তিন হ্যাটট্রিকের তিন রকমের স্বাদ
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৬:০৭
।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।
হ্যাটট্রিক! আহ! তাও আবার টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে, যেখানে রীতিমতো বোলারদের ওপর দিয়ে রোলার কোস্টার চালানো হয়! চার-ছক্কার এমন ফরম্যাটে হ্যাটট্রিক তো বোলারদের পরম আরাধ্য, বড় পাওয়া। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) আগের পাঁচটি আসরে হ্যাটট্রিক হয়েছে মাত্র দুইটি। সেখানে এই আসরেই হয়েছে তিনটি। এরমধ্যে দুটি হ্যাটট্রিক ঢাকা ডায়নামাইটসের জার্সিতে, অ্যালিস ইসলাম এবং ক্যারিবীয়ান তারকা আন্দ্রে রাসেলের দখলে। বাকিটি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের পাকিস্তানি পেসার ওয়াহাব রিয়াজের। হ্যাটট্রিক হিরো অ্যালিস-ওয়াহাব ম্যাচ শেষে জয়ের আনন্দ পেলেও রাসেল পাননি।
হ্যাটট্রিকে বিশ্ব রেকর্ড, তারপর দেখলেন মুদ্রার উলটো পিঠ:
দুটি ক্যাচ মিস করে যখন দলকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন পরে নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন দলের ভার। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ঢাকা ডায়নামাইটসের হাইভোল্টেজ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে সব হিসাব পাল্টে দেন ২২ বছর বয়সী বাংলাদেশি অফস্পিনার অ্যালিস আল ইসলাম। বিপিএলে সেটাই ছিল তার অভিষেক ম্যাচ। শুধু বিপিএল না, যে কোনো ধরনের টি-টোয়েন্টির প্রথম ম্যাচ। তার ওই হ্যাটট্রিকে জয়ের পথে থাকা রংপুর রাইডার্সের কপাল পোড়ে। শেষ বলের লড়াইয়ে ২ রানের রুদ্ধশ্বাস জয় তুলে নেয় ঢাকা ডায়নামাইটস। আর অভিষেকে হ্যাটট্রিক করে বিশ্বরেকর্ড গড়ে ফেলেন অ্যালিস।
রংপুর রাইডার্সের ইনিংসের ১৮তম ওভারে ঢাকার দলপতি সাকিব বল তুলে দেন অ্যালিসের হাতে। ওভারের তৃতীয় বলটিতে বেনি হাওয়েল ক্যাচ তুলে দিলেও তা হাতছাড়া হয়। এর পরের তিন বলেই তিন উইকেট তুলে নেন অ্যালিস। ওভারের চতুর্থ বলে মোহাম্মদ মিঠুনকে বোল্ড করেন তিনি। রংপুর তখন জয় থেকে মাত্র ২৩ রান দূরে। উইকেটে আসেন অধিনায়ক মাশরাফি। প্রথম বলেই বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন ম্যাশ। পরের ব্যাটসম্যান ফরহাদ রেজা। অ্যালিসের চমৎকার লেন্থের বলটি রেজার ব্যাট ছুঁয়ে প্রথম স্লিপে থাকা সাকিবের হাতে আশ্রয় নেয়, অ্যালিসের হাত ধরে লেখা হয় নতুন ইতিহাস। অভিষেকেই হ্যাটট্রিক হিরো বনে যান তিনি।
বিরল বিশ্বরেকর্ডের প্রথম অধিকারী হলেও বাংলাদেশের এই অচেনা স্পিনার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মুদ্রার অন্য পিঠ দেখে ফেলেন। বল হাতে বিশ্বকে জানান দেওয়া ডানহাতি অফ স্পিনারের বিরুদ্ধে অবৈধ অ্যাকশনের অভিযোগ তোলে রংপুর টিম ম্যানেজমেন্ট। ম্যাচ শেষে রংপুর তার ‘দুসরা’ বোলিং নিয়ে আপত্তি জানায়। ম্যাচের দুই আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুল ও মার্টিনেজ সন্দেহজনক বোলিং অ্যাকশন নিয়ে রিপোর্ট জমা দেন। হ্যাটট্রিকের আনন্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগে অ্যালিস বুঝেছেন ফিরে আসতে হলে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে আবার।
একটু লোভনীয় হ্যাটট্রিক ওয়াহাব রিয়াজের:
ক্যারিবীয়ান ওপেনার এভিন লুইসের সেঞ্চুরিতে ভর করে তখন রান পাহাড়ে চড়ে বসেছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। প্রতিপক্ষ খুলনা টাইটান্স, একের পর এক ম্যাচ হেরে যারা তখন বিদায়ের প্রহর গুনছিল। খুলনাকে নিয়ে সব দলই যখন ছেলে-খেলায় মেতেছে তখন কুমিল্লার পাকিস্তানি পেসার ওয়াহাব রিয়াজ হ্যাটট্রিক করে বসেন।
কুমিল্লার জয়টা এমনিতেই নিশ্চিত ছিল। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ২৩৭ রানের বড় স্কোর দাঁড় করানো কুমিল্লা জিতেছিল ৮০ রানের বড় ব্যবধানে। ১৮তম ওভারে খুলনার শেষ তিন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরান ওয়াহাব রিয়াজ। একটু সহজ, একটু লোভনীয়ই তো! টেলএন্ডারদের দিকে সুইং ছুঁড়ে দিতে জুড়ি নেই ওয়াহাবের, তার উপর আবার হ্যাটট্রিকের সুযোগ। এমন সুযোগ পেলে পেসারদের শিকারি জিহ্বা তো লকলকিয়ে উঠবেই। খুলনার ইনিংসের ১৮তম ও নিজের তৃতীয় ওভারের তৃতীয় বলে ওয়াহাবের ডেলিভারিতে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন ডেভিড উইসি। পরের বলে তাইজুল ইসলামকে বোল্ড করেন ওয়াহাব। ওভারের পঞ্চম বলে সাদ্দাম হোসেনের ব্যাট ছুঁয়ে বল আশ্রয় নেয় তামিম ইকবালের তালুতে। টেলএন্ডারদের বিপক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ হ্যাটট্রিকের স্বাদ পান পাকিস্তানি পেসার ওয়াহাব রিয়াজ।
রাসেলের হ্যাটট্রিকটা ছিল অন্যরকম ‘হ্যাটট্রিক’:
ষষ্ঠ আসরে তৃতীয় হ্যাটট্রিক তুলে নেন ঢাকা ডায়নামাইটসের ক্যারীবিয়ান অলরাউন্ডার আন্দ্রে রাসেল। চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষে শেষ ওভারে হ্যাটট্রিক করেন তিনি। যদিও সেদিন শুরুটা ভালো হয়নি রাসেলের। প্রথম ৩ ওভারে দিয়েছিলেন ৩১ রান, ছিলেন উইকেটশূন্য। ফিল্ডিংয়েও ছেড়েছেন সহজ ক্যাচ। শেষ ওভারে ডায়নামাইটস দলপতি সাকিব বল তুলে দেন রাসেলের হাতে। ওভারের প্রথম বলে তাকে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে লংঅনে ক্যাচ দেন চিটাগং দলপতি মুশফিক। পরের বলে ক্যামেরন ডেলপোর্ট ক্যাচ দেন লংঅফে। আর তৃতীয় বলে স্কুপ করতে গিয়ে আউট হন শ্রীলঙ্কান অলরাউন্ডার দাশুন শানাকা। যদিও শেষ ওভারের হ্যাটট্রিক ইনিংসে খুব বেশি প্রভাব হয়তো ফেলতে পারেনি।
ছয় মাসের মধ্যে নিজের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক করেন রাসেল। আর ক্যারিয়ারে ছিল সেটা রাসেলের তৃতীয় হ্যাটট্রিক। তার মানে হ্যাটট্রিকের ‘হ্যাটট্রিক’। এর আগে ২০১৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের হয়ে ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে করেছিলেন প্রথম হ্যাটট্রিক, সেবার তো চার বলে চারটি উইকেট নিয়েছিলেন। আর গত বছরই সিপিএলে জ্যামাইকা তালাওয়াহসের হয়ে ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন রাসেল। বিপিএলে হ্যাটট্রিক করে রাসেল ছুঁয়েছেন একটি অন্যরকম রেকর্ড। টি-টোয়েন্টিতে তিনটি হ্যাটট্রিক করা মাত্র তৃতীয় বোলার রাসেল। টি-টোয়েন্টিতে তিনটি হ্যাটট্রিক করতে পেরেছেন আর কেবল দুজন, ভারতের অমিত মিশ্র ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু টাই।
ছয় আসরে পাঁচ হ্যাটট্রিক:
বিপিএলের প্রথম আসরেই হ্যাটট্রিক দেখেছিল ক্রিকেটপ্রেমীরা। দুরন্ত রাজশাহীর হয়ে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ সামি। দ্বিতীয় আসরে হ্যাটট্রিক না হলেও এরপর ২০১৫ সালের আসরে বরিশাল বুলসের হয়ে সিলেট সুপার স্টার্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন আল আমিন হোসেন। এরপর পরের দুই আসরে কোনো হ্যাটট্রিক হয়নি। সদ্য সমাপ্ত আসরেই হয়ে গেল আরও তিনটি হ্যাটট্রিক।
সারাবাংলা/এমআরপি