Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খেলার মাঠেও আলো জ্বালিয়েছেন তিনি


১৮ মার্চ ২০১৯ ০০:০৫

ছবিসংগ্রহ: কিরণ

।। স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকাঃ তাঁর হাত ধরেই বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছিল একটি নাম। যার জন্ম না হলে হয়তো পরাধীনতার শিকল ভেঙে আলোর মুখ দেখতে পেতো না দেশটি। বাংলাদেশ। শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদী মানুষটিই স্বাধীনতার ডাক দিয়ে সংগঠিত করেছিল একটি প্রতিবাদকে। সেই প্রতিবাদ জন্ম দিয়েছে আজকের এই দেশকে। শত বছরের শ্রেষ্ঠ সেই বাঙালির নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বাধীনতার গৌরবে ভাসতে থাকা ভঙ্গুর দেশটাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার এই ঘোষক। কেবল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনেও তিনি রেখেছেন অসামান্য অবদান।

বিজ্ঞাপন

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এই ক্রীড়াপ্রেমী দেশের ক্রীড়াঙ্গন উন্নয়নে নিয়েছিলেন যুগোপোযুগী পরিকল্পনা। খেলার উন্নতিতে তাঁর সময়োচিত সিদ্ধান্তগুলোই আজ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সাফল্যের শেখড়ে।

পারিবারিকভাবে খেলার হাতেখড়ি বলে দেশের ক্রীড়াঙ্গন উন্নয়নে তাঁর সুসংগঠিত পরিকল্পনাগুলো দেশগড়ায় অনন্য ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধু নিজেই ফুটবল খেলতেন। ওয়ান্ডার্স ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। স্বাধীনোত্তর পর্বে দেশকে খেলার প্রগতিতে রেখেছেন অনস্বীকার্য অবদান।

ক্রীড়ার সঙ্গে তাঁর আবেগ কতটা জড়িয়ে ছিল সেই গল্পটা তিনি উল্লেখ করতে ভুলেন নি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে, ‘আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে। লেখাপড়ায় আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ, কয়েক বৎসর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করেছি। স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। খেলাধুলার দিকে আমার খুব ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভাল ছিল। মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।’

খেলা

যখন ফুটবলার ছিলেন

‘১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবই নামকরা খেলোয়াড়। বংসরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র; এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত। আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন, “কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ।”

বিজ্ঞাপন

আমি বললাম, “আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না, আমাদের পরীক্ষা।” গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে বললেন, “তোমাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না।” আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেটও পড়াতেন। আব্বা হেডমাস্টার বাবুকে খবর দিয়ে আনলেন। আমি আমার দলবল নিয়ে এক গোলপোস্টে আর আব্বা তার দলবল নিয়ে অন্য গোলপোস্টে। হেডমাস্টার বাবু বললেন, “মুজিব, তোমার বাবার কাছে হার মান। আগামীকাল সকালে খেল, তাদের অসুবিধা হবে।” আমি বললাম “স্যার, আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারজনই সারা বছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যথা, দুই-চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাব।” এবছর তো একটা খেলায়ও আমরা হারি নাই, আর ‘এ জেড খান শিল্ডের’ এই শেষ ফাইনাল খেলা। হেডমাস্টার বাবুর কথা মানতে হল। পরের দিন সকালে খেলা হল। আমার টিম আব্বার টিমের কাছে এক গোলে পরাজিত হল।’

ক্রীড়াপ্রেমী বঙ্গবন্ধু তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই নজর দিয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে। খেলার ভালবাসার টান থেকে ১৯৭২ সালে গঠন করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড। যা বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) নামে পরিচিত।

শুধু তাই নয় ক্রীড়ার সমন্বয় ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একই বছরে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। দেশের ক্রীড়া এই অভিভাবকই এখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

এই সংস্থাই পরে বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভিন্ন ভিন্ন ৪৩টি খেলাধুলা বিষয়ক সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার মধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) অন্যতম। দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ১৯৭২ সালেই।

সব খেলার প্রতি দুর্বলতা ছিল ক্রীড়াপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর। তবে, ফুটবলের জন্য একটু বিশেষ দুর্বলতা ছিল তাঁর। নিজে খেলেছেন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে। ফুটবল মাতানোর পাশাপাশি ভলিবল ও হকিতেও নিজের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ক্রীড়া উন্নয়নে উঠে-পড়ে লাগা বঙ্গব্ন্ধুর আন্তরিকতার যে অভাব ছিলো না তার প্রমাণ মেলে স্বাধীনতার দুই মাসের মধ্যেই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেই ম্যাচের সাক্ষী আজকের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। দেশের তখনকার তারকা ফুটবলারদের সমন্বয়ে ম্যাচটি আয়োজিত হয়। বাংলাদেশ একাদশ ও রাষ্ট্রপ্রতি একাদশের মধ্যে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসে ঢাকায় খেলতে আসে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা দল কলকাতা মোহনবাগান। প্রথম ম্যাচে কলকাতা মোহনবাগান ঢাকা মোহামেডানকে হারালেও পরের ম্যাচে হারতে হয়েছিল সফরকারীদের।

খেলা

১৯৭২ সালে কলকাতা মোহনবাগানের সঙ্গে ঢাকা একাদশের ম্যাচে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মাঠে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। ম্যাচের আগে খেলোয়াড়দের উজ্জ্বীবিত করেছেন। প্রথম হারের পর খেলোয়াড়দের মনোবল চাঙ্গা করেছেন। সেই ম্যাচ ১-০ ব্যবধানে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল ঢাকা মোহামেডান। সেই ঐতিহাসিক জয়ের ম্যাচে গোল করেছিলেন কাজী সালাউদ্দীন। যিনি এখন বাফুফের সভাপতির দায়িত্বে।

দেশের ফুটবলকে পরিচিত করতে আন্তর্জাতিক ক্লাবকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার পরের বছরেই রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামো ক্লাবকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য। ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়েই সেবার ভিআইপি গ্যালারিতে বসে ঢাকা একাদশ ও রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামোর খেলা উপভোগ করেছেন তিনি।

খেলোয়াড়দের প্রতি তার যে বিশেষ ভালোবাসা আছে সেটা বিভিন্ন সময়ই দেখিয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েছিল ফুটবল দল। খেলোয়াড়দের গণভবনে ডেকেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাওয়ার আগে খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করেছেন এই ক্রীড়ামোদী নেতা। যাবার আগে ফুটবলারদের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালি।

তাঁর পুরো পরিবার দেশের উন্নয়নের জন্য যা করেছেন সেটাও কম নয়। শেখ কামাল ও শেখ জামালও দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের জন্য অবদান রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে খেলাধুলা। সম্প্রতি দেশের ক্রীড়ার উন্নয়ন সেই কথাই প্রমাণ করে।

সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট নিজ বাসভবনেই ঘাতকের বুলেটে হারাতে হয় বঙ্গবন্ধুর প্রাণ। দেশ তখন শুধু জাতির পিতাকেই হারায়নি হারিয়েছে একজন আপামর ক্রীড়াপ্রেমীকে। ক্রীড়ার জন্য তাঁর অনন্ত ভালবাসাই আপামর মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবো যুগ থেকে যুগান্তরে। লোক থেকে লোকান্তরে। সারাজীবনের জন্য।

সারাবাংলা/জেএইচ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর