সাম্বা অ্যাটাকের পরিকল্পনা করছে রিয়াল?
১২ মার্চ ২০১৯ ২০:২৫
।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।
নেইমারের উত্থানের খবর প্রায় সবার মুখে মুখেই ছিল। সান্তোসে অসাধারণ ফুটবল উপহার দিয়ে স্প্যানিশ গণমাধ্যমের লাইমলাইটে চলে আসেন নেইমার। উঠতি বয়সে সাম্বার দেশ ব্রাজিলের আর কোনো খেলোয়াড় অতীতে এভাবে স্প্যানিশ জায়ান্ট ক্লাবগুলোর টার্গেটে পড়েছিলেন কী না বলা মুশকিল। নেইমারকে নিয়ে বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের টানাহেঁচড়া খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এরই মধ্যে আরও দুই ব্রাজিলিয়ান বিস্ময় বালকের উত্থান হয়েছে। সেই দুই তরুণ বিস্ময় একই দলে, রিয়ালে। আর সেই রিয়ালই উঠেপড়ে লেগেছে নেইমারকে আনতে। রিয়াল কি তাহলে সাম্বা অ্যাটাকের পরিকল্পনা করছে?
কদিন আগে বার্সেলোনার বিপক্ষে ঘরের মাঠে টানা দুই এল ক্লাসিকো হেরেছে রিয়াল মাদ্রিদ। কোপা দেল রেতে বার্সার বিপক্ষে হেরে বিদায় নিয়েছে, লা লিগায় হেরে শিরোপা দৌড়েও পিছিয়ে রিয়াল। তার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে ডাচ জায়ান্ট আয়াক্সের বিপক্ষে নিজেদের মাঠেই হেরে বিদায় নিয়েছে লুকা মদ্রিচ, গ্যারেথ বেল, করিম বেনজেমা, ক্যাসেমিরো, ভিনসিয়াসরা। কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই বিদায় নিতে হয় টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়নদের। এর পর রিয়ালের কোচ সান্তিয়াগো সোলারিকে বরখাস্ত করে স্প্যানিশ জায়ান্টরা। তবে, বিশেষ শর্তে সোলারিকে রেখে দিতে চেয়েছে রিয়াল।
এদিকে, রিয়ালকে টানা তিন মৌসুম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতিয়ে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যাওয়া ফরাসি কোচ জিনেদিন জিদানকে আবারো রিয়ালের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ক্লাব প্রেসিডেন্ট এরই মধ্যে আভাস দিয়ে রেখেছেন, পিএসজি থেকে নেইমারকে যে কোনো মূল্যে নিয়ে আসা হবে। যোগফল ঠিকঠাক থাকলে রিয়ালের আক্রমণভাগে নেতৃত্ব দেবেন তিন ব্রাজিলিয়ান-নেইমার-ভিনসিয়াস-রদ্রিগো। ১৮ পেরিয়ে ভিনসিয়াস এখন রিয়ালের মূল দলের শুরুর একাদশে খেলছেন। রদ্রিগো এই জানুয়ারিতে ১৮ বছর পেরিয়েছেন। পরের মৌসুমে রিয়ালের মূল একাদশে খেলার সমূহ সম্ভাবনা আছে তার। আর নেইমার যোগ দিলে তো সোনায় সোহাগা। রিয়ালের আক্রমণভাগ সাজবে-নাচবে সাম্বার নৃত্যে। রিয়ালের পরিকল্পনা তো সেই কথারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
৯ বছর রিয়ালে থাকার পর গত মৌসুমে ইতালির ক্লাব জুভেন্টাসে পাড়ি জমান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। মাদ্রিদ থেকে তার চলে যাওয়ার পর রিয়ালের আক্রমণভাগে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই। রিয়ালের সাম্প্রতিক এই ফর্মহীনতার পেছনে রোনালদোর অনুপস্থিতিকে বড় চোখে দেখছেন অনেক ফুটবল বোদ্ধা। রোনালদো চলে যাবার পর ক্লাব ভেবেছিল দলের বাকি খেলোয়াড়েরা তার অভাব পূরণ করতে পারবে। সিআর সেভেন প্রতি মৌসুমে ৫০টা করে গোল করেছেন, ৫০টা গোল না হোক, দলের বাকি খেলোয়াড়ের কাছে প্রত্যাশা ছিল ১৫-২০টা গোল তারা করবে। কিন্তু, সেভাবে কেউ রোনালদোর ঘাটতি পুষিয়ে দিতে পারেননি। তবে, রিয়াল এখনও গ্যারেথ বেল, করিম বেনজেমা, মার্কো অ্যাসেনসিও, মারিয়ানো ডিয়াজ, ভিনসিয়াস জুনিয়রের উপর আস্থা রেখেছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্রাজিলের ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে দলে নিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল স্প্যানিশ জায়ান্ট ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। তিন মাস পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা ক্লাবটি আরেক ব্রাজিলিয়ান প্রতিভাকে দলে টানে। তখনকার রোনালদো-জিদানদের দলটি ব্রাজিলের উদীয়মান তারকা রদ্রিগো রদ্রিগুয়েজকে দলে ভেড়ায়। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোস থেকে ছয় বছরের চুক্তিতে রদ্রিগোকে দলে টানে রিয়াল। চলতি বছরের জুন থেকে রিয়ালের জার্সিতে নামতে পারবেন এই ব্রাজিলিয়ান বিস্ময়। তাতে রিয়ালের মূল দলে ব্রাজিল তারকা ভিনসিয়াস, মার্সেলো, ক্যাসিমিরোদের সঙ্গে পরের মৌসুমেই খেলার সুযোগ পাবেন না রদ্রিগো। তাকে প্রথমে খেলতে হবে রিয়ালের ইয়ুথ টিমে।
নতুন মৌসুমে তাকে দলে নিতে ৪৫ মিলিয়ন ইউরো চুক্তি করে স্প্যানিশ জায়ান্টরা। সান্তোসের ৯ নম্বর জার্সিতে খেলা তরুণ এই ফরোয়ার্ডের লক্ষ্য এবার নিজের মতো খেলেই পরের বিশ্বকাপে অংশ নেয়া। রদ্রিগো নিজের এবং রিয়ালের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘বিশ্বের সেরা একটি ক্লাবের জার্সি পড়াটা আসলে স্বপ্নের মতো। আমি নিশ্চিত যে একজন ফুটবলার হিসেবে বেড়ে ওঠার জন্য সঠিক স্থানেই এসেছি। আমি সমর্থকদের অনেক আনন্দ এবং শিরোপা এনে দিতে চাই। জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপে খেলতে মুখিয়ে আছি। বিশ্বকাপে নিজেকে সেরা হিসেবে দেখাটাই এখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। নতুন ক্লাবের হয়ে শতভাগ দেয়াটাই লক্ষ্য থাকবে। আশা করি ভালো কিছুই হবে। মাদ্রিদের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক আছে। তারা আমাকে জানিয়েছে, ভালো ভাবে অনুশীলন করে গেলেই সেখানে শুরুটা ভালো হবে।’
রিয়ালের সঙ্গে চুক্তির আগে রদ্রিগোকে নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিল স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা, ইংলিশ ক্লাব লিভারপুল ও ফরাসি ক্লাব পিএসজি। তবে, জয়ীর হাসিটা হেসেছে রিয়াল। রিয়ালের জার্সিতে অভিষেকের অপেক্ষায় থাকছেন এই ফরোয়ার্ড। এরই মধ্যে রদ্রিগোকে নিয়ে উচ্ছ্বাস ছড়িয়েছে ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে। ১৬ বছর বয়সে ক্লাব সান্তোসের হয়ে মাঠে নামা তরুণ এই ফুটবলারকে নিয়ে অনেকেই তুলনা করেছেন রবিনহো-নেইমারদের সঙ্গে। সদ্যই ১৮তে পা রাখা এই তরুণ ফুটবলারের স্বপ্ন ছিল ইউরোপিয়ান বড় কোনো ক্লাবে খেলা। সেই স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে।
আগেভাগেই চুক্তি হয়ে গেলেও ভিনসিয়াস জুনিয়র রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। তার আগ পর্যন্ত ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লামেঙ্গোতেই ধারে খেলেছেন। ব্রাজিলিয়ান গণমাধ্যমের দাবি, ভিনসিয়াস জুনিয়র আসলে নেইমারের চেয়েও বেশি প্রতিভাবান। এমনকি তার নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘নতুন নেইমার’ খেতাব। ভিনসিয়াসের সঙ্গে রিয়ালের চুক্তির অঙ্কটাও ছিল চোখ কপালে উঠার মতোই। উঠতি তারকার খ্যাতি ছড়ানোর আগেই রিয়াল তাকে কিনেছে বিশাল অঙ্ক দিয়ে। এক বছর নিজেদের সংগৃহীত অমূল্য রত্নকে ফুটবলবিশ্বের সামনে এই মৌসুমে উন্মোচন করে রিয়াল মাদ্রিদ। ব্রাজিলের বিখ্যাত যুব ফুটবল প্রতিযোগিতা কোপা সাও পাওলোতে দারুণ খেলে তিনি সবার নজর কাড়েন।
১৫ বছর বয়সে ফ্লামেঙ্গোর হয়ে বোতাফোগোর বিরুদ্ধে ডার্বিতে ভিনসিয়াসের গোল দেখে ব্রাজিলের ফুটবল ভক্তরা নিশ্চিত হয়ে যান, তাদের নতুন প্রতিভা উপস্থিত। ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-১৭ দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল। সেখানে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পেয়েছিলেন ভিনিসিয়াস। গ্রীষ্মকালীন দলবদলে ৩৮ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফারে তাকে দলে নিয়ে চমক দেখায় স্পেনের ক্লাবটি। ২০১৩ সালে সান্তোস থেকে নেইমার জুনিয়রকে ৪৯ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফারে দলে ভেড়ায় আরেক স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা। কিন্তু নেইমার তখন প্রায় পরিণত এবং সান্তোসের সেরা তারকা। অন্যদিকে ভিনিসিয়াসের ছিল না তেমন কোনো তারকাখ্যাতি।
এদিকে, স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনা ছেড়ে ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে নাম লেখানোর পর থেকেই আলোচনা শুরু। ব্রাজিল সুপারস্টার নেইমার কি সেখানে সুখী? বিভিন্ন সময়ে যা গল্পের খোরাক হয়েছিল। বার্সায় যোগ দেওয়ার আগে থেকেই নেইমারকে টার্গেট করেছিল আরেক স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর দলটির আশা পূরণ হয়নি। ট্রান্সফার ফির বিশ্ব রেকর্ড গড়ে বার্সা থেকে তিনি নাম লেখান পিএসজিতে। এখনও রিয়াল তাদের আশা পূরণে নেইমারের দিকে তাকিয়ে আছে! রোনালদো রিয়াল ছেড়ে ইতালির ক্লাব জুভেন্টাসে নাম লেখানোয় আক্রমণভাগের শক্তি বাড়াতে নেইমারের উপর দৃষ্টি স্প্যানিশ ক্লাবটির। রিয়ালের চাওয়া পূরণ হবে কী না সেটি সময় বলে দেবে।
তবে, নেইমার বলে দিয়েছেন নিজের কথা। ইনজুরির কারণে এ মুহূর্তে নিজ দেশ ব্রাজিলে অবস্থান করছেন তিনি। সেখানে গণমাধ্যমে তিনি জানান, ‘আমি রিয়ালে খেলতে চাই কী না? রিয়াল বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি ক্লাব। কে না চায় সেখানে খেলতে? প্রতিটি ফুটবলার রিয়ালের মতো ক্লাবে নিজেকে জড়াতে চায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন আর না করুন, আমি পিএসজিতে সুখী আছি। আমি রিয়ালে খেলার কথা এই মুহূর্তে ভাবছি না। শান্ত থাকুন। কিন্তু, ভবিষ্যতে রিয়ালে খেলবো কী না, সেটি কেউ জানে না। কারণ রিয়াল বিশ্বের সেরা একটি দল আর তারা আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেছে। একজন ফুটবলারের জীবন খুব দ্রুত পার হয়ে যায়। কেউ জানে না পরের মুহূর্তে তার জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকবে। কেউ জানে না আগামীকাল কি হতে পারে।’
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমের মতে, নেইমারকে দলে নিতে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করার ইচ্ছা আছে স্প্যানিশ জায়ান্টদের। পিএসজিতে নেইমারের বর্তমানে বাৎসরিক পারিশ্রমিক ৩১ মিলিয়ন পাউন্ড। তবে রিয়াল চাইছে তাকে বাৎসরিক ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড দিতে। সব ঠিক থাকলে, নেইমার যদি ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড রিলিজ ক্লজে রিয়ালে আসেন, তাহলে ট্রান্সফার ফি’র আরেকটি রেকর্ড গড়বেন তিনি।
টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ী রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান অবস্থা অনেকটাই নাজুক। ইতোমধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চলতি আসরের শেষ ষোলো থেকে ছিটকে গেছে দলটি। এর আগে কোপা দেল রে থেকেও বিদায় নিয়েছে তারা। তাতে হতাশ হয়ে পড়েছেন দলের কর্মকর্তা ও সমর্থকরা। এই অবস্থায় পর্তুগিজ তারকা রোনালদোর অভাবটাই বেশি ভোগাচ্ছে রিয়ালকে। স্প্যানিশ গণমাধ্যম জানিয়েছে ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ সেই অভাব গুছানোর কাজে নেমেছেন। সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এজন্য পিএসজির ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারকে যেকোনো মূল্যে দলে নিতে চান রিয়াল সভাপতি। ইতোমধ্যে নেইমারের এজেন্টের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ কর্তৃপক্ষের। তাতে, রিয়াল সমর্থকরা নতুন আশায় বুক বাধতে পারেন। যদি ক্লাবটি তিন ব্রাজিলিয়ান নেইমার-ভিনসিয়াস-রদ্রিগোকে একসঙ্গে নামাতে পারে। সাম্বার নৃত্য দেখতে হয়তো মুখিয়ে থাকবেন বিশ্বের কোটি ফুটবলপ্রেমী।
সারাবাংলা/এমআরপি