ২০১৮ সাল ইতিবাচক-নেতিবাচক দুভাবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মাঠের লড়াইয়ে তামিম-সাকিব-মাশরাফি-মুশফিকদের বছরটা ছিল জমজমাট। পুরোনো সৈনিকদের সঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন নতুন যোদ্ধা সাদমান ইসলাম, নাঈম ইসলামরা। গত এশিয়া কাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে সিরিজ জিতেছিল মাশরাফির দল। তারও আগে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে খেলেছে টাইগাররা। এশিয়া কাপে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, হংকং, আরব আমিরাতকে টপকে ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল খেলেছিল লাল-সবুজের দলটি। কিন্তু সেই ফাইনাল ম্যাচটি কতটা বিতর্কিত ছিল, তা সবারই জানা। এরপর ঘরের মাটিতে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে টাইগাররা।
নাজমুল হাসান পাপন:
চতুর্থ বাংলাদেশি হিসেবে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) সভাপতির দায়িত্ব নেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। গত ১৭ নভেম্বর লাহোরে এসিসির এক বৈঠকে আগের সভাপতি পাকিস্তানের এহসান মানির কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে পান নাজমুল হাসান। এসিসি সভাপতি হিসেবে নাজমুল হাসান দুই বছরের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন। এর আগে ১৯৮৯-৯১ সালে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ২০০২-০৪ থেকে পর্যন্ত তৎকালীন বিসিবি সভাপতি আলী আসগর লবি এবং ২০১০-১২ পর্যন্ত আ হ ম মোস্তফা কামালও এসিসির সভাপতি ছিলেন।
নাসির হোসেন:
বছরের মাঝামাঝি সময়ে ক্রিকেটপাড়ায় নতুন বিতর্কের জন্ম দেন নাসির হোসেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই ধারাবাহিক ভালো করা নাসির পথ হারিয়ে ফেলেছেন অনেক দিন হলো। বোর্ডকে না জানিয়ে বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে ফুটবল খেলে পায়ে চোট নিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। এরপর বোর্ডকে সেটা না জানানোয় সমালোচনা ওঠে। পরে বোর্ডের টাকায় তার চিকিৎসা করানো হয়। এরই মধ্যে বেপরোয়া উঠতি এক মডেলের সঙ্গে কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়েন নাসির। তার বিরুদ্ধে ওঠা নারীঘটিত অভিযোগ এর আগেও উঠেছিল। ক্যারিয়ারের দুঃসময়ে নাসির ভীষণ সমালোচিত হয়েছেন তার এই কথিত মডেল বান্ধবীর সৌজন্যে। গত জুনে সেই বান্ধবী নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে ‘বোমা’ ফাটাতে শুরু করেন, তাতে শুধু সতীর্থ খেলোয়াড়েরাই নয়, ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় পুরো বিসিবি। তাতে ক্রিকেটের গায়ে আরেকবার কলঙ্ক লাগে। ফলে, দেশের জার্সিতে নাসির যে পারফর্ম করেছেন এক নিমিষেই সবকিছু বিতর্কিত হয়ে যায়।
সাব্বির রহমান:
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একের পর এক ভুল কারণে আলোচনায় ছিলেন সাব্বির। বিপিএলে ‘গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের’ কারণে বিশাল অঙ্কের জরিমানা করা হয়েছিল। ক’দিন সঠিক পথে চলেছেন, কিন্তু আবারো পুরোনো সাব্বির, নিষেধাজ্ঞার খড়গ। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাব্বিরের ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছিল ২০১৮ সালের জুনে। এরপর দুই মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ছয় মাস নিষিদ্ধ হন সাব্বির। গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তাকে ছয় মাস নিষিদ্ধ করে বিসিবি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ থাকায় সাব্বির ঘরের মাটিতে জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলতে পারেননি। এমনকি সদ্যই শেষ হওয়া ইমার্জিং এশিয়া কাপেও তার খেলা হয়নি। ক্রমেই বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠা সাব্বিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিস্তর। গত বছর ডিসেম্বরে রাজশাহীর শহীদ কামারুজ্জামান স্টেডিয়ামে জাতীয় ক্রিকেট লিগের (এনসিএল) ম্যাচ চলাকালে এক কিশোরকে পেটানোর দায়ে, মাঠে আম্পায়ারদের হুমকি দিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন সাব্বির। নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জরিমানা হিসেবে দেন ২০ লাখ টাকা। বাদ পড়েন বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেও। এরপর মাঠে তেমন কিছু করতে না পারলেও মাঠের বাইরে খুব একটা শোধরাননি।
আফগানিস্তান সিরিজের সময় ড্রেসিংরুমে মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন, তবে ব্যাপারটা তখন বেশিদূর গড়ায়নি। বাজে আচরণের জন্য একটি টি-টোয়েন্টিতে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে থাকাকালীন করলেন আরেকটি কাণ্ড। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচ যখন বাংলাদেশের হাতে, ফুলটস বলে ক্যাচ দিয়ে সাব্বির ৪৯তম ওভারে ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হেরেই যায় বাংলাদেশ। সেটি নিয়ে ফেসবুকে সাব্বিরকে তীর্যক ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন একজন। তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে ইনবক্সে একটা মেসেজ পাঠান সাব্বির। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে এসে তাকে ‘দেখে নেবেন’ বলেও হুমকি দেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ে খেলোয়াড়দের ওপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সাব্বির সেই নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখান। বাদ পড়েন এশিয়া কাপের স্কোয়াড থেকে। শুধু কি তাই, বিসিবির ডিসিপ্লিনারি কমিটির মুখোমুখি হওয়ার আগে সাব্বির রহমানের বিরুদ্ধে আরও এক গুরুতর অভিযোগ আলোচনায় আসে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জি নিউজ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, চার বছর আগে বিপিএল খেলতে এসেছিলেন পাকিস্তানের সিনিয়র অলরাউন্ডার শোয়েব মালিক। সঙ্গে এসেছিলেন শোয়েবের ভারতীয় স্ত্রী, টেনিস সেনসেশন সানিয়া মির্জা। সে সময় সাব্বির উত্ত্যক্ত করেছিলেন সানিয়াকে। বারবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন তিনি।
মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত:
রুবেল হোসেন, নাসির হোসেন, আল আমিন হোসেন, শাহাদাত হোসেন রাজীব, আরাফাত সানি, সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ শহীদের পর নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন বাংলাদেশ জাতীয় দলের আরেক তারকা ক্রিকেটার মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও ১০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির অভিযোগে ময়মনসিংহের একটি আদালতে মামলা করেন তার স্ত্রী সামিনা শারমিন উষা। পরে মামলার বিষয়টি জানাজানি হয়। আদালত পরযন্ত গড়ায় বিষয়টি। ১৬ বছর বয়সে খালাতো বোনকে বিয়ে করা বিতর্কিত ক্রিকেটারদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন মোসাদ্দেক গত ১৬ আগস্ট স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছেন। নির্যাতনের বিভিন্ন সময়ে ছেলের পক্ষ নিয়ে মৌন থাকা ও ছেলেকে সহযোগিতা করায় মোসাদ্দেকের মা পারুল বেগমকেও আসামি করেন সামিনা।
মোহাম্মদ আশরাফুল:
২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট থেকে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক সময়ের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান মোহাম্মদ আশরাফুল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) সিজন টু’এ স্পট ফিক্সিংয়ের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর নিষিদ্ধ হন তিনি। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশরাফুলের ওপর থেকে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে। ২০১৪ সালের জুন মাসে বিপিএলের এন্টি-করাপশন ট্রাইবুন্যাল আশরাফুলকে ৮ বছরের নিষেধাজ্ঞা ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে। কিন্তু পরে সেপ্টেম্বরে বিসিবির ডিসিপ্লিনারি প্যানেল সেই নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে ৫ বছরে নিয়ে আসে। ২০১৬ সাল থেকে আশরাফুল ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা শুরু করলেও জাতীয় দল ও বিপিএলের জন্য তার দরজা বন্ধ ছিল। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট আশরাফুলের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। আগামী বিপিএলে দলও পেয়েছেন তিনি।
সাদমান ইসলাম:
বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গেম ডেভেলপমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শহিদুল ইসলামের ছেলে সাদমান ইসলাম অনিক। যার আন্তর্জাতিক অভিষেক হতে পারত আরো আগে। তবে তার বাবা শহীদুল ইসলাম চেয়েছিলেন ছেলে পরিপক্ক হয়েই মাঠে নামুক। টাইগারদের টেস্ট একাদশে সুযোগ পেয়েই এই সাদমান বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৭৩ রানের ইনিংস খেলার পর দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ডাক পড়ে সাদমানের। নিজের অভিষেক ম্যাচে ওপেনিংয়ে নেমে বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান খেলেন ৭৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। ২০১৪ সালে পাকিস্তানের ইমাম-উল-হক, দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাডাম মারক্রাম, ইংল্যান্ডের বেন ডাকেটদের টেক্কা দিয়ে সেবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে ৬ ইনিংসে সাদমান ১০১.৫০ গড়ে করেছিলেন ৪০৬ রান। তাতে ছিল ১টি শতক ও ২টি অর্ধশতক। সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ছিল ১২৬*।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত এই পারফরমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৪ ম্যাচে ৭০ ইনিংসে ৪৬.৭৯ গড়ে রান তুলেছেন। আছে ৭টি সেঞ্চুরি আর ১৮টি হাফসেঞ্চুরির ইনিংস। সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ১৮৯। অভিষেকের আগে জাতীয় ক্রিকেট লিগে ১০ ইনিংসে ২ সেঞ্চুরি ও ৩ হাফসেঞ্চুরিতে ৬৪৮ রান করেছেন সাদমান। রান সংগ্রহে ছিলেন সবার ওপরে। প্রমাণ করেছেন আন্তর্জাতিক ঘরানায় ফুরিয়ে যেতে আসেননি তিনি।
নাঈম হাসান:
চট্টগ্রাম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক হয় নাঈম হাসানের। ১৭ বছর ৩৫৬ দিন বয়সী নাঈম নিজের অভিষেক টেস্টে ৫ উইকেট শিকার করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। শুধু তাই নয়, দেশের সবচেয়ে ছোট ক্রিকেটার হিসেবে এই রেকর্ড গড়েছেন ডানহাতি এই অফ স্পিনার। ১৭ বছর ২৫৭ দিন বয়সে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন পাকিস্তানের তারকা পেস বোলার মোহাম্মদ আমির। এছাড়া ১৬ বছর ৩০৩ দিন বয়সে পাকিস্তানের নাসিম-উল-গনি ৫ উইকেট শিকার করেছেন। তবে এই দুইজনের কেউই অভিষেকে ৫ উইকেট শিকারে নজির স্থাপন করতে পারেননি। যেটি করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন ফুটবলার বাবার ছেলে নাঈম।
তামিম ইকবাল কিংবা আফতাব আহমেদদের দেখে একটা সময় মাহবুবুল আলমের শখ জাগে, ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। এরপর বাবার ভালোবাসা আর সমর্থনে এতদূর এসেছেন নাঈম। প্রথমশ্রেণির ক্রিকেটে সবশেষ ম্যাচেই নিয়েছেন ৮ উইকেট। এই ফরম্যাটে গত অক্টোবরে নিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আট উইকেট। প্রথমশ্রেণিতে ১৮ ম্যাচে তার দখলে আছে ৬৪টি উইকেট।
অভিষেকের বছর ২০১৮:
টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক হয়েছে মোট ১৪ জন ক্রিকেটারের। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ২০১৮ সালে অভিষেক হওয়া সেই ১৪ জন ক্রিকেটার হলেন সানজামুল ইসলাম, আবু জায়েদ রাহী, আরিফুল হক, নাজমুল ইসলাম অপু, মোহাম্মদ মিঠুন, খালেদ আহমেদ, নাঈম হাসান, সাদমান ইসলাম অনিক, আবু হায়দার রনি, নাজমুল হোসেন শান্ত, ফজলে মাহমুদ রাব্বি, আফিফ হোসেন, জাকির হাসান ও মেহেদি হাসান।
২০১৮ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়া ৮ ক্রিকেটার:
সানজামুল ইসলাম, আবু জায়েদ রাহী, আরিফুল হক, নাজমুল ইসলাম অপু, মোহাম্মদ মিঠুন, খালেদ আহমেদ, নাঈম হাসান ও সাদমান ইসলাম অনিক।
২০১৮ সালে ওয়ানডে অভিষেক হওয়া ৫ ক্রিকেটার:
আবু হায়দার রনি, নাজমুল হোসেন শান্ত, নাজমুল ইসলাম অপু, ফজলে মাহমুদ রাব্বি ও আরিফুল হক।
২০১৮ সালে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হওয়া ৬ ক্রিকেটার:
আফিফ হোসেন ধ্রুব, আরিফুল হক, নাজমুল ইসলাম অপু, জাকির হাসান, আবু জায়েদ রাহী ও মেহেদি হাসান।
এ বছর বাংলাদেশ পেয়েছে নতুন নতুন ম্যাচ উইনার। টেস্টের বিস্ময় মুমিনুল হক, মেহেদি হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলামদের সঙ্গে সাদা পোশাকে টাইগারদের গর্জন শুনিয়েছেন সাদমান ইসলাম, নাঈম ইসলামরা, সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন লিটন দাস, মোহাম্মদ মিঠুনরা। বিশ্ব র্স্পোটস মিডিয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির কথা বারবার ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। বারবার প্রমাণ হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক ফলাফল নিশ্চিত উর্ধগামী। ২০১৮’কে পেরিয়ে ২০১৯ এ টাইগারদের সাফল্য লুটোপুটি খাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে দেশে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান রয়েছেন, যে দেশে ক্রিকেট বিশ্বকে বারবার চমকে দেওয়া অধিনায়ক মাশরাফি রয়েছেন, যে দেশে অকুতোভয় ওপেনার তামিম রয়েছেন, মুশফিকের মতো রানমেশিন রয়েছেন, অধিনায়কের বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখা মাহমুদউল্লাহ রয়েছেন, সে দেশটি ক্রিকেটের পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে এটিও আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সারাবাংলা/এমআরপি/এসএন